আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

নভেল করোনার উৎস সন্ধানে

স্বপন ভট্টাচার্য


আমাদের লিখিত ইতিহাসেই অতিমারির ঘটনা বহুবার মানুষকে কাবু করে ছেড়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্লেগ, বিংশ শতাব্দীর ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি মানবেতিহাসের ল্যান্ডমার্ক দুটো ঘটনা বলে বিবেচিত। বিজ্ঞান আজকে যে অবস্থায় পৌঁছেছে তা একশো বছর আগে ভাবাও অসম্ভব ছিল, কিন্তু এখন দাঁড়িয়ে পিছনের জৈবিক ঘটনাবলীকে অনুসরণ করা অসম্ভব নয়। প্লেগের সময় না হলেও ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির কালে বিভিন্ন দেশে সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞদের হদিশ দিচ্ছে ইতিহাস। তাদেরই কারো গবেষণাগার থেকে মারক জীবাণু ছড়িয়ে পড়বার কোনো নজির আজ তেমনভাবে কেউ খোঁজেন বা খুঁজেছেন বলে মনে হয় না যদিও প্রত্নভাইরোলজি একটা জীবন্ত বিষয় এবং করোনাভাইরাসের উৎস সন্ধানে চমকপ্রদ সমস্ত তথ্য এই শাখাটিতে গবেষণার ফলে আমাদের হাতে এসেছে।

নভেল করোনার ক্ষেত্রে একটা বড়সড় চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ল্যাব-লিক’ তত্ত্ব। করোনাভাইরাস নিয়ে আজ নয়, বহুদিন ধরেই কাজ হয় চিনের উহান প্রদেশের উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি (WIV)তে। করোনার উৎসেই যেহেতু উহান প্রদেশের নামটি জড়িয়ে আছে এবং যেহেতু আজ দেড় বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও তার দাপট কমার তেমন কোনো লক্ষণ নেই, সেহেতু এই অভিনব অতিথিটি প্রকৃতিতেই স্বতঃউদ্ভাবিত নাকি উহানের গবেষণাগারটি থেকে কোনোভাবে তা বেরিয়ে পড়েছে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মানবজীবনকে বিপর্যস্ত করে বাণিজ্যে দখলদারির উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন উঠে আসছে ক্রমশ আরও তীব্রতার সঙ্গে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সদস্য দু’শোটির উপর দেশের ক্রমবর্ধমান দাবি মেনে এ বছরের শুরুর দিকে চিনে প্রথম অনুসন্ধানকারীর দল পাঠায় এবং বলাই বাহুল্য তারা চিনের কাছ থেকে খোলা খাতা আশা করেনি, পায়ও নি। তবুও তদন্তে তারা এমন সন্দেহজনক কিছু পায়নি যাতে করে ল্যাব-লিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। গত বছরে আমেরিকায় নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে  'চিনা ভাইরাস' নামে চিহ্নিত করতে শুরু করেন এবং প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন নির্বাচিত হয়ে আসার পরেও সে তত্ত্ব পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি। এ বছরের মে মাসে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে তাদের সত্য সামনে আনবার জন্য নব্বই দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। সুতরাং আশা করা যায় আগস্টের শেষাশেষি আমরা এই যুক্তি তক্কো গপ্পের পরের এপিসোড দেখতে পাব। আপাতত, সুনির্দিষ্টভাবে জবাব না মিললেও যে সমস্ত প্রশ্নগুলো এ প্রসঙ্গে উঠে আসছে আমরা তারই কয়েকটার পক্ষে-বিপক্ষে উঠে আসা যুক্তিগুলো ভেবে দেখতে পারি।

প্রশ্নঃ চিনের উহান প্রদেশেই রয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার সব চেয়ে বড় গবেষণাগার ‘উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি’ আবার সেই উহান থেকেই সংক্রমণের শুরু, সুতরাং WIV থেকে নভেল করোনার লিক হবার তত্ত্ব খুব উড়িয়ে দেবার মত কী?

এ কথা ঠিক যে এই অতিমারির প্রথম সংক্রামিতের সঙ্গে (পেশেন্ট জিরো) উহানের ‘লাইভ ফুড মার্কেট’-এর যোগসূত্র ওই উহান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য থেকেই জানা গিয়েছে। চিনে একটা মাস সার্ভেইলেন্স নেটওয়ার্ক আছে যা ১৪০টি সংক্রামক রোগের যে কোনো প্রাদুর্ভাবের জন্য সমস্ত মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর নজরদারি চালায়। ২০১৯-এর নভেম্বরের শেষাশেষি ও ডিসেম্বরের শুরু নাগাদ উহান শহরে কয়েকটি অজানা জ্বরের ঘটনা নজরে আসার পরে সে দেশের ভাইরোলজিস্টরা এই নেটওয়ার্কের উপরেই ভরসা রেখেছিলেন প্রথম দফায়, যাতে নেটওয়ার্কে জমা পড়া বিভিন্ন জীবাণু সংক্রান্ত তথ্যের মধ্য থেকেই সেটাকে শনাক্ত করা যায়। সে প্রচেষ্টা, বলাই বাহুল্য, ব্যর্থ হয় এবং এই অজানা জ্বরে আক্রান্তদের লালারস থেকে জীবাণু সংগ্রহ করে তার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা যায় এটি একটি করোনাভাইরাস বটে তবে তা এতাবৎকাল পর্যন্ত শনাক্তকৃত সমস্ত করোনাভাইরাসের থেকে ভিন্নতর। এটিকে ‘নভেল’ বা নতুন অতিথি হিসেবে চিহ্নিত করে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯-এ যখন চিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এটির আগমনের কথা জানায় তখন ইংরেজি বর্ষপূর্তি এবং নতুন বছরের আগমনের ছুটি কাটাতে কেবল উহান থেকেই এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার লোক বেরিয়ে পড়েছে। তাদের মোবাইল ফোনের গমনাগমন ট্রেস করে দেখা যাচ্ছে এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছড়িয়ে পড়েছে সে দেশের নানা প্রান্তে এবং ৯০০ জনের একটি দল গেছে নিউ ইয়র্কে, ২২০০ মানুষ গেছে সিডনীতে, ১৫০০০ গেছে ব্যাংককে। করোনার চীন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার খবর পাওয়া যেতে থাকে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, সিওল আর সিয়াটল থেকেও।

সুতরাং কৃত্রিমভাবে তৈরি হোক বা প্রকৃতিতে পাওয়া ভাইরাস উহানের ভাইরলোজি ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে সংরক্ষিত নমুনা, যাই হোক না কেন সেটাকে বেশ গুছিয়ে ভাইরাসের পক্ষে সুসময় বেছে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ তো আছেই, সেখান থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে না হলেও অনাবধনতায় ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগও আছে। সব মিলিয়ে চিনকে বায়োটেরর থেকে ‘ব্যাড সায়েন্স’ সব রকম অভিযোগে অভিযুক্ত করার সুযোগ আছে এখানে। WIV-এর করোনা বিশেষজ্ঞ ভাইরোলজিস্ট শি ঝেংলি (Shi Zhengli) এই অভিযোগের সুবাদে ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। শি’কে সারা পৃথিবীর ভাইরোলজিস্টরা চেনেন ‘ব্যাট ওম্যান’ নামে। আজ নয়, সেই ২০১২ থেকেই শি এবং তাঁর সহযোগীরা চিনের পরিত্যক্ত খনিতে বাসা বাঁধা বাদুড়ের থেকে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করে আসছেন। বলা হচ্ছে তিনশো’র উপর নমুনা সংগ্রহ করেছেন শি বাদুড়ের লালা, পুরীষ বা মৃতদেহ থেকে। এই এত যে সংগ্রহ তার মাত্র ১৪টির জিনোম সিকোয়েন্স তাঁরা প্রকাশ করেছেন পিয়ার রিভিউড জার্নালে, সুতরাং এই নভেল করোনা যে এতাবৎ অপ্রকাশিত কোনো নমুনা নয় তার নিশ্চয়তা কোথায়?

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় কলেরা বা রোটাভাইরাস নিয়ে কাজ করার গবেষণাগার কলকাতায় কেন বা ইবোলা নিয়ে কাজ কেন নাইজেরিয়ায় হয় বা এইডস নিয়ে কাজ কেন দক্ষিণ আফ্রিকায় হয় তাহলে এর উত্তর কিছুটা মিলতে পারে। সমস্ত সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেই গবেষণাগারগার গড়ে উঠেছে যে অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সে অঞ্চলকে ঘিরেই। চিনের হুবেই প্রদেশের উহান কোনো ছোটখাটো শহর নয়। এক কোটি দশ লক্ষ লোকের বাস সেখানে। এখানকার লাইভ ফুড মার্কেট সারা চিনে বিখ্যাত এবং সেখানে বাদুড়ের মাংস খাওয়ার চল আছে। চিনে প্রথম করোনা মহামারি হয় ২০০২ সালে যা SARS নামে পরিচিত হয়েছিল। ফলে এমন একটা ভাইরাসকে নিয়ে গবেষণাগার উহানে গড়ে উঠেছিল কেন সে প্রশ্ন নেহাতই অবান্তর।

পরের প্রশ্ন অবশ্যই তিনশো নমুনার মধ্যে মাত্র ডজনখানেকের তথ্য জানিয়ে বাকিদের কথা শি চেপে গিয়েছিলেন কেন? ভাইরোলজির লোকেরা বলবেন তিনশো সংগৃহীত স্যাম্পেলের মধ্যে এক ডজনের জিনোম সিকোয়েন্স করতে পারাটাই একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য, কেন না বাদুড়ের কলোনীতে গিয়ে সেখান থেকে তাদের দেহাংশ বা খাদ্য বা বিষ্ঠা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে আসার পরে খুব কম সংখ্যক নমুনাতেই সম্পুর্ণ জিনোমটি অক্ষতভাবে পাওয়া যেতে পারে। অভিযোগ এসেছে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উহান ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে তদন্তে যায় তখন তাদের সমস্ত নমুনা শি দেখাননি। তারা ল্যাবরেটারির ফ্রিজার খুলে সব নমুনা দেখতে চানও নি, তবে চাইলেও সে এক্তিয়ার তাদের আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারত চিন। তা সত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯-এর উদ্ভব ওই গবেষণাগার থেকেই হয়েছে এ কথায় সায় দেননি কিন্তু মার্কিন কমিশন বসেছে। সেখানকার সেনা ইন্টেলিজেন্স গোপন রিপোর্ট দিয়েছে চিন যে সময়ে পেশেন্ট জিরো’র কথা জানাচ্ছে তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই উহান ইনস্টিটিউট এই নভেল করোনার প্রাদুর্ভাবের কথা জানত। সুতরাং, এই প্রশ্ন আরো অনেকদিন জাগরুক থাকবে অনুমান করা যায়।

প্রশ্নঃ ২০০২-এর SARS (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) অথবা ২০১৩-এর MERS (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) রোগগুলির জীবাণু করোনাভাইরাস হলেও তাদের প্রাণি উৎস খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এবারের নভেল করোনার ক্ষেত্রে সেরকম কোন প্রাণিকে চিহ্নিত করা গেল না আজও। আসল কথা হল, ল্যাবে তৈরি ভাইরাস হলে প্রাণিজ উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে, তাই না কি?

প্যালিওভাইরোলজিস্টরা বলেছেন করোনাভাইরাসের উদ্ভব ১০,০০০ থেকে ৩০ কোটি বছর আগের যে কোন সময়ে হয়ে থাকতে পারে। এর ডজন ডজন প্রকরণের মধ্য থেকে সাতটি প্রকরণ মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। এদের মধ্যে চারটি মামুলি সর্দি-কাশি ঘটিয়েই ছেড়ে দেয়। এই চারের দুটি পাওয়া যায় ইঁদুর জাতীয় প্রাণিতে এবং বাকি দুটি বাদুড়ে। তিনটি প্রকরণ মারাত্মক, এরা হল SARS-Cov যা ২০০২-০৩-এর SARS রোগের জীবাণু, MERS-Cov যার জন্য ২০১৩-তে মধ্য প্রাচ্যে MERS রোগ চার হাজারের বেশি মৃত্যু ঘটিয়েছিল এবং এই এখনকার জীবানুটি যাকে আমরা SARS-Cov-2 নামে চিনেছি।

এই তিনটে প্রকরণই যে কোনো এককালে বাদুড়েই ছিল এবং বাদুড় থেকেই মানুষে এসেছে এমন মনে করার অনেক কারণ আছে। এমনিতে বাদুড়ে আজ পর্যন্ত ৬১ রকমের এমন ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা মানুষের কোনো না কোনো রোগ ঘটাতে পারে। করোনা তার মধ্যে একটি বটে কিন্তু বাদুড়ে তা নিরীহ, টেরই পাওয়া যায় না যে সেটা আছে, কারণ বাদুড়ের সংক্রমিত কোষ যে কেমিক্যাল সিগন্যাল দেয় তা সহযোগিতার, ডিসট্রেস সিগন্যাল নয়। মানুষে সেটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল কীভাবে?

এত দিন ধরেই যখন সে প্রকৃতিতে আছে তাহলে হোমিনিড দেহের প্রোটেকশন দেওয়া লক্ষ লক্ষ বছরের ইমিউনিটিকে বোকা বানাচ্ছেই বা কীভাবে? এখানেই আসে রিকম্বিনেশন তত্ত্ব। সম্ভবত বাদুড় থেকে মানুষে আসার পথে মধ্যবর্তী কোনো প্রাণিতে দুটি আলাদা আলাদা করোনাভাইরাস জিনোমের খন্ড বিনিময় করে অনন্য হয়ে উঠেছে। ২০০২-০৩-এর SARS-Cov-এর ক্ষেত্রে সেটা ছিল সিভেট ক্যাট বা ভাম-বেড়াল। ২০১৩-এর MERS মহামারির সময় বোঝা গিয়েছিল বাদুড়ের শরীর থেকে নিরীহ করোনা উটের শরীরে বাসা বেঁধে SARS-Cov সঙ্গে রিকম্বিনেশন ঘটিয়েছে এবং নিজেকে এমনভাবে বদলে ফেলেছে যে তা যেমন নিরীহও থাকেনি আর তেমনই চেনা SARS-Cov-এর সঙ্গেও তার পুরোপুরি মিল ছিল না। নভেল করোনা বা SARS-Cov-2-এর সঙ্গেও সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া গেছে বাদুড়ের লালায় পাওয়া করোনার। চিনের ইউয়ান প্রদেশ থেকে সংগৃহীত ‘হর্স-শু ব্যাট’ (Rhinolophus affinis) বা ঘোড়ার নাল সদৃশ বাদুড়ের লালায় মেলা RATG13 নামক করোনার জিনোমের সঙ্গে এর জিনগত মিল ৯৬ শতাংশ। ৯৬ শতাংশ মিলটা জিনবিদ্যায় ‘আইডেন্টিক্যাল’ ঘরানাভুক্ত করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। নভেল করোনার একটা নিকটতর আত্মীয় কোথাও একটা আছে এবং সম্ভবত বাদুড় বা সিভেট বা প্যাঙ্গোলিন কিছু একটা সেটা হবে সেই ‘ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট’ কিন্তু সেটা যে কোন প্রাণি তা আজ প্রায় ৫০,০০০ প্রাণিদেহ ছেনে ছেঁচে ফেলবার পরেও জানা যায়নি। বলা হচ্ছে, এটা ‘লাস্ট পিস অফ পাজল’ যেটার হদিশ পেলে আমাদের করোনাজ্ঞান সম্পূর্ণ হতে পারে এবং অতিমারি নিয়ন্ত্রণেরও একটা রূপরেখা মেলে।

এখন কথা হল কোটি কোটি সম্ভাব্য প্রাণির মধ্যে ঠিক কোন জাতের প্রাণি এই ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট হিসাবে কাজ করেছিল তা নির্ণয় করা সহজ নয় এবং চটজলদি তা হবারও নয়। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমক ভুমিকার প্রথম রেকর্ড ১৯১২'র যখন জার্মানিতে পশুচিকিৎসকেরা একটা জ্বরে ভোগা দুর্বল বিড়ালের মধ্যে এমন একটা ফুলে যাওয়া পেটের উপসর্গ দেখতে পান যা তখন পর্যন্ত নতুন। ওই পশুচিকিৎসকেরা অবশ্য জানতেন না যে ওই একই সংক্রমণে দু’সপ্তাহ যেতে না যেতে কোনো কোনো শূকরের প্রতিটি বাচ্চা মারা পড়ে এবং মুরগির ব্রঙ্কাইটিস হয় ব্যাপকহারে। ১৯৬০-এর পর এটির চরিত্র বিশ্লেষণ করে বোঝা গেছে জীবাণুটি রীতিমত বহুগামী - যা কুকুরের জীবাণু তা বেড়ালকে এবং যা বেড়ালের মৃত্যুর কারণ তা শূকরছানাদের চোখ ফোটার আগেই মেরে দেয়। মানুষও যে এই মধ্যবর্তী বাহকের ভূমিকায় থাকতে পারে তা বোঝা গেছে ভারতে সন্ধান মেলা ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট B.1.617.2-এর আচমকা প্রাদুর্ভাব থেকে। এটি প্রথম দিকে পাওয়া নভেল করোনার থেকে এতটাই আলাদা যে আর এক নভেল বলে ভুল হওয়াও অসম্ভব ছিল না। মধ্যবর্তিনীর সন্ধান পাওয়া যায়নি মানেই যে এটা ল্যাবে তৈরি করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলাটা অবিজ্ঞান। দেড় বছর পরে গত মে মাসে চিনের গবেষকরাই জানিয়েছেন আর একটি বাদুড়ে প্রাপ্ত করোনাভাইরাস RmYNO2 সম্ভবত নভেল করোনার আরো নিকতবর্তী আত্মীয়। সুতরাং, খোঁজ চলছে এবং ‘জিগ-স’ পাজলের ওই শেষ খন্ডকটি না পাওয়া অবধি ল্যাব তত্ত্ব যে চলবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

প্রশ্নঃ নভেল করোনার স্পাইক প্রোটিন, যাকে বলে তার পাওয়ার স্পাইক, সে নাকি এতটাই আলাদা যে তাকে একটা ফিউশন ভাইরাস মনে করার কারণ থেকে যায় না কি?

নভেল করোনার ছবিটির সঙ্গে এখন বিশ্বের শিশুরাও পরিচিত। গোলাকৃতি খোলসের গায়ে যে কাঁটা কাঁটা বহিঃবৃদ্ধি সেগুলোই তার ‘পাওয়ার স্পাইক’। কোষের ভিতরে ঢুকতে গেলে সব রকম করোনাকেই আগে চিনে নিতে হয় আমাদের কোশপর্দার গায়ে থাকা এক ধরনের যৌগকে যেটাকে ACE2 নামে আমরা অনেকেই জেনে গেছি ইতিমধ্যে। মানুষের শরীরে সব শিরা ধমণীর প্রাচীরে এই ACE2 থাকে বটে, কিন্তু বিশেষভাবে ঘন পরিমাণে থাকে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর ভিতরের পর্দায়। স্পাইক আর ACE2‘র মধ্যে চেনাজানা এবং সংযোগ ঘটে গেলে আক্রান্ত কোশ নিজেই স্পাইকটাকে খন্ডিত করে ফেলে, যে ঘটনাকে বলে ‘ক্লিভেজ’। এটা হয়ত কোশ প্রতিরক্ষার তাগিদে করে কিন্তু তার ফল হয় উলটো। খন্ডিত অংশগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কোশপর্দার বাধাকে অতিক্রম করে কোশের মধ্যে ঢুকে পড়ে। নভেল করোনাভাইরাসের একটা সত্যিকারের নভেল এবং চিন্তায় ফেলে দেবার মত বৈশিষ্ট্য হল এদের এই ক্লিভেজ পয়েন্ট। স্পাইককে কাটার কাজে মানুষের ফুসফুসের বায়ুথলির কোশগুলি যে যৌগগুলো ব্যবহার করে তার একটির নাম হল ‘ফিউরিন’ যা সাধারণত ইবোলা, ডেঙ্গি বা এইডস এবং ফ্লু ভাইরাসেরা ব্যবহার করে থাকে। এই একটা ক্ষমতা SARS-Cov-2-কে ১০০ থেকে ১০০০ গুন শক্তিশালী করেছে তার অন্য সমস্ত ভাই-বেরাদরের তুলনায় কারণ ফুসফুসের কোষে ফিউরিনের পরিমাণ প্রচুর, অপরিমেয়। লুইসিয়ানার প্রফেসর রবার্ট গ্যারির কথা তুলে দিতে পারিঃ “When I saw SARS-CoV-2 had that cleavage site, I did not sleep very well that night,”[১] ল্যাব-লিক তত্ত্ববাদীরা বলছেন এই ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট তো নভেল করোনার সঙ্গে বেশি সাদৃশ্য আছে এমন ভাইরাসগুলোতে নেই, সুতরাং এটা গবেষণাগারে বানানো সিনথেটিক জীবাণু যার ভিতরে ওই ইবোলা বা এইডস সাইট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ তত্ত্বও দাঁড়ায় না ততটা যখন জানা যায় করোনাভাইরাস গ্রুপটাতে অন্য অনেক সদস্যেরই এই ফিউরিন ক্লিভেজ পয়েন্ট আছে। OC43 নামের একটা সাধারণ সর্দি-জ্বর ঘটানো করোনাভাইরাস এককালে ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল (১৮৯০-এর ফ্লু মহামারি যে আসলে আর একটা করোনা মহামারি ছিল এবং OC43 যে তার জীবাণু ছিল তা প্রত্ন-ভাইরোলজিস্টরা আজ বুঝতে পেরেছেন)। এটাকে নভেল করোনার ‘ডিসট্যান্ট রিলেটিভ’ বলা যায়, কিন্তু ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট তারও আছে। সুতরাং এটা ততখানি পোক্ত প্রমাণ নয় যা দিয়ে ল্যাব লিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়।

প্রশ্নঃ মানুষের তৈরি ভাইরাস নয় এটা নিশ্চিতভাবে বলার সপক্ষেও তেমন বড় কোনো প্রমাণ নেই বিশেষত ইদানিংকালে করোনা জিনোমে এমন কিছু কিছু জেনেটিক কোডের কথা জানা গেছে যা ভাইরাসের স্বাভাবিক কোড নয় বরং তা মানুষের জেনেটিক কোডের অনুরূপ। সুতরাং একটা ‘স্মোকিং গান’ যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেটা কী অস্বীকার করা যায়?

করোনাভাইরাসের জীনোমে যদি মানুষের তৈরি সিগন্যাল ভরে দেওয়া থাকতো তাহলে তা শনাক্ত করতে এতদিন সময় লাগতো না। কৃত্রিমভাবে তৈরি জিন পদার্থ কিছু সূত্র না রেখে তৈরি করা অসম্ভব বললেই চলে। এগুলো হল ল্যাবে সৃষ্ট জিন বস্তুর ‘টেল টেল’ চিহ্ন যা জেনেটিসিস্টরা ধরে ফেলতে পারেন, কৃত্রিম মেধাও তা শনাক্ত করতে পারে। এখনও পর্যন্ত একটিও এমন দাবি সারা বিশ্বের কোনো জায়গা থেকেই ওঠেনি যে এ করোনাতে সে সূত্র এক বা একাধিক আছে। লা জোলা, ক্যালিফোর্নিয়ার টিম ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসেন-এর নেতৃত্বে [২] অতিমারির শুরু থেকেই এই সূত্র খোঁজার কাজটা করে আসছেন এবং কৃত্রিমভাবে তৈরির সম্ভাবনাকে তাঁরা স্রেফ অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটকে ল্যাব লিক তত্ত্বের প্রবক্তারা ওই সূত্র বলে দেখাতে চাইলে ভাইরাসের বিবর্তনের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে হয়। ভাইরাস বিবর্তিত হতে থাকে মিউটেশন ও রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে। করোনা পরিবারে ফিউরিন সাইট আজ নতুন করে ধরা পড়ল এমন তো নয়, সুতরাং বিবর্তিত হয়ে আরও ব্যাপক সংক্রামক চেহারা অর্জন করতে এটা যে রিকম্বিনেশনের সাহায্য নিয়ে ফিউরিন সাইটটি নিজের অস্ত্র করে নিয়েছে তা বিবর্তনের সূত্র মেনেই প্রমাণ করা যায়।

বাকি রইল ‘স্মোকিং গান’-এর কথা - বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখলেই বুঝতে হবে গুলি চলেছিল। ডেভিড বাল্টিমোর সারা পৃথিবীর ক্লাসরুম জেনেটিসিস্টের মধ্যে একজন। তিনি একটি গবেষণাপত্রে বলেছেন নভেল করোনার CGG ট্রিপলেট কোডন (প্রতিটি ট্রিপলেট কোডন আসলে এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড এর বার্তাবাহী, আর অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়েই তৈরি হয় প্রোটিন এবং প্রোটিন দিয়েই তৈরি আমাদের দেহ ও দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র) যে অ্যামাইনো অ্যাসিডের বার্তাবাহী (এক্ষেত্রে তার নাম আর্জিনিন) তা মানুষে দেখা গেলেও ভাইরাসে সহজলভ্য নয় [৩]। এর উত্তরে 'নেচার' পত্রিকাতেই অ্যান্ডারসেন বলেছেন, SARS Cov2-এর মাত্র ৩ শতাংশ CGG কোডন (একই কোডন একটি জিনোমে বহুসংখ্যকবার উপস্থিত থাকতে পারে) মানুষের মত আর্জিনিন গঠনের সংকেত দেয় এবং কোভিড-১৯ অতিমারি সৃষ্টিকারী মাত্র ৫ শতাংশের মত জীবাণুতে এই ‘মানবীয়’ ধর্ম ছিল, বাকিদের সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না। গুঁজে দেওয়া জিনিস হলে তার মধ্যে এই অসাম্যের সম্ভাবনা ও হিসাব ল্যাব লিক তত্ত্বের সমর্থনে কিন্তু কথা বলছে না। বাল্টিমোর সে কথা মেনে নিয়েও ওই মোক্ষম ‘স্মোকিং গান’ বাক্যবন্ধটি সামনে এনেছেন, সুতরাং ধোঁয়া এখনও উড়বে আরও কিছুদিন।

প্রশ্নঃ চিনের কাছ থেকে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠছে - এটাই কী অস্বাভাবিক নয়?

এটা ঠিক যে চিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্তে একশো শতাংশ সহযোগিতা করেনি। তারা যা দেখিয়েছে তাই দেখে অনুসন্ধানী দল জানিয়েছিল তারা খুশি এবং কোনোরকম গোলমাল তাদের নজরে আসেনি। এবং ইতিমধ্যে আমেরিকার গোয়েন্দা দপ্তর জানিয়েছে যে চিনে প্রথম কেস ধরা পরে ডিসেম্বর ২০১৯-এ অথচ তাদের কাছে খবর নভেম্বরেই উহান ইনস্টিটিউটের তিনজন স্টাফ ‘অসুস্থ’ ছিলেন। WIV এদের জানুয়ারির রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট জানিয়ে বলেছে এদের রক্তে জানুয়ারি মাসে কোনো কোভিড অ্যান্টিবডি ছিল না যা নভেম্বরে সংক্রমণ হয়ে থাকলে অসম্ভব ছিল। এ জবাবে সকলে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আমেরিকা দাবি করেছে উহান ল্যাবের প্রতিটি কর্মচারীর বর্তমান ও বিগত মেডিক্যাল রিপোর্ট, তাদের রক্তের নমুনা, ফ্রিজারে থাকা সমস্ত নমুনার সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের অধিকার, কম্পিউটার হার্ড ডিস্ক দেখার অধিকার এবং সমস্ত ল্যাব রেকর্ড বা নোট বুক দেখার অধিকার। এসব দাবি, বলাই বাহুল্য, চিন উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে আমেরিকা বরং তাদের নিজেদের দেশের ভাইরোলজি ল্যাবগুলোকে একবার পরীক্ষা করে দেখুক ওখান থেকেই কিছু বেরিয়ে গেল কিনা! সুতরাং প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্নে হাওয়া ক্রমশ উষ্ণতর হয়ে উঠছে। আগস্টে আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স কী রিপোর্ট দেয় তাই এই বিতর্কে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে কিন্তু বিজ্ঞান গোয়েন্দা কানুন মেনে চলেনা। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হাজারো ভাইরাস নমুনা সারা বিশ্বের নানান গবেষণাগারে যুক্তির তীব্রতম আতসকাঁচের তলায় ফেলেও করোনার কৃত্রিম উৎসের সপক্ষে বলার মত কিছু পাওয়া যায়নি।


তথ্যঋণঃ
1. David Cyranoski; Nature; Vol 581; 7 May 2020; p.22-26
2. Nature med. Vol 26; p.450-452
3. Nature; Vol 594; 17 June 2021; 313-315