আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

সবুজ দ্বীপে বাণিজ্যিক হানা


ভারত সরকার সম্প্রতি একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আগ্রহ পত্র আহ্বান করেছে। সরকারি কাজের ব্যাপারে ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে এটাই প্রাথমিক কাজ। এমনটা তো হামেশাই ঘটে। সরকারের যে বিভাগ বা সংস্থা কাজ করাতে চাইছে তাদের তরফ থেকে খবরের কাগজ বা ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এটাই প্রচলিত রীতি।

নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই যে কোনো বিষয় নজরে আসে। সেইরকমই একটি ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য উৎসাহী নির্মাতাদের কাছ থেকে আগ্রহ পত্র আহ্বান করা হয়েছে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনের তরফে আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ডস্ ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (এএনআইআইডিকো) দায়িত্ব প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন। কাজেই আগ্রহ পত্র এএনআইআইডিকো-র আহ্বান করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। সরকারের 'থিঙ্ক ট্যাঙ্ক' বলে অধুনা প্রচারিত নীতি আয়োগ এই আগ্রহ পত্র সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। নীতি আয়োগের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে, গত ৫ই জুলাই, ২০২১ ছিল আগ্রহ পত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। আর আগ্রহীদের কাছ থেকে দরপত্র নিয়ে সামগ্রিক বিচার বিবেচনার পর যথাযথ নির্মাতা অর্থাৎ ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া ২৮শে আগস্ট, ২০২১-এর মধ্যে সম্পন্ন করা হবে বলে বিজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান 'প্ল্যানিং কমিশন'কে তুলে দিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে 'নীতি আয়োগ' নামের যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি বয়ানে তা নাকি সরকারের 'থিঙ্ক ট্যাঙ্ক'। পূর্বতন প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে বর্তমান সংস্থার কাজকর্মে কোনো মিল নেই। সরকারকে উন্নয়ন সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার বদলে সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আসা নির্দেশকে কাগজে-কলমে নিয়মানুগ করে দিতেই যেন নীতি আয়োগকে নিয়োজিত করা হয়েছে। সেই অবস্থান থেকেই হয়তো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের প্রাথমিক কাজ নীতি আয়োগ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করেছে।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত লং আইল্যান্ড, অভেস আইল্যান্ড, স্মিথ আইল্যান্ড ও শহীদ দ্বীপ-এ চারটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোথাও ৪২.২০ হেক্টর জমির উপর ২২০টি কামরা (লং আইল্যান্ড), কোথাও ২.৭৫ হেক্টর জমিতে ৫০টি কামরা (অভেস আইল্যান্ড), অন্য কোথাও ২৫ হেক্টর জমিতে ৭০টি কামরা (স্মিথ আইল্যান্ড) আবার শহীদ দ্বীপে ৯.৭০ হেক্টর জমিতে ১২০ কামরার সৈকতাবাস নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কামরা দ্বি-শয্যা বিশিষ্ট। পর্যটন মন্ত্রকের বিধিমালা মেনে প্রতিটি সৈকতাবাসে পাঁচতারা বিলাসব্যাসনের বন্দোবস্ত থাকবে। ডিজেল জেনারেটর, সোলার পাওয়ার, ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট, রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্ল্যান্ট ইত্যাদি প্রতিটি সৈকতাবাসে সংস্থাপন করতে হবে।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে প্রস্তাবিত সৈকতাবাসগুলি নির্মিত হবে। পিপিপি মডেলে নির্মিত প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বেসরকারি বিনিয়োগকারীর কার্যকাল। অর্থাৎ কত বছরের জন্য বিনিয়োগকারী নিজের পুঁজি ও নকশায় নির্মিত প্রকল্পের পরিচালনা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করবেন। পরিভাষায় যাকে বলা হয় লাইসেন্সের মেয়াদ। এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে পিপিপি মডেলে নির্মিত বা নির্মীয়মান পরিকাঠামো প্রকল্পের লাইসেন্সের সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩০ বছর। একমাত্র ব্যতিক্রম - দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এখানে লাইসেন্সের মেয়াদ ৩০ + ৩০ বছর। অর্থাৎ প্রথম দফার ৩০ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক-মুহূর্তে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করার আগে বর্তমান লাইসেন্সধারীর কাছে সবার আগে প্রস্তাব দিতে হবে। বর্তমান লাইসেন্সধারী রাজি হলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা যাবে না এবং পরের ৩০ বছরের জন্য তাকেই দায়-দায়িত্ব সামলাতে হবে। অন্যথায় নতুন লাইসেন্সধারীর সন্ধান করতে হবে। এবং সে ক্ষেত্রেও লাইসেন্সের মেয়াদ ৩০ বছর।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলি লাইসেন্সের মেয়াদের বিষয়েও ব্যতিক্রমী। চারটির মধ্যে দুটিতে লাইসেন্সের মেয়াদ ৭৫ বছর। বাকি দুটির জন্য ৫০ বছর। বাদবাকি শর্ত একই রকম। এএনআইআইডিকো কোস্টাল রেগুলেশন জোন বা সিআরজেড সংক্রান্ত নীতিগত অনুমোদন আদায় করে দেবে। পরিবেশ সংক্রান্ত অনুমতি সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করবে এএনআইআইডিকো। জমি ব্যবহারের চরিত্র পরিবর্তনের আইনি প্রক্রিয়াও এএনআইআইডিকো সামলাবে। সর্বোপরি প্রস্তাবিত সৈকতাবাসগুলিতে সুরা আমদানি ও মজুদ করার অনুমোদন এএনআইআইডিকো করিয়ে নেবে।

এত বড়ো একটা প্রকল্প। এর প্রভাব সুদূর বিস্তারী। অথচ সংসদে বা সংবাদমাধ্যমে কিংবা কোনো জন পরিসরে এই বিষয়ে কোনও আলোচনা নেই। আগ্রাসী ঔদ্ধত্যের দাপটে এবং সংসদে সংখ্যাধিক্যের কারণে সমস্ত রকমের বিধি বহির্ভূত অনুমোদন আদায় করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্র সৈকতে নির্মিত পাঁচতারা সৈকতাবাসে অফুরান প্রমোদ-বিলাস বিক্রি করে ভালোই বাণিজ্য হবে। তবুও চূড়ান্ত বিচারে প্রশ্ন থেকে যায়।

২০০৪-এর সুনামির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল কোস্টাল রেগুলেশন জোন বা সিআরজেড আইন। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত যেখানেই সমুদ্র সৈকতে ইস্পাত-সিমেন্টের সংমিশ্রণে বিভিন্ন ধরনের ভারী পরিকাঠামো নির্মিত হয়েছিল সেখানেই সুনামির আঘাত ছিল ভয়ঙ্কর। সুনামির প্রথম ঝটকায় হারিয়ে যায় দেশের দক্ষিণতম স্থলভূমি কাছাল আইল্যান্ড। এই দ্বীপের দক্ষিণতম প্রান্ত যা 'ইন্দিরা পয়েন্ট' নামে পরিচিত ছিল তা আর নেই। নৌ-বাহিনীর বিশাল পরিকাঠামো সহ সমগ্র কাছাল দ্বীপ ভারত মহাসাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে ভারতের ভৌগোলিক আয়তন হ্রাস পায়। একইরকম ভাবে দেখা গিয়েছিল যেখানে যেখানে সমুদ্র সৈকতের উপর পাকা পরিকাঠামো ছিল সুনামির দাপট তুলনামূলক ভাবে সেখানেই অনেক বেশি। যে সব দ্বীপে স্থানীয় জনজাতির মানুষের বসবাস সেইসব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দীর্ঘ মত বিনিময়ের পর প্রণীত হয় কোস্টাল রেগুলেশন জোন বা সিআরজেড আইনের প্রাথমিক খসড়া। সেই খসড়া নিয়ে সংসদে দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে দেশে প্রথম অনুমোদিত হয় কোস্টাল রেগুলেশন জোন বা সিআরজেড আইন। এই আইন অনুযায়ী ভরা কোটালের সময় সমুদ্রের জোয়ারের জল সৈকতের যত পর্যন্ত এলাকা প্লাবিত করে তার ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনো নির্মাণ নিষিদ্ধ। আবার সমুদ্রের মধ্যেও ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সিআরজেড আইন মেনে চলতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রকের এই আইন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ২০১৮ থেকে সংশোধন করে অনেক বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয়। নীতি নির্ধারকদের বোধ হয় খেয়াল ছিল না বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে চলেছে। ফলে আগামী দিনে ভরা কোটালের সময় সমুদ্রের জোয়ারের জল সৈকতের আরও অনেক বেশি এলাকা প্লাবিত করতে পারে। অর্থাৎ যখন দরকার ছিল সিআরজেড আইনকে আরও শক্তপোক্ত করা ঠিক তখনই আইনের ধারায় অনেক ছাড় দেওয়া হয়। হয়তো সংশোধিত সিআরজেড আইনের ভিত্তিতেই প্রস্তাবিত পাঁচতারা সৈকতাবাসের প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে।

আগ্রহ পত্রে উল্লেখ করা হয়নি কত বৃক্ষের বিনিময়ে অর্জিত হবে সৈকতাবাসের জন্য এত বিস্তৃত জমি? বলা হয়নি এর ফলে স্থানীয় জনজাতির মানুষ যারা সারা বিশ্বে 'বিলুপ্তপ্রায় জনগোষ্ঠী' বলে পরিচিত তাদের জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় কী প্রভাব পড়বে? পয়সা খরচ করে উল্লাস কিনতে আসা পর্যটকদের উন্মাদনায় স্থানীয় পশুপাখির স্বাভাবিক বিচরণ বিঘ্নিত হবে। ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের উপর দারুণ প্রভাব পড়বে। সবমিলিয়ে হারিয়ে যাবে সবুজ দ্বীপের শান্ত পরিবেশ।

পরিবেশবিদরা নীরব। পরিবেশ রক্ষার দাবিতে যাঁরা সতত মুখর তাঁদের কণ্ঠেও কোনো প্রতিবাদী শব্দ উচ্চারিত হয়নি। রাজনীতির আঙিনায় যাঁদের নিত্য বিচরণ তাঁরাও কেমন যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। সর্বোপরি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত সংবাদমাধ্যম তাঁদের কাছেও প্রকৃতির ওপর এই আক্রমণ একেবারেই গুরুত্বহীন।

শেষ পর্যন্ত বোধ হয় সত্যি হতে চলেছে সেই বিখ্যাত উক্তি - অন্ধদের শহরে আয়নার বিক্রি বেশি।