আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
সমসাময়িক
‘কত হাজার মরলে পরে...’
প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ, সরকারী হিসেবে, আমাদের দেশে প্রয়াত হয়েছেন করোনা সংক্রমণে। করোনা ভাইরাসের দাপট যখন প্রথম ভারতে দেখা যেতে শুরু করে, অনেক শিক্ষিত মানুষও মনে করছিলেন, এই রোগটি এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়। এমনকি, শুরুর দিকে যখন মৃতের সংখ্যা প্রায় নগন্য ছিল, তখন এমন কথাও সামাজিক মাধ্যমে দেখা যেত, যে এর থেকে বেশি মানুষ অমুক অমুক অসুখে মারা গিয়েছেন, অতএব করোনা কোনো ব্যাপার নয়। সেইসব পণ্ডিতদের আজ অবশ্য দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, যখন করোনায় মৃতের সংখ্যা সরকারী মতেই চার লক্ষে এসে ঠেকেছে। ২০১৯ সালে, অর্থাৎ করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগে, ভারতে টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল সাড়ে চার লক্ষ। ইতিমধ্যেই সরকারী হিসেবে করোনায় মৃতের সংখ্যা প্রায় টিবি রোগে মৃতের সংখ্যার কাছাকাছি চলে গিয়েছে।
কিন্তু সরকারী হিসেবে যেই সংখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু? এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এখন উঠছে। গঙ্গা এবং যমুনা দিয়ে বয়ে যাওয়া লাশ, নদীতীরে পোঁতা লাশের সারি, শ্মশান ও কবরস্থানে মৃতের সৎকার করার অকুলান জায়গা, দেশব্যাপী হাহাকার এই কথা প্রমাণ করেছে যে সরকারী তথ্যে বড়ো ফাঁক এবং ফাঁকি রয়েছে। আসলে করোনায় মৃতের সংখ্যা সরকারী হিসেবের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু কতটা বেশি?
২৫ মে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' পত্রিকায় একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। এই প্রবন্ধে গবেষকরা বলেন মে মাসের ২৪ তারিখ অবধি যেখানে সরকারী মতে ভারতে মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষের সামান্য বেশি, সেখানে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা অন্তত ৬ লক্ষ এবং তা ১৬ লক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কোন তথ্যের ভিত্তিতে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' এই গণনা করেছে? আরটিপিসিআর টেস্ট ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ বা আইসিএমআর জনগণের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করে কতজন মানুষের শরীরে করোনা-র আ্যান্টিবডি রয়েছে, অর্থাৎ কতজন মানুষ করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সরকারী মতে জনসংখ্যার যত শতাংশ করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে, তার তুলনায় প্রকৃত সংক্রমণ কয়েক গুণ বেশি। প্রকৃত সংক্রমণের সংখ্যা সরকারী সংখ্যার ২৬ গুণ বেশি, এমনটাই দেখাচ্ছে এই সমীক্ষা। সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে যদি ০.৩ শতাংশ মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়, (যা প্রকৃত সংক্রমিত মৃতের হারে তুলনায় আসলে কম), তাহলে ভারতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ লক্ষ।
'ইকনমিস্ট' পত্রিকা মে মাসের ১৫ তারিখে গোটা বিশ্বে প্রাক-কোভিড গত কয়েক বছরের গড় মৃতের সংখ্যার তুলনায় অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যার হিসেব প্রকাশ করে। এই সংখ্যায় তারা উপনীত হয়েছে একটি জটিল গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে। গোটা বিশ্বেই সরকারী কোভিড মৃতের তুলনায় অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যা বেশ কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে যখন কোভিড মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষের কোঠায়, তখন অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যা ১০ লক্ষের কাছাকাছি বলে ইকনমিস্টের গণনা দেখাচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত মৃত মানুষ যে কোভিডের শিকার তা বোঝাই যায়, কারণ অন্য কোনো বড়ো বিপত্তি এই সময়ে আসেনি। শববাহিনী গঙ্গা নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ইকনমিস্টে প্রকাশিত তথ্যের সত্যতার একটি খণ্ডচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যাশা মতই সমস্ত তথ্যকে অস্বীকার করেছে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যে সত্যের অপলাপ করছে তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ঘটনা এবং গণনা থেকেই পরিষ্কার। পাটনা হাইকোর্ট বিহার সরকারকে নির্দেশ দেয় কোভিড মৃতের প্রকৃত গণনা বা অডিট করতে। এই গণনা হওয়ার পরে বিহারে মৃতের সংখ্যা এক লাফে ৭২ শতাংশ বেড়ে যায়। গুজরাট থেকে প্রকাশিত দিব্য ভাস্কর দৈনিকের রিপোর্ট বলছে ১ মার্চ ২০২১ থেকে ১০ মে ২০২১-এর মধ্যে গুজরাটে সরকারী হিসেবে মোট ৪২১৮ জনের করোনায় মৃত্যু হয়। কিন্তু এই একই সময়ে রাজ্যের ৩৩টি জেলায় মোট ১২৩৮৭১ জনের ডেথ সার্টিফিকেট নথিভুক্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালের এই ১ মার্চ থেকে ১০ মে-র মধ্যে গুজরাটে মোট ডেথ সার্টিফিকেট নথিভুক্ত হয়েছিল ৫৮ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ ২০২১ সালের মার্চ ও মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যে আগের বছরের তুলনায় দুই গুণ বেশি মানুষ মারা গেছেন। এই বিপুল সংখ্যক মৃত্যু করোনার জন্যই হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
'হিন্দু' পত্রিকা লাগাতার বিভিন্ন রাজ্য ও শহরের ডেথ রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যার পর্যালোচনা করে চলেছে। তাদের গণনা বলছে যে কলকাতা শহরে প্রাক-কোভিড বছরের গড় ডেথ রেজিস্ট্রেশনের তুলনায় ২০২১ সালে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারী কোভিড মৃতের তুলনায় ৪-৫ গুণ বেশি। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কলকাতায় মোট কোভিড মৃতের সংখ্যা ছিল ২৯৫০, যেখানে এই সময়ে, অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০২। এই অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যা আসলে এপ্রিল-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রাক-কোভিড বছরে গড় মৃতের সংখ্যা ও ২০২১ সালের মৃতের সংখ্যার মধ্যে ব্যবধান। একই পদ্ধতিতে দেখা যাচ্ছে যে ২০২১ সালের এপ্রিল এবং মে মাসের ২৭ তারিখের মধ্যে সরকারী মতে কোভিড মৃতের সংখ্যা ১১৯৮, যেখানে আগের বছরগুলির তুলনায় এই বছরের এই দুই মাসে অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যা ৮২৩৪। অর্থাৎ, কোভিডে সরকারী মৃতের সংখ্যা অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যার তুলনায় অনেকটাই কম। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে প্রকৃত কোভিড মৃতের সংখ্যা সরকারী ব্যবস্থায় ধরা পড়ছে না।
'হিন্দু' পত্রিকায় অন্যান্য রাজ্যের হিসেবও প্রকাশ হয়েছে। সেই হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্ণাটক ইত্যাদি রাজ্যগুলিতেও অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যা সরকারী কোভিড মৃতের সংখ্যার তুলনায় ৫-৬ গুণ বেশি। সমস্ত রাজ্যে অতিরিক্ত মৃতের সংখ্যা লাফ দিয়ে বেড়ে যাওয়া এবং তা কোভিডে সরকারী মৃতের সংখ্যার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থাকা প্রমাণ করছে যে দেশে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা যদি সরকারী কোভিড মৃতের তুলনায় ৫-৬ গুণ বেশি প্রকৃত মৃতের সংখ্যা না ধরে ২-৩ গুণ মৃতের সংখ্যা ধরি, তাহলেও ভারতে কোভিডের প্রকোপে মৃত হয়েছেন ৮-১২ লক্ষ মানুষ, যা টিবি-র মতন ঘাতক রোগে মৃতের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
সরকারী কোভিড মৃতের তুলনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা যে শুধু ভারতবর্ষে বেশি তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা গোটা দুনিয়ায় সরকারী সংখ্যার তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি হতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে পৃথিবীতে প্রায় ১ কোটি মানুষ বিগত দেড় বছরে কোভিডের প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছেন। অবশ্যই এর মধ্যে অনেক ব্যক্তি থাকবেন যারা কোভিড নয়, হয়ত কো-মর্বিডিটি থাকার ফলে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু গোটা বিশ্বে তথা ভারতে এই অতিমারির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রকোপে কতজন মানুষ প্রাণ হারালেন তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।
ভারত সরকার অবশ্য এইসব শিষ্টাচারের ধার ধারে না। তারা প্রকৃত তথ্যকে গোপন করতে ব্যস্ত। এতটাই তারা মরিয়া যে সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য তারা জনগণের সামনে পেশ করছে। ভারতে মোট আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা হলে তারা শতাংশের হিসেব করে দেখাচ্ছেন যে ভারত অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো, কারণ আসল সংখ্যায় এই হিসেব পেশ করা হলে দেখা যাবে যে ভারত পৃথিবীতে আক্রান্ত ও মৃতের নিরিখে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অথচ, টিকা কতজন পেয়েছেন সেই সংখ্যা সরকার শতাংশে নয় প্রকৃত সংখ্যায় হিসেব দিচ্ছেন। ভারতে একটি ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ, আর দুটি ডোজ পেয়েছেন ৫.৭৫ কোটি মানুষ। এই হিসেব সরকার পেশ করছে। কিন্তু বলছে না যে এই সংখ্যা বড় হলেও, ভারতে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ একটি ভ্যাক্সিন পেয়েছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ৫৪ শতাংশ, আর ব্রাজিলে ৩৪ শতাংশ। ভারতে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ ভ্যাক্সিনের দুটো ডোজই পেয়েছেন, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ৪৬ শতাংশ আর ব্রাজিলে ১২ শতাংশ। ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে শতাংশের হিসেবটিই প্রাসঙ্গিক কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষকে ভ্যাক্সিন না দিলে করোনার থেকে রেহাই নেই। অর্থাৎ, বিশ্বের যেই তিনটি দেশে করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ভ্যাক্সিনের নিরিখে ভারতের অবস্থা সর্বনিম্ন। ভারত সরকার এই তথ্য মানুষের থেকে গোপন করতে চাইছে।
সরকার এতটাই নির্লজ্জ যে তারা কোভিডে মৃত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে অপারগ বলে সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে। তাদের যুক্তি ছিল যে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। আসলে সরকার জানে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা মেনে মিলে যারা এই অতিমারিতে মৃত হয়েছেন তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণের দাবি জানাবেন এবং প্রকৃত মৃতের সংখ্যায় সরকারী শিলমোহর পড়ে যাবে। তাই সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করছে। কিন্তু দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে জানিয়েছে যে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকার বাধ্য। ছয় সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে কোভিডের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত নিয়মবিধি তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য আদালত। আমরা আশা করব দেশের মানুষের সঙ্গে শঠতা না করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃত তথ্য মানুষের সামনে হাজির করবেন এবং কোভিডে মৃতের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।