আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
প্রবন্ধ
কৃষি সংস্কারঃ দুই ইকো-সিস্টেমের লড়াই
রঞ্জন রায়
ভুমিকা
রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন, দুষ্প্রচার ও উপেক্ষার চোখে চোখ রেখে উত্তর ভারতের কৃষকদের আন্দোলন এখন পাঁচ মাস হওয়ার মুখেও টিঁকে আছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক প্ররোচনা সত্ত্বেও আন্দোলনের অহিংস চরিত্রে দাগ লাগেনি। বিদেশের পয়সা, পাকিস্তানের সাপোর্ট, মুষ্টিমেয় আড়তিয়া ও ধনী কৃষকদের আন্দোলন জাতীয় তকমা টেঁকেনি। কিন্তু বিজেপি সরকার এবং বিরোধীদলগুলোর ভিন্নমতের বাইনারি ছাপিয়ে ভারতের কৃষিক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন বারবার আম নাগরিকদের চিন্তাভাবনায় উঠে আসছে।
ধরুনঃ
১) বর্তমান কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় কৃষকরা কি খুব সুখে আছে? তাহলেকেন কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পায়না?
২) এপিএমসি বা কৃষি উপজ মান্ডি ব্যবস্থা কী? এর সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি নেই?
৩) এপিএমসি অ্যাক্টের মাধ্যমে মান্ডি ব্যবস্থা তুলে দিলে কি সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে? বিহার, ও কেরালার অভিজ্ঞতা কী বলে?
৪) বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিতকৃষির করপোরাটাইজেশন কি স্থায়ী সমাধান নয়? ইউরোপ আমেরিকার অভিজ্ঞতা কী বলে?
৫) কৃষকদের প্রধান দাবি, অর্থাৎ মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস(এমএসপি)-কে আইন বানানো কতটা যুক্তিযুক্ত? এতে কী বাজারের নিয়মের উল্লংঘন হবেনা?
এগুলো খুব নতুন কিছু নয়, বিভিন্ন প্রতিবেদনে অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় এসব কথাগুলো কয়েকবার উঠে এসেছে। কিন্তু লোকজনের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় যে হাজারো কথা এবং বিভিন্ন পলিটিক্যাল রেটোরিকের মাঝে এই প্রশ্ন এবং সম্ভাব্য উত্তরমালার মেড ইজিটা হারিয়ে গেছে। জনমানসে ঠিকমতো ‘sync’ করেনি। সেই খামতিটি দূর করার উদ্দেশ্যে এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটির অবতারণা।
অবিশ্বাসের কুয়াশা
প্রশ্ন হল যে রাজ্য বা অঞ্চল থেকে আন্দোলনকারীরা এসেছেন সেখান থেকে মোদী সরকার গত সংসদীয় নির্বাচনে প্রচূর ভোট পেয়েছেন। কিন্তু আজ এদের সরকারের প্রতি আস্থায় ফাটল ধরল কেন?
বিশাল ভোটে জিতে ২০১৯-এ ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপগুলো খেয়াল করুন -
• সরকার গত বছর করোনা মহামারীর লকডাউনের সময় জুন মাসে তিনটে অর্ডিন্যান্স এনে চাষিদের মাথার থেকে ভরসার হাত সরিয়ে নিল।
তারপর সেপ্টেম্বরে সংসদের অধিবেশন ডেকে তিনদিনে হুড়ুম দুড়ুম করে বিলগুলো পাশ করানো এবং তার কয়েক দিনের মধ্যে অর্থাৎ, সেপ্টেম্বর, ২০২০তে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সই করিয়ে তাকে আইন বানিয়ে ফেলা! কৃষিব্যবস্থায় ধাঁচাগত পরিবর্তনের এই আইনগুলো নিয়ে কারও সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা নয়, বিলগুলো সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো নয়। এমন প্রথাবিরুদ্ধ কাজ কেন? করোনা ঠেকানো কি ফসলের খোলাবাজার তৈরি করা? কোনটা বেশি দরকারি? এত তাড়া কিসের?
∙ নিন্দুকে বলে - তাড়াহুড়োর কারণ আছে। গৌতম আদানির “আদানি অ্যাগ্রো লজিস্টিক্স লিমিটেড” (এএএলএল) দশ বছর আগে থেকে ভারত সরকারের ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে যে ওরা আধুনিকতম ফসলের গোদাম বা ‘সাইলো’ বানাবে যাতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ফসল সংগ্রহ, ঝাড়াই বাছাই সব খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কৃষক চাইলে সোজা ওই সাইলোতে এসেও ফসল সরাসরি জমা করতে পারে। কোনো কমিশন এজেন্ট বা আড়তিয়ার দরকার নেই। চাষির এবং সরকারের চটের বস্তা, তেরপল এবং মাল তোলা নামানোর খরচা বাঁচবে। এইভাবে সরকার ও আদানির যৌথ উদ্যোগে ফুড সাপ্লাইয়ের চেন তৈরি হয়ে খাদ্য সুরক্ষার সহায়তা হবে। আদানির বেস ডিপোগুলোকে ‘নোটিফায়েড মার্কেট ইয়ার্ডস’ বা কৃষিপণ্যের ‘ঘোষিত মুক্তাঙ্গন’ বলা হয়। এভাবে এফসিআইয়ের হয়ে আদানীর কোম্পানি প্রায় ৫,৭৫,০০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র পশ্চিমবঙ্গের জন্যে গুদামজাত করেছে। মধ্যপ্রদেশে এরা আরও ৩,০০,০০০ মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করেছে। ফলে গত আর্থিক বছরে মধ্যপ্রদেশ থেকে সরকারের গম সংগ্রহ প্রথমবার পাঞ্জাবকে ছাড়িয়ে গেছে।এখন এদের পরিকল্পনা হল শীগগির মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে আরও ৪,০০,০০০ মেট্রিক টন ভান্ডারণ বা মজুত করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। এইজন্যে বহু জায়গায় জমি কিনে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে জায়ান্ট গোডাউন বা সাইলো বানানো চলছে। [সূত্রঃ আদানি পোর্টস এন্ড লজিস্টিক্স-এর সাইট]
∙ এর মধ্যে ২০১৭ সালে হরিয়ানার একটি গ্রামে ১০০ একর জমি কিনে বিশ্বের আধুনিকতম ফসল ভান্ডার গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু কমদামে কৃষিজমি কিনে সেটাকে অ-কৃষি কাজে ব্যবহার করার জন্যে দরকারি অনুমতি চেয়ে আবেদন হরিয়ানার ভূমি-রাজস্ব বিভাগে দু’বার খারিজ করে শেষে গত মার্চ ২০২০তে মঞ্জুর করেছে।আর তার তিন মাসের মধ্যেই সরকার জারি করল কৃষি পণ্যের বেচাকেনা নিয়ে তিনটি অর্ডিন্যান্স!চাষীদের সন্দেহঃ এই অর্ডিন্যান্স কার স্বার্থে?
∙ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ওঁর আর্থিক নীতিতে ২০২৪ সাল নাগাদ সমস্ত কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু কীভাবে হবে তার কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ এখনও কারও কাছে নেই। তাহলে কি বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে সব গরীবের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা এবং ২১ দিনে করোনা কৌরব বধের মতো এটাও একটা কথার কথা বা ‘জুমলা’?
∙ কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথাবার্তা নয়, পাবলিক ডোমেইনে কোনো আলোচনা নয়। কিন্তু বড়ো গলায় বারবার অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বলা যে এই ‘যুগান্তকারী’ সংস্কার দেশের চাষিদের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ‘উপহার’।
কৃষকেরা বলছেন - এই উপহার কি আমরা চেয়েছি? আমরা তো শুধুমাত্র স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে C2 cost (পরে ব্যাখ্যা করছি) এর ওপর ৫০% বেশি এমএসপি দেবার দাবি করেছিলাম। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে চাহিলাম জল, তাড়াতাড়ি এনে দিলে একজোড়া বেল!
উপহারটি দেয়ার আগে আমাদের একবার জিজ্ঞেসও করলেন না?ভারত কিসান ইউনিয়নের নেতারা বলছেন - অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার পর আমাদের শঙ্কা জানিয়ে সরকারের কাছে সাত বার চিঠি পাঠিয়েছিলাম, কোনো উত্তর আসেনি।
∙ কুৎসা রটনা চলছে। এরা শুধু হরিয়ানা পাঞ্জাবের। এরা ধনী কৃষক। এরা ড্রাই ফ্রুট খাচ্ছে। এদের লঙ্গরের পয়সা কে জোটাচ্ছে? আসলে আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা কৃষক বলতে টিভিতে দেখা দিলীপকুমারের‘নয়া দৌড়’, নার্গিসের ‘মাদার ইণ্ডিয়া’, মনোজ কুমারের ‘উপকার’ সিনেমায় চাষি বলতে মাথায় পাগড়ি, হেঁটো ধুতি, কাঁধে লাঙল বা কোদাল চরিত্রে মজে আছি।
সবুজ বিপ্লবের পরে পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে। আজকের ট্রাক্টর চালানো এবং ছেলেকে শহরে পড়তে পাঠানো পাঞ্জাব-হরিয়ানার চাষির সঙ্গে এ ছবি মেলে না। তাই আমাদের বামপন্থী অন্তরাত্মা সরকারি প্রচারতন্ত্রের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে ওঠে - এ হল কুলাকদের আন্দোলন। দলিত- শোষিত-নিপীড়িত চাষি কোথায়? আসলে আমরা শুধু শ্রেণিচেতনার কথা বলি । কৌমী চেতনা বা কৌমী সংস্কৃতির কথা আমাদের মানসে নেই। তাই বোঝা সম্ভব নয় রাস্তায় বসে পড়া লাখো কিসানদের দুবেলা খাওয়াতে কেন গুরুদ্বারা লঙ্গর খোলে? কেন লোক-শিল্পী এবং পপ-গায়কেরা এদের পাশে দাঁড়িয়েছেন? কেন রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত লেখক এবং খেলোয়াড়েরা কৃষকদের আন্দোলনের সমর্থনে ‘লও ফিরে তব স্বর্ণমুদ্রা, লও ফিরে তব পুরস্কার’ ধ্বনি তোলেন?
আমরা দেখাতে চাইছি এ লড়াই আসলে দুটো ইকোসিস্টেমের লড়াই। পরিখার একদিকে শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে মিশে যাওয়া কৌমীচেতনা, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় বৃহৎ কর্পোরেট হাউস এবং প্রথম বিশ্বের সস্তায় জৈব ফসল ও খাদ্যান্ন পাওয়ার উপভোক্তাদের স্বার্থ।
• দুটো ইকোসিস্টেম এবং ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য (এমএসপি) - প্রথমটি হল সরকার নিয়ন্ত্রিত কৃষি বাজার এবং খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা।
∙ এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে মূল সমস্যা হল চাষিদের ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়া। কিন্তু সরকাররের আরেকটি দায়িত্ব হল আম নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী সুলভ অন্ন জোগানোর ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এটা বোঝা গেল যে ব্যাপারটা পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে জনতার একটা অংশ না খেয়েই থাকবে। বিশেষ করে যখন খাদ্যান্নের উৎপাদন জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তাই প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ১৯৫৫ সালে সংসদে‘এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট’পাশ করালেন যার মানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি খাদ্যান্ন মজুত করা আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। আর আনলেন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস) বা রেশন ব্যবস্থা যাতে গরীব মানুষ কম দামে অন্ততঃ মোটা চাল গম খেয়েও বাঁচতে পারে। এই আইনটিই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে বাতিল করেছেন। তাই আশঙ্কা, গণবন্টন ব্যবস্থা থেকেও সরকার হাত ধুয়ে ফেলবে না তো? এখন ভারত খাদ্যশস্য রফতানি করা দেশ। আমাদের দেশে চাল গম প্রয়োজনের তুলনায় উদ্বৃত্ত। সরকারের গোডাউনে বাড়তি অন্ন পচে যায়। তবু কিছু লোক অনাহারে মারা যায়। কারণ আয়বৈষম্য ও বিতরণ ব্যবস্থায় অসাম্য।
∙ ষাটের দশকের শেষে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে দুটো যুদ্ধ সামলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ারে মা-ভবানী। কিন্তু পরপর দুটো অনাবৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষে রেশনে দেওয়ার মত চাল-গমেও টান পড়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে কৃষি-অর্থনীতিবিদ এম এস স্বামীনাথন নিয়ে এলেন মার্কিন বিশেষজ্ঞ নরম্যান বোরলাগকে। এল মেক্সিকো থেকে উ্রচ্চ-ফলনশীল হাইব্রিড বীজ। শুরু হল কেমিক্যাল সার ও কীটনাশকের ব্যবহাসমৃদ্ধ ‘সবুজ বিপ্লব’। এর অনেক দুর্গুণ আছে, যেমন গ্রামাঞ্চলে আর্থিক অসাম্য ও জমির কেন্দ্রীকরণ বাড়িয়ে দেওয়া এবং জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট করা।
∙ কিন্তু এর সুফল হল এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে ভারত খাদ্যশস্যের ব্যাপারে আমদানি-নির্ভর দেশের বদলে খাদ্যে আত্মনির্ভর রফতানি-কারক দেশ হয়ে গেল। এখন সমস্যা হল উদ্বৃত্ত ফসলের, ফলে দাম পড়ে গেলে কৃষক খাবে কি, পরবে কি? আবার দাম বাড়ালে শহুরে অকৃষক জনতা রেগে যাবে। সরকারের হল শাঁখের করাতের অবস্থা।
∙ গত শতাব্দীর শেষে সরকার ওই সমস্যার মোকাবিলা করেছে তিনভাবে।
► ইনপুট কস্ট বা উৎপাদন ব্যয় কম করতে সরকার কৃষককে ভর্তুকি দিয়েছে বীজ ও কেমিক্যাল সারে, বিদ্যুৎ বিলে এবং সেচ করে।
► পুঁজির ব্যাপারে ব্যাংক ঋণে সুদের হারেও ভর্তুকি দিয়েছে।
► কৃষককে ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দিতে এগ্রিকালচারাল প্রোডাকশন অ্যান্ড মার্কেটিং কমিটি (এপিএমসি) গঠন করে সরকারি মান্ডি শুরু করেছে। যেখানে লাইসেন্স প্রাপ্ত ক্রেতা নিলাম করে ফসলের দর ঠিক করবে। কিসান হয় ওই দামে বিক্রি করবে, নয় সরকার ন্যূনতম সমর্থন মূল্য বা এমএসপি দরে (যা বাজার দরের চেয়ে সামান্য বেশি) কিনে নেবে। আর সরকার এর থেকেই রেশন দোকানে চাল গম দেবে।
∙ ইউপিএ-২ এর অন্তিম দিনগুলোতে মনমোহন সিং সরকার পাশ করল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা খাদ্য সুরক্ষা আইন, অর্থাৎ সরকারের দায়িত্ব হল পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য সরকারি ব্যবস্থায় মজুত করে সুনিশ্চিত করা যাতে কেউ না খেয়ে মরে না যায়। এর প্রয়োগে এল গণবন্টন ব্যবস্থা মজবুত করে নাগরিকদের দুটো ভাগে - গরীবি রেখার নীচে(বিপিএল) ও ওপরে (এপিএল) - ভাগ করে গম ২ টাকাএবং চাল ৩ টাকা ও ১০ টাকা কিলো দরে বিতরণ করা। পাশাপাশি সক্ষম মানুষেরা খোলা বাজারে বেশি দামে সরু চাল ও সরবতি গম কিনে খাচ্ছেন।
∙ সুপ্রীম কোর্ট তখন একধাপ এগিয়ে বলল যে কোনো জেলায় কেউ অনাহারে মারা গেলে তার জন্যে জেলার কালেক্টর দায়ী হবে। এও বলল যে সরকারি গুদামে উদ্বৃত্ত অন্ন পচতে না দিয়ে নিরন্নদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা উচিত।
∙ এর থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে এমএসপি শুধু কিসানের জন্যে পয়মন্ত না, সরকারের জন্যেও। নইলে খোলা বাজারে সরকারকে বেশি দামে চাল কিনে রেশন ব্যবস্থা চালাতে হবে।
বেশ, এর মধ্যে গলদ কোথায়?
আছে, ফাঁক ফাঁকি দুইই আছে, ভালর সংখ্যা সাতান্ন হলেও মন্দ তিন-চল্লিশ হবেই - রবি ঠাকুর বলে গেছেন।
► গোটা দেশে মান্ডি বা সরকারি এপিএমসি বাজার মাত্র ৭৪০০; তারমধ্যে ৪০০০ হল পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে।
► পাঞ্জাব, হরিয়ানা বাদ দিলে অধিকাংশ রাজ্যেই মান্ডি অনেক দূরে দূরে; মান্ডি পৌঁছনোর রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অবহেলিত। তাই নিরুপায় গরীব চাষি তার অল্প উৎপাদন স্থানীয় ফড়ের কাছেই বেচতে বাধ্য হয়।
► রেজিস্টার্ড ক্রেতা ও আড়তিয়াদের কমিশনের ফলে চাষি প্রাপ্যের চেয়ে কম দাম পায়।
► ওই বিক্রেতারা সম্পন্ন এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। ওরা নিজেদের মধ্যে সাঁট করে (কার্টেল বানিয়ে) ক্রয়মূল্য চড়তে দেয় না।
► সরকারি (এফসিআই) গোডাউনের ভান্ডারণ বা স্টোরেজ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। কাজেই চাষিরা চাইলেও সরকারের কাছে সবটা বিক্রি করতে পারে না। এছাড়া এফসিআইয়ের করাপশনও কৃষককে ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়ার পথে একটা বাধা।
► আর একটা ব্যাপার হল এমএসপি’র লিস্টিতে ২১টি নাম থাকলেও সরকার কেনে শুধু ধান ও গম, কখনও কখনও সামান্য ডাল। ফলে শাকসবজি ফলফুলের চাষ করতে গিয়ে চাষি বাজারের ওঠানামায় ধোঁকা খায়। একবছর পেঁয়াজ ও আলুর দাম চড়ল তো চাষি পরের বছর ধার করে আলু বুনল বিশাল লাভের আশায়। সবাই তাই করায় অতি-উৎপাদনের ফলে দাম ঝপ করে পড়ে গেল। নিরুপায় চাষি আত্মহত্যা করল।
অবশ্য সন ২০১৬ থেকে বর্তমান সরকার কৃষকের আত্মহত্যার ডেটা প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
কাজেই পুরনো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে যত বেচাকেনা, আর চলিবে না। কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় ধাঁচাগত পরিবর্তন বা সংস্কার চাই।
দ্বিতীয় ইকোসিস্টেম বা ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও’
বর্তমান সরকার তিনটি কৃষি সংশোধনী আইনের মাধ্যমে যে বিকল্প ব্যবস্থাকে ‘ঐতিহাসিক’ পদক্ষেপ বলে গর্বিত হচ্ছে তার মূল স্বরূপ হল কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে ঠিক শিল্পের মত খোলা বাজার তৈরি করা। কেন? সরকার পক্ষের যুক্তিগুলো শোনা যাক -
• ভারতের প্রায় ৫০% জনসংখ্যা আজও কৃষিতে নিযুক্ত। অথচ জিডিপিতে তার যোগদান ১৭% এর বেশি নয়। এদের মধ্যে ৮০% হল ছোটো ও প্রান্তিক চাষি; এবং দেখা যাচ্ছে চাষের জমির উপর জনসংখ্যার ভার অনেক বেশি। অনেক কৃষকই সারা বছর পুরো কাজ পায় না। এর জন্যে কৃষকদের মধ্যে অন্ততঃ অর্ধেক লোকজনের উচিত কৃষি ছেড়ে কারিগরি, শিল্প বা শহরে অন্য জীবিকা খুঁজে নেওয়া। এটা হলে পরিবারে কৃষিতে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমে প্রতি ব্যক্তি আয় বেড়ে যাবে।
• এছাড়া দরকার উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়া যা সরকার নয় মুক্ত বাজার ঠিক করবে। কীভাবে?
• কৃষক কেবল সরকারি মান্ডিতে ফসল বেচার বাধ্যবাধকতার থেকে মুক্ত হয়ে গোটা দেশে যেখানে ভালো দাম পাবে সেখানেই বেচতে পারবে। ফলে আয় বৃদ্ধি হবে।
•কেমিক্যাল সার, কীটনাশকের সাহায্যে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান-গমের চাষে খরচ প্রচুর, লাভের মার্জিন কম। তাই দরকার হল ধান-গমে আটকে না থেকে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপন্ন করা (ডাইভারসিফিকেশন)। কিন্তু চাষিরা ভয় পায় ফল-ফুল-শাক-সব্জীর বাজারের ওঠানামায়। এর সমাধান হিসেবে মোদী সরকার এনেছেন ‘কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং’। তাতে গাঁয়ের ছোট কৃষকেরা উপকৃত হবে। বড়ো পুঁজিপতি খবর রাখে শুধু দেশের বাজারের নয়, বিশ্ববাজারেরও। সে দেখবে কোন বিশেষ ফসল বা ক্যাশ ক্রপে বাঁধা বাজার আছে এবং লাভের মার্জিন ভালো। একজন পুঁজিপতির সঙ্গে চুক্তি করবে গোটা গাঁয়ের ছোটো বড়ো সব চাষি। দাম আগাম ঠিক করা হবে। কোন ফসল বোনা হবে তা ঠিক করবে চাষি নয়, পুঁজিপতি। চাষির কাজ খালি চাষ করা। বাজারের চিন্তা ওকে করতে হবে না। খোলা বাজারে দাম কমুক বাড়ুক, ওর কী ? ওতো আগাম চুক্তি অনুযায়ী যা দাম তাই পাবে। “তুফান যদি এসেই থাকে তোমার কিসের দায়”!
• এর জন্যে চাই কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ। সরকারের বিনিয়োগ হল ২০২০-২১এর বাজেটের ৫%, এবং জিডিপি’র ১% এরও কম। সরকার কত করবে? তাই চাই বেসরকারি বিনিয়োগ, দেশি-বিদেশি সব চলবে।
• ফসল ভান্ডারণ ইত্যাদিতে বেসরকারি বিনিয়োগ আনতে হলে কৃষিতে সরকারি হস্তক্ষেপ কমিয়ে বাজারনির্ভর এবং লাভজনক করতে হবে। স্থানীয় নয়, দেশ জোড়া বড়ো বিনিয়োগ চাই। কর্পোরেট পুঁজি এসে বিশাল সব স্টোর বানাবে। মিডলম্যানদের বাদ দেবে। বিশ্ববাজারে কৃষিজাত পণ্য রফতানি হবে। তাই মজুতের ওপর কোনো নিষেধ, কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ চলবে না।
• এই নতুন ইকো-সিস্টেমে কোনো মিডলম্যান, আড়তিয়া বা ফড়ে থাকবে না। এতে কিসান হবে বেচারাম, বড় পুঁজি হবে কেনারাম। এভাবে ফসল, বড়ো ক্রেতা ও অ-কৃষক শহুরে উপভোক্তার মধ্যেও সিধে সম্পর্ক তৈরি হবে। আদানির অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় বিশাল ‘সাইলো’ গোদাম এবং রিলায়েন্স বা অ্যমাজন রিটেইলস চেনে আমরা তার আগামী পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।
• গোটা দেশে একটাই বাজার হবে সেটা মোদী সরকারের e-NAM যোজনার মাধ্যমে ইন্টারনেট দিয়ে যুক্ত হবে। তাতে বঙ্গের কিসান নেটে চেক করে কেরালায় যদি ভালো দাম পায় তো সেখানে চাল পাঠানো বুক করে নেবে। ক্রেতা তার এজেন্ট দিয়ে চাষির দোরগোড়া থেকে ফসল তুলে নেবে। চাষির অ্যাকাউন্টে অনলাইনে পেমেন্ট এসে যাবে। কী মজা! যেন আমরা ঘরে বসে অ্যামাজন বা ওলেক্সে কেনাবেচা করছি!
• সমস্যা হল ১৪ এপ্রিল ২০১৬তে প্রধানমন্ত্রী এই ই-নাম যোজনার উদ্ঘাটন করেছিলেন। এখন সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী মেরেকেটে ১০০০ মান্ডি যুক্ত হয়েছে। মাত্র ১৫%। প্রশ্ন ১০০% লক্ষ্য প্রাপ্ত হলেও দেশের ৫ কোটি কৃষক অনলাইনে ধান গম ফল শাকশব্জী কেনা বেচা করবে? নেটওয়ার্ক? অবশ্য আগামী বছরে গোটা দেশে ৫-জি নেটওয়ার্ক কে আনছেন আমরা সবাই জানি।
বেশ, এর মধ্যে গলদ কোথায়?
► এই মডেলের পেছনে ধারণাটি(অ্যাসাম্পশান) হচ্ছে ক্রেতা কর্পোরেট হাউস এবং বিক্রেতা চাষিরা সমান সমান। যেন বার্সেলোনা ও রিয়েল মাদ্রিদের ম্যাচ! তাই দুপক্ষকে সমান স্বাধীনতা দিলে সবার ভালো হবে। কিন্তু বেসিক ধারণাটিই ভুল। সারাদেশ জুড়ে আম্বানী আদানীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি অত্যাধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গোডাউনের জালের সঙ্গে অবাধ মজুতের আইনি অধিকার যুক্ত হয়ে এমন বিশাল শক্তি যার সঙ্গে চাষিদের এঁটে ওঠার প্রশ্নই নেই। কারণ কৃষকদের ৮০% হল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি।
► নিও ক্ল্যাসিক্যাল ইকনমিক্সের ফ্রি মার্কেটের মডেলের পেছনে ধারণাটি হল ক্রেতা ও বিক্রেতা দুপক্ষেই এত অসংখ্য সদস্য যে কোনো একজন ক্রেতা (পড়ুন ব্যবসায়ী) বা কোনো একজন বিক্রেতা (পড়ুন কৃষক) একা বাজারের দামকে প্রভাবিত করতে পারবে না। দাম নির্ধারণ হবে অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতার দরাদরিতে চাহিদা ও যোগানের সাম্যবিন্দুতে।
► এটা টেক্সটবুকে বা পরীক্ষার খাতায় ভালো লাগে। কিন্তু যেই আপনি এর সঙ্গে এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্টে সংশোধন করে ক্রেতা-ব্যাপারিকে পণ্য স্টক করার অসীমিত আইনি অধিকার দিলেন অমনি ফ্রি মার্কেট ফ্রি কম্পিটিশন রইলো না। আদানি আম্বানিদের পুঁজির জোর ও জায়ান্ট আধুনিক গোডাউন(গোটা দেশে এর মধ্যেই আদানি ভদ্রলোক কয়েক শ’ ওই ‘সাইলো’ বানিয়ে ফেলেছেন) পিকচারে আসতেই ফসল ক্রেতাদের মধ্যে ‘লেভেল প্লে-গ্রাউন্ড’ এবং ফ্রি-কম্পিটিশন খতম। যদি একজন ব্যাটসম্যানকেই হেলমেট পরতে দেন আর বাকিরা ‘নট অ্যালাউড’, এবং লাগাতার বাম্পার দিতে থাকে লিলি ও টমসন? এরপর কী হবে বুঝতে কোনো রকেট সায়েন্স লাগেনা।
ছোটো, মাঝারি ও স্থানীয় ক্রেতারা আউট। ফলে একদিকে দু’তিনটে বড় কর্পোরেট ও তার প্রতিনিধি ফড়েরা (আম্বানি আদানি কি গোডাউনে গোডাউনে ঘুরে বেড়াবেন?) অন্যদিকে কয়েক লক্ষ মাঝারি ও ছোট চাষি। বাজার হল ডুয়োপলি বা অলিগোপলি।
► অধিকাংশ ছোটো চাষিরা ভালো দামের আশায় ফসলকে গুদামে ধরে রাখতে পারেনা। ওদের নতুন ফসল ওঠামাত্র কম দামে ছেড়ে দিতে হয় ধার শোধ করতে এবং ঘরের খরচা চালাতে। এই সহজ সত্যিটা অমর্ত্য সেন ও অশোক রুদ্র বোলপুরের কাছে ফিল্ড স্টাডি করে দেখিয়েছিলেন 'নন-ম্যাক্সিমাইজিং বিহেভিয়র অফ ফার্মার' প্রবন্ধে; ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে সম্ভবতঃ আশির দশকে বেরিয়েছিল।
► কিন্তু কর্পোরেট হাউসগুলো এক বছর ফসল গোডাউনে ধরে রেখে পরের বছর প্রথমে কেনার গরজ না দেখিয়ে চাপ দিয়ে দর কমাতে বাধ্য করতে পারে। অর্থাৎ, শক্তিমান ও দুর্বলের সমান স্বাধীনতা বাস্তবে শক্তিমানের স্বাধীনতা।
► তাই কৃষকদের মান্ডি ব্যবস্থায় ‘খাঁচার পাখি’ আর নতুন আইনে ‘মুক্ত বিহঙ্গম’ বলার কোনো মানে নেই।নীল আকাশে বাজপাখি ও টিয়া একসঙ্গে উড়লে কী হবে সবাই বোঝে। সেই রিস্ক নেয়ার চাইতে খাঁচার সুরক্ষা ছোটো চাষিদের জন্যে বেশি দরকারি।চাষির স্বাধীনতা রয়েছে যে কোনো বাজারে ফসল বেচার - সরকারি মান্ডি বা বাইরে প্রাইভেট মান্ডি - কথাটা সত্যি নয়। পরিস্থিতি ও ইকোসিস্টেম ঠিক করে ও কোথায় যাবে।
► আপনি ছাপোষা মানুষ। সামান্য সঞ্চয় কোথায় রাখবেন কম সুদে সরকারি ব্যাঙ্কে? নাকি বেশি লাভ করে বড়লোক হবার আশায় শেয়ার বাজারে? একদিকে আপনার অবস্থা বদলাবে না কিন্তু খারাপও হবে না, আপনি সেফ। অন্যদিকে রাতারাতি রাজা হতে পারেন বা ফকির। দেখুন, এই ফাটকায় বড়োভাই রাজা হয়েছে, ছোটোভাই ফকির।
চাষিরা আপনার আমার মতোই ভাবছে - চাইনা মাগো রাজা হতে! কিন্তু আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
► কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং হলে চাষি নিজের ইচ্ছেমতো ফসল বোনার স্বাধীনতা হারাবে। কর্পোরেট লাভের জন্যে বা নিজের শিল্পের কাঁচামালের জন্যে যে চাষ করতে হবে তাই ওকে করতে হবে। এইভাবে ক্যাশ ক্রপ বেড়ে এবং খাদ্যশস্যের চাষ কমে ‘খাদ্য সুরক্ষা’ মার খেতে পারে।
► এইখানেই দরকার সরকারের হস্তক্ষেপের। সরকারকে খেলতে হবে না, আম্পায়ারিং করলেই হবে। ফাউল হলে বা এলবিডব্লিউ হলে অন্তিম নির্ণয় কে দেবে? সরকার সেই দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে?
► কৃষি এবং শিল্পকেএক আসনে বসিয়ে দেখলে ভুল হবে। শিল্পপতির প্রেরণা হল মুনাফা এবং পুঁজি বৃদ্ধি। কৃষকের জমির সঙ্গে রয়েছে এক পুরুষানুক্রমিক আত্মীয়তা বোধ। জমিকে বা মাটিকে আদিম কাল থেকে সবাই মা বলে। খাদ্য ও সুরক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবে। চাষ করাকে কেন্দ্র করে কত গান, উৎসব লোকাচার গড়ে উঠেছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে?
► এই কৌমী চেতনা থেকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন “দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে, এমনি লক্ষ্মীছাড়া!” বাম সরকার এই আবেগকে বোঝেনি বলেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হয়েছে।
► কিছু মিডিয়া ও অর্থনীতিবিদ বলছেন যে এই আইনের ফলে খোলাবাজারের ওঠানামায় কেউ কেউ চাষবাস ছেড়ে অন্য জীবিকা খুঁজবে। ফলে জমির উপর চাপ কমে কৃষি আবার লাভজনক হবে।
► কৃষক পরিবার থেকে অর্ধেক লোক শহরে গিয়ে ভীড় করবে? কাজ কোথায় খুঁজবে? শিল্পে? পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে? এই প্রেস্ক্রিপশন সবচেয়ে মারাত্মক। এটি ২০০ বছর আগের ইকনমিক হিস্ট্রির ইউরোপীয় মডেল থেকে ধার করা। আজকের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে যোগ কোথায়?
► শহরে কাজ কোথায়? শিল্পে করোনা আসার আগে থেকেই ভারতে গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারি ৬.৫%।শিল্পে মন্দা। মনমোহন সিং সরকারের মুক্তবাজারের শিল্পনীতিতে হয়েছে রোজগারবিহীন বিকাশ বা ‘জবলেস গ্রোথ’। এখন তো ফ্যাশন হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগে আরও লেবার কমানো। উন্নত প্রযুক্তি মানেই মেশিন বেশি, শ্রমিক কম।
► শিল্পে বিক্রেতা নিজের পণ্যের দাম বলে দরাদরি শুরু করে। সার্ভিসসেক্টরের পণ্য অর্থাৎ বীমা, শিক্ষা, ডাক্তার, উকিল - সবার জন্যেই এটি সত্যি।
কিন্তু কৃষিপণ্য বা ফসলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো। ফসলের দাম ঠিক করে উৎপাদক কৃষক নয়, ক্রেতা ফড়ে।
► তাই ফসল বিক্রির খোলা বাজারে কৃষকের স্বাধীনতা সীমিত। কারণ ৮০% হল ছোটো ও প্রান্তিক গরীব চাষি। ওরা কর্পোরেটের প্রতিনিধির সঙ্গে কি করে দরাদরি করবে? ওদের নগদ টাকা চাই। ডিজিটাল পেমেন্ট বা একমাস পরে টাকা পেলে ওদের চলবে না।
► মুখ খুলেছেন মোদী সরকারের মন্ত্রীসভা থেকে কয়েক্ মাস আগে ইস্তফা দেয়া হরসিমরত কৌর বাদল। বলছেন আম্বানীর জিও ধরিয়ে সব প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দিয়ে শেষে সমানে দাম বাড়াচ্ছে, নতুন আইনে স্বাধীনতা পাওয়া কর্পোরেট হাউস ঠিক ওইভাবে প্রথমে চাষিদের লোভ দেখিয়ে মন্ডীর বাইরে আনবে, তারপর একচেটিয়া অধিকার জমিয়ে ওদের লুঠে নেবে।
► এপিএমসি অ্যাক্টের মাধ্যমে মান্ডি ব্যবস্থা তুলে দিলে কি সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে? বিহার, মহারাষ্ট্র ও কেরালার অভিজ্ঞতা কী বলে?
প্রধানমন্ত্রী বলছেনঃ কৃষিসংস্কারের উদ্দেশ্যে তৈরি এই তিনটি আইন পাশ হওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা! এবার শোষিত পরাধীন কৃষকেরা খাঁচা থেকে বেরোতে পারবে, স্বাধীন হবে! কীভাবে? কৃষিপণ্যের বাজার এখন থেকে সরকার-নিয়ন্ত্রিত না হয়ে হবে ‘খোলা বাজার’, যাতে অসংখ্য ক্রেতা (প্যান বা আধার কার্ডধারী বড় ব্যবসায়ী বা তাদের এজেন্ট) এবং অসংখ্য ক্রেতা (ছোটো এবং বড়ো কৃষক) নিজেদের মধ্যে দরাদরি করে দু’পক্ষের সুবিধাজনক দরে ফসল কেনাবেচা করবে। তাতে চাষির লাভ?
এক, কৃষক নিজের উৎপন্ন দ্রব্যের দাম নিজে ঠিক করতে পারবে এবং আড়তিয়া বা মিডলম্যানদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হবে।
দুই, দেশের এক প্রান্তের কৃষক তার নিজের সুবিধে মতো দেশের আরেক প্রান্তে বা যে কোনো জায়গায় নিজের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবে। এভাবে একটি রাষ্ট্রীয় কৃষিপণ্যের বাজার রূপ নেবে।
তিন, কন্ট্রাক্ট ফারমিং বা চুক্তিমাফিক চাষের মাধ্যমে পণ্যের বিক্রয় মূল্যের দাম চাষ শুরু করার আগে থেকেই ঠিক হয়ে থাকবে। ফলে বাজারদরের ওঠানামার ঝক্কি চাষিকে পোয়াতে হবে না। এর ফলে কৃষকের আয় ২০২২ নাগাদ দু’গুণ হয়ে যাবে।ব্যস, ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে কৃষকদের এতদিনের সমস্যা তিন তুড়িতে উড়ে গেল।
চার, সরকারের খবরদারি এবং ট্যাক্স বন্ধ হলে কৃষি লাভজনক উদ্যোগ হবে। কৃষিতে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট আসবে। উন্নত প্রোডাকশন টেকনোলজি আসবে, বিশাল বিশাল হিমঘর, সাইলো সব তৈরি হবে। দেশের কৃষি উৎপাদন বেড়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিযোগ্য হবে। ফলে জিডিপি বাড়বে।
বাস্তব অবস্থা কী বলে?
নীতিশ কুমার সরকার ২০০৫ সালেই আইন পাশ করে বিহারকে মান্ডি ব্যবস্থার বাইরে নিয়ে এসেছে। কিন্তুবিহারের চাষিদের খোলাবাজারে ধান বেচে কোনো উন্নতি হয়নি।ওরা আজও ভারতের কৃষক সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের অন্যতম।এটাই বোঝায় যে নতুন আইনে খোলাবাজার ব্যবস্থায় চাষির কোন উন্নতি হবে না।ওদের মধ্যে যারা সম্পন্ন, তারা ফসল পাঞ্জাবের মান্ডিতে বেচতে নিয়ে যায়।
কেরালায় মান্ডি আইন নেই।কিন্তু কেরালা একমাত্র রাজ্য যে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে সঠিক ভাবে C2 cost এর দেড়গুণ (১৫০%) এম এস পিতে ধান কিনছে।ওখানকার চাষি কেন হরিয়ানা পাঞ্জাব নিয়ে মাথা ঘামাবে?
বলে রাখা ভালো, গত কয়েক বছর ধরে কৃষক আন্দোলন হচ্ছে ভারত সরকার যাতে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে এমএসপি ঠিক করে সেই দাবিতে। সরকার এখানে সত্যি বলছে না। ওরা দিচ্ছে C1 cost এর ১৫০%। যা অনেক কম। এছাড়া মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, হিমাচল প্রদেশ ইত্যাদি আগেই মান্ডি ব্যবস্থার আঁটাপত্তি অনেক ঢিলে করে দিয়েছে।
বঙ্গে কৃষকেরা সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে সামিল হননি কেন?
বঙ্গে অনেক কম কৃষক মান্ডিতে কেনাবেচা করে। কারণ অধিকাংশ কৃষক (৯০%) ছোটো বা গরীব চাষি। ওদের পক্ষে অল্প ফসল নিয়ে দূরের মান্ডিতে গিয়ে বিক্রী করে কখন সরকারের চেক আসবে তার জন্যে অপেক্ষা করা পোষায় না। (4thpillars.com এবং গুরুচন্ডালি ডটকমেশান্তিনিকেতনের অধ্যাপক/কৃষক বিজয় মুখার্জির বক্তব্য দেখুন)।
তারা বাধ্য হয় অনেক কমদামে নগদে ঘরের দরজায় ধান বিক্রি করতে। তাদের বীজ ও সারের ধার শোধ করতে হবে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। বৃষ্টির আগে ছাত মেরামত করতে হবে। ছেলেমেয়েকে স্কুল বা কলেজে ভর্তি করতে হবে।
অর্থাৎ অপর্যাপ্ত এবং ঘুণধরা মান্ডি ব্যবস্থার জন্যে শুধু বঙ্গ নয় গোটা দেশের গরীব কৃষক(দেশের ৮৫%) মান্ডিতে নয়, খোলা বাজারে বা ঘরের দরজায় ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। মানে এই মান্ডি ব্যবস্থা নেহেরুজী যে উদ্দেশ্যে করেছিলেন তা উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ। তাহলে অমন মান্ডি ব্যবস্থা বঙ্গে এবং বেশির ভাগ রাজ্যে থাকলে বা না থাকলে কৃষকের আপাততঃ কিস্যু আসে যায় না।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? পশ্চিমবঙ্গের চাষীদের ওপর কি নতুন কৃষি বিল কোনো প্রতিকূল প্রভাব ফেলে না?
∙ ফেলে , সেটা বেশ দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। কারণ মান্ডি ব্যবস্থা অকেজো করার আসল উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে সরকারের এমএসপিতে চাল-গম কেনা বন্ধ করা এবং পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া। তখন আর গরীবদের (বিপিএল কার্ডধারী) ২ টাকা ৩ টাকায় গম ও চাল এবং অন্যদের (এপিএল কার্ড) ১০টাকা কিলোয় চাল দেওয়া বন্ধ হবে। কাজেই এই আন্দোলনের মূল দাবিঃ “এমএসপি’র চেয়ে কম দামে কেনা আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করা হোক”আসলে বঙ্গ সমেত গোটা ভারতের গরীবমানুষ ও চাষিদের স্বার্থরক্ষার দাবি।তাহলে বঙ্গের গরীব চাষিও ঘরের দরজায় বসে ফসল অপেক্ষাকৃত ভালো দামে বেচতে পারবে। এইরকম এমএসপি আইন হলে সেটা গোটা দেশের চাষিদের রক্ষা কবচ হবে। সে মান্ডিতেই বেচুক, কি কর্পোরেটকে অথবা গাঁয়ের ধনীকে।
তাহলে কীরকম সংস্কার চাই?
এই তিনটে আইন যেন মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলা গোছের সংস্কার। সরকারি মান্ডি ব্যবস্থায় গলদ আছে। সেগুলো না শুধরে সরকারের ভূমিকাই বাতিল করে দেওয়া? বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী এবং স্বরাজ ইন্ডিয়া দলের প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্র যাদবের ভাষায় এই আইন এপিএমসি অ্যাক্ট ও মান্ডি ব্যবস্থার ভাঙা ছাদের ফুটো সারানোর বদলে কিসানদের বাড়ি থেকে বের করে খোলা আকাশের নীচে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
বুঝলাম। কিন্তু কী করা দরকার? অনেক কিছুই -
∙ সবচেয়ে আগে দরকার মান্ডি ব্যবস্থা বন্ধ না করে গোটা দেশের জন্যে বিস্তৃত করা। প্রথম পর্যায়ে কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস্ অ্যান্ড প্রাইসেস্ (সিএসিপি) এর অনুশংসা অনুযায়ী ৪২,০০০ মান্ডির এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে কৃষকেরা ক্ষেত থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে একটি মান্ডি পায়।
∙ দরকার এফসিআইয়ের গোডাউনের চেন তৈরি করা, এটা আদানি আম্বানিদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো। এখনও কৃষি পরিকাঠামো এবং গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ১% এর বেশি নয়।
∙ দরকার কৃষকেরা যাতে ধান-গম ছাড়াও অন্য ফসল যেমন ফল-ফুল-শাকসব্জী চাষের দিকে যান, তার জন্যে নগদ ইন্সেন্টিভ দেওয়া। ষাটের দশকের শেষে তৎকালীন সরকার অনিচ্ছুক কৃষকদের ওই উচ্চফলনশীল চাষ এবং গোবরের বদলে কেমিক্যাল সার ব্যবহার করতে অমনই ‘ইন্সেন্টিভ’ দিয়ে ফল পেয়েছিল।
∙ দরকার খাদ্য সুরক্ষা এবং কৃষকদের স্বার্থের কথা ভেবে রক্ষাকবচ হিসেবে এমএসপিকে আইন করে বেস্ প্রাইস্ করে দেওয়া এবং অন্য ফসল যেমন ফল-ফুল-শাকসব্জীকেও এর অধীনে আনা।
∙ এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্টের পরিবর্তন বাতিল করে অতি আবশ্যক বস্তু, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের ব্যাপারে মজুতদারিকে নিয়ন্ত্রণ করা।তাহলে ক্রেতা ব্যাপারিদের মধ্যে কিছুটা সমানে সমানে কম্পিটিশন হতে পারবে।
∙ কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর চুক্তি ত্রিপাক্ষিক হোক। তাতে চাষি এবং কর্পোরেট ক্রেতার সঙ্গে সরকারও গ্যারান্টর হোক।
∙ ফসল বীমা সুরক্ষা কোম্পানী অনিল আম্বানী আদি কর্পোরেটের হাতে ছেড়ে না দিয়ে সরকার আগের মত দায়িত্ব নিক। বীমা কোম্পানি সরকারের জন্যে মুনাফা দেয়, এটা প্রমাণিত।
∙ মান্ডি এবং ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার পরিচালনা ব্যবস্থায় করাপশন ঠেকাতে আন্তরিক চেক সিস্টেম মজবুত করা হোক।
শেষ করি কিছু প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে।
প্রশ্নঃ এই আন্দোলনে কেবল পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের চাষিরাই বেশি কেন?
• সবুজ বিপ্লবের ফলে পাঞ্জাবে ও হরিয়ানায় দ্রুত গড়ে উঠেছে মধ্য কৃষকদের এক সম্পন্ন সমাজ। লাগোয়া পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেও এর ছোঁয়া। যদিও কৃষিতে নিযুক্ত চাষিদের ৩০% কৃষিশ্রমিক।
∙ খেয়াল করুন গোড়ায় বর্ণিত গত শতাব্দীর ইকোসিস্টেমে পাঞ্জাব হরিয়ানাই সরকারের খাদ্য ভান্ডারে সবচেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত ফসল জমা করে গোটা দেশকে খাইয়েছে। কয়েক বছর আগেও ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গমের মোট ৭০% এবং চালের ৬০% যোগাত ওই তিনটি অঞ্চল।
∙ কৃষিতে ট্যাক্স নেই, অথচ গ্যারান্টি রয়েছে যে মান্ডিতে অবিক্রীত চাল-গম সরকার এমএসপি দরে কিনে নেবে যা কিনা সবসময় বাজার দরের চেয়ে একটু বেশি। ফলে এই অঞ্চলের কৃষকদের উইন-উইন সিচুয়েশন। এবং গড়পড়তা আয় গোটা দেশের তুলনায় অনেক বেশি। যদি এক একরে একটি ফসলে দেশের অন্য এলাকায় কৃষকের গড়পড়তা নীট আয় বছরে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা, তো পাঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তর প্রদেশে এই আয় ১৪০০০ টাকা।
ওরা চিন্তিত নতুন আইনের প্রয়োগে ওদের ‘সুরক্ষিত’ ইকোসিস্টেম ভেঙে যাবে এই আশঙ্কায়।
প্রশ্নঃ মিডিয়ায় তো জ্ঞানীগুণীরা বলে চলেছেন যে এমএসপির সুবিধে পায় দেশের মাত্র ৭% কৃষক। এমনকি বিজেপির এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত শান্তাকুমার কমিটির বক্তব্যও তাই। কারণ ওই ৭% কৃষকই শুধু এপিএমসি সরকারি মান্ডিতে ফসল বেচে। তাহলে অমন মান্ডি বা এপিএমসি ব্যবস্থার প্রয়োজন কি? এসব তুলে দেয়াই উচিত। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার জন্যে করদাতাদের পয়সা নষ্ট করারই কি মানে? এই কমিটি ২০১৫তে রেকমেন্ড করে যে কৃষকদের থেকে শস্য এফসিআইয়ের গোডাউনে রাখার কাজটা রাজ্যসরকার এবং প্রাইভেট সেক্টরের হাতে তুলে দেওয়া হোক।
তাই তো বর্তমান সরকার আইন বদলে দিচ্ছে। এবং সেপ্টেম্বর ২০১৯শে অর্থমন্ত্রী সীতারমণ এবং তার আগে নীতি আয়োগ এই কথাই বলেছিলেন।
প্রশ্নঃ ওরা কি মিত্থ্যা কথা বলছেন?
না; মিথ্যা নয়, কিন্তু অর্ধসত্য। লুকোনো হচ্ছে যে গোটা দেশের ৭০০০ মান্ডির ৪০০০ এর ওপর শুধু এই এলাকায় রয়েছে। ফলে মান্ডিতে যাওয়া ৭% এর ৮০% কৃষক ওই এলাকার। এবং ওই অঞ্চলের ৯০% মান্ডিতেই ধান বিক্রি করেন।
প্রশ্নঃ কিন্তু এই ধনী কৃষকেরা আন্দোলন করছে, কেন?
আমি বলব, এই রহস্যের চাবিকাঠি পেতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “ছিনিয়ে খায়নি কেন” গল্পটি দেখুন। যোগী ডাকাতের নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষে অনাহারে থাকা মানুষ টুপ করে রাস্তায় মরে পড়ে গেছে কিন্তু ছিনিয়ে খাওয়ার কথা ভাবেনি। বরং একবার লুঠের ভাত পেটে পরার পর গুদাম লুঠতে রাজি হয়েছে।
মানুষ লড়াইয়ে নামে চরম দারিদ্র্য থেকে নয়, সেটা মেনে নেয় ভবিতব্য বা বিধির বিধান মেনে। লড়তে রাজি হয় যে সুবিধা বা অবস্থায় রয়েছে (পড়ুন বর্তমান ইকোসিস্টেম) তা ধ্বংস হবার সম্ভাবনা দেখলে। যে কারণে সিপাহী অভ্যুত্থানে নানাসাহেব, তাঁতিয়া টোপী, লক্ষ্মীবাঈ ও কুঁয়র সিং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রশ্নঃ সরকার যে বলছে মান্ডির বাইরে খোলা বাজারে বিক্রি করলে কৃষকেরা ভালো দাম পাবে?
অন্ততঃ ন’টি রাজ্য এপিএমসি থেকে বেরিয়ে গেছে। কারণ কৃষি রাজ্যের এক্তিয়ারে। কিন্তু তাদের আয় কি দ্বিগুণ হয়েছে? বিহারে নীতিশ কুমার ১৫ বছর আগে ওই কৃষি উৎপাদন এবং বিপণন কমিটি (এপিএমসি) আইনের থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ফলটা কী হয়েছে? আজও বিহারের কৃষক এবং কৃষি ভারতে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের অন্যতম। এমএসপির ঠেকনো থাকায় যে ধানের দাম পাঞ্জাবে ১৮০০ টাকা কুইন্টাল, সেটা পূর্ব বিহারে অসহায় চাষিরা ১১০০-১২০০ টাকা কুইন্টলে বেচতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রশ্নঃ চাষিরা কী চাইছেন?
ওঁরা চাইছেন যে এমএসপি আইন হলে গোটা দেশের চাষিদের লাভ হবে। এই এমএসপি দামের বটমলাইন হোক। এর নীচে বেচলে শাস্তি হোক। এদের সমর্থনে কৃষি অর্থনীতিবিদ দেবিন্দর শর্মা বলছেন যে শান্তাকুমার কমিটির কৃষিকে কর্পোরেট পুঁজির অধীন করার রেকমেন্ডেশন বাতিল করে কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস্ অ্যান্ড প্রাইসেস্ (সিএসিপি)এর রেকমেন্ডেশন মেনে নিয়ে ৭০০০ মান্ডির জায়গায় গোটা দেশে সংখ্যা বাড়িয়ে অন্ততঃ ৪২,০০০ করা হোক। তাহলে চাষির ক্ষেত থেকে মান্ডির গড়পড়তা দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের বেশি হবে না।
প্রশ্নঃ সরকার বলছে চাষিদের স্বামীনাথন কমিশনের হিসেবে বর্ধিত এমএসপি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু চাষিরা মানছে না। সত্যিটা কী?
সরকারের বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক নয়। স্বামীনাথন কমিশন দু’রকম উৎপাদন ব্যয়ের কথা বলেছেঃ সি-১ ও সি-২। সি-১ = (বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ কর, বিদ্যুৎ, পরিবহন, ডিজেল, হালগরু ইত্যাদি) + পারিবারিক শ্রম। সি-২ = সি-১ + অপর্চুনিটি কস্ট, (অর্থাৎ কৃষক যদি চাষে খরচা না করে ওই টাকাটা ব্যাংকে রাখত বা অন্য কোনো বিনিয়োগে যা আয় করত সেটা)। স্বামীনাথনের সুপারিশঃ সরকারের উচিত চাষিদের থেকে সি-২ রাশির দেড়গুণো বা ১৫০% দামে ফসল কেনা। অর্থাৎ, এমএসপি হবে সি-২ খরচের ১৫০%। চাষীরা তাই চাইছে। কিন্তু সরকার এমএসপি হিসেবে দিচ্ছে সি-১ এর ১৫০%।
প্রশ্নঃ এই অভিযোগটি কি সত্যি যে কংগ্রেস সরকারও এই ধরনের রিফর্ম করে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনকে খোলা বাজারের আওতায় আনতে চেয়েছিল?
পুরোপুরি সত্যি। এমনকি গত ২০১৯-এর কংগ্রেসের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো বলছে - “Congress will repeal the Agricultural Produce Market Committee Act and make trade in agricultural produce-free from all restrictions’.[1]
প্রশ্নঃ এটাও কি সত্যি যে সেই সময় , মানে ইউপিএ-২ সরকারের আমলে বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারাই এর বিরোধিতা করেছিলেন?
এটাও সত্যি। আজ বিজেপি মন্ত্রীরা কৃষকদের ‘আড়তিয়া’ বা ‘বিচৌলিয়া’দের খপ্পর থেকে বের করে আনার কথা বলছেন, আন্দোলনের পেছনে আড়তিয়াদের টাকা বলে আঙুল তুলছেন। কিন্তু সন ২০১২র ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর বিজেপির দুই খ্যাতিমান সাংসদ (বর্তমানে প্রয়াত) সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলি কংগ্রেসের এপিএমসি তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে মান্ডি ব্যবস্থার পক্ষে ‘স্পিরিটেড ডিফেন্স’ দিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। উৎসাহী পাঠকেরা ইউটিউবে ওঁদের চমৎকার যুক্তিতর্ক শুনতে পারেন।
∙ জেটলির বক্তব্য ছিল - আপনারা মশাই ক্যাপিটালিস্ট মার্কেটের ডায়নামিক্স কিস্যু বোঝেননি। গোড়ায় গলদ। আড়তিয়া নামক স্থানীয় ছোটোখাটো মিডলম্যানদের সরিয়ে দিলে তার জায়গা নেবে কর্পোরেটের রাঘববোয়াল মিডলম্যানেরা। চাষির সর্বনাশ হবে।
∙ সুষমার বক্তব্য - আড়তিয়ারা স্থানীয়, চাষিদের পরিচিত এবং ওদের ইকোসিস্টেমের অংশ। এরা ওদের সময়ে অসময়ে সার-বীজ, নগদ টাকা ধার এবং দরকার হলে মেয়ের বিয়েতে সাহায্য সবই করে।
∙ বাকিদের কথা ছাড়ুন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গত ১২ এপ্রিল, ২০১৬তে ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল মার্কেটের অনলাইন কেনা বেচার প্ল্যাটফর্ম বা e-NAM এর উদ্বোধন করতে গিয়ে জোর দিয়ে বলেন যে আড়তিয়ারা কৃষি পণ্য কেনাবেচার গুরত্বপূর্ণ অঙ্গ। এরাও এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লাভবান হবে। আজ নতুন আইনে কয়েক হাজার আড়তিয়া কাজ হারাচ্ছে। এরা যে সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে সামিল হবে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?
প্রশ্নঃ কৃষকদের প্রধান দাবি, অর্থাৎ মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস্(এমএসপি)কে আইন বানানো কতটা যুক্তিযুক্ত? এতে কী বাজারের নিয়মের উল্লংঘন হবেনা?
এটা নিও-লিবার্যা ল মিডিয়া ও অর্থনীতিবিদদের সবচেয়ে বড়ো কুযুক্তি। শিল্পজগতে প্রাইভেট সেক্টরেও মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট থাকায় এতদিন তো কোনো ফ্রি-মার্কেট নীতির দোহাই দেওয়া হয়নি। তাহলে কৃষি বিপণনের ক্ষেত্রে এমএসপি বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসে আপত্তি কেন? দুটোই মূলতঃ বেঁচে থাকার অসম যুদ্ধে দুর্বলের রক্ষা কবচ।
প্রশ্নঃ বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিতকৃষির করপোরাটাইজেশন কি স্থায়ী সমাধান নয়? ইউরোপ আমেরিকার অভিজ্ঞতা কী বলে?
কৃষি অর্থনীতিবিদ দেবেন্দ্র শর্মা সম্প্রতি বিভিন্ন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছেনকেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবিতকৃষির এই খোলাবাজারের মডেলটি নতুন কিছু নয় বরং ইউরোপ আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই পরীক্ষিত একটি ব্যর্থ মডেল। এর ফলে ওদের দেশে কৃষকদের আমদানি বছরের পর বছর সমানে কমছে এবং কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। প্রথম বিশ্বের ওসব দেশে কৃষি এবং তারপণ্য রপ্তানি মূলতঃ সরকারি সাবসিডি নির্ভর। প্রতিবছর বিশ্ব ব্যাপার সংগঠন বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন প্রতিবছর রীতিমতো বৈঠক করে এই ভর্তুকির পরিমাণ ঠিক করে।[2]
আমেরিকাতে খোলাবাজারের হাতে কৃষিকে তুলে দেওয়ায় আজ কৃষি উৎপাদনে আমেরিকা বিশ্বে অগ্রগণ্য, কিন্তু কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণ ও কন্ট্রাক্ট ফারমিং-এর ফলে জনসংখ্যার মাত্র ২% কৃষিতে এখনও মাথা গুঁজে আছেন এবং তার ৮০% হল ছোটো এবং প্রান্তিক কৃষক। কিন্তু আমেরিকার জিডিপিতে কৃষির যা অবদান তার থেকে অনেক বেশি সরকার সাবসিডি দেয়, ৮০% থেকে ৯০%। ইউরোপেও একই অবস্থা। কিন্তু ভারতে কৃষির যোগদান জিডিপির ১৭%, অথচ সরকারের কৃষিতে ব্যয় জিডিপির ১% বা বাজেটের ৫%। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ০৯/০৩/২০২১)।
দিল্লির জেএনইউয়ের ‘সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ অ্যান্ড প্ল্যানিং’ এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিমাংশু’র বক্তব্য ভাবার মতো। উনি বলছেন যদিও কৃষকদের মান্ডি ব্যবস্থার অদক্ষতা/ত্রুটি/আড়তিয়াদের কার্টেল নিয়ে প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে তবু তারা এটাকে তুলে দেয়ার বদলে সংস্কারের পক্ষপাতী। কেন? ওদের চোখে বর্তমান ইকো-সিস্টেমে আড়তিয়ারা গাঁয়ের কৃষকদের জন্যে ‘তথ্য, খবরাখবর, বীজ-সার এবং কখনও কখনও বিনা কোল্যাটারাল সরল ঋণ পাওয়ার উৎস’।এছাড়া যেভাবে ওদের প্রতিনিধিদের, মান্ডি সংগঠনের বা রাজ্যসরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে আইনগুলো ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হল তাতে ওরা ক্ষুব্ধ। ওরা বলছে এই আইনগুলো কৃষকদের নয়, বড়ো কর্পোরেটদের কৃষিতে যা খুশি করার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। এর আগে কৃষি উৎপাদন বা বিপণন নিয়ে যত সংস্কার হয়েছে তাতে সবসময় স্টেক-হোল্ডারদের মতামত নেওয়া হয়েছে।[3]
গত ১১ ডিসেম্বর মুখ খুলেছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা কৌশিক বসু। বলছেন ভারতের কৃষিতে সংস্কার দরকার। কিন্তু এই তিনটে আইন কর্পোরেটের স্বার্থে তৈরি এবং কৃষকদের জন্যে ক্ষতিকর। উনি দেখিয়েছেন একই মডেলে কন্ট্রাক্ট ফারমিং করে ফিলিপাইন্সে চাষিরা প্রথম তিনবছরে ভালো দাম পেল। তারপরই কর্পোরেটের বিশাল মজুতের ফলে ওরা বাধ্য হল অনেক কম দামে ফসল বেচতে এবং অনেক এরিয়ায় খাদ্য শস্যের বদলে উন্নত দুনিয়ার চাহিদা অনুযায়ী কমার্শিয়াল ক্রপের চাষ করে বিরাট খাদ্য সমস্যা দেখা দিল। তারপর ম্যানিলায় ব্যাপক ফুড রায়ট।
অর্থনীতিবিদ উৎসা পটনায়েক বলেছেন যে কন্ট্রাক্ট ফারমিং এবং আয় বাড়াতে ফসল রপ্তানির বড়ো বড়ো কথার আড়ালে যা হবে তা হল আমেরিকা/ইউরোপে ইথানল/মিথানলের জন্য খাঁটি অর্গানিক কাঁচামালের জোগান দিতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমানো। ফলে আগামী দিনে ভারতেও ফের খাদ্য সমস্যা দেখা দেবে। (দি হিন্দু, ৩০/১২/২০২০)।
তাই সরকার যদি জিদ ছেড়ে কৃষকদের কথা মেনে এই আইন তিনটে বাতিল করে এবং কৃষকদের প্রতিনিধি ও অর্থনীতিবিদদের এক কমিটি বানিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে নতুন বিল আনে তাহলে তাঁর গৌরব বাড়বে বই কমবে না।
কিন্তু সরকার কি ধর্মকথা শুনবে? তাহলে এই করোনা বাজারে সাত তাড়াতাড়ি ওই তিনটে বিল অমন হুড়ুম দুড়ুম করে পাশ করালো কেন? অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ি একটি প্রবন্ধে (4thpillars.com দেখুন) কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন - এই বিলগুলো আসলে আনা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের পুরনো দুই পেয়ারের কর্পোরেট বন্ধুদের সহায়তার জন্যে।
হঠাৎ খবরটা চোখে পড়ল যে আরটিআই অ্যাক্টের চিফ কমিশনার ভদ্রলোক ইলেকশন ফান্ডে ডোনারদের নামগুলো জানানোর আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।
তথ্যঋণঃ
[1] Ashok Gulati, Indian Express, 28th September, 2020.
[2] দেবেন্দ্র শর্মা, ২৪ সেপ্টেমবর, ২০২০।
[3] হিমাংশু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০।