আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পয়ারে সিনেমা লিখতেন বুদ্ধদেব

তিমিরকান্তি ঘোষ


চরাচর থেকে সন্ধ্যার আগে ফিরে যাওয়া পাখিগুলো আমার মাথার উপর বসে পড়ল। টুকরো টুকরো ম্যাগাজিন দিয়ে সাজানো তাদের বাসা। সারারাত পাখিদের কিচির মিচির, ম্যাগাজিনের ঘর-ঘর আওয়াজ। হালকা নীলাভ আলো আর লম্বা ট্রলি চলে গেছে স্বপ্নের ভিতর। ঘুম ভাঙ্গলে শুনলাম 'রোবটের গান'। 'দেখতে পাই প্যান্টের তলা দিয়ে দিয়ে উঁকি মারছে আরও লোহার পা'।

রাজদা। রাজকল্যাণ চেল। ‘কবিতা দশদিনে’ পত্রিকার সম্পাদক। দিয়েছিলেন বইটি । কিশোর বয়সে সবকিছু ভেঙ্গে ফেলার নেশা ছিল। ভাঙ্গনের প্রতি ছিল নিষিদ্ধ আকর্ষণ। 'রোবটের গান' পড়ে মনে হল এই তো পথ। এরপর হেঁটে যাও। তারও আগে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের একটি ছবি দেখছিলাম দূরদর্শনে। 'তাহাদের কথা'। চিনতাম না কমলকুমার মজুমদার। চিনতাম না বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। 'রোবটের গান' জানি। জানতাম 'উঁকি মারে নীল আর্মস্ট্রং'। রাজদার কাছ থেকে নিয়ে পড়া। সন্ধ্যায় বাংলার মোড়ে নিরঞ্জনদার গুমটির সামনে স্বরূপ-আনন্দ-সুদীপ-রাজদা-প্রণবদার সঙ্গে আড্ডা, তর্ক। প্রতিকবিতার সংজ্ঞা নিয়ে। প্রতিকবিতা কেমন? তখন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে 'নিজস্ব ঘুড়ির প্রতি'। প্রণবেন্দু বললেন প্রতিকবিতা কী! আমরা চিনলাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে বাংলার মোড়ে দাঁড়িয়ে। মোড়ের মাঝে একটা ভেঙ্গে পড়া রাজীব গান্ধীর মূর্তি। রাজদা চলে গেলেন সাকিলে। পরেরদিন আবার পড়তে দিলেন 'হিমযুগ' - এর আগের বই 'কফিন কিংবা সুটকেশ ' -
'...তারাভরা ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সমস্ত দিন এভাবেই
ছুটে চলেছে চাঁদের পেছনে ধর্মভ্রষ্ট সেই কুকুর
ও তার মালিক, আমি...'

'দূরত্ব', 'নিমঅণ্ণপূর্ণা', 'গৃহযুদ্ধ' তখনই তো - জন্ম নিচ্ছে পেটের ভেতর। একজন কবির ভেতর -
'...দ্রুত পরে নিলে বুট, হাঁটতে শুরু করলে একাই, কাঁধে
তোমারই সেই পুরোনো ক্যামেরা আর রেড ফিলটার…'

আমার তখন বয়স বেশি নয়। কলেজে ভরতি হয়েছি। মাথার ভেতর লখার পাখিগুলো সারাদিন উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা মেলে। উৎপলদাকে (উৎপল চক্রবর্তী) বললাম একটা চিঠি লিখে দিন। দেখা করতে চাই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে। লিখে দিলেন।

চিঠি হাত থেকে উড়ে গেল ১৯ নং গড়িয়াহাট রোড। আমি আর ঝিলদা এক সপ্তাহ ধরে খুঁজে চলেছি। খুঁজেই চলেছি। খুঁজে পেলাম না বাড়ি। আসলে বাড়ি না ফ্ল্যাট। লেক থানায় দেখালাম ঠিকানা। বললেন, এটা সেলিমপুর। সোজা চলে যাও। গেলাম। ভোরের ট্রেনে গ্রাম থেকে এসেছি। প্লেট দেওয়া প্যান্ট। পায়ে প্লাস্টিকের চপ্পল। চুলে হালকা গ্রামীণ আলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বেল বাজালাম। এক ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। তাঁকে উৎপলদার চিঠি দিলাম। তিনি বললেন বাড়িতে নেই। বোম্বে গেছেন। কিছুদিন পর ফিরবেন। মন খারাপ। কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাওয়ার একটা আনন্দ আছে। ফিরে এলাম বাঁকুড়ায়। অবশেষে ফোন নাম্বার পেয়ে গেছি। ফোন করে আবার এলাম কয়েক মাস পরে। সঙ্গে "রং নাম্বার" পত্রিকার ভাস্করদার চিঠি সংখ্যা। ওঁর চিঠি আছে। এবার তিনি দরজা খুললেন। পত্রিকা দিলাম। সঙ্গে উৎপলদার চিরকুট। বললেন অফিসে এসো বিকেলের দিকে। গোলপার্ক। কাকুলিয়া রোড।

বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা। বন্ধু বিপ্লবের গেস্ট হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেল উঠেছি। সামনে সেলিমপুর। ইচ্ছে হলেই ফোন করে বুদ্ধদার বাড়িতে চলে যাই। ঢাকুরিয়া ব্রিজ পেরোলেই অফিস। ভয়ে ভয়ে অটো থেকে নামলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ডানদিকে একতলা। দরজা খুললেন একজন। বাইরে সোফায় বসে আছি। পেছনে 'চরাচর' ছবির একটা বিরাট পোস্টার। চোখের সামনে, পূর্ণেন্দু পত্রীর করা 'দূরত্ব'-র ক্যালিগ্রাফি। একটু পরেই এলেন।

- তিমির আজ কি বাঁকুড়া থেকে এলে?

আমি- না স্যার। এখন যাদবপুরে থাকছি।

কিছুক্ষণ পরে সোহিনী বলে ডাকতেই একজন এলেন। এবং তাঁকে বললেন, সোহিনী এ হল তিমির। বাঁকুড়ায় বাড়ি। তরুণ কবি। ও আমাদের সঙ্গে কাজ করবে।

মহাশ্বেতা দেবীর তেরোটি গল্প নিয়ে তেরোটি টেলিফিল্ম। ইউনিট রেডি। আমার স্থান হল না ইউনিটে। পুরো ইউনিট চলে গেল পুরুলিয়া। আমি ফিরে গেলাম বাঁকুড়ায়। একটু বিষণ্ণ। বাড়ি ফিরে স্যারকে ফোন করলাম একদিন। বললাম- পুরুলিয়া যাবো শুটিং দেখতে?

- চলে এসো তিমির।

সকালের বাস ধরে পুরুলিয়া। শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারি। জানলা দিয়ে দেখছি পলাশ জ্বলে উঠছে। রঞ্জনদাকে বললাম পুরুলিয়া যাচ্ছি। শেষ বিকেল, গেলাম আকাশ হোটেলে। হোটেলের লবিতে বসে আছে শুটিং ফেরত ক্লান্ত ইউনিট। বুদ্ধদার কাছে যেতেই বুদ্ধদা বললেন- 'স্বপন ও তিমির। তরুণ কবি। মাথায় সিনেমার পোকা ঢুকছে। কাল থেকে শুটিং-এ থাকবে। শুটিং দেখবে।' ঘনঘন সিগারেট খাওয়া একজন মানুষ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিলেন সকাল ছ'টায় চলে আসবে। পরের দিন ছ'টার অনেক আগেই আকাশ হোটেলের সামনে এসে দাঁড়িয় আছি। স্বপনদা একটা জিপ গাড়ি দেখিয়ে বললেন উঠে পড়ো গাড়িতে।

লোকেশন ডুরিং। ভোরবেলা পিঠে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়তাম আর্ট সেটিং-এর গাড়িতে। সারাদিন লোকেশান থেকে লোকেশন। শুটিং-এ দূর থেকে স্যারকে দেখতাম। নির্দেশ দিচ্ছেন, 'যাদব ট্রলি'। অর্জুন গাছটাকে ঘিরে রাউন্ড ট্রলি। কখনও দেখেছি চুপচাপ বসে আছেন। হাতে চায়ের কাপ। হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে চলে গেলেন। বললেন ক্যামেরা। ক্যামেরার লোকজন ছুটছেন ক্যামেরা কাঁধে। দু’তিনটি মনিটর, তারপর টেক। কলটাইম থেকে প্যাক আপ একটা কি দুটো টেক হত।

নতুন ছবি মানেই অফিসে উৎসব। সারাদিন অফিস গমগম করছে। নতুন ছবির নাম 'জানালা'। লোকেশান পুরুলিয়া। এবার আমি ইউনিট মেম্বার। সহকারী পরিচালক। একটা অন্যরকম ব্যস্ততা। দেখছি, অফিসে সারাদিন মিটিং সিনেমাটোগ্রাফার, আর্ট ডিরেক্টর্, প্রোডাকশন কন্ট্রোলার সঙ্গে পরিচালক। এসময় বুদ্ধদাকে দেখতাম একেবারে অন্য মানুষ। সেই খোলামেলা বুদ্ধদা কেমন পাল্টে গেছেন, একটু ভাবুক।

এইবার সুযোগ এল হাতেকলমে কাজ শেখার দেখার। আমার স্বপ্ন যেন পূর্ণ হল। বুদ্ধদাকে কাছ থেকে, তাঁর কাজের ঘরানাকে অবজার্ভ করার। কলটাইম থেকে প্যাক আপ আমার কাছে ছিল ফিল্ম স্কুলের দীর্ঘ ক্লাস। দেখতাম কীভাবে শট নির্মাণ করছেন। শট অনুযায়ী লেন্সের প্রয়োগ। যেন ছোট বড় শট দিয়ে সাজানো একটি পয়ার। কখনও দু'মাত্রা। কখনও তিনমাত্রা। বা তিন তিন দুই। শুটিং থেকে ফিরে ভাবতাম কেন ৮ নাম্বার সিনে ৫ নাম্বার শটে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল এরকম হল। এক একজন শিল্পী একরকম ভাবে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ। বুদ্ধদাকে দেখেছি - সোহিনীদি বা অরুণদাকে সিন পড়ে শোনাচ্ছেন। দৃশ্যটা শুনে নেওয়ার পর লোকেশনটা ভালো করে দেখতেন। কখনও বা একটু দূরে চলে যেতেন। ডাক পড়তো ক্যামেরা। ট্রলি। এরপর লেন্স। প্রথমে হয়তো ৩৫ লাগালো। লুক থ্রু করলেন নিজেই। ফ্রেম পছন্দ হল না। লেন্স বদলালেন। ২৪ লাগালেন। আবার লুক থ্রু। হ্যাঁ ঠিক আছে। লেন্স, ফ্রেম পচ্ছন্দ হলে এবার ট্রলির রিহার্সাল। আস্তে আস্তে নির্মিত হত ক্যাবিক দৃশ্যায়ন। শুটিং থেকে ফিরে হোটেলের লবিতে এসে সকলে বসতাম। আগামীদিনের শুটিংয়ের আলোচনা চলতো। একদিন হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলাম - সবাই আপনার সিনেমাকে কাব্যিক বলে। কিন্তু সিনেমায় কাব্যিক ব্যাপারটা কীভাবে তৈরি করেন?

- দেখো তিমির, এই কাব্যিকতা সিনেমার মধ্যে হয়তো অনেকরকম ভাবেই চলে আসে। শট ডিজাইন, ইমেজ, আলো, ট্রলি, আবহ সঙ্গীত, ফিল্ম স্পিড, সবশেষে সম্পাদনা। সমস্ত কিছুর দক্ষ শৈল্পিক সমন্বয়ে হয়তো আলোর ব্যকরণ মেনে ছবি তুলে নিতে পারা পরিচালকের প্রধান কাজ। এরকম খণ্ড খণ্ড কথাবার্তাগুলি ছিল আমাদের কাছে ফিল্ম স্কুলের অধ্যাপকদের নোটের মতো। আমরা শুনতাম আর দেখতাম। শুটিং লোকেশনে বুদ্ধদা খুবই গম্ভীর। কিন্তু প্যাক আপের পর হোটেলে ফিরেই দেখেছি খোলামেলা রসিক বুদ্ধদাকে।

মাঝে মাঝে কয়েকটি কবিতার লাইন বলে সহসা জিজ্ঞেস করতেন, বলো তো কার লাইন? কিছুক্ষণ পরে নিজেই হেসে উত্তর দিতেন সমর সেন। কখনও প্রণবেন্দু, কখনও ভাস্কর, কখনও শামসের-এর কবিতার লাইন ছুঁড়ে দিতেন আমাদের দিকে। আমরা কখনও উত্তর দিতাম এটা ভাস্কর। বুদ্ধদা মুচকি হাসতেন। হাসতে হাসতে বলতেন কাল তোমার কবিতা নিয়ে আসবে শুনব। অনেকদিন পর ভয়ে ভয়ে বুদ্ধদাকে অনেকগুলি কবিতা শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। এখন বুদ্ধদা নিজেই একটা ওয়াইড এঙ্গেল ফ্রেমের ভেতর হারিয়ে গেলেন এই শহরে। পাখিগুলি উড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। চারিদিকে ঘন কুয়াশা ঘিরে ধরেছে। বিড়বিড় করে মন্ত্র বললেও আমরা জানি লাল দরজা আর খুলবে না কখনও...


বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১৯৪৪-২০২১)

ফিচার ফিল্ম -
সময়ের কাছে (১৯৬৮, ছোট ছবি); দূরত্ব (১৯৭৮); নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯); গৃহযুদ্ধ (১৯৮২); অন্ধি গলি (১৯৮৪); ফেরা (১৯৮৮); বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯); তাহাদের কথা (১৯৯২); চরাচর (১৯৯৩); লাল দরজা (১৯৯৭); উত্তরা (২০০০); মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২); স্বপ্নের দিন (২০০৪); আমি, ইয়াসিন আর আমার মধুবালা (২০০৭); কালপুরুষ (২০০৮); জানালা (২০০৯); “ও” (ছোটদের ছবি ২০১০); আনোয়ার কা আজব কিসসা (২০১৩); টোপ (২০১৬); উড়োজাহাজ (২০১৮)।

টেলিভিশন -
মহাশ্বেতা দেবীর ১৩টি গল্প নিয়ে ১৩টি টেলিফিল্ম (২০০৭); রবীন্দ্রনাথের ১৩টি কবিতা নিয়ে ১৩টি টেলিফিল্ম ‘ত্রয়োদশী’(২০১১)।

তথ্যচিত্র -
দ্য কন্টিনেন্ট অফ লাভ (১৯৬৮); ঢোলের রাজা ক্ষিরোদ নট্ট (১৯৭৩); ফিশারমেন অফ সুন্দরবন (১৯৭৪); শরৎচন্দ্র (১৯৭৫); রিদম অফ ষ্টিল (১৯৮১); ইন্ডিয়ান সায়েন্স মার্চেস আহেড (১৯৮৪); বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কার (১৯৮০); স্টোরি অফ গ্লাস (১৯৮৫); ইন্ডিয়া অন দ্য মুভ (১৯৮৫); সেরামিকস (১৯৮৬); শঙ্খ; অন্নদাশংকর রায়; দ্য পেইন্টার অফ এলোকুইন্ট সাইলেন্স - গণেশ পাইন (১৯৯৮); রবীন মণ্ডল (২০০৩); বি ই কলেজ - দি মার্চ কন্টিনিউজ।

কবিতার বই -
গভীর এরিয়েলে (১৯৬৩); কফিন কিংবা সুটকেশ (১৯৭২); হিমযুগ (১৯৭৭); ছাতাকাহিনী (১৩৩৮ পৌষ); রোবটের গান (১৯৮৫); ভোম্বলের আশ্চর্য কাহিনী ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৪); উঁকি মারে নীল আর্মস্ট্রং (২০০৬); গুটগুটিয়ে চলেছে নীল পোকা (২০১৫); ভূতেরা কোথায় থাকে (২০১৭); বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ (২০১৮); শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৪); কবিতা সংগ্রহ (২০১৭)।