আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা অথবা জীবনের হিসাব

অনিন্দিতা রায় সাহা


গোড়ার কথা

এক মাসও হয়নি ভারতের দুই উপকূল বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়েছে। পূর্ব উপকূলে এ যেন এক বার্ষিক উৎসব। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব কষা হচ্ছে, সেই সঙ্গে চলছে নিরন্তর রাজনৈতিক চাপান উতোর। পশ্চিমবঙ্গ আর ওড়িশার তুলনামূলক আলোচনাও সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আকস্মিক বিপদ না ভেবে তাকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করতে হবে, তার সঙ্গে শক্ত হাতে যুঝতে হবে, এটাই এই সময়ের চাহিদা। ওড়িশা দীর্ঘ মেয়াদে সেই চেষ্টাই করছে আর পশ্চিমবঙ্গ স্বল্পকালীন মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রতি বছর হিমশিম খাচ্ছে, এমন কথা বলা হচ্ছে। যেহেতু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কৌশলে এখন পূর্বাভাস অনেক সহজ হয়েছে, তাই মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে ব্যাপক প্রাণহানি এড়ানো গেছে। কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? বিপর্যয়ের পরে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো এক কথা, আর আগে থেকেই তার জন্য প্রস্তুত হওয়া আরেক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার জন্য চাই দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি, যুদ্ধনীতি আর সঠিক ব্যবস্থাপনা।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান হল মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কালে তাদের সাহায্য করা আর প্রাণ বাঁচানো। আজকের সময়ে রাজ্যাধিপতির জায়গায় বসানো যেতে পারে রাষ্ট্রকে, সেই সঙ্গে হয়তো সমাজকেও। বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হলে চাই একদিকে যথোপযুক্ত সরকারি নীতি ও তার প্রয়োগ, অন্যদিকে একটি প্রশিক্ষণ-প্রাপ্ত নাগরিক সমাজ। সাম্প্রতিক কালে পৃথিবী গ্রহের জলবায়ু ক্রমাগত পরিবর্তন হওয়ার ফলে ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়ায় এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বাড়ছে। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প আর খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে কেবল এক বছরেই (২০১৯) পৃথিবীর সাড়ে সাত’শ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে নয় কোটি মানুষ বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে মৃতের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার, ছোট বড়ো মিলিয়ে বিপর্যয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। শুধু এশিয়া মহাদেশেই আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০০ কোটি, আর দুর্যোগের সংখ্যা প্রায় দেড়শো। কোনো কোনো অঞ্চল বারে বারে দুর্যোগের কবলে পড়ে। সে হিসেব ধরলে সংখ্যাটা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

এই বিপুল ক্ষতি এবং ক্ষতিগ্রস্তের বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখলে সহজেই চোখে পড়বে যে উন্নয়নশীল দেশে এইসব সমস্যার কিছু অতিরিক্ত মাত্রা আছে। সেখানে প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের পরিমাণ সীমিত, দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশল অজ্ঞাত, আর জনসাধারণ সঠিকভাবে প্রস্তুত নন। যদি বলা হয় উপযুক্ত সরকারি নীতি ও সদিচ্ছা অনুপস্থিত, তাহলে হয়তো খুব ভুল বলা হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা বা তার জন্য তৈরি থাকা আমাদের মতো দেশে এক বিরাট সামাজিক পরীক্ষা। রাষ্ট্রীয় স্তরে অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যবস্থার সাহায্যে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান জরুরি। অন্যদিকে প্রকৃতির খেয়ালের সঙ্গে যুঝে ওঠার জন্য মানবজাতির প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মতো জনবহুল, অশিক্ষিত ও দরিদ্র দেশে মানুষকে তৈরি করা কঠিন কাজ বটে, কিন্তু অসম্ভব নয়। বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ সেই অর্থে বেঁচে থাকার একটি প্রাথমিক শিক্ষা। শুধু সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা নয়, শুধু নদী-মোহনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নয়, শুধু মালভূমি আর পার্বত্যভূমি নয়, বর্তমান সময়ে পৃথিবীর যে কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলে যেকোনো সময়ে বিপর্যয়ের যথেষ্ট সম্ভাবনা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিপর্যয়ের ঝুঁকির বিরুদ্ধে প্রস্তুতি (Disaster Risk Preparedness) যে কোনো সমাজ ও দেশের পক্ষে একটি অবশ্য শিক্ষণীয় কৌশল, জীবনের লড়াইয়ের হাতিয়ার। উন্নত বিশ্বে এ জাতীয় প্রশিক্ষণের ঐতিহ্য অনেক দিনের। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সে প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার উপযুক্ত শিক্ষা সম্পর্কে জনচেতনা বাড়ানো ও সেই সংক্রান্ত নীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি।

ভারতবর্ষে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা

বিগত দুই দশকে সারা পৃথিবীতে যতগুলি দেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, তার মধ্যে ভারতবর্ষের জায়গা বেশ ওপরের দিকে। বিশ্ব ঝুঁকি সূচক (World Risk Index) পরিমাপ করার জন্য যে বৈশিষ্ট্যগুলি গণ্য করা হয়, তার মধ্যে পড়ে বিপর্যয়ের ভৌগোলিক সম্ভাবনা, প্রাণীজগতের অভিযোজনের ক্ষমতা, পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি ইত্যাদি। যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনাকে এর মধ্যে গণ্য করা হয় সেগুলি আমাদের অতি পরিচিত, যেমন, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঝড়, সামুদ্রিক স্তরের বেড়ে যাওয়া, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি। এই গড় সূচক অনুযায়ী প্রথম সত্তরটি স্থানে থাকা দেশগুলিকে সর্বোচ্চ ঝুঁকির দেশ বলে মানা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতবর্ষ ঝুঁকি সূচকের নিরিখে ২০২০ সালে বিশ্বের ১৮১টি দেশের মধ্যে ৮৯তম স্থান দখল করেছে। সদ্য প্রকাশিত এসডিজি (টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্য) রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত বা নিরুদ্দিষ্টের হার প্রতি লক্ষে ১০,৭৩৮ (২০১৮)। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের (Global Climate Risk Index) বিচারে ভারতের স্থান সপ্তম ( ২০১৯)।

ভৌগোলিক দিক থেকে পর্যালোচনা করলে ভারতবর্ষে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কেন বেশি তা বোঝা কঠিন নয়। প্রায় দেড়শো কোটি জনসংখ্যা, ৩৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তন আর সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার তটভূমি - প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে ভারতবর্ষে কারণের অভাব নেই। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অংশের হিমালয় পার্বত্য প্রদেশসহ দেশের শতকরা ষাট ভাগ এলাকায় ভূমিকম্পের সম্ভাবনার মাত্রা অত্যুচ্চ। ছোট বড়ো মিলিয়ে সারা দেশে বহতা নদীর সংখ্যা অগুনতি। সারা দেশে বার্ষিক যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ হচ্ছে ভারী ধারাপাত, যার ফলস্বরূপ দেশের শতকরা বারো ভাগ অঞ্চলে বন্যার সম্ভাবনা প্রবল। গত তিরিশ বছরের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ভারতবর্ষে পারমানবিক, রাসায়নিক ও অন্যান্য জৈবিক দুর্ঘটনা বাদ দিয়ে শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশোটি। স্বাভাবিকভাবেই এইসব বিপর্যয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে দরিদ্র, মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের ওপর, যাদের না আছে সম্বল, না আছে মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি, যাদের না দেওয়া হয়েছে কোনো প্রশিক্ষণ।

ভারতবর্ষে ২০০৫ সালের বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা আইনে (Disaster Management Act) স্থানীয়, জেলা, রাজ্য ও জাতীয় স্তরে করণীয় বিধি ও দায়বদ্ধতার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এতে আইনী ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোনো বিপর্যয় ঘটে গেলে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন এবং কীভাবে তা সাধিত হবে, কানুন তা পর্যালোচনা করছে। কিন্তু এই সমাধানগুলি প্রায়শই সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া ক্ষয়ক্ষতি তো আগেই হয়ে গেছে। আমরা বলছি আরো গোড়ার কথা, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে আগে থেকেই নাগরিক সমাজের চেতনা ও প্রস্তুতির কথা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কমিয়ে আনা আর সামাজিকভাবে মানুষকে বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেওয়া, দুইটি দিকই সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যথাযথ প্রতিরোধ-প্রস্তুতি বিপর্যয়ের প্রভাব অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষেও ঘূর্ণিঝড়ের সঠিক পূর্বাভাস অনেক প্রাণহানি কম করতে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে যদি মানুষকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাহলে একটি সহনশীল সমাজগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব যা বিপর্যয়ের পরে আবার আগের মতো স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।

শুরুর থেকে শিক্ষার শুরু

বিপর্যয় মোকাবিলার শিক্ষা আটটি মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। এগুলি হল তথ্য সংগ্রহ ও সম্প্রচার করা, শৈক্ষিক প্রয়োজনের পরিমাপ অনুমান করা, শিক্ষা বিষয়ক পরিকল্পনা গ্রহণ করা, শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিরূপণ করা, শিক্ষণীয় সামগ্রী একত্র করে পাঠক্রম প্রস্তুত করা, প্রশিক্ষণের কৌশল উদ্ভাবন করা, নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো গঠন করা এবং প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাধাবিপত্তি ও সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করা। যথাযথ পদ্ধতিতে এই জাতীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে কম খরচে একটি দীর্ঘকালীন প্রতিরোধ-প্রস্তুতির সৃষ্টি করা যায়। নানা দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, যথাযথ নীতি নির্ধারণ করলে মানুষ এই ধরনের কর্মসূচিতে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপর্যয় মোকাবিলার শিক্ষাপ্রণালীতে শিশুরা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদিও শিশুরা তাদের বয়স ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বেশি প্রভাবিত হয়, তবু তারাই আবার হয়ে উঠতে পারে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির যোগ্যতম কুশীলব। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ও পাঠক্রমকে ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়ার অনেক নজীর উন্নত বিশ্বে আছে। শিশুদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেন শিক্ষক, অভিভাবক ও জননেতারা, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাটি নিঃসন্দেহে শিক্ষকদের। সমীক্ষায় আরো দেখা গিয়েছে, এই ধরনের পাঠক্রম শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে প্রভূত সাহায্য করে। এই যে দলবদ্ধতার শিক্ষা, এই যে বিপদের মুখে শক্ত হয়ে দাঁড়ানো, এর থেকেই পরবর্তীকালে জন্ম নিতে পারে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নাগরিক। আর তাদের হাত ধরে ভবিষ্যতে যে কোনো সামাজিক কর্মসূচী সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যদিও সব দেশে বা সব কালে কী হবে তা একভাবে বিচার করা যায় না, তবু শিশুদের প্রস্তুত করার সপক্ষে মোটামুটি সব দেশের মনোবিজ্ঞানীরা একমত। সারা বিশ্ব জুড়ে তাই বলা হচ্ছে, বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের মধ্যেই ঢুকিয়ে দিতে হবে এই অতি জরুরি প্রাথমিক শিক্ষাটিকে।

উন্নয়নশীল দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব শিশুদের ওপর কতখানি হতে পারে তাই নিয়ে ভাবনা চিন্তা কিছুটা হলেও তাদের প্রশিক্ষণ দেবার বিষয়টা এখনো তেমন গুরুত্ব পায়নি। মায়ানমার থেকে পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে থেকে নেপাল সর্বত্রই মোটামুটি একরকম চিত্র দেখা গেছে। যে সব অঞ্চলে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে বা প্রায়শই ঘটে থাকে, সেসব জায়গার স্কুলগুলিতে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা, প্রশিক্ষণ বা কৌশলের মাত্রা খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আকস্মিক ও জরুরি অবস্থার জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই। যেমন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে বেরোবার মানচিত্র বা রাস্তা, আগুন নেভানোর ব্যবস্থা, ভূমিকম্প হলে ছুটে যাওয়ার মতো খোলা মাঠ ইত্যাদি কিছুই সুশৃঙ্খলভাবে তৈরি করা হয়নি। স্কুলের স্পোর্টস রুমে সামান্য ফার্স্ট এইডটুকুই হয়তো রাখা আছে। এ ধরনের বিপর্যয়ে ছোটোদের মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তা থাকা উচিত, সে কথাটা ভাবাই হয়নি। প্রতিবন্ধী মানুষদের যে বিশেষ সাহায্যের প্রয়োজন, তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এখন আর আকস্মিক নয়। পূর্বাভাস পাওয়ার পর যা যা ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেগুলিকে আগে থেকেই সম্ভাব্য এলাকায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে। যেমন, মজবুত জুতো-জামা পড়া, দরজা বন্ধ রাখা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জলের লাইনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবে সকলের জানা থাকার কথা । আজকাল সরকারি উদ্যোগে মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়, পালিত জীবজন্তুর ব্যবস্থা করা হয়। সেটা সাময়িক। স্থানীয় মানুষ যা করছেন তা অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমরা বলছি এই পুরো ব্যবস্থাটাকেই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করার কথা। বাঁধাগতের শিক্ষাপদ্ধতিকে নতুন করে না সাজালে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবেশ সমস্যার মুখোমুখি হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের লক্ষ্য একাধারে দুটি, বিপর্যয়ের তাৎক্ষণিক মোকাবিলা ও দীর্ঘকালীন উপায়ে মোকাবিলার জন্য যথোপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ-প্রস্তুতি। বিদ্যালয় স্তর থেকে শুরু করার তাৎপর্য বর্তমান থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত একটি মজবুত নাগরিক সমাজ গড়ে তোলা। সাধারণভাবে বিদ্যালয়ে যে দুটি উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে, পাঠ্যবই আর হাতেকলমে শেখা, বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এই দুটিকে সহজেই একসাথে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ফল সুদূরপ্রসারী হয়।

ভারতবর্ষে প্রস্তুতি-প্রশিক্ষণের হাল

অন্য অনেক অনগ্রসরতার মতো আমরা বিপর্যয় প্রস্তুতি প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও বেশ পিছিয়ে আছি। ছাত্র, শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষ, শিক্ষাব্যবস্থার যে কোনো অংশীদারের সঙ্গে কথাবার্তা বললেই এই সচেতনতার অভাব বেশ টের পাওয়া যায়। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ভরা রাজধানী দিল্লি, মহারাষ্ট্রের পুনে, মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, এইসব অঞ্চলে কিছু সমীক্ষা করা হয়েছে। কোথাওই তেমন আশাব্যঞ্জক ফল দেখা যায়নি। আমাদের দেশে শিক্ষানীতি ও কর্মসূচির মধ্যে হাতেকলমে শিক্ষার স্থান অতি নগন্য। পুঁথি মুখস্ত করে ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’ তৈরি করা যেখানে পড়াশুনার প্রচলিত ধারা, সেখানে বিপর্যয় মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বাস্তব প্রশিক্ষণের মতো একটি অনিয়মিত বিষয়কে নিয়ে ভাবা হবে, তার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।

আমাদের দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির মধ্যে প্রধান হল ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ও অগ্নিকান্ড । প্রথম তিনটি প্রাকৃতিক কারণে যে কোনো অঞ্চলে ও শেষেরটি ঘনবসতির জন্য শহর এলাকায় সহজেই ঘটতে পারে। এ ছাড়া বনাঞ্চলে দাবানলের সম্ভাবনাকেও কোনোমতেই বাদ দেওয়া যাবে না। এর মধ্যে কোনোটির জন্যই ন্যূনতম জ্ঞান, চেতনা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আমাদের শিক্ষাসূচিতে দেখা যায় না। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতবর্ষে দশ থেকে পনেরো বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিপর্যয় মোকাবিলার প্রাথমিক ধারণাটুকুও নেই। যেমন ধরা যাক, ভূমিকম্প এলে drop cover and hold অথবা আগুন লাগলে stop drop and roll, এগুলি খুব সাধারণ কৌশল। তেমনি কোন ধরনের আগুন কীভাবে নেভাতে হয়, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, এগুলি সাধারণ জ্ঞান। অথচ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই ন্যূনতম অথচ ভীষণ জরুরি জ্ঞানগুলি তৈরি করা হয় না। দিল্লি শহরের কিছু সরকারি বিদ্যালয়ে খোলাখুলি প্রশ্ন করে জানা গেছে, বিপদ হলে কোন নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে, অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে তাও সঠিক বলতে পারে না। আরো বিস্মিত হতে হয়, যখন দেখা যায়, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা যতটুকু বা জানে, নবম-দশম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা তাও বলতে পারে না। হয়তো বোর্ডের পরীক্ষার পড়ার চাপে এই পাঠ্য-বহির্ভূত শিক্ষাগুলি পিছনের সারিতে জায়গা নিয়েছে। শিক্ষকদের সাথে কথাবার্তা বলেও তেমন আশাব্যঞ্জক উত্তর পাওয়া যায়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষের অবস্থাও তথৈবচ। সরকারি অনুশাসন অনুযায়ী যন্ত্রপাতি হয়তো লাগানো আছে, কিন্তু তার ক্ষমতা, মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষণ নিয়মিত হয় না। কিছু বেসরকারি স্কুলে অনুসন্ধান করেও জানা গেল যে সেখানে কোনো ফায়ার ড্রিল হয় না, কদাচিৎ পরিদর্শন না হলে নিয়মিত কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অন্য কোথাও বিধ্বংসী বন্যা বা ভূমিকম্প হলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সাহায্য অবশ্যই পাঠায়। কিন্তু এই চেতনা তৈরি হয়নি যে কেবল সাহায্য পাঠানোর মধ্যেই দায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এটি সকলের সমস্যা, এটি যে কারুর বিপদ। তাই এর জন্য পুরো সমাজের প্রস্তুতির প্ৰয়োজন।

এই আলোচনা একটা ঘন্টা বাজানোর চেষ্টা, একটা সাবধানতার ঘোষণা। যদিও অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে, তবু ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এখনই শুরু করা যায়। আর সেটা করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে, অর্থাৎ শিশু শিক্ষার প্রথম পর্ব থেকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দোসর মেনে নিয়ে প্রস্তুত হওয়াটাই বিচক্ষণতা। তাই বিপর্যয় মোকাবিলার শিক্ষা যত শীঘ্র সম্ভব পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। শিক্ষনীতিতে, শিক্ষক শিক্ষণ পদ্ধতিতে, পাঠক্রমে এবং শিক্ষার্থীর মূল্যায়নে এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হোক প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার শিক্ষা। পুরোপুরি খোলনলচে বদলে বিকল্প নয়, কিন্তু একটি পরিবর্তিত শিক্ষাসূচি তৈরি হোক যার দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে উঠবে অর্থপূর্ণ এবং সুস্থ জীবনযাপনের সহায়ক। জীবনের আসল হিসাব তো বেঁচে থাকার, তা বিনে জীবনখানা যে “ষোলো আনাই মিছে”।