আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮
সম্পাদকীয়
কাশ্মীরের ‘ক্রোনোলজি’
অমিত শাহের বিখ্যাত উক্তি, 'আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে'। এনআরসি – সিএএ’র কালানুক্রম বোঝাতে তিনি এই ‘ক্রোনোলজি’ প্রথম ভারতবাসীকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু ‘ক্রোনোলজি’র খেলা এতেই সীমাবদ্ধ নেই। অনেক সময় আমরা অজ্ঞ দেশবাসী, ধরতে পারি না কখন অমিত শাহের ক্রোনোলজি আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। আর সত্যিই বুঝতে পারি না বলেই, হয়ত বিজেপির রাজনীতির খেলাটাও ধরতে পারি না। সেজন্যই যখন কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাবার উদ্দেশ্যে ওখানকার নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে, আমাদের মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের একাংশ আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে - যাক, এবার তাহলে শান্তি ফিরবে। ভেবেও দেখি না, বিজেপির প্রস্তাবিত গেমপ্ল্যানের মধ্যে ঐ লুকিয়ে থাকা ক্রোনোলজি, সেটার গুরুত্ব ঠিক কোথায়।
২৪ জুন প্রধানমন্ত্রী মিটিং করলেন কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে। কাদের সঙ্গে? যাদেরকে কেন্দ্রীয় সরকার মাসের পর মাস বিনা বিচারে বন্দী করে রেখেছিল, ৩৭০ ধারা রদ হওয়ার পরে, যাদেরকে বিজেপি বারংবার দেশদ্রোহির তক্মা লাগিয়েছে, যাদের জনগণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার এক বছরের বেশি সময় ধরে জুলুমবাজি চালিয়েছে। সেই নেতাদের সঙ্গে মিটিং করে বিজেপি বার্তা দিতে চাইছে যে তাঁরা কাশ্মীরের শান্তি এবং গণতন্ত্র ফেরাতে উদ্যোগী। ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে, যারা কাশ্মীরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার জোর করে, অসাংবিধানিক উপায়ে কেড়ে নিল, তারাই আবার গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য মিটিং করে তার জন্য জনগণের হাততালিও দাবি করছে! আসলে পুরোটাই বিজেপি-র রাজনৈতিক কৌশলের অঙ্গ।
২৪ জুন যে মিটিং হল, সেখানে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটা গুরূত্বপূর্ণ কথা বলেছে, যার মধ্যে এই ক্রোনোলজি ব্যাপারটাই তার রাজনীতির নির্ধারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রথমত, বিজেপি বলেছে যে কাশ্মীরে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে হবে। এটা জো বাইডেনের কড়া অবস্থানের ফলে, নাকি আফগানিস্তানে উত্তরোত্তর বেড়ে চলা পাকিস্তানের প্রভাবের ফলে আশংকিত হয়ে, নাকি কাশ্মীরে আসন্ন ভোটের স্বার্থে, সে প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাক। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই কথার বিরোধিতার অবকাশ নেই। এবার, বিজেপি দ্বিতীয় যে কথাটা বলেছে, সেটা ওই ক্রোনোলজি। জম্মু কাশ্মীরে আগে ডিলিমিটেশন হবে, তারপর হবে ভোট, তারপর কাশ্মীরকে রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। তৃতীয়ত, ৩৭০ ধারা নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি বিজেপি দিচ্ছে না। চতুর্থত, রাজ্যের স্বীকৃতি কবে দেওয়া হবে? অমিত শাহের কথায়, ভোট পরবর্তী 'উপযুক্ত কোনো সময়ে'।
খুঁটিয়ে দেখতে গেলে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রস্তাব আসলে এক প্রকার চাল, এবং কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের অনান্তরিক প্রয়াস। প্রথমত, ডিলিমিটেশন করে বিজেপি চায় জম্মু অঞ্চলের ৩৭টি বিধানসভা আসনের সংখ্যা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে ফেলতে। সেটা করলে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি ওই অঞ্চল থেকে শক্তি নিয়ে বাকি অংশের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সহায়কই শুধু হবে না, গোটা অঞ্চলে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বেড়ে উঠবে, যার ফায়দা তুলবে বিজেপি। তাদের লক্ষ্য মুসলিম প্রধান একটি রাজ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের আধিপত্য বিস্তার, যেটায় সহায়তা করবে ডিলিমিটেশন। দ্বিতীয়ত, বিজেপি যদি সত্যিই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হত, তাহলে কাশ্মীরকে রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার পর ভোটের কথা বলত। কিন্তু এই ক্রোনোলজির মানেই হল, ভোট হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। সেটার পর গণতন্ত্র ফেরাবার আশা আর না করাই ভাল। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে পারে না, যেটা পারে তা হল অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ, আর কিছুই পারে না। তার মানে, বিজেপি অশান্তি জিইয়ে রাখতেই চায়। তৃতীয়ত, এই যে অমিত শাহ বলেছেন ভোট পরবর্তী 'উপযুক্ত কোনও সময়ে' কাশ্মীরকে রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হবে, সেই উপযুক্ত সময় কে স্থির করবে? কবে আসবে সেই সময়? কেউ জানে না। তার মানে, পুরোটাই বিজেপির তৈরি করে দেওয়া নিয়মে খেলা হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা কি সেটা জানেন না? তাহলে তাঁরা ৩৭০ ধারা ফেরানোর দাবি কেন তুলছেন না? কেন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর অনুমান করা হচ্ছে যে নেতারা এটা মেনে নেবেন? তাঁরা এ সবই জানেন। কিন্তু বিজেপি এমন একটা পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে, যেটা প্রায় এরকম - হয় রাজ্যের স্বীকৃতি নাও, আর নাহলে ৩৭০ ধারা কেন, কিছুই মিলবে না। এবার, একটা অঙ্গরাজ্যের শাসক বা বিরোধী আসনে বসা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু রাজ্যের স্বীকৃতি নেই এরকম অঞ্চলে রাজনীতি করতে হলে সেই রাজনীতি এবং তার কাণ্ডারি কারোরই কোনো গুরুত্ব থাকে না। কাজেই রাজ্যের স্বীকৃতিকে সব মূলধারার দলই অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য। এবার, নেতারা বলতেই পারতেন যে ৩৭০ না ফেরালে কোনো আলোচনা নয়। কিন্তু তাতে সমস্যার জট তো কাটতই না, উলটে রাজ্যের স্বীকৃতি, যেটুকু আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটাও আসবে না। সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। তাহলে কি এই দাবি মেনে নিয়েই ভোট বয়কটের রাস্তায় হাঁটবে রাজনৈতিক দলগুলো? মুশকিল হল, যদি ভোটে তারা লড়ে, সে ন্যাশনাল কনফারেন্স হোক বা কংগ্রেস, তাহলে ব্যাপক হারে জনপ্রিয়তা খোয়াবে ওখানকার মানুষদের মধ্যে। কারণ ভোটে লড়া মানে আইনগতভাবে স্বীকার করেই নেওয়া হচ্ছে যে কাশ্মীরের রাজ্যের স্বীকৃতি হরণ এই দলগুলো মেনে নিল। মনে রাখতে হবে, ভোট হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবেই। আবার এরা যদি ভোট বয়কট করে, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়ে যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় 'শয়তানের বিকল্প' - ডেভিলস অলটারনেটিভ। এই অদ্ভুত সংকটের মধ্যে বিজেপি এনে ফেলেছে কাশ্মীরের রাজনীতিকে।
বিজেপি জানে কাশ্মীর থেকে তার জনপ্রিয়তা পাবার কিছুই নেই। ৩৭০ ধারা বিলোপের সময়ে বিজেপি দুটো দাবি করেছিল - কাশ্মীরে শিল্প ও উন্নতির জোয়ার আনবে, আর সন্ত্রাস বন্ধ করবে। করোনার জন্য প্রথমটা কিছুই হয়নি। আবার সেই করোনাজনিত লকডাউনের কারণেই কাশ্মীরে খুব একটা সন্ত্রাসও হয়নি। সেটায় কেন্দ্রীয় সরকারের অবদান নেই বিশেষ। একবার লকডাউন উঠে যাক, তারপর কাশ্মীর কেমন থাকে সেটাই আসল প্রশ্ন। কারণ সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানপন্থী মনোভাব এর প্রতিক্রিয়ায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে অবাক হবার কিছু নেই। তখন উপত্যকা সত্যিই শান্ত থাকবে কী না, কেউ জানে না। কিন্তু তাও বিজেপি এই ঝুঁকিটা নিচ্ছে, কারণ সে তার এ্যাজেন্ডার কাছে সৎ। বিজেপি বলে এসেছে কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা রদ করবে, সেটা তো করেছেই, উলটে ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে ডেমোগ্রাফি পালটে দেবার ভয়ংকর খেলায় নেমেছে। দেশের মূলধারার বিরোধী দলগুলি ৩৭০ ধারার পক্ষে মুখ খোলার সাহস হারিয়েছে। এই সুযোগে বিজেপি তাদের এ্যাজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টায় নেমেছে। বিজেপি ভাবছে এর ফলে কাশ্মীরে তারা ক্ষমতায় আসবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, সেটা আমরা ভেবেও দেখছি না।
আর কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ? ঘরছাড়া পণ্ডিতরা? জেলবন্দী হুরিয়ত নেতারা? নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের পরিবার? তাঁরা কী পাবেন? সম্ভবত কিছুই নয়। বিজেপি যদি আধিপত্য পাকাপাকি করে, কাশ্মীর একটা আধাসেনা শাসিত অঞ্চল হিসেবেই থেকে যাবে। আর যদি বিজেপি আধিপত্য না বিস্তার করতে পারে, মানে যদি নির্বাচনে খারাপ ফল করে, তাহলে কাশ্মীরকে রাজ্যের স্বীকৃতি কবে দেওয়া হবে, আদৌ দেওয়া হবে কী না, সেটা কেউ জানে না। এই দুই বিকল্পের ক্ষেত্রেই সাধারণ কাশ্মীরিদের অবস্থা শোচনীয় হয়েই থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ বিজেপির পরিকল্পিত হিন্দু সাম্রাজ্যের ব্লু প্রিন্টে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো স্থানই যে কখনো ছিল না, সেটা আমরা বহুবার দেখেছি।