আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
সমসাময়িক
চিন নিয়ে এত চিন্তা?
কিমিন কোনো পর্যটন কেন্দ্র নয়। তীর্থস্থানও নয়। কোনো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এখানে অনুপস্থিত। এমনকি প্রশাসনিক কারণে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নয়। নেহাতই একটা ছোটখাটো গ্রামীণ এলাকা। কিমিন আসলে তেইশটি গ্রামের সমাহার। সম্মিলিত জনসংখ্যা ২ হাজার ১৬৮। নিশি (Nishyi) জনজাতির ২৫২টি পরিবারের বসবাস এই তেইশটি গ্রামে। পাহাড় থেকে সমভূমির দিকে এগিয়ে চলা পথের দু'ধারে ছড়িয়ে আছে শ'আড়াই বাড়ি আর লাগোয়া কৃষি জমি। প্রান্তিক এলাকার কৃষি নির্ভর এই গ্রামীণ জনপদে শিক্ষার হার কিন্তু ৯৬ শতাংশ। কিমিন থেকে রাজ্যের রাজধানী শহরের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। আর সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেই রেল স্টেশন আবার অন্য রাজ্যের অন্তর্গত।
অসম আর অরুণাচল প্রদেশের সীমানায় অবস্থিত পাপুম পারে জেলার কিমিন সত্যি সত্যিই একটি প্রান্তিক গ্রামীণ জনপদ। তবে গাঁয়ের পাশেই গড়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর এক বিশাল ছাউনি। অরুণাচল প্রদেশের পাপুম পারে জেলার কিমিন ছাউনি প্রকৃত অর্থে এক সুবিস্তৃত শহুরে আবাসন। ফৌজিদের মেস্ ছাড়াও রয়েছে সপরিবারে থাকার কোয়ার্টার। খেলার মাঠ, অডিটোরিয়াম, বাজার থেকে শুরু করে রয়েছে নাগরিক জীবনের জন্য উপযোগী সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধার যাবতীয় বন্দোবস্ত এবং প্রতিবেশী হিসেবে গ্রামীণ কিমিন আর কিমিন ছাউনি দিব্যি শান্তিতে কালাতিপাত করে চলেছে।
তবুও অতি সম্প্রতি কিমিন সংবাদমাধ্যমে হঠাৎ করেই জায়গা করে নিল। দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গত ১৭ জুন কিমিন পৌঁছে এক ডজন রাস্তার উদ্বোধন করলেন। কিমিন থেকে পোতিন পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি তিনি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে উদ্বোধন করলেন। বাদবাকি এগারোটির হল ই-উদ্বোধন। কোনোটাই খুব দীর্ঘ সড়ক নয়। তবে সবকটি রাস্তাই মূলত অরুণাচল প্রদেশে অবস্থিত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন আধা-সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত রাস্তার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুপস্থিত। এমনকি সড়ক মন্ত্রকের মন্ত্রীও আসেননি। অবিশ্যি তা-তে কী আসে যায়! এখনকার ভারত সরকার কোনোরকম শিষ্টাচারের মান্যতা মেনে চলতে আগ্রহী নয়। এখন পরিবেশ মন্ত্রী ভ্যাকসিন নীতির ব্যাখ্যা দেন। অক্সিজেনের অভাবে যখন সংক্রমিত রোগীরা খাবি খেতে খেতে প্রাণ হারাচ্ছেন তখন রেলমন্ত্রী বললেন যে সকলেই একটু করে কম শ্বাস নিলেই অক্সিজেনের টানাটানি হত না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী জানালেন যে অপুষ্টি নয়, মোটা হয়ে যাওয়াই এখন সমাজের সব চাইতে বড়ো সমস্যা। স্কিল ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বলেছিলেন যে ক্রুজ বা প্রমোদতরণীর পর্যটকদের পরিষেবার জন্য ভারতীয় তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকলে অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেন তাঁর মতো সকলেই পেঁয়াজ বর্জন করলেই পেঁয়াজের দামের ঝাঁজ সহ্য করতে হবে না। এইসব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য অথবা নিদান দেওয়ার পরিসরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ার পর জনৈক বাবাজীকে পাশে বসিয়ে তিনি জরিবুটি ব্যবহারের নিদানপত্র দিয়েছেন। প্রথিতযশা চিকিৎসক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সুবাদে পরামর্শ দিচ্ছেন যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশের মানুষের বেশি করে ডার্ক চকলেট খাওয়া উচিত। দারিদ্র নিপীড়িত দেশবাসীকে অতি মহার্ঘ ডার্ক চকলেট খাওয়ার পরামর্শ মনে করিয়ে দেয় ফরাসি বিপ্লবের সময়কার ফ্রান্সের রানীর উপদেশ।
অরুণাচল প্রদেশের কিমিন-এ আয়োজিত সড়ক উদ্বোধন অনুষ্ঠানের খবর তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত না, যদি না উদ্বোধনী ভাষণে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলতেন, ‘‘ভারত শান্তির পূজারি হলেও প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনের মুখের মতো জবাব দেবে।’’
কোথায় দাঁড়িয়ে কোন সময় তিনি এমন হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তা বোধ হয় খেয়াল ছিল না। গালওয়ানে গোলমালের বর্ষপূর্তির মরশুমে অরুণাচল প্রদেশের ভূমিতে উচ্চারিত এমন মন্তব্য চিন নিয়ে সরকারের চিন্তাকে অনুমোদন দেয়। গালওয়ান এলাকার কত বর্গ কিলোমিটার জমি প্রতিবেশী দেশের আয়ত্বে চলে গেল এবং কতটুকুই বা উদ্ধার করা গেছে তার কোনো হিসেব এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে গালওয়ান থেকে অনেক দূরের অন্য এক সেনা ছাউনিতে ফৌজি পোশাক পরিহিত প্রধানমন্ত্রীর ছবি সম্প্রচারিত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একই দোলনায় দুলতে দুলতে অথবা মহাবলিপুরমের সমুদ্রতটে একত্রে প্রাতঃভ্রমণ ও প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করার সময় কোন কোন দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে তার কোনো খবর নেই। তবে ছবি আছে। এহেন প্রতিবেশীকে নিয়ে আত্মনির্ভরতার দাবিদার আত্মম্ভরী অহঙ্কারী সরকার এতই বিব্রত অথবা শঙ্কিত যে কিমিন-এর ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে অসত্য ভাষ্যের আশ্রয় নিতে হয়। সর্বত্র সম্প্রচার করা হল যে অসমের লখিমপুর জেলার কিমিন-এ অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়। অরুণাচলপ্রদেশ ও অসম দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী তথা রাজ্যের সাংসদও ছিলেন। তাঁরা এই অসততার প্রতিবাদ করেছিলেন বলে জানা যায়নি।
তবে শাসকদলের রাজ্য সভাপতি তথা স্থানীয় সাংসদ এই ঘটনায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে আধা-সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বিপথে চালিত করেছে। কিমিন অরুণাচলে জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে অসমের অংশ বলে দেখানো হয়েছে। পরিকল্পনা করে আশপাশের সর্বত্র কিমিন ও অরুণাচল লেখা মুছে ফেলা হয়েছে। এত বড়ো অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানস্থল সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য দেওয়া কি অপরাধ নয়? অরুণাচলবাসীর আত্মসম্মানে আঘাত দেওয়া নিশ্চিতরূপে গর্হিত অপরাধ।
চিনকে নিয়ে এতই চিন্তা যে হিমালয় পাহাড়ের উপর অবস্থিত চিনের সীমান্ত থেকে বহুদূরের জনপদ কিমিন-এর মানচিত্র-পরিচয় পাল্টে দিতে হল। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতে ভারত প্রতিবেশীর হুমকিতে পাত্তা দেয় না, তা হলে কেন অনুষ্ঠান থেকে মুছে দেওয়া হল অরুণাচলের নাম? অনুষ্ঠানের আগে থেকেই রহস্যজনক ভাবে আশপাশের সব বোর্ড, সড়কফলক থেকে কিমিন ও অরুণাচলের নাম কেন ঢেকে দেওয়া হয়েছিল? কেন অনুষ্ঠানস্থল নিয়ে মিথ্যে বিবৃতি দিল সরকারি সংবাদ সংস্থা? তবে কি, ইচ্ছাকৃতভাবেই অরুণাচলের শহরকে অসমের শহর হিসেবে তুলে ধরতে চায় কেন্দ্র? এমন বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হয়েছে অরুণাচলে। চিনকে কড়া বার্তা দিতে গিয়ে চিন-ভারত সীমান্ত সংক্রান্ত সঙ্কট নিরসনের বদলে কার্যত নতুন করে অসম-অরুণাচল সীমানা সমস্যাই উস্কে দেওয়া হল।
নিজের টুইটে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিমিন প্রসঙ্গে অরুণাচলের নাম সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। সরকারি সংবাদ সংস্থা আরও একধাপ এগিয়ে লেখে, অনুষ্ঠান হয়েছে অসমের লখিমপুরে। ফলে অনেক সংবাদমাধ্যমই ভেবে নেয় কিমিন অসমের কোনো এলাকা। অরুণাচলের নামোল্লেখ না করা মেনে নিলেও অসম-অরুণাচল সীমানা বিবাদের মধ্যেই কিমিনকে অসমের অংশ বলে প্রচার করায় স্বভাবতই আগুনে ঘি পড়ে। সরকারের সাফাই, অরুণাচলে ভারতের মন্ত্রীদের সফর হলেই বেজিংয়ের তরফে প্রতিবাদ জানানো হয়। তাই ইচ্ছে করেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি না করে ও সংবেদনশীলতার দিকে নজর রেখে অরুণাচলের নাম ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
চমৎকার যুক্তি! চিনকে সন্তুষ্ট রাখতে নাকি এমন মানচিত্র-বদল। অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দারা চিনে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করলে এখনও পাসপোর্টের পৃষ্ঠায় ভিসার স্ট্যাম্প লাগানো হয় না। আলাদা কাগজে ভিসার মোহর দেওয়া হয়। দেশের সমস্ত নাগরিকদের জন্য সমানাধিকার এখনও পর্যন্ত চিনের কাছ থেকে আদায় করা যায়নি। চিন-ভারত সীমানা লাগোয়া এলাকায় চিন প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার রেললাইন তৈরি করে ফেলল। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির শততম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আগামী অক্টোবর মাসে শুরু হতে চলেছে লাসা থেকে নিংচি পর্যন্ত এই রেলপথে নিয়মিত বৈদ্যুতিক ট্রেনের চলাচল। এর ফলে সীমান্তের এপারে অরুণাচল প্রদেশের পার্বত্য এলাকায় যে ভূতাত্ত্বিক অভিঘাত সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে ভারতের কোনো চিন্তা দেখা গেছে কি?
ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার সর্বস্ব সরকার এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে আগ্রহী নয়। প্রতিবাদের বালাই নেই। তার থেকে অনেক সহজ অরুণাচল প্রদেশের জনপদকে অসমের অংশবিশেষ দেখিয়ে সর্বাত্মক প্রচার। অদক্ষতা-ব্যর্থতার রূঢ় বাস্তবতা কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে বিজ্ঞাপনের মোড়ক ছিন্ন করে দেয়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে।