আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

কিউবার সংকট


ছোট্ট একটি দেশ কিউবা, ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু তার অনুরণন রয়েছে গোটা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের মনে। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে কিউবা সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা করে চলেছে। শত প্রলোভন, আক্রমণ, হিংসার শিকার হয়েও মাথা নত করেনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে। এই প্রতিস্পর্ধার মাশুল কিউবার জনগণ গুনছে বিগত ৬০ বছর ধরে। মানবতা বিরোধী মার্কিন প্রশাসন কিউবার উপরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই অবরোধের নীতির ফলে কিউবায় কোনো দেশ খাদ্য বা অর্থ পাঠালে বা অন্য কোনো সাহায্য পাঠালে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়বে। কিন্তু ছোট্ট কিউবার পক্ষে সম্ভব নয়, পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ তেল, বিভিন্ন রকমের ওষুধ বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করার। কিন্তু মার্কিন অবরোধের ফলে এই পণ্যগুলি কিউবায় দুর্লভ। তবু, সমাজতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থেকে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে এহেন ভয়াবহ অবরোধের মধ্যে দাঁড়িয়েও কিউবা বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, বিভিন্ন দেশে তাদের চিকিৎসকরা পৌঁছিয়ে গিয়েছে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে, আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামে আলোকবর্তিকার কাজ করেছে কিউবা, স্বাধীন বিদেশনীতির বার্তাবাহী নির্জোট আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় কিউবা, সংগ্রামী মানুষের স্বপ্ন কিউবা।

কিন্তু কোভিড সংকটের ফলে কিউবার অর্থব্যবস্থায় ব্যাপক ধাক্কা লেগেছে। একদিকে, পর্যটন শিল্প বিপর্যস্ত, কারণ কোভিডের ফলে পর্যটকদের সংখ্যায় ভাটা পড়েছে। পর্যটন শিল্প কিউবার মতন ছোট দেশের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটনের মাধ্যমে দুর্লভ বিদেশী মুদ্রা কিউবায় প্রবেশ করে। আবার পর্যটন শিল্পে নিযুক্ত থাকে বহু মানুষ। কিন্তু কোভিডের ফলে এই শিল্প মৃতপ্রায়। অতএব, বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, বিদেশী মুদ্রার আমদানীতেও লেগেছে ভাটার টান। তদুপরি, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে কিউবায় এই পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগানের সংকট। খাওয়ার দোকানে লম্বা লাইন, খাদ্যের তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ অপ্রতুল, তেল অপ্রতুল, এমনকি কোভিড ভ্যাক্সিন দেওয়ার সিরিঞ্জও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। এহেন পরিস্থিতিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে কোনো দেশ কিউবার পাশে দাঁড়াতে পারছে না। কিউবার সরকার এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের দেশের মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছে।

তবু, মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। বিগত বহু দশকের মধ্যে সর্ববৃহৎ সরকার বিরোধী সমাবেশ ঘটেছে কিউবায়। বহু সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমেছেন সরকারের বিরোধিতা করতে। এহেন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন হানাদার এবং তাদের পোষ্য মিডিয়ার চোখ শিকারের নেশায় চকচক করছে। তারা বলছেন কিউবায় পরিবর্তন আসন্ন। কিউবার সরকারকে গদিচ্যুত করার সময় এসে গিয়েছে।

কিন্তু যারা কিউবায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন, তারা কী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট স্বৈরাচারী সরকারের জমানায় ফিরতে চান? মনে হয় না। তাদের নিজেদের দেশের সরকারের প্রতি কিছু দাবিদাওয়া আছে মানেই তারা কিউবার সমাজতন্ত্রের পতন চান এমন ধরে নেওয়ার কারণ নেই। অন্যদিকে, কিউবার রাষ্ট্রপতি বলেছেন যে মার্কিন ষড়যন্ত্রকারীরা এহেন প্রতিবাদী সমাবেশে মদত দিচ্ছে। তিনি কিউবার সমস্ত সমাজতান্ত্রিক মানুষকে রাস্তায় নেমে বিপ্লবের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে হাজারো মানুষ ফিদেলের নামে স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমেছেন। কিউবার সমাজতন্ত্রের পতনের স্বপ্ন যারা দেখছেন তারা বোধহয় আপাতত দিবাস্বপ্ন দেখছেন।

তবে, এই কথা ঠিক যে কিউবার অর্থব্যবস্থায় সমস্যা রয়েছে। সেই সমস্যা আপাতত কোভিডের অভিঘাতে বেড়েছে ঠিকই, তবে সমস্যার সূত্রপাত নিশ্চিতভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের নীতি। ১৯৬০ সালে কিউবার উপর এই অমানবিক নিষেধাজ্ঞা চালু করার সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিকারিকরা কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন যে, কিউবার অধিকাংশ মানুষ ফিদেল কাস্ত্রোকে সমর্থন করেন, এবং বলার মতন কোনো বিরোধী পক্ষ কিউবায় নেই। অতএব, একমাত্র উপায় যা কিউবাকে কমিউনিস্টদের থেকে মুক্তি দিতে পারে তা হল যদি কিউবার মানুষ সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। কিন্তু কীভাবে তা হবে? কিউবার অর্থনীতিকে দুর্বল করার সমস্তরকম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কিউবাকে অর্থ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে, সেখানকার প্রকৃত মজুরি কমিয়ে রাখতে হবে। এই সমস্ত নীতি গ্রহণ করা হলে কিউবায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে, মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়বে এবং ফিদেলের কমিউনিস্ট শাসনের সমাপ্তি ঘটাবে। এই কথাগুলি কারো কল্পনা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী দলিলেই লিপিবদ্ধ। কিন্তু মার্কিনদের এই দিবাস্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। তার কারণ একদিকে কিউবার মানুষ তথা কমিউনিস্ট পার্টির দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দরাজ সাহায্য।

কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের পর থেকে কিউবার সংকট আবার বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কিউবা তৃতীয় বিশ্বের দেশের সাহায্য নেয়। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকায়, বিশেষ করে ব্রাজিল এবং ভেনেজুয়েলায় বাম সরকার গঠন হওয়ার পরে কিউবাকে একঘরে করে রাখার নীতি ধাক্কা খায়। ভেনেজুয়েলা সরকার কিউবাকে তেলের জোগান দেয়, বিনিময়ে কিউবার ডাক্তাররা ভেনেজুয়েলায় চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত করতে ব্রতী হয়। কিন্তু সাভেজের মৃত্যু, ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকট, কমতে থাকা তেলের দাম, ব্রাজিলে লুলার পতন, এবং সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের জয়, আবারো কিউবাকে কোণঠাসা করে দেয়। ট্রাম্প কিউবার উপর আরো বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে কিউবার সংকট বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে কিউবার অর্থব্যবস্থায় কিছু সংস্কার করা হলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে তার দশা ভঙ্গুরই ছিল। ডেমোক্রাট রাষ্ট্রপতি বিডেন কিউবার প্রশ্নে ট্রাম্পের থেকে ভিন্ন কোনো নীতি গ্রহণ করার কথা বলেননি। বরং তিনিও প্রচ্ছন্নভাবে কিউবার সরকারকে হুমকি দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে এসে গেল কোভিডের অভিঘাত। যার ফলে বিপর্যস্ত অর্থব্যবস্থা, বিপর্যস্ত কিউবা। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রসারের ফলে কিউবাতেও কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। কিন্তু মার্কিন দক্ষিণপন্থীরা এই অজুহাতে কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থা তথা সরকারের বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করছে, তার কোনো যুক্তি নেই। কিউবায় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে মোট কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ২,৪০,০০০-এর কাছাকাছি, মৃত হয়েছেন মোট ১,৫৩৭ জন মানুষ। মার্কিন দেশের ওহাইও রাজ্যের মতই কিউবার জনসংখ্যা। কিন্তু ওহাইওতে মোট কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লক্ষ এবং মৃত ২০ হাজারের বেশি। কাজেই যেই দেশে সর্বাধিক বেশি মানুষ মৃত হয়েছেন কোভিডে, সেই দেশের সরকার বা বুদ্ধিজীবিদের কিউবার কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে জ্ঞান না দেওয়াই ভালো।

গোটা পৃথিবীতে কোভিডের ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বহু মানুষ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’-এর মতন আন্দোলন সেই দেশের বর্ণবিদ্বেষের কলঙ্কময় চরিত্রকে উন্মোচিত করেছে। কিন্তু তাই বলে কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর বাইরের কোনো দেশের খবরদারি করার দাবি জানায়নি। তাই কিউবায় যদি মানুষের কোনো দাবিদাওয়া থাকে, তা নিয়ে যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন হয়, তবে সেই দাবিদাওয়াকে মান্যতা দেওয়া সেই দেশের সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে খবরদারি করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী এবং তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী মতকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কিউবার সরকারকে উৎখাত করবে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

মনে রাখতে হবে যে জুন মাসের ২৩ তারিখে রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় কিউবার উপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, এই নিয়ে টানা ২৯ বছর। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেয় ভারত-সহ ১৮৪টি দেশ, বিপক্ষে দুটি দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল), এবং ভোট দানে বিরত থাকে তিনটি দেশ। এই বিপুল সংখ্যক দেশের রায় জানার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হেলদোল নেই। তাদের মুখপত্র রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় বলেন যে, এই নিষেধাজ্ঞা নাকি কিউবায় গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রয়াস। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি গোটা দেশের জনগণকে গণহত্যার সম্মুখীন করে তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এই পৃথিবীর বাকি সব দেশের মতই কিউবার অধিকার আছে নিজের প্রয়োজনমত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাস্তানির ফলে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা না তোলা হলে কিউবার মানুষের সর্বনাশ হবে। আর সেই সর্বনাশের উপর শকুনের মতন উড়ে এসে মৃত গণতন্ত্রের মহড়া দিতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেমন তারা করেছে ইরাকে, লেবাননে, আফগানিস্তানে। এই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় এখন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা থেকে দূর হটো - এই স্লোগান তোলার সময় এখন।