আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি সমস্যাঃ বর্তমান সংকটের রূপরেখা এবং মূল্যায়ন

সোহম ভট্টাচার্য


গত ছয় মাসের কিছু বেশি সময় ধরে দেশের উত্তরপ্রান্তে এবং অন্যত্রও কৃষকদের প্রতিবাদ বেশ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থান করেছে। এই প্রশ্নগুলির আপাতভাবে মূলত দুটি দিক, প্রাথমিক ভাবে কৃষি আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার মূলত কৃষকদের ন্যায্য মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রির রাস্তাটি কার্যত বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করছেন (সরকার এবং ভট্টাচার্য, ২০২০; রামকুমার, ২০২০)। দ্বিতীয়ত, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সংশোধনের ফলে লকডাউন এবং কোভিড-উত্তর অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে মূল্যবৃদ্ধির ভীতি থেকে উঠে আসা প্রতিবাদও দৃশ্যমান। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে টিকরি কিংবা সিঙ্ঘুসীমানায়, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ কিংবা রাজস্থান থেকে আসা কৃষকদের অবস্থান এখনো রয়েছে। প্রতিবাদের সামনে দাঁড়িয়েও মোদী সরকারের দিক থেকে কোনো সদুত্তর আসেনি।

এইরকম একটি অবস্থায়, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কৃষক-বন্ধু যোজনার আওতায় বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০০০০ টাকা (পূর্বে ৫০০০ টাকা)। ছোট জোতের ভাগচাষীদের ক্ষেত্রে এই অনুদান বাড়ানো হয়েছে বার্ষিক ৪০০০ টাকা (পূর্বে ২০০০ টাকা)। তুলনামূলক ভাবে এই অনুদান কেন্দ্রের পি-এম কিসান যোজনার চেয়ে বেশি এবং সেই ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়ের পরে, তুলনামূলক টেক্কা দেওয়ার একটি আখ্যান রচনাও শুরু হয়েছে। রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকারের কৃষি ক্ষেত্রের প্রতি এই আনুকূল্য এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলের সাথে এক দশক আগে থেকে জড়িয়ে থাকা 'ভূমি রক্ষা' আন্দোলনের প্রেক্ষিত, এই সমস্তটি জুড়ে নিয়েই ইতিবাচক আলোচনাগুলি উঠে এসেছে সম্প্রতি।

এই নিবন্ধের প্রেক্ষিত এবং প্রেরণাও মূলত এইখানেই নিহিত। পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে এবং বৃহত্তর জাতীয় স্তরের কৃষিক্ষেত্রে, (মূলত কৃষকের প্রতি) অনুদানভিত্তিক বা ঋণমকুবের মাধ্যমে সংকটমুক্তির কিছু রাস্তা গত এক দশক ধরে সামনে এসেছে। মূলত কৃষক আত্মহত্যার ঘটনার সামনে দাঁড়িয়েই এই প্রকল্পগুলির উদ্ভাস। সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে আসা কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিবাদের দিকগুলিতেও বারংবার ন্যায্যমূল্য, ঋণমকুব এই দাবিগুলিই ফিরে এসেছে।

এই নিবন্ধের শুরুতেই তাই, একটি সন্দর্ভ সামনে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করব। উদারনৈতিক বা নিও-লিবারাল সময়ে দাঁড়িয়ে, এই রাজ্যের কৃষিজীবি অংশের একটি আধা-সর্বহারাকরণের (semi-protetarianisation) পদ্ধতি ক্রমশ প্রকট হয়েছে। এই পদ্ধতিটির সাথেই তিনটি অনুসারী পদ্ধতির জন্ম হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, এই আধা-সর্বহারা অংশের জন্যে চাষের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বিপুলভাবে এবং শুধুমাত্র চাষ থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয় (immiserisation)। দ্বিতীয়ত, এই স্বল্প আয়ের ফলেই এই শ্রেণির কৃষিজীবীদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে ঋণের উপর নির্ভরতা। সর্বশেষে, এই দুটি সংকটের পাশাপাশি গত একদশকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বেড়েছে বেকারত্বের পরিমাণ। এর ফলে একটি বড় অংশের প্রান্তিক কৃষিজীবী পরিবারের নির্ভরতা থেকে গিয়েছে অনুদানের উপরেই, যা এই সংকটের একটি সাময়িক উপশম মাত্র, কোনো রাজনৈতিক সমাধান নয়।

আগামী তিনটি অংশে এই সন্দর্ভটির সাথে যুক্ত তিনটি উপজীব্য নিয়েই কিছু আলোচনার চেষ্টা করব। শেষ অংশে কিছু বিকল্প সন্ধানের চেষ্টা থাকবে, যা একইসাথে সাংগঠনিক রাজনীতির এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির কিছু প্রশ্নের উত্থাপনের চেষ্টামাত্র।

ছোট জোত, স্বল্প উৎপাদনক্ষমতা এবং আধা-সর্বহারাকরণ

পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিকগুলির বিচারে তিনটি মূল ঐতিহাসিক ধারাকে প্রথমে চিহ্নিত করে ফেলা প্রয়োজন। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০-র দশকরে সময়ে কৃষি অর্থনীতির মূল সমস্যার দিকটি ছিল রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষমতার অভাব। এর পাশাপাশিই উৎপাদনের ক্ষেত্রে আধা-সামন্ততান্ত্রিক (semi-feudal) যে সম্পর্কগুলি বারংবার ফিরে এসেছে, তার প্রেক্ষিতে ভাগচাষের ন্যায্য অধিকার, কৃষি জমির অধিকার, এই সমস্তই দেখা দেয় রাজনৈতিক প্রশ্ন রূপে। শ্রেণিভিত্তিক ভাবে প্রান্তিক কৃষক, ভাগচাষি এবং বর্গাদারদের কাছে জমির এবং চাষেরঅধিকার হয়ে দাঁড়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। তাই ১৯৭৭ সালের বাম রাজনৈতিক পরিবর্তন, একদিকে 'অপারেশন বর্গা' এবং অন্যদিকে কৃষি উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির ভিত্তিতে কৃষিক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ধারারও পরিবর্তন। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ দশকে, প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষির ফলন বৃদ্ধি পায় প্রায় ৭ শতাংশ হারে। এই একই সময়ে সেচের বৃদ্ধি, জমির অধিকার বন্টন এবং সবুজ বিপ্লব পরবর্তী উচ্চ-ফলনশীল বীজের সহায়তা, কৃষির এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়ে ওঠে (রাওয়াল এবং স্বামীনাথান, ১৯৯৮, রাওয়াল এবং মিশ্র, ২০০২)। এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এবং কৃষিক্ষেত্রের কিছু উন্নয়নের ধারা, অবশ্য ১৯৯৫ সালের পর থেকেই অধোগামী হতে শুরু করে। ফলন এবং উৎপাদন, দুই ক্ষেত্রেই গত দুই দশকে, বৃদ্ধির হার ২-৩ শতাংশ। বহুক্ষেত্রেই উদারনীতিকে এই অধোগমনের জন্য দায়ী করা হয়েছে।

সে প্রসঙ্গে না গিয়ে, আমরা, রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক চরিত্রের দিকে এবার একটু মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করব। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে জোতের আয়তন ক্রমাগত ক্ষু্দ্র হতে থেকেছে। ২০১৫-১৬ সালের এগ্রিকালচারল সেন্সাস থেকে আমরা দেখি, রাজ্যের গড় জোতের আয়তন মাত্র ০.৭ হেক্টর (৪-৫ বিঘা)। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই আয়তন ১.০৩ হেক্টর (৭-৮ বিঘা)। সারণি ১ থেকে এই বিষয়টিও খুবই দৃশ্যমান, রাজ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষি জমি এবং প্রায় ৯৫ শতাংশ কৃষি জোতই ২ হেক্টরের কম জমি রয়েছে, এইরকম ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক চাষিরা চাষ করছেন।

সারণি ১: পশ্চিমবঙ্গে কৃষিজমির বন্টন, শতাংশে। ২০১৫-২০১৬।

কৃষিজোতের আয়তন জোতের সংখ্যা (%) কর্ষিত জমি (%)
প্রান্তিক (১ হেক্টরের কম) ৮২.৮ ৫৩.৪
ক্ষুদ্র (১-২ হেক্টর) ১৩.৪ ২৮.৩
আধা-মাঝারি (২-৪ হেক্টর) ৩.৫ ১২.৮
মাঝারি ও বৃহৎ (৪ হেক্টরের বেশি) ০.২ ৫.৫
সামগ্রিক ১০০ ১০০

সূত্রঃ এগ্রিকালচারাল সেন্সাস, ২০১৫-১৬।

দ্বিতীয়ত, ২০১১ থেকে ২০১৯ সালে, রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কৃষির উপর নির্ভর করছেন এমন কর্মীর সংখ্যা সামান্য কমেছে (৫২ থেকে কমে ৪৭ শতাংশ)। এই হ্রাসের পাশাপাশিই বেড়েছে গ্রামীণ পরিষেবা ক্ষেত্রের গুরুত্ব। একই সাথে ২০১২-১৩ সালের ন্যাশানল স্যাম্পেল সার্ভে কৃত সিচুয়েশন অ্যাসেসমেন্ট সমীক্ষা থেকে দেখতে পাই, এই রাজ্যে, ফসল থেকে প্রাপ্ত বার্ষিক গড় আয় ৪৭,৭৬০ টাকা, যেখানে সর্বভারতীয় গড় ৭৭,১৬২ টাকা। একটি কৃষিজীবী পরিবারের শুধুমাত্র কৃষিকাজ থেকে আয়ের পরিমাণ মোট পারিবারিক আয়ের ২৪ শতাংশ মাত্র। একইভাবে ২০১৬-১৭ সালে নাবারড কৃত সমীক্ষা থেকেও দেখতে পাই, কৃষিজীবি পরিবারের মাসিক গড় আয় মাত্র ৭৭৫৬ টাকা, যেখানে সর্বভারতীয় গড় আয় প্রায় ৮৯৪০ টাকা এবং পাঞ্জাব বা হরিয়ানার ক্ষেত্রে এই আয়ের পরিমাণ ১৭ হাজার টাকারও বেশি।

অর্থাৎ, একদিকে ক্রমহ্রাসমান জোতের আয়তন এবং অন্যদিকে কৃষিজাত আয়ের সংকোচন, এই দুটি অর্থনৈতিক চরিত্র এক সাথে, একটি প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়। যেহেতু ছোট জোতের উৎপাদনের ক্ষেত্রে বহু প্রযুক্তিগত বাধা থাকে, তাই এই ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষেত্রে, উৎপাদন বা আয় কৃষি থেকে বাড়ানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। ফলনের বৃদ্ধি একটি স্থগিত অবস্থায়। তাই জমির উপর তাঁদের এই নির্ভরতা যথেষ্ট আয়ের সুযোগ করে দিতে পারছে না। এই প্রবণতাটির মধ্যেই রাজ্যের একটি বড় অংশের কৃষিজীবীদের মধ্যে, আধা-সর্বহারাকরণের একটি নির্দেশ লুকিয়ে আছে। সামান্য পরিমাণ জমিতে চাষের উৎপাদনে যেমন এখনও নির্ভরতা রয়ে গিয়েছে, একই সাথে কিন্তু পারিবারিক আয়ের একটি বড় অংশ উঠে আসছে অ-কৃষিজাত কর্মে নিযুক্ত হয়ে। এই ক্ষেত্রে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, এই শ্রেণির একটি বড় অংশের পারিবারিক জোতের শ্রমটি বহুক্ষেত্রেই পরিবারের মহিলা সদস্যের বিনা মজুরীতে কর্মরত শ্রম। খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে, গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে, কর্মক্ষম জনসংখ্যার (১৮-৬৫ বছর বয়স যাঁদের), প্রায় ১৯ শতাংশই এই বিনা মজুরীতে কর্মরত (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে, ২০১৮-১৯)।

বাজার-মূল্য এবং পণ্য সহায়তাঃ সংকটের কিছু ইঙ্গিত

পশ্চিমবঙ্গের মূলত এই প্রান্তিক চাষিদের ক্ষেত্রে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্যে সংকটের প্রশ্নগুলি কিন্তু এখনো দেশের অন্যান্য অংশের কৃষকদের কৃষিপণ্য আইনের বিরোধিতার প্রশ্নগুলির সাথেই যুক্ত। সেই কৃষিপণ্যের দামের প্রশ্নগুলিতে যাওয়ার আগেই আমাদের কয়েকটি প্রবণতার ইঙ্গিত মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, রাজ্যের মূল কৃষিজ উৎপাদন এখনো ধান উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। এই ফসলের আলোচনা থেকে তাই কিছু ইঙ্গিত পাওয়া সম্ভবপর। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ সালের ধানের ফলনের দিকটি যদি আমরা দেখি, তাহলে এই ফলনের হার বৃদ্ধি স্থগিত হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি আরো পরিস্কার হবে। সারণী ২ থেকেই আমরা দেখতে পাই, ২০১৬ সালে গড়ে মাত্র ৪৬ ক্যুইন্টাল প্রতি হেক্টরে এবং ২০১৭-১৮ সালে গড়ে ৪৩ ক্যুইন্টাল ফলন হয়েছে রাজ্যে। এই একই বছরে অন্ধ্রপ্রদেশ, যে রাজ্যেও ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্য, সেখানে ফলন হয়েছে ৬০ থেকে ৫৭ ক্যুইন্টাল। দ্বিতীয়ত, ২০১৭-১৮ কৃষি বর্ষে যদি আমরা রাজ্যের বাজেটে সেচ, এবং অন্যান্য কৃষিজ ক্ষেত্রে সরকারী খরচের পরিমাণ দেখি, তা বাজেটে ঘোষিত মোট খরচের মাত্র ০.৫ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনের বৃদ্ধির জন্য রাজ্যের কৃষক ফলনের দিক থেকে কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, সেচ বা অন্যান্য বিনিয়োগে মূল খাতের সরকারি ব্যয় যৎসামান্য।

সারণি ২: ধানের ফলন, প্রাপ্ত বাজার মূল্য এবং কেন্দ্রঘোষিত ন্যায্যমূল্য, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮।

সাল রাজ্য ধানের ফলন (Yield) ক্যুইন্টাল/হেক্টর ধানের প্রাপ্ত বাজার মূল্য
(টাকা/ক্যুইন্টাল)
মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস
২০১৬-১৭ পশ্চিমবঙ্গ ৪৫.৮ ১৪১০ ১৪৭০
" পাঞ্জাব ৬৯ ১৫৬৮ ১৪৭০
" অন্ধ্রপ্রদেশ ৬০ ১৫৭৮ ১৪৭০
২০১৭-১৮ পশ্চিমবঙ্গ ৪৩ ১৫৪৫ ১৫৫০
" পাঞ্জাব ৭৫ ১৬৫১ ১৫৫০
" অন্ধ্রপ্রদেশ ৫৭ ১৫০৬ ১৫৫০

সূত্রঃ ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যার্টিসটিক্স, এগ্রিকালচার। ধানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খারিফ মরসুমের ধানের আলোচনাই রয়েছে।

এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে। কৃষকের আয় বৃদ্ধির উপায় কী? জোতের পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ নেই। সুযোগ নেই ছোট জোতেই উচ্চ ফলনের সুবিধা পাবার। অর্থাৎ কৃষিজ পণ্যের জন্য বাজারে পণ্য মূল্যটি ন্যায্য কার ব্যতীত, আপাতদৃষ্টিতে কোনো সুরাহা নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাজ্যের কৃষিজ পণ্যের জন্য যে সরকারি পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা এখনো গড়ে উঠতে পারেনি। যেখানে পাঞ্জাব বা অন্ধ্রপ্রদেশের মত রাজ্যে কৃষকের কাছে গড়ে যে মূল্যে ধান কেনা হয়, তা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে যথেষ্ট বেশি। এই রাজ্যে কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা দেখতে পাইনা।

সারণি ৩: ২০১৭-১৮ সালে ধান উৎপাদনের আয় এবং ব্যয়।

রাজ্য হেক্টর পিছু গড় ধানের আয়
(Gross Value of Output) (টাকায়)
হেক্টরপিছু গড় ধান উৎপাদনের সার্বিক খরচ
(C2) (টাকায়)
হেক্টর পিছু গড় ফসলের আয়
(Farm Business Income=GVO-C2) (টাকা)
পশ্চিমবঙ্গ ৬৬২০৮ ৭৮০৫৭ -১১৮৪৯
পাঞ্জাব ১২৩৬২৪ ৮১৩৭৮ ৪২২৪৬
অন্ধ্রপ্রদেশ ৯২১৭৫ ৯১২৪৫ ৯৩০

সূত্রঃ CACP

আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে, প্রতি হেক্টর জমিতে যদি ধান উৎপাদনের থেকে আয় এবং ব্যয়ের বিষয়টি দেখি, সেক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিমাণ ফারাক দেখা যায়। স্বামীনাথন কমিশন (২০০৬) কৃত ব্যয়ের সূত্র ব্যবহার করে সার্বিক ব্যয়ের আকারটি নেওয়া হল (Comprehensive Cost C2, Commission for Agricultural Cost and Prices)। এই ব্যয়ের হিসাবে, প্রতি হেক্টর জমিতে দেখা যাচ্ছে আয়ের পরিমাণ (GVO-C2) দাঁড়ায় ঋণাত্মক। যেখানে প্রতি হেক্টরে পাঞ্জাবে এবং অন্ধ্রপ্রদেশে আয়ের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। আরো পরিষ্কার ভাবে, পশ্চিমবঙ্গে একজন ধান উৎপাদনকারী কৃষকের প্রতি কেজি উৎপাদনে ৮-৯ চাকা মোট ক্ষতি, আর পাঞ্জাবে বা অন্ধ্রপ্রদেশে সেই প্রতি কেজিতে লাভ ৫ টাকা এবং ১ টাকা।

অর্থাৎ রাজ্যের কৃষিতে তিনটি প্রবণতা প্রকট। প্রথমত, ছোট জোতের জমিতে চাষের ক্ষেত্রে ফলনের সুবিধা নেই। দ্বিতীয়ত, মিনিমাম সাপো্রট প্রাইস বা ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কম দামে ফসল বিক্রির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। তৃতীয়ত, ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণটি ক্রমবর্ধমান। এই তিনটি প্রবণতাকে একত্র করলেই আমরা টের পাই, কেন কৃষিজীবী অংশের শ্রেণিবিন্যাসে এই আধা-সর্বহারাকরণের পদ্ধতিটির সাথেই কৃষকের দারিদ্রকরণের সাথে জড়িত।

অনুদানের রাজনীতি এবং শ্রেণি প্রশ্নের উত্থাপনঃ সংকটের সূত্রপাত

কৃষিক্ষেত্রে শ্রেণিবিন্যাস এবং শ্রেণিবিভাজনের বিষয়ে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত হয় দুজন সমাজবিজ্ঞাণীর মধ্যে। অধ্যাপক টেরি বায়ারস এবং হেনরি বার্নস্টাইনের এই আলোচনা বা দ্বন্দ্বের মূল তাত্ত্বিক দিকটি ছিল কৃষিভিত্তিক শ্রেণিবিভাজনের (peasant differentiation) ঐতিহাসিক পদ্ধতি ঘিরেই। কৃষিভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে শ্রেণিবিভাজন এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে আলোচনার সূত্রটি লেনিন-কাউটস্কি কিংবা মাও-জে-দং থেকে শুরু করে ১৯৬০-৭০ এর দশকে উৎসা পট্টনায়ক- অশোক রুদ্র- প্রণব বর্ধনের আলোচনাতেও (Mode of Production debate) এসেছে। বার্নস্টাইন-বায়ারস আলোচনায় উঠে এসেছে, তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে নয়া-উদারবাদী সময়ে এই শ্রেণিবিভাজন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এই আলোচনার দীর্ঘ পরিসর এই নিবন্ধে নেই, তাই দ্বন্দ্বের মূল অংশটি তুলে ধরাই এখানে আমার লক্ষ্য।

স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন সম্পর্কে বহুলাংশেই প্রাক-ধনতান্ত্রিক কিছু সম্পর্কের আলোচনা বারংবার উঠে এসেছে। এই প্রবণতাকে অমিত ভাদুড়ী চিহ্নিত করেছেন পূর্বভারতের ক্ষেত্রে। জাতিভিত্তিক (caste) ভাবে জমির অধিকারভোগী গ্রামের উচ্চ বর্ণের জমিদার এবং উলটোদিকে কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত আধা-শ্রমিক ও আধা-ভাগচাষি শ্রেণির মূল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ভিত্তি ছিল জমির অধিকার। অর্থাৎ ভুমিসংস্কারের সূত্রে উৎপাদন সম্পর্কের কিছু পরিবর্তন এবং পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের ফলে একটি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের রূপরেখা দেবার চেষ্টা। এই উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন কিন্তু উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং উদ্বৃত্ত সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত ভাবে জড়িয়ে। এই যাত্রাপথটি অবশ্যই সরলরেখার নয়, এবং কোনো আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেই এই বিশেষ অবস্থান ভাবা হয়নি, যেখানে গ্রামের শ্রেণি বিন্যাসে শুধু মাত্র ধনতান্ত্রিক কৃষিজীবি শ্রেণি এবং কৃষিক্ষেত্রের সম্পদহীন শ্রমিক, এইদুটি শ্রেণিই সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই প্রবণতার দিকে কৃষিক্ষেত্র যেতে পারে এমন কিছু ঐতিহাসিক পথের আলোচনা করেছেন অধ্যাপক বায়ারস।

কিন্তু ভারতবর্ষের কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে, ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে কৃষিতে বিনিয়োগ এবং কৃষিজাত বিনিয়োগের সূত্রে, অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত সৃষ্টির এই পরিকল্পনা থেকে আমরা ধীরে ধীরে সরে এসেছি। বায়ারস-বার্নস্টাইনের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্যে সরে আসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উঠে আসে বিশ্বায়নের ফলে, তৃতীয় বিশ্বের ধনতান্ত্রিক রূপান্তরে কৃষিক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত কিংবা সেই উদ্বৃত্ত ভিত্তিক শিল্পায়নের গুরুত্বহ্রাসের কথা। এই প্রবণতাকে অধ্যাপক বার্নস্টাইন বলছেন "Bypassing the Agrarian Question"। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত প্রশ্নে ধনতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন, কিংবা শ্রেণি সম্পর্কের উপর গুরুত্বহ্রাস। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রবণতা এসেছে কি না, তা দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ, এবং পশ্চিমবঙ্গেরও বিভিন্ন অঞ্চলের বিন্যাসের উপর এই প্রবণতা নির্ভরশীল।

তা সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান কৃষিক্ষেত্রের আলোচনা করতে গেলে আমাদের এই তত্ত্ববিশ্বের কিছু আলোচনাকে কেন্দ্রে রাখা প্রয়োজন। রাজ্যের গ্রামীণ ক্ষেত্রে 'অপারেশন বর্গা' এবং ১৯৮০-৯০ দশকের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পাশাপাশিই কিন্তু লুকিয়ে আছে রাজ্যের ছোট জোতের কৃষিজমির দ্বন্দ্বটি। জমি সমবায় সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি রাজ্যে। তাই ২০১০ পরবর্তী সময়ে এসে যখন সরকারি বিনিয়োগ নেই, নেই যথেষ্ট পরিমাণ কৃষিতে যান্ত্রিক ব্যবহার, নেই যলনের বৃদ্ধির জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক উপায়, তখন আধা-সর্বহারা শ্রেণির কৃষকের কাছে এই ছোট জোতের চাষে উৎপাদনের পদ্ধতির রূপান্তর ঘটানোর কোনো উপায় থাকে না। কৃষিকে একটি উৎপাদনক্ষম, অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তক্ষম ক্ষেত্রে রূপান্তর করতে না পারার ফলে, আমরা দেখি রাষ্ট্রের নীতি আলোচনায় কৃষিক্ষেত্রের আলোচনাটিকে নিয়ে যাওয়া হয় কৃষকের আয়ের এবং মূল্যের অধিকারে। আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে এবং রাজ্য সরকারে অনুদানে। কিংবা ঋণ-মকুবের ঘোষণায়। যেখানে অনুদানভিত্তিক ভাবে দুয়োরানী করে রাখা ক্ষেত্রটি কিন্তু ক্রমাগত স্বল্প ফলন- স্বল্প আয়- ঋণমূলক নির্ভরতার সংকটের বৃত্তে জড়িয়ে যেতে থাকবে। সাময়িক শ্বাস নিতে সাহায্য করবে রাষ্ট্র। কিন্তু আবার সেই রাষ্ট্রই উচ্চ পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেবে কৃষিপণ্যের বাজার।

নিও-লিবারাল অর্থনীতির এবং রাজনৈতিক ভাষ্যের একটি মূল লক্ষ্য থাকে বাইনারী সৃষ্টি করা। এই বাইনারীর মধ্যেই তাই আপাতভাবে দারিদ্র্যকরণ রুখতে মনে হয় অনুদান যিনি দিচ্ছেন, তিনি মোক্ষম ত্রাতা। কিছু ক্ষেত্রে, মূলত কোভিড এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ে আয়ের অনুদান সাহায্য অবশ্যই রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু একইভাবে অনুদান এর 'পপুলিজম' দিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে ভ্রান্তির অবকাশ থাকে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যদান এবং ব্যয়হ্রাস একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে যেমন পণ্যমূল্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে শুধু মাত্র মূল্যভিত্তিক রাষ্ট্রসহায়তা সংকটের গভীর কারণটিকে তুলে ধরে না। সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা দেখি স্বল্প-জোতের স্বল্প ফলনে, বিনা মজুরির পারিবারিক শ্রমিকের উপর নির্ভর করে, উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার প্রবণতার মধ্যে নিহিত।

এই প্রশ্নটির সমাধান সম্ভবত শুধু কৃষিভূমি রক্ষা করে রাখলেই চলবে না। কৃষিকে উৎপাদনশীল করে তোলাও প্রয়োজন। এই উৎপাদনশীলতার জন্য যেমন চাই সরকারি বিনিয়োগ, চাই উন্নত ফলনশীল ফসলের বিজ্ঞানের। একইসাথে ধান এবং আলুর পাশাপাশি অন্য ফসলের ক্ষেত্রেও চাষের প্রযুক্তির প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের সাথেই যুক্ত কিছু বামপন্থী সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন। সম্ভবত কৃষি বনাম শিল্প, কিংবা কৃষির বর্তমান অবস্থার রূপান্তর না ঘটিয়েই শিল্পের জন্য জমি রূপান্তরের মত অবস্থনের বাইরেও কিছু রাজনৈতিক বিকল্প রয়েছে। যা এড়িয়ে গেলে চলবে না।

জমি-কৃষি-রোমান্টিকতার বাইরেঃ শ্রেণিভিত্তিক কিছু প্রশ্ন

কেন্দ্রের এবং রাজ্যের কৃষিভিত্তিক অনুদান এবং আলোচনায় বারংবার ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক চাষির কথা উঠে আসে। সেই প্রাসঙ্গিকতার সাথেই জড়িয়ে আছে কিছু নাগরিক এবং উচ্চবর্ণভিত্তিক শ্রেণির ধারণা। ছোট কৃষককে ত্রাণ এবং অনুদান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে এই আপাত আকুলতার নাগরিক রোমান্টিকতার পিছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের চোখ ফিরিয়ে থাকা। ছোট জোতের কৃষিতে যান্ত্রিক শ্রমের ব্যবহার সীমিত। ছোট জোতের কৃষকের ক্ষেত্রে, মূলত এই রাজ্যে, পারিবারিক শ্রম এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শ্রমের একটি বড় অংশই আসে পরিবারের মহিলাদের থেকে। যার কোনো মজুরি স্বাভাবিকভাবেই নেই। ছোট জোতের কৃষকের কাছে বহুক্ষেত্রেই স্বল্পপুঁজির কারণে সেচের জন্য নির্ভর করতে হয় সামান্য বড় কৃষকের টিউব-ওয়েলের কিংবা পাম্প-সেটের জলে। যে জল সেই কৃষককে কিনে নিতে হয় পাম্প-সেট ব্যবহারের সময়ের উপরে ভিত্তি করে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে সেচের বিদ্যুতের জন্য শুল্কের পরিমাণ সারা ভারতের মধ্যে এই রাজ্যে সর্বাধিক। ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষককে কৃষি মূল্যের জন্য নির্ভর করে থাকতে হয় ফড়ে বা দালালের কাছ থেকে পাওয়া পণ্যমূল্যের উপর। যা বহুসময়েই মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের চেয়ে কম। তাই প্রান্তিক কৃষককে শুধুমাত্র টিকিয়ে রাখার কথা বলার যে রাজনীতি, তা মূলত এই বাস্তবকে অস্বীকার করার রাজনীতি।

এই কারণেই রাজনৈতিক ভাবে প্রান্তিক কৃষকের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রশ্নকে ভুল গেলে চলবে না। এই মূহূর্তে দাঁড়িয়ে ভূমি-সমবায় হয়তো সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত ভূমি অধিকার ছেড়ে সমবায় কৃষির সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কঠিন। কিন্তু কৃষিব্যয় এবং পণ্যমূল্যের প্রশ্নে সমবায় সম্ভব। সেই সমবায়ের সূত্রেই সম্ভব জমিতে যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহার। সম্ভব সেচের জলের জন্য সমবায়ভিত্তিক ভাবে ব্যয় সংকোচন। মানস রঞ্জন ভৌমিক, তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই রাজ্যেই তাঁত শিল্পীদের ক্ষেত্রে সমবায়গুলির সঙ্গে যুক্ত তাঁতিদের অর্থনৈতিক অধিকারের সুযোগ যথেষ্ট বেশি (ভৌমিক, গুহ-ঠাকুরতা, এবং বিশ্বাস, ২০২০)। বাম-রাজনৈতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে, এই রাজ্যে, কৃষি এবং কৃষক সমবায়ের আন্দোলন খুব নতুন কথা নয়। কিন্তু অতীতের সাথে দূরত্বের কারণেই এই বিকল্পকে বিস্মৃত মনে হয় আজ। কেরালাতে, ধান চাষের ক্ষেত্রে চাষিদের সমবায়ের ধারণায় তৈরি হয়েছে, 'পাদশেখারাম'। মূলত নাবালজমিতে (wetland) ধান চাষের জন্য যে স্থায়ী খরচ, সেচের খরচ, সেইসব খরচ, এই সমবায়ের ফলে, ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকের ব্যয় সংকোচনে সাহায্য করে। ঐ কেরালা রাজ্যেই তৈরি হয়েছে, 'কুডুম্বাশ্রী প্রকল্প। যেখানে মহিলাদের জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ তৈরি করে শুরু হয়েছে সমবায়ের কৃষি। সেই কৃষি একইসাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারের দিশা দিয়েছে এই রাজ্যের নারীদের। পাঞ্জাবের বৃহৎ জোতের কৃষকের উচ্চফলনশীল খেত, কিংবা যন্ত্র ব্যবহারের সুবিধা, এবং সর্বোপরি কৃষিক্ষেত্রে নিয়মিত বিনিয়োগের অবস্থা বাংলার ক্ষুদ্র কৃষকের এককভাবে নেই। কিন্তু সমবায়ের কৃষিতে তা আছে। সমষ্টির ধারণায় জমি অধিকারহরণ ছাড়াও, সমবায় সম্ভব। বহু সমাজবিজ্ঞানীই বলেছেন, বিভিন্ন আয়তনের জমির কৃষকরা, কেউ ক্ষুদ্র এবং কেউ বৃহৎ হলে, তাঁরা একইসাথে এই সমবায়ের অংশ হলে, সমবায়ের মধ্যেই গণতন্ত্র হ্রাস হয়। কিন্তু রাজ্যের যেখানে নব্বই শতাংশ কৃষকই ছোট জোতের জমির কৃষক, সেখানে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সমবায় সৃষ্টি কিন্তু সেই সংঘাতের প্রশ্নের দিকটিতেও সমাধান আনতে পারে। আলোচনায় আনা সম্ভব, ভূমিহীন ভাগচাষীর কাছে স্বল্পব্যয়ের উন্নত কৃষি প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া। বর্ণভিত্তিকভাবে ভূমিহীন, মূলত দলিত, যে ভাগচাষি, সেই শ্রেণি এবং বর্ণের প্রশ্নের দিকেও কিছু প্রাসঙ্গিক সদুত্তরের চেষ্টা থাকা সম্ভব।

এই প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। সাংগঠনিক রাজনীতির প্রশ্ন। নয়া-উদারনীতির যুগে একদিকে কৃষি ব্যয় বৃদ্ধি, কর্পোরেট পুঁজির কাছে পণ্যের বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া যেমন আছে। তেমনি আপাতদৃষ্টিতে অন্যদিকে শুধুমাত্র ভূমিরক্ষা এবং জনমোহিনী অনুদানের রাজনীতির বাইরে, বামপন্থী বিকল্পগুলি কিন্তু নতুন আন্দোলনেরই বিকল্প। সেই আন্দোলন শুধুমাত্র মূল্য এবং আয়ের অধিকারের প্রশ্নে আটকে থাকলে, এই আধা-সর্বহারা শ্রেণির দারিদ্র্যকরণের প্রশ্নটি ক্রমশই হারিয়ে যাওয়ার অবকাশ থাকে।

______________________________

1. এই বিষয়ে বিস্তারে আলোচনা করেছেন V. K. Ramachandran (2010): The state of Agrarian Relations in India Today (https://www.cpim.org/marxist/201101-agrarian-relations-vkr.pdf)।
● বার্নস্টাইন-বায়ারস আলোচনার সংক্ষেপ রয়েছেঃ Haroon Akram Lodhi and Cristobla Kay (2010) Surveying the agrarian question (part 2): unearthing foundations, exploring diversity.


তথ্যপঞ্জীঃ

● 'Who will Pay the Price' by Biplab Sarkar and Soham Bhattacharya. Frontline. The Hindu. October 23, 2020.
    Retrieved at: https://frontline.thehindu.com/cover-story/who-will-pay-the-price/article32759888.ece

● 'The perils of deregulated imperfect agrimarkets' by R. Ramakumar. The Hindu. December 1, 2020.
    Retrieved at: https://frontline.thehindu.com/opinion/lead/the-perils-of-deregulated-imperfect-agrimarkets/article33216046

● "Changing Trajectories of Agricultural Growth in West Bengal" by Vikas Rawal and Madhura Swaminathan, Economic and Political Weekly. Vol. 33, Issue No. 40, 03 Oct, 1998.
    https://www.epw.in/journal/1998/40/special-articles/changing-traievtories-agricultural-growth-west-bengal-1950-1996

● "Agrarian Relations in Contemporary West Bengal and Tasks for the Left", by Surjya Knata Mishra and Vikas Rawal in V. K. Ramachandran and Madhura Swaminathan (eds.), Agrarian Studies: Essays on Agrarian Relations in Less-Developed Countries, Tulika and Zed Books. 2002.

● "Economic Growth and Rural Crisis in India: Imagining Cooperatives as a Viable Solution" by Bhowmik Mr, Thakurata S G, Biswas D. Agrarian South: Journal of Political Economy. 2020;9(2):228-254. doi:10.1177/2277976020935408
    Retrieved at: https://journals. sagepub.com/doi/abs/10.1177/2277976020935408