আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড


রাজ্য সরকারের তৃতীয় সংস্করণের দ্বিতীয় মাসে চালু হল একটি নতুন প্রকল্প। 'স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’।

এবার আর দান খয়রাতি নয়। শিক্ষার জন্য ঋণ। স্বল্প সুদে শিক্ষার্থীদের ঋণ দেওয়ার প্রকল্প। এই প্রকল্পে শিক্ষার্থীরা ৮ বছরে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। দেশের এবং বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই ঋণের সাহায্যে পড়াশোনা এবং গবেষণা করা যাবে। কেনা যাবে শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও। দশম শ্রেণি থেকে শুরু করে স্নাতক এমনকি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থীরা ঋণ পাবেন। গ্যারান্টার, রাজ্য সরকার। ঋণের টাকায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পেশাভিত্তিক পাঠ্যক্রম, ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রম, ডক্টরাল এবং পোস্ট ডক্টরাল স্তরে গবেষণার খরচ চালানো যাবে। ঋণের আবেদন করার বয়সসীমা ৪০ বছর রাখা হয়েছে। কোর্স ফি, টিউশন ফি, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের জন্যও ঋণ দেওয়া হবে এই কর্মসূচিতে। লেখাপড়া সমাপ্ত হওয়ার পর এক বছর সময় পাওয়া যাবে ঋণশোধের পর্ব শুরু করার জন্য। পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে ঋণ।

আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় প্রকল্প। সত্যিই তো অর্থাভাবে বহু ছাত্রছাত্রী ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেন না। শিক্ষান্তে মাত্র ৪ শতাংশ হারে সরল সুদের হিসেবে ঋণ পরিশোধ করলেই চলবে। তা-ও আবার শেষ পরীক্ষা দেওয়ার এক বছর পর থেকে ঋণ পরিশোধের পনেরো বছরের সময়সীমা শুরু হবে। অর্থাৎ ১৫x১২=১৮০ মাসে সুদ সহ মূল ঋণ পরিশোধ করা যাবে। অভাবের সংসারে লেখাপড়ার এমন সুযোগ পাওয়ায় বহু ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকরা নিশ্চয়ই খুশি।

এমন আনন্দঘন মুহূর্তে প্রশ্ন ওঠে, যে রাজ্যে ১৯৮০-র দশক থেকেই সরকারি ও সরকার পোষিত ইশকুলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে সেখানে হঠাৎ করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ঋণের আওতায় কেন আনা হয়েছে। তাহলে কি সরকার শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত আইনকে উপেক্ষা করে শিক্ষা ক্ষেত্রের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার পথে চলা শুরু করতে চলেছে? উত্তরে না বলার সঙ্গে সঙ্গে বলতে হবে নিজের জনদরদী ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে এহেন পদক্ষেপ।

আজকাল অধিকাংশ মা-বাবাই উচ্চশিক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশিক্ষণের জন্য ছেলেমেয়েদের খ্যাতনামা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিতে অভ্যস্ত। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক পরীক্ষার প্রবেশিকা পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এইসব কোচিং সেন্টারগুলিতে ভর্তি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রচুর অর্থ জমা দিতে হয়। সাধারণত দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের দিয়েই শুরু হয় এই ধরনের প্রশিক্ষণ। কোনো কোনো কোচিং সেন্টার আবার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলে খবরের কাগজে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। নিদেনপক্ষে দশম শ্রেণি থেকে শুরু করলেও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ চলে। কোচিং সেন্টারের তিন বছরের ফী জমা করতে অনেক অভিভাবকের কালঘাম ছুটে যায়। নিঃসন্দেহে তাঁরা এই প্রকল্প চালু হওয়ায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন।

এই কোচিং সেন্টারগুলি এমন একটা সামাজিক প্রভাব বিস্তার করেছে যেন এখানে প্রশিক্ষণ না নিলে ডাক্তারি অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না। অথবা এই কোচিং সেন্টারগুলি জন্ম নেওয়ার আগে দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক তৈরি হয়নি। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এদের শাখাপ্রশাখা। হাতের কাছে উজ্জ্বল উদাহরণ, বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য অসংখ্য কোচিং সেন্টার চালু হওয়ার ফলে রাজস্থানের কোটা শহরের এত রমরমা। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে বাড়ির পয়সায় প্রতি বছর কোটা-র পথে রওনা দিয়ে চলেছে। সেখানে আবার মূলত প্রশাসনিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অর্থাৎ স্নাতক হওয়ার পর থেকেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্রছাত্রী কোটা-র উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাহলে দাঁড়ালো দশম থেকে দ্বাদশ তিন বছর এবং স্নাতক হওয়ার জন্য তিন বছর। মোট ছয় বছর। এরপরও স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা পাওয়ার জন্য হাতে থাকে আরও দু' বছর। সেই সময়টা না হয় প্রশাসনিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যাবে। মা-বাবার ওপর চাপ নেই। সরকার ঋণের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। আর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া গেলে দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তিন বছর ছাড়াও পরের পাঁচ বছর যোগ করে মোট আট বছরের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে এক বছর সময় কম লাগে বলে সাত বছর ঋণ নিলেই চলবে।

অর্থাৎ কর্মজীবনের প্রায় প্রান্তসীমায় পৌঁছে তিনি লেখাপড়ার খরচ থেকে ঋণমুক্ত হতে পারবেন।

এবার একটু অঙ্ক কষা যাক। ধরে নেওয়া যাক কোনো শিক্ষার্থী আট বছর ধরে নিয়মিত ঋণ নিলেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। আট বছরের পরের বছরই ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করার হিসেব কষার সময় কিন্তু ৯ বছরের সুদ যুক্ত হয়ে যাবে। সেই হিসেবে ৯ বছর পর মূল ঋণ (৮ লক্ষ টাকা) এবং ৪% হারে সরল সুদ যুক্ত হয়ে পরিশোধ যোগ্য অর্থের অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ১২ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা। পরের ১৫ বছর প্রতি মাসে ১০ হাজার ৯৩ টাকা পরিশোধ করতে পারলেই ঋণমুক্ত হওয়া যাবে। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক কোনো শিক্ষার্থী ৪০ বছর বয়সে শেষ দফার ঋণ নিয়েছেন। প্রকল্পের বিধি অনুযায়ী তিনি আরও এক বছর পর ঋণ পরিশোধ করা শুরু করতে পারেন। অর্থাৎ ৪১ বছর বয়সে ঋণ পরিশোধ পর্ব শুরুর পর একটানা ১৫ বছর নিয়মিত সুদ এবং মূল পরিশোধ করে চলার পর ৫৬ বছর বয়সে পৌঁছে তিনি ঋণমুক্ত হতে পারেন। অর্থাৎ কর্মজীবনের প্রায় উপান্তে এসে তিনি শিক্ষা ঋণ থেকে মুক্তি পাবেন। পরিশোধ না করতে পারলে কী হবে তা অবিশ্যি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে (ওয়েবসাইটে) বলা নেই। এমনকি ৩০শে জুন ২০২১-এ প্রকাশিত সরকারি গেজেট [No. WB (Part-I/2021/SAR-275)] এই বিষয়ে নীরব।

এ তো গেল অনেক পরের কথা। এবার ফিরে যাওয়া যাক একদম প্রাথমিক প্রশ্নে যা বিজ্ঞাপনের মনভোলানো সুন্দর সুন্দর কথায় হারিয়ে গেছিল। ক্রেডিট কার্ড মানে যা কোনো না কোনো ব্যাঙ্কের সঙ্গে জড়িত। সরকার তো আর সরাসরি ঋণ দেবে না। সরকারের তত্ত্বাবধানে কোনো ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার কথা। যেমন ১৯৯৫-এ পি ভি নরসীমা রাও যখন প্রধানমন্ত্রী তখন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া এদেশে প্রথম চালু করেছিল শিক্ষা ঋণ। ১৯৬৫-তে পৃথিবীর প্রথম শিক্ষা ঋণ প্রকল্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে পদ্ধতিতে চালু হয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া তা অনুকরণ করায় অল্প সময়ের মধ্যেই অনাদায়ী শিক্ষা ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ২০০১-এ প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষা ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। এবার আর শুধু স্টেট ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া নয়, সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কই শিক্ষা ঋণ প্রকল্প চালু করে। এমনকি বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্কও এই প্রকল্প হাতে নেয়। তবে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর সুদের হার যথেষ্ট বেশি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী রাজ্যের সমস্ত সমবায় ব্যাঙ্কগুলি থেকে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের ঋণ পাওয়া যাবে। তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় কেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বপ্নের প্রকল্পের সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সমবায় ব্যাঙ্কগুলি সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা ঋণ দিতে পারে বলেই এমন বন্দোবস্ত। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির শিক্ষা ঋণের কিন্তু সর্বোচ্চ সীমারেখা নেই। যে শিক্ষার্থীর যেমন দরকার সেই পরিমাণ অর্থ ঋণ নেওয়া যায়। অবিশ্যি তাদের সুদের হার আকাশছোঁয়া। হয়তো সেই কারণেই তাদের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ইতিমধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। বলা ভালো এক নয় একাধিক। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে সংসদের দুই কক্ষেই কৃষি আইন, সংশোধিত শ্রম বিধি ইত্যাদির সঙ্গেই সমবায় আইন সংশোধনের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। কৃষি আইন, সংশোধিত শ্রম বিধি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা আন্দোলনের মধ্যে খেয়াল হয়নি যে এই সুযোগে নতুন সমবায় আইন মারফত সংবিধান অনুযায়ী পুরোপুরি রাজ্যের এক্তিয়ারে থাকা সমবায় ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে নেওয়া হয়েছে। সংবিধানের সপ্তম তফসিলে পরিষ্কার বলা আছে সমবায় রাজ্যের বিষয়। সেই নতুন আইন অনুসারে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সমবায় ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনামা জারি করে ২০২১-এর ২৫শে জুন (RBI/2021-22/60DOR.GOV.REC.25/12.10.000/2021-22, June 25, 2021)। এই নির্দেশনামা অনুযায়ী এখন থেকে দেশের সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন থেকে কোনো জনপ্রতিনিধি আর সমবায় ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতিতে থাকতে পারবেন না। এমনকি স্বার্থের সংঘাত (conflict of interest) আছে এমন কোনো ব্যক্তিও পরিচালন সমিতির সদস্য হতে পারবেন না। সবমিলিয়ে নতুন সমবায় আইন যা দেশের সংবিধানকে অস্বীকার করে সংখ্যাধিক্যের আধিপত্যে অনুমোদন পেয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন নির্দেশনামা। বিস্ময়ের বিষয় যে ভাবে রাজ্যের অধিকারগুলিকে সংবিধানকে অস্বীকার করে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে তা নিয়ে রাজ্য সরকার হয় অবহিত নয় অথবা এতে রাজ্য সরকারের আপত্তি নেই। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন নির্দেশ প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে বেরিয়ে এল মন কী বাত। হঠাৎ করে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে মন্ত্রীসভার পুনর্গঠনের সময় তৈরি হল সমবায় মন্ত্রক। দেশের প্রবল প্রতাপশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নতুন সমবায় মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হবে নাই বা কেন? তিনি তো এককালে আহমেদাবাদের একটি সমবায় ব্যাঙ্কের সভাপতি ছিলেন। লোকশ্রুতি নোট বাতিলের মরশুমে এই ব্যাঙ্কটি থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার পুরোনো অর্থাৎ বাতিল নোটের বিনিময়ে নিয়মের বাইরে গিয়ে নতুন নোট দেওয়া হয়েছিল।

এত কিছুর পরেও ৩০শে জুন থেকে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন নীতি মেনে এই প্রকল্প চালু করা হয়েছে এমনটাই আশা করা যায়। অন্যথায় এই জনমোহিনী প্রকল্প সূচনা লগ্নেই হোঁচট খেতে পারে। অথবা হয়ে উঠতে পারে কেন্দ্র রাজ্য দ্বন্দ্বের নতুন উপাদান।