আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

'রাজা, তোর কাপড় কোথায়'?

মালবী গুপ্ত


ভারতে কেউ যদি এখন শাসকের দিকে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন -তবে সে প্রশ্নের উত্তর শুধু মিলবেনাই তা নয়,তাঁর গ্রেফতার হওয়াও বোধহয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। কারণ ‘সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ,তবুও/সবাই হাততালি দিচ্ছে।/সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ/কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;/কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;...’। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর গত কয়েক মাস ধরে দেশের সরকারের ভূমিকা দেখে কেবলই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার এই লাইনগুলি মনে পড়ছিল।

কারণ গত ১০ ফেব্রুয়ারি নথিভুক্ত ১১,০০০ কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ নিয়ে দ্বিতীয় ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়ে।তারপর ৫০ দিন ধরে গড়ে প্রতিদিন২২,০০০ এবং পরে দিনে ৮৯,৮০০ নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেন গত ১০ মে পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩৪.৮ মিলিয়ন বা ২.৫% মানুষের পুরো টিকাকরণ হয়েছে? কেন প্রতিদিন দেশের লক্ষ লক্ষ করোনাক্রান্ত চিকিৎসাহীন, অক্সিজেনহীন রোগী চরম দুর্দশায় পড়েছেন? এবং অসহায় মৃত্যুর অতলান্তিক অন্ধকারে তাঁরা তলিয়ে যাচ্ছেন?যদিও এই মুহূর্তে দেশে সংক্রমণ বা মৃত্যুর সংখ্যা নিম্নগামী। এবং বর্তমানে টিকাককরণ বাড়া সত্ত্বেও ওই সব প্রশ্নের গুরুত্ব কিন্তু কিছুমাত্র কমে না।

কারণ করোনার আসন্ন তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়লে দেশের শিশুরা এবার কতটা বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে তা নিয়ে আশঙ্কার মেঘ যেমন ঘনিয়ে উঠছে। তেমনি দেশের সমস্ত মানুষের টিকা দান কবে সম্পন্ন হবেতা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় দেশবাসী জীবনের চরম নিরাপত্তহীনতায় ভুগছে। তবে সত্যি কি দেশের বর্তমান মহামহিম শাসককে এইসব প্রশ্ন করা যায়? বিশেষ করে সেই প্রশ্ন যদি আবার রাজধানীর দেওয়ালে দেওয়ালে জেগে ওঠে? নাহ, তার কোনো উত্তর তো মিলবে না, বরংপ্রশ্নকারীর গ্রেফতার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে দিল্লিতে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভ্যাকসিন নীতি নিয়ে ‘মোদী জি হামারে বাচ্চোঁ কা ভ্যাকসিন বিদেশ কিঁউ ভেজ দিয়া’–এই প্রশ্ন- পোস্টার দেওয়ালে সেঁটে দেওয়ার অপরাধে২৫ জন গ্রেফতার হয়েছিলেন।

অবশ্য ভ্যাকসিন না পাওয়া ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবংকোভিডে আক্রান্ত রোগী এবং২জুন এই লেখটি লেখার সময় পর্যন্ত ওয়র্ল্ডোমিটারের হিসেবে করোনায় মৃত ৩৩৫,১১৪ রোগীর বহু পরিজনদের মনেই তো এই প্রশ্ন ঘুরছে। পাশাপাশি, রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী দলের নেতা মন্ত্রীরাওনিজেদের ওই প্রশ্নকারী বলে সরবও হয়েছেন। কারণ দেশে কোভিড ১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর যখন প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন আর ওষুধের অভাবে মৃত্যু হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা নাগরিকদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ওইসব চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা মেটাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে করজোড়ে কাকুতি মিনতি করেছেন। ভ্যাকসিনের জন্য রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও বিফল, হতক্লান্ত প্রবীণ নাগরিকদের ঘরে ফিরতে হয়েছে - তখনও তাঁর টুঁ শব্দটি শোনা যায়নি।

বরং এতদিন ‘কোবিডকে জয় করে ফেলা’র ঢাকটি পিটিয়ে চলেছিল দেশের সরকার।সাফল্যের বেলুনটি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা তো হল না।করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ওই ঢাকটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। খসে পড়তে লাগলআত্মপ্রসাদের চকচকে মুখোশগুলি।কে জানত এমন নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে হবে দেশবাসীকে?

তবে ভারত সহ বিশ্ব জুড়েই বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও ডাক্তারদের অতিমারির আসন্ন দ্বিতীয় ঢেউয়ের সম্পর্কে আগাম সতর্কবাণী ছিল না? অতিমারির প্রথম ধাক্কায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জীর্ণ ভঙ্গুর পরিকাঠামোর কঙ্কালটি বেরিয়ে পড়ায়, তার সংস্কার ও উজ্জীবনের পরামর্শওতো ছিল? এবংদেশের অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ভারতে কোভিড-১৯-এর মোকাবিলায় প্রয়োজন হলে ভ্যাক্সিনের জন্য ছিল তো ৩৫,০০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতিও?তার কী হল?

না, সরকারি কোনো কাজকর্মের, তা যদি আবার মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না। আসলে প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াএবং কোভিড সংক্রান্ত আগাম পরামর্শকে উপেক্ষা করারমধ্যে যে একটা ঔদ্ধত্য থাকে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তা বোধহয় বেশ উপভোগ করেন সংখ্যাগুরুর অহমিকায়।তা নাহলে দেশের শাসক কোনো সংবাদ সম্মেলনের মুখোমুখিইহন না? পাছে কোনো জবাবদিহি করতে হয়।

তবে শাসকরা ভুলে যান, দেশের আপামর জনতা, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমস্ত প্রান্তিক মানুষদের ভোটও তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার এক একটি সিঁড়ি। এবং শাসকরা তো কেউই অমরত্ব লাভ করেননি।যে চিরকাল তাঁরা গদিতে আসীন থাকার সুযোগ পেয়ে যাবেন। তাই সাধারণ নাগরিকের আর্তি এবংতাঁদের প্রশ্ন উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করার যতই উপায় আবিষ্কার করা হোক না কেন, তাঁদের হয়ে কেউ না কেউ তো সে প্রশ্ন তুলবেই। আজ না হলেও কাল কাঠগোড়ায় শাসকদের দাঁড়াতেও হবে।

তাই যখন দেশের মতো বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেও করোনা মোকাবিলার ব্যর্থতা নিয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা শুরু হয়, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলতে শুরু করে, তৎক্ষণাত প্রধানমন্ত্রীর ভাববমূর্তি রক্ষায় শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সর্বোপরিশাসক দলের আইটিসেল’র (অনেকের মতে দেশের বৃহত্ততম ফেক নিউজের কারখানা) যৎপরনাস্তি মিথ্যা প্রচারও চলতে থাকে। কোভিড মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী যে কি ‘কঠোর পরিশ্রম করছেন’, তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে সোশ্যাল মিডিয়া সহ সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের অন্ত থাকে না।

কিন্তু সত্য আর মিথ্যার ফারাকটুকু ক্রমশ নাগরিকদের কাছে, ভুক্তভোগীদের কাছেযে আর অপ্রকাশ থাকছিল না। হাসপাতালে হাসপাতালে মৃতদেহের সারি, আর মৃত্যু পথযাত্রীদের অক্সিজেনের অভাবে খাবি খাওয়ার দৃশ্যগুলিকেও যেনআর ধামাচাপা দেওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি ‘ল্যানসেট’র মতো চিকিৎসা-পত্রিকাতেও দেশের করোনা পরিস্থিতির জন্য সাম্প্রতিকধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমাবেশকে দায়ী করে,যখন কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা উঠে এলো, তখন যেন আর কোনোমতেই মুখ রক্ষার জো থাকল না।

আর তখনই হঠাৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী যেন হাইবারনেশন থেকে জেগে উঠলেন।শীতঘুম কাটিয়ে প্রায় দু’মাস পরে মৌনতা ভেঙে প্রথমে নিজেকে দেশে’র ‘প্রধান সেবক’ হিসেবে দেশবাসীর ‘সমব্যথী’ বলে বর্ণনা করলেন। হায় মূঢ় ভারতবাসী! হায় অসহায় দেশের নাগরিকবৃন্দ!ভারত বুঝি কখনো এমন নিষ্ঠুরতার শাসনকাল যাপন করেনি।

নাহ, এই নিষ্ঠুরতায় শাসকের তরবারির কোনো আস্ফালন নেই। এই নিষ্ঠুরতায় মানুষের রক্তে দেশের মাটিও লাল হয়ে উঠছে না।কেবল শাসকের অবিবেচনা, অপরিসীম ঔদ্ধত্য আর পরিকল্পনাহীনতায় রাজ্যে রাজ্যে নিঃশব্দে মৃত্যুমিছিল চলেছে। প্রতিদিন হাজারে হাজারে শবদেহের পাহাড় জমে উঠেছে।যে মৃতদেহ বা লাশ বেশি দিন লুকিয়েও রাখা যাচ্ছে না। যাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যাচ্ছে না গণচিতায় পুড়িয়ে, গণকবরে সমাধিস্ত করেও।

তাই সরকারি পরিসংখ্যানে কোভিডাক্রান্ত মৃতের আসল সংখ্যা যতই ‘গোপন করা’র চেষ্টা হোক না কেন, নদীর জল থেকে, চড়ার বালি থেকে, কখনো বা মাটি ফুঁড়ে তাঁরা বেরিয়ে পড়ছেন।তাই উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের আকাশে বাতাসে ‘জলে ভেসে যায় কার শব/ কোথা ছিল বাড়ি’- (কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) এই প্রশ্নআজ মাথা কুটে মরছে।কারণ সেই জলে ভেসে চলা, সেই ঠিকানাহীন, পরিচয়হীন দেশের যত্রতত্র অনাগরিকদের অনুসারী ক্ষুধার্ত অসংখ্য কাক, শকুন, শেয়াল কুকুরের খুবলে নেওয়া দেহের নারকীয় বীভৎস ছবি ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে।অনাগরিক বলছি, কারণ নাগরিকের ন্যূনতম সম্মানও যে তাঁদের কপালে জোটেনি, মৃত্যুর পরেও না। তা না জুটুক এবং নিন্দুকেরা যাই বলুক, ভারতবর্ষের মুখ নিশ্চয়ই এতে বেশ উজ্জ্বল হচ্ছে।

আজ দেশের কোটি কোটি অসহায় মানুষ আমরা, যাঁরা প্রথম ডোজ ভ্যাক্সিন পেয়ে দ্বিতীয়টি পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছি,যাঁরা একটা ডোজও পাইনি, কবেতা মিলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এবং প্রথম ও দ্বিতীয় টিকাকরণের সপ্তাহ ও মাসের ঘোষিত নির্দিষ্ট সময়কাল যখন বারবার পরিবর্তিত হতে থাকে, তখন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘ভাঁড়’সদৃশ কথাবর্তা ও প্রতিশ্রুতি কেবল বিরক্তি ও বিশ্বাসহীনতারই উদ্রেক করে।

দেশের প্রধানমন্ত্রী বিগত কয়েক মাসে দেশে দেশে কিছু ভ্যাকসিন দান করেছেন এবং প্রচুর ভ্যাকসিন বিক্রিও করেছেন। তাই এখন তিনি অসহায় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কথা বলতে গিয়ে যতই আবেগে রুদ্ধবাক হয়ে পড়ুন, যতই তাঁর চোখ ছলছল করে উঠুক না কেন,দেশের অসংখ্য মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও তা নিছকই ‘কুম্ভীরাশ্রু’ হয়ে ওঠে।

তাই সেসব বন্ধ করে সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ করার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। তা নাহলে‘আত্মপ্রচারের লোভ’ সামলাতে না পেরে, তাঁর সেই ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’র পক্ষে সওয়াল করে এবং তাজারি রেখে আজ লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে কেন তিনিজীবন-মরণ ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন –দেশবাসীর সেই নিরন্তর প্রশ্ন যে তাঁর প্রতি জারি থাকবেই। এবং রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তাঁদের বোধহয় আর জেলে পোরাও সম্ভব হবে না।


ঋণ স্বীকারঃ

● bbc.com/news/world-asia-india-56811315

● indianexpress.com/article/india/anti-pm-posters-arrest-delhi-police-modis-criticism-covid-vaccination-drive-7316779

● reuters.com/world/india/india-posts-366161-new-coronavirus-cases-over-last-24-hours-2021-05-10