আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
প্রবন্ধ
আরেকটা জন্মদিন, চে-কে দেখা
শুভময় মৈত্র
তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপনে আরও কয়েকটা ক্যালেন্ডার বদলাতে হবে। জন্মসাল ১৯২৮, দিনটি আজকের, জুন ১৪। মৃত্যু ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর। অন্তর্জালের সুবিধে প্রচুর। দিন কয়েক আগে থেকে একটু খুঁজলে কোনো না কোনো এক মনীষীর জন্মদিন আসবেই। বছরে খুব বেশি হলে ৩৬৬ দিন। এর প্রতিদিনেই এক বা একাধিক মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে এমন আশঙ্কা করা যেতেই পারে যে এই চে-স্মরণ সেই পথেই নির্ধারিত। অর্থাৎ জুনের শুরুতে একবার আকাশপাতায় উঁকি মেরে কোনো এক খ্যাতনামার খোঁজ, অতঃপর গুয়েভারা পুনরাবিষ্কার। তবে এই লেখার কথা সেভাবে মাথায় আসে নি, এসেছে অন্য এক প্রেক্ষিতে।
দেড় বছর পেরিয়েছে অতিমারী। বিশেষভাবে গত প্রায় দেড়মাস ধরে কলকাতা শহর এবং তার আশেপাশে কোভিডের প্রকোপ ছিল ভয়াবহ। আমজনতা চরম বিপদে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে যেমন লড়াই করছেন শাসক, প্রশাসক, আইনরক্ষক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা, তেমনই পথে নেমেছেন প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক। কেউ দল বেঁধে, কেউ একা, এবং অবশ্যই দলমত নির্বিশেষে। এর মধ্যে বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনের একটা বড় অংশ উল্লেখযোগ্য কাজ করছেন রেড ভলেন্টিয়ার নামে। এমনই একটি মেধাবী ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয় পড়াশোনার সুবাদে। এক ভরদুপুরে গুগুল মিটে যখন তার সঙ্গে অঙ্ক কষছি, তখন বুঝতে পারি সে আসলে একটি বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করছে। তার বন্ধু গেছে সেই বাড়ির ভেতরে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছতে। সেদিন রাতেই তার সঙ্গে আবার বৈঠক। রাত একটা নাগাদ ধস্তাধস্তি শেষ হওয়ার পর ছাত্রকে যখন অন্তর্জালে শুভরাত্রি বলার উদ্যোগ নিচ্ছি, তখন সে বলে কিনা, "এখন শোয়া যাবে না স্যার। ভোরের দিকে আরও একজনের অক্সিজেন ফুরোবে, সেখানে একটা সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়ে এসে তবে আজকের ছুটি। এ-কদিনে যা বাইক চালালাম তাতে 'দ্য মোটরসাইকেল ডাইরি'-র রেকর্ড না ভেঙে যায়।" সকলেই জানেন, তবু একবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক আরনেস্তো গুয়েভারার লেখা সেই ভ্রমণবৃত্তান্তের কথা। মোটর সাইকেলে চেপে, লাতিন আমেরিকায়, একজন চিকিৎসক থেকে লড়াকু রাজনীতিক হয়ে ওঠার কাহিনি। অবশ্যই কলকাতার উপকণ্ঠের শুধু এই স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রটির মধ্যে চে খুঁজে পাওয়া বড় বেশি একচোখামি হয়ে যাবে। তাই সঙ্গে এটাও শুনিয়ে রাখা ভালো যে পরিচিত এক তৃণমূল সমর্থক নিজের ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধ রেখে অতিমারী পরিস্থিতিতে অপরকে সাহায্য করছেন। সহকর্মী এক বিজেপি অনুরাগী নিয়মিত ওষুধ যোগান দেওয়া থেকে হাসপাতালে পৌঁছনোর কাজ করছেন ডাক দিলেই। সবটাই নিজের চোখে দেখা, চেখে দেখা, এবং সেই সূত্রে চে-কে দেখা এই কলকাতায়। ক্লিশে হয়ে যাওয়া রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিকতার উদাহরণ আজকের দিনে প্রতুল। তবে চে-কে মনে পড়ার কারণ সেদিন রাতেভোরের কথোপকথন সূত্রে মোটরসাইকেল, তার সাথে লেখকের ডাইরি, তারপর লাতিন আমেরিকা থেকে লাটবাগানের মোড় - অক্সিজেনের আয়োজনে। সেখান থেকেই জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করার ভাবনা।
চে সম্পর্কে যে মূল দুটি বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, তার প্রথমটি হল তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট মেধাবী। চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেই পড়াশোনা শেষ করার পরেই তাঁর দেশভ্রমণের সূত্রপাত, যেখান থেকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন লাতিন আমেরিকার রাজনীতিকে। দুই, যে রাজনীতির কথা ভেবেছিলেন, সেখানে একবার সফল হয়েই ক্ষান্ত হন নি। অর্থাৎ কিউবাতে মন্ত্রী হয়েই তিনি জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে, তারপরেও বলিভিয়াতে এক অভ্যুত্থানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সেখানেই লড়াইয়ের ময়দানে মৃত্যু হয় তাঁর। বামপন্থী রাজনীতিতে মার্কসসাহেব তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে সবথেকে প্রভাবশালী। অন্যদিকে ফলিত ক্ষেত্রে একেবারে প্রথমে নাম আসবে লেনিন, মাও কিংবা কাস্ত্রোর। তবে একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে চে এঁদের থেকে কম তো যাবেনই না, বরং তাঁর অবদান তীক্ষ্ণতর। সেখানে শেষ যুদ্ধ সবসময়েই শুরু। সেখানে ব্যর্থতাকে বরণ করার মধ্যেই সাফল্য। বিশ্ব রাজনীতির সব বড় নাম-ই মোটের ওপর একটা দেশ সামলেছেন। কয়েকজন আবার তারপর নিজের দেশ ছেড়ে আগ্রাসনে গেছেন দখলদারিতে। কিন্তু গোটা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের ভাবনায় অন্য দেশে বন্দুক হাতে কাদাজলে লড়াই করতে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এমন উদাহরণ বিরল বলাটাও বাড়াবাড়ি। সেখানে শুধুই চে।
কী কী ভাবে পরিচয় দেওয়া যায় এই লেখকের? কী ভাবে চিনিয়ে দেওয়া যায় এই কূটনীতিককে? এরকম কত যে প্রশ্ন আসবে গুয়েভারা সারনাম এর সঙ্গে, তার ইয়ত্তা নেই। উইকি খুঁজলে শুরুতেই পাবেন তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। এঁর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করুন এক পর্যটককে। গোটা লাতিন আমেরিকা চষে বেড়ানো এই মানুষটি হেলিকপ্টারে বন্যা দেখেন নি, মোটরবাইকের তেল পুড়িয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গিয়েছেন। মাঝের একটা সময় চেষ্টা করেছেন আফ্রিকাকেও বিপ্লবের পথ দেখাতে। কোন রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের উত্তরণ তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই কারণেই গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর ভাবনার বেশিটা জুড়ে ছিল লাতিন আমেরিকা কিংবা আফ্রিকার মত পিছিয়ে থাকা মহাদেশ। শেষে সশস্ত্র বিপ্লবকে শোষিত মানুষের মুক্তির সর্বোত্তম পথ ভেবে বলিভিয়ার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ। যেটুকু জানা যায়, ৭ অক্টোবর ধরা পড়েন এবং তাঁকে হত্যা করা হয় ৯ অক্টোবর ১৯৬৭, দুপুরবেলা।
চে-র মৃত্যু মার্কিন সংবাদমাধ্যম স্মরণ করেছিল 'একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল' বলে। সে রূপকথা আসলে একটি নয়, অনেক। আজকের কোভিড অতিমারীতে সে রূপকথা আমরা প্রত্যক্ষ করছি এই শহরে। শাসক এবং সরকারের অসম্পূর্ণতা পেরিয়ে সাধারণ মানুষ পথে নেমেছেন, একে অপরের দিকে বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। এই শহর, এই রাজ্য, এই দেশের স্বেচ্ছাসেবকেরা মোটরসাইকেলে যত পথ পেরিয়েছেন, তা অবশ্যই চে-এর যাত্রার থেকে বেশি। অন্তত এই একটা হিসেবে যদি আমরা এই রূপকথার পুরুষটিকে অতিক্রম করতে পারি, তাহলে বাকিগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? তাই জন্মদিনে চে-স্মরণে বিরতি দেওয়া যাক 'দ্য মোটরসাইকেল ডাইরি'-র আর একটি উল্লেখযোগ্য কথা ভাবানুবাদ করে। "সূর্যের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বেশ অদ্ভুত। রাতশেষে এখনও দিগন্ত টপকায়নি। কিন্তু এতেই আমরা নিশ্চিন্ত, যে সে আগামীর উষ্ণতা নিয়ে আসছে।" গানের কলিতে "একদিন সূর্যের ভোর, একদিন স্বপ্নের ভোর, একদিন সত্যের ভোর আসবেই" শুনতে পাচ্ছেন কি? অতিমারীতেও সূর্য ওঠে, মনে পড়ে যায় আজকে চে-কে চেখে দেখার দিন।