আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
প্রবন্ধ
এনআরসি এবং বাঙালির ভবিষ্যৎ
গৌতম লাহিড়ী
বহুচর্চিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জির ভবিষ্যৎকী? এনআরসি শব্দটা বহুল পরিচিত। সম্প্রতি রাজধানী দিল্লির ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা আয়োজিত ই-আড্ডায় না গেলে হয়তো জানা যেত না - এনআরসি নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির পরিকল্পনা কী?
এই 'আড্ডায়' আমন্ত্রিত ছিলেন আসামের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সমাজের বিশিষ্ট সুশীল সমাজ-বুদ্ধিজীবি এবং সাংবাদিকরাও ছিলেন আমন্ত্রিত। সৌভাগ্যক্রমে ওই আড্ডায় দুজন সাংবাদিকের প্রশ্ন করার সুযোগ হয়েছিল। বিশিষ্ট সাংবাদিক তভলীন সিং এবং এই কলমনবীশ। মুখ্যমন্ত্রীর জবাব শুনে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল। এককথায় বলি, - উনি বলেছিলেন এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়াদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। মনে রাখবেন - যে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল তাদের মধ্যে বারো লক্ষ বাঙালি। শেষ পর্যন্ত যদি মুখ্যমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয়, তাহলে বাঙালিরা নিজভূমেই পরবাসী হয়ে রইবেন।
যেদিন মুখ্যমন্ত্রী ই-আড্ডায় উপস্থিত হন সেই দিনই তিনি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নিশ্চিত তিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আসামে ঝুলে থাকা এনআরসি নিয়েও আলোচনা করেছেন। আড্ডার সঞ্চালক ছিলেন এক্সপ্রেস গোষ্ঠীর ন্যাশনাল ওপিনিওন সম্পাদক বন্দিতা মিশ্র। অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল এনআরসির ভবিষ্যত নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর হিমন্তবিস্ব শর্মা কোনো ভনিতা না করেই বললেন, - আগে যে এনআরসি হয়েছিল তার তালিকায় অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। "আমরা প্রথমে আসামের সীমান্ত জেলার তালিকার ২০ শতাংশ এবং অন্যত্র ১০ শতাংশ তালিকার পুনর্মূল্যায়ন চাই।"
আসামের সীমান্তবর্তী ষেসব জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস সেই ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বড়পেটা, মরিগাঁও এবং নওগাঁও, করিমগঞ্জ, দরং এবং হাইলাকান্দির তালিকা নিয়ে বিজেপি আপত্তি করেছিল। এঁরা সকলেই বাংলাভাষী। সকলেই মুসলিম তা-ও নয়। মুখ্যমন্ত্রীর মতে ভোটার তালিকা যেমন পুর্নসমীক্ষার পরেই চূড়ান্ত হয় তেমন এনআরসি তালিকা নিয়েও করতে হবে। প্রশ্ন হল - যে ১৯ লক্ষ মানুষ তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী হবে? মুখ্যমন্ত্রীর সহজ জবাব - বিদেশি চিহ্নিতকরণের ট্রাইবুনাল তৈরি হয়েছে। সেই ট্রাইবুনাল যাঁদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করবে বা বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করবে তাঁদেরকে সেই রায়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
যদি বাংলাদেশ রাজি না হয়? মুখ্যমন্ত্রী জানালেন যে তাহলে এইসব ব্যাক্তিদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। "আমার মনে হয় না এটা খুব কঠিন কাজ।" বলে রাখা ভালো বাংলাদেশ সরকার আগেই সরকারিভাবে জানিয়ে দিয়েছিল তাঁদের কোনো নাগরিক আসামে নেই। তাঁরা কাউকেই ফেরত নেবেন না।
তার থেকেও মৌলিক প্রশ্ন তুলে প্রয়াত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি বলেছিলেন - 'কোন দুঃখে বাংলাদেশিরা গরীব আসামে আসবেন? এখন সেই বাংলাদেশ নেই।
বাংলাদেশিরা সুযোগ পেলে ভুমধ্যসাগরের নীল জলে সাঁতার কাটা পছন্দ করবে। আসামে এসে কী করবে?'
বাংলাদেশের রসিক হাইকমিশনার প্রয়াত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির ভ্রাতুষ্পুত্র। সিলেট পৈতিৃক বাসভূমি। তখন সিলেট অবিভক্ত ভারতের অঙ্গ ছিল। সম্প্রতি আর্ন্তজাতিক অর্থ ভান্ডার (এইএমএফ) এক সমীক্ষায় জানিয়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের থেকে বেশি। ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় ১৮৭৬ ডলার বা বর্তমান হিসাবে প্রায় ১৩,৬০০ টাকা। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হলো ১৪,৬০০ টাকা। আসামের কত? মাত্র ৬৭৫৬ টাকা। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কোন সুখে আসামে বাস করতে যাবেন?
আর্থিক বিকাশের দৌড়েও বাংলাদেশ ভারতকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। কোভিডের আগেই ভারতের বিকাশ ছিল নিম্নগামী। কোভিড অতিমারীর পরে সেই হার নেতিবাচক স্তরে এসেছে। সে জায়গায় বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধি কোভিডের কারণে কম হলেও ৫ শতাংশের বেশি। এমন একটা আর্ন্তজাতিক স্তরে স্বীকৃত তথ্য থাকা সত্ত্বেও বিজেপি 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকে' হাতিয়ার করতে চাইছে। তা কেবলমাত্র মেরুকরণের জন্য নয় কি? এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল সংশয় তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, 'যাঁরা নাগরিকত্বর প্রমাণ দিতে পারবেন না তাঁদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তবে যতদিন না তা হচ্ছে ততদিন তাঁদের রেখে দেওয়া হবে। কিন্তু ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। অন্য যাবতীয় নাগরিক সুবিধা অবশ্য পাবেন।' এই ঘোষণা থেকে স্পষ্ট নয় কি সমাজের এক বিশেষ অংশের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করাই আসল উদ্দেশ্য। আক্ষরিকভাবেই সংখ্যালঘু বাঙ্গালিদের 'দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' করে তোলাই উদ্দেশ্য নয় তো?
ভারতের মধ্যে আসাম একমাত্র রাজ্য যেখানে ভোটার তালিকায় 'ডি-ভোটার' বা 'সন্দেহজনক ভোটার' বলে একটি পৃথক তালিকা রয়েছে। বিদেশি চিহ্নিতকরণের আইন অনুযায়ী ট্রাইবুনাল এই ডি ভোটার তালিকা তৈরি করেছে। যাঁরা নাগরিকত্বর প্রমাণ দিতে পারেননি, ১৯৭১ সালের আগে এবং পরে যাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছিলেন তাঁদের নাম উঠেছে এই তালিকায়। এঁদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বাঙ্গালিই রয়েছেন। এঁদেরকে ভোটার পরিচয় পত্র দেওয়া হয়নি। নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির আসাম শাখার সুদীপ শর্মার মতে এই ধরণের ডি ভোটার রয়েছে প্রায় ছ'লক্ষ। এর সঙ্গে এনআরসি থেকে বাদ পরা ১৯ লক্ষ সংখ্যাটা জুড়ে দিলে পঁচিশ লক্ষ হয়ে যায়।
কথোপকথনের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব সগর্বে ঘোষণা করছিলেন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য আসাম প্রদেশকে দেশের মধ্যে অন্যতম বিকশিত রাজ্য হিসেবে উন্নীত করা। সেই সময়ে আমি জানতে চাই ভৌগোলিক দিক থেকে আসাম স্থলবন্দি রাজ্য। সড়ক ছাড়া ভারতের পুর্ব বা অন্য প্রান্তের সঙ্গে কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অনেকটা স্থলদ্বীপের মতো। এহেন আসামে আর্থিক কর্মকান্ডর বৃদ্ধি ঘটাতে হলে নিরবিছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আসামের সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের মধ্যিখানে বাংলাদেশ অবস্থিত। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অবাধ ট্রানজিট সুবিধা না পেলে বাণিজ্যের বিকাশ সম্ভব নয়।
এবারই মুখ্যমন্ত্রীর দোলাচল স্পষ্ট হয়ে উঠল। যে মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে চান তিনিই আবার বাংলাদেশের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বললেন। প্রথমেই স্বীকার করে নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই আসাম আজ শান্ত। তিনি আলফা জঙ্গীদের গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। জঙ্গী শিবির ধ্বংস করেছেন। ভারতের সার্বিক নিরাপত্তার কারণে এটা যে কত বড়ো সহযোগিতা সেটা তিনি স্বীকার করলেন। এও বললেন, 'আমার ইচ্ছা রয়েছে কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ সফর করবো।' প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তাঁকে শুভেচ্ছা পাঠিয়ে বাংলাদেশের আর্থিক প্রগতির কথা জানিয়েছেন। চিঠিতে এও বলেছেন, বাংলাদেশ শীঘ্রই স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে চলেছে। বাংলাদেশের আর্থিক বিকাশের সুযোগ যেন আসাম নেয়। এতে উভয়ের লাভ। সেই মুখ্যমন্ত্রী 'বাংলাদেশি' ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করছেন। এতো ভাবের ঘরে চুরি। সুতরাং তিনি কোন পথে হাঁটবেন? ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাপূরণের জন্য আরএসএসের দর্শন মেনে চলবেন নাকি আসামের সার্বিক বিকাশের পথ বেছে নেবেন? এটা ঠিকই যে আরএসএসের বিরাগভাজন হলে মূখ্যমন্ত্রীর গদি থাকবে না। দেখা যাক আসামের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী কোন পথে এগিয়ে চলেন।