আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

স্ট্যান স্বামী এক বিপজ্জনক প্রতিবাদীর নাম


যে কথাটা শুরুতেই স্বীকার করে নিতে হবে, ফাদার স্ট্যান স্বামী নির্দোষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন গুরুতর এক অপরাধী। কী সেই অপরাধ? না, স্ট্যান স্বামী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। রাষ্ট্র যতই বলুক না কেন, স্ট্যান স্বামী সরকারকে উৎখাত করবার আন্দোলনে নিজেকে সঁপে দেননি। স্ট্যান স্বামী এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলেরও নেতা ছিলেন না। সশস্ত্র বিপ্লব অথবা সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্র নামক কোনো কিছুর সঙ্গেই চুরাশি বছরের বৃদ্ধের কোনো যোগসূত্র প্রমাণ করা যায়নি। তাহলে স্ট্যান স্বামী কে ছিলেন?

তিনি ছিলেন নিখাদ মানবতাবাদী, এবং বামদিক ঘেঁষা এক তাত্ত্বিক, যিনি ভারতে লিবারেশন থিওলজি ভাবনাটির অন্যতম উদ্গাতা ছিলেন। ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউটে কমিউনিটি ডেভলপমেন্টের ওপর যে কোর্স হত, তাতে ফাদার স্ট্যান স্বামী পড়াতেন মার্কসের ক্যাপিটাল। জেশুইট পাদ্রী হলেও তিনি ক্রিশ্চান চার্চের সেই শাখাটির অনুসারী, যাঁরা বরাবর জিশুকে একজন প্রথম সাম্যবাদী মানুষ হিসেবে দেখে এসেছে এবং তাঁর প্রেরণায় নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্যে আন্দোলনে নেমেছে। লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম এই আন্দোলন শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে ভিন্নভিন্ন রূপে বিকশিত হয় প্যালেস্টাইন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের দলিত লিবারেশন থিওলজিতে। ঠিক তেমনভাবেই নিকারাগুয়াতে সান্দিনিস্তা অথবা পেরুর পাদ্রী গুস্তাভো গুতিয়েরেজকে অনুসরণ করেই স্ট্যান স্বামীও দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে জনজাতি আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন। এবং এ ব্যতিরেকে তাঁর কাজ ছিল অনেকটাই তাত্ত্বিকও বটে। এবং এই প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ যেটা বলার, স্ট্যান স্বামীর কর্মকাণ্ডের তাত্ত্বিক ভিতটির অন্যতম ছিল অহিংসা। এবং তার পরেও, অহিংস এক সন্ন্যাসীকেও বিজেপি সরকার ভয় পেল, এবং পরিকল্পিত হত্যা করল কারাগারের মধ্যে।

কিন্তু তাই বলে এটা ভুললে চলবে না যে স্ট্যান স্বামী আসলে একজন বিপ্লবীই ছিলেন। তাঁর বিপ্লব সশস্ত্র ছিল না, সন্ত্রাসের ধারকাছ দিয়েও যায়নি, কিন্তু সেই নিরুচ্চার মানবতাবাদের শক্তি এমনই যে বিজেপি ভয় পায়, বাধ্য হয় ভুয়ো অভিযোগে তাঁকে জেলে পুরতে। তার কারণ বহুবার ভিন্ন প্রসঙ্গে ফাদার স্ট্যান বলেছিলেন যে বড় পুঁজি ও মুনাফালোভীরা পুঁজির স্বার্থেই আদিবাসী, দলিত ও মহিলাদের সমানাধিকার চায় না। শুধু বলেননি, চল্লিশ বছর ধরে লড়াই করে এসেছেন সেই অধিকারের দাবিতে। স্বাধীন ভারতবর্ষে ষাট-সত্তরের দশক থেকে প্রান্তিক মানুষের আত্মসম্মান অধিকারের লড়াইয়ে যে মাইলফলকগুলি আছে, যেগুলো কমিউনিস্টদের পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রেণির আন্দোলনের থেকে কিছুটা ভিন্নবর্গে দাঁড়িয়েও স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, যেমন ষাট-সত্তর দশকের অ্যাকশন গ্রুপের আন্দোলন, জয়প্রকাশ নারায়ণের কৃষক আন্দোলন, সুন্দরলাল বহুগুণার চিপকো আন্দোলন, শঙ্কর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে লোহাখনি শ্রমিক, নদী-বাঁধ বিরোধী ও জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আন্দোলন, ফাদার স্ট্যানের ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের অধিকার-সংক্রান্ত কাজকেও সেই সব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেখতে হবে। সেই কারণেই, তাঁকে নির্দোষ পাদ্রী, সাতেপাঁচে না থাকা কোনো ঝামেলাতে না জড়ানো সন্ন্যাসী হিসেবে দেখা উচিত নয়।

তবে ঝাড়খণ্ডেরও আগে ফাদার স্ট্যান সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কৃষিক্ষেত্রের বেগার মজদুরদের স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য লড়েছেন বেঙ্গালুরুতে। ১৯৭৮ সাল থেকে লড়েছেন ভিল্লুপুরম এবং তাঞ্জোরের দলিতদের জন্য। খ্রিস্টান চার্চও সব সময় তাঁর এই জড়িয়ে পড়াকে ভাল চোখে দেখেনি। তাই তাঁকে অনেক সময় চার্চের ভিতরেও লড়তে হয়েছে বিরোধী শিবিরের সঙ্গে। এই বিরোধ চরমে ওঠে তাঁর ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী আন্দোলনের জড়িয়ে পড়ার সময়ে। আদিবাসীরা যে জঙ্গল-টিলায় বাস করে, তার বড় অংশ হল কয়লা, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তাই এই অঞ্চলে কয়লা মাফিয়া থেকে শুরু করে কর্পোরেট বাণিজ্যের নজর। তারা জঙ্গল সাফ করে ডিনামাইট দিয়ে টিলার পাথর উড়িয়ে জমির দখল চেয়েছে। এবং আদিবাসীদের ব্যবহার করতে চেয়েছে সস্তার শ্রমিক হিসেবে। আদিবাসীরা স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদ করেছে। জল-জঙ্গল-জমির অধিকার ছেড়ে নিজভূমে পরবাসী হতে চায়নি। ফাদার স্ট্যান হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ‘প্রিভেনশন অব ট্রাইবাল ল্যান্ড এলিয়েনেশন’ প্রয়োগ করার দাবিতে ও পঞ্চায়েতের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে। স্থানীয় চার্চ থেকে তখন দাবি করা হয়েছিল যে ফাদার স্ট্যানের এই কাজকর্মের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু তাতে পিছু হটেননি, বরং তিন হাজার আদিবাসী যুবার জেল থেকে মুক্তির দাবিতেও তিনি আদালতে যান। সেই মামলার শুনানির কয়েক দিন আগেই তাঁকে জামিন-অযোগ্য ইউএপিএ-র আওতায় গ্রেফতার করা হয়। কাজেই, স্ট্যান স্বামী কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সশস্ত্র বিপ্লবী না হয়েও নিজের মত করে এক অনন্য বিপ্লবীই ছিলেন, যাকে বড় পুঁজির পা চাটা নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহদের সরকার ভয় পেয়েছে। এমনকি ভয় পেয়েছে তাঁর স্ট্র ব্যবহারের অধিকারকেও। তিনি স্ট্র ছাড়া খেতে পারতেন না, সেটুকুও ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। স্বাধীন ভারতে একজন বৃদ্ধ পার্কিনসন্স রোগী জল পান করার জন্য স্ট্র চেয়েও পাননি, এই গ্লানির ভার ভারতের সুপ্রিম কোর্টকেও বহন করতে হবে। বারবার আদালত জামিন দিতে অস্বীকার করেছে। কেন? আদালতও কী তাহলে মোদী সরকারের তৈরি করে দেওয়া ‘আর্বান নক্সাল’ জাতীয় তক্‌মাগুলিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে?

কাজেই, ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় স্ট্যান স্বামী নির্দোষ হলেও যে অপরাধ তিনি করেছেন, তার জন্য বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষে দণ্ড তাঁর জন্য অবধারিতই ছিল। বস্তুত ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় যে ১৬ জন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং সমাজ আন্দোলনের অংশীদারকে গ্রেফতার করে মামলায় জড়ানো হয়েছে, তাঁরা অনেকেই পরস্পরকে চেনেন না, কেউ কোনো দিন ওই জায়গায় যাননি। তাই এক সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা নয়— অভিযুক্তদের মধ্যে আসলে মিল অন্য জায়গায়। তাঁরা যে যাঁর মতো করে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন ও বৃহত্তর সমাজে প্রান্তিক মানুষের অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করছিলেন। তার থেকে বড় অপরাধ বিজেপির চোখে আর কিছুই নয়।

আর এটা ভুললেও চলবে না, স্ট্যান স্বামীকে যেদিন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেদিন থেকেই তাঁর মৃত্যুর ব্লু-প্রিন্টও ছকে ফেলা হয়েছিল। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও চার্জ না এনেও, এবং কোনোরকম বিচার না করেও, শুধুমাত্র দিনের পর দিন শুনানির দিন পিছিয়ে আর জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে, এবং একইসঙ্গে চিকিৎসার ন্যূনতম সুবিধেটুকুও শুরুতে না দিয়ে যেটা করা হল, তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত করা। স্ট্যান স্বামীও নমনীয়ভাবে বলে গিয়েছেন, তিনি হাসপাতালে যাবেন না। হয় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক, অথবা তিনি কারাগারেই মৃত্যুবরণ করবেন। সেই, বিপ্লবীর অদম্য জেদ, নিজের মৃত্যুকে রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা, বিজেপির চোখে এগুলোই ক্ষমাহীন অপরাধ।

এগুলো বলার অর্থ এটাই যে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমরা যেন ফাদার স্ট্যানকে অসম্মান না করি। যেন না বলি, তিনি নির্দোষ ছিলেন। তিনি অবশ্যই অপরাধী ছিলেন, বিজেপির চোখে, রাষ্ট্রের চোখে। আর এই ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদী বিজেপির চোখে যে অপরাধী, নির্বিষ নির্দোষের তুলনায় সে যে মহত্তর, ফাদার স্ট্যান সে কথা জানতেন। ফাদার স্ট্যানের আন্দোলন ও মানবপ্রেম রাষ্ট্রের চোখে ক্ষমার অযোগ্য। তাই তাঁর দণ্ড যেমন অনিবার্য ছিল, তাঁর রক্তের দায় সাউথ ব্লককে আগামী বহুদিন চোকাতে হবে, সেটাও অনিবার্য। ফাদার স্ট্যান ভারতের প্রতিবাদীদের হৃদয়ে হার-না-মানা জেদ ও তেজের মাইলফলক হিসেবে সদা ভাস্বর থাকবেন।