আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
প্রবন্ধ
সুন্দরবনঃ একটি বিকল্প ভাবনা
শৌভনিক রায়
প্রতি বছরের মতো আবারও বিধ্বস্ত সুন্দরবন। ২০০৯ সালে আইলার পর, ২০১৯-এ বুলবুল, ২০২০-তে আমফান ও ২০২১-এ ইয়াস। উপর্যুপরি বিপর্যয় ও দীর্ঘস্থায়ী অভিঘাতের ঘটনাপ্রবাহ। এবারের ক্ষতি যত না ঘূর্ণিঝড়ে তার থেকে অনেক বেশি ভরা কোটাল ও পূর্ণিমাজনিত সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে। বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের নোনা জলে প্লাবিত সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, গোসাবা, সন্দেশখালি ও হিঙ্গলগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ভেসে গেছে চাষের জমি, মিষ্টিজলের পুকুর। ভেঙে পড়েছে অসংখ্য বাড়ি। চতুর্দিকে পানীয় জলের হাহাকার। ঘোড়ামারা, মৌসুনি ও কুমিরমারীর দুর্বিষহ অবস্থার ছবি এখন কলকাতার কাগজে। অনেক জায়গাতেই মানুষ আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার উপর অস্থায়ী ছাউনিতে। বিপর্যস্ত জীবনজীবিকা প্রতি বছরের মতো আবার নির্ভরশীল ত্রাণের উপর। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বিপর্যয়ের সাথে সহাবস্থান করে চলা গ্রামবাসীদের। আইলার পরে বাঁধ নির্মাণের জন্য অনুমোদিত সিংহভাগ টাকা ফেরত যাওয়ায় মানুষের ক্ষোভ এখন দৃশ্যমান। পরিদর্শনকারী কেন্দ্রীয় দলের কাছে গোসাবা ও পাথরপ্রতিমার সাধারণ মানুষের দাবি কংক্রিটের বাঁধ ও সমস্যার স্থায়ী সমাধান। হয়তো আরও আগেই ওঠা স্বাভাবিক ছিল। সংবেদনশীল নাগরিকদের অনেকেই সহমত এই অনিশ্চয়তার নিরসনে। আর একটি সমাধান সূত্রও উঠে আসছে আলোচনায়। তা হলো দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের মানুষের অন্যত্র পুনর্বাসন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সংযুক্ত নদী-বদ্বীপ অঞ্চল সুন্দরবনে সমস্যার চরিত্র বহুমুখী। বিশ্ব উষ্ণায়ন, কোভিড পরবর্তী বেকারত্ব ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। ২০১১ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড-এর গবেষণা অনুসারে সুন্দরবনে গত পাঁচ দশকে চারটি দ্বীপ - লোহাচরা, বেডফোর্ড, কাবাসগাডি ও সুপারিভাঙ্গা সমুদ্রতল বৃদ্ধির কারণে বিলীন হয়ে গেছে। পরিবেশ শরণার্থী হয়েছেন আনুমানিক ৬৯,০০০ মানুষ। এই বিশেষ অঞ্চলের বহুমাত্রিক সমস্যা অনুধাবনে ভুল হলে বা কোনো চটজলদি সমাধান নতুন জটিলতা সৃষ্টি করবে। বৃদ্ধি পাবে সামাজিক অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা।
প্রথমে বাঁধের বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক। পূর্ত দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে নদীবাঁধের দৈর্ঘ্য ৩,৭০০ কিলোমিটার। এ নিয়ে নদী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তাঁদের মতে বর্তমানে বাঁধের দৈর্ঘ্য অনেক কম। যদিও এ বিষয়ে তথ্য অমিল। বাঁধগুলি তৈরি শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবিভক্ত বাংলার ইজারাদার হিসাবে জঙ্গল অধ্যুষিত সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ লিজ দেয় মেদিনীপুর ও ২৪ পরগণা জেলা থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মানুষদের। কৃষিকাজের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে। আজ্ঞাবহ জমিদারকুল দ্বীপগুলিতে সমুদ্রের লবণাক্ত জলের প্রবেশ আটকাতে ছোটনাগপুর থেকে আদিবাসীদের নিয়ে এসে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ম্যানগ্রোভ সমৃদ্ধ সুন্দরবনে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জঙ্গল বিনাশ করে কৃষি ও মানুষের বসতি স্থাপনের সেই শুরু। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে আশা বহু শরণার্থীও এখানে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমানে ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৫২টি দ্বীপে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের বাস এই জল জঙ্গল পরিবেষ্টিত অঞ্চলে। বাকি ৫০টি দ্বীপে বাদাবন (ম্যানগ্রোভ) ও বন্যপ্রাণীর আস্তানা। এ নিয়েও নদী বিশেষজ্ঞরা সহমতে পৌঁছতে পারেননি। তাঁরা বলছেন পরবর্তীকালে অনেকগুলি দ্বীপ জুড়ে গিয়ে মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবনের নদীগুলিতে জোয়ার-ভাটায় জলস্তরের ওঠানামা এক স্বাভাবিক বিষয়। ব-দ্বীপের ভূমিরূপ গঠনের দিক থেকে নবীন। আজও তার গঠন প্রক্রিয়া চলছে। নদীর গতিপথ সর্বদা পরিবর্তনশীল। হঠাৎ কোনো জায়গায় নদীর মধ্যে চর জেগে ওঠা বা নদীর কোনো একটি দিকে ভাঙ্গনের হার বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। আমফান ঝড়ের ফলে গোসাবার রাঙ্গাবেলিয়া গ্রামের যে অংশের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাঁধ ভেঙে, সেখানকার মানচিত্র দেখলে বোঝা যাবে, দ্বীপটির দু'দিক থেকে বিদ্যা ও গোমর নদী গত কয়েক দশকে বিপদজনক বাঁক নিয়ে কাছে আসার চেষ্টা করছে। বস্তুত দুটি নদী মাঝের ভূমিখণ্ড মাত্র ২৫০ মিটারে এসে ঠেকেছে।
দু'শো বছর আগে নদীগুলিতে জলের স্তর নিচে থাকায় বাঁধগুলি তৈরি হয়েছিল জোয়ারের উচ্চসীমা ও ভাঁটার নিম্নসীমার অন্তর্বর্তী স্থানে (ইন্টার টাইডাল স্পেস)। বিগত দু'দশকে উষ্ণায়নের ফলে ক্রমবর্ধমান জলস্তর ও নদীবক্ষে পলি জমার কারণে নদীগুলিতে জলস্তর অধিকাংশ সময় পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও কৃষি জমির থেকে উপরেই থাকে। ফলে জোয়ারের সময় বাঁধ উপচে গ্রাম ভেসে যায়। ১৯৬০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আসে সেচ দপ্তরের কাছে। কিন্তু উন্নয়নের কার্যক্রমে প্রান্তিক মানুষের বসতি বাঁচাতে বাঁধ সংরক্ষণ কখনোই অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল না। নদীর গতিপথ ও গভীরতা বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্যের অভাব, দরিদ্র মানুষের আধিক্য, সীমিত চাষের জমি এ সবই বাঁধ সংরক্ষণ ও মেরামতের পথে বড়ো অন্তরায়।
সেচ দপ্তরের মতে আইলার বিপর্যয়ের পর বাঁধ মেরামতের জন্য অনুমোদিত ৫,০০০ কোটি টাকার আশি শতাংশ ফেরত যাওয়ার মূল কারণ ছিল গ্রামবাসীদের জমি দিতে অনিচ্ছা। ৮০০ কি.মি. বাঁধ তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল ৬,০০০ একর জমি। পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ২,৫০০ একর। তাই দিয়ে ৮৪ কি.মি. নির্মাণ হওয়ার পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় বিতর্ক। এ বিষয়ে মানুষের অভিমত অবশ্য ভিন্ন। তাদের অভিজ্ঞতা এবং সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে সেচ দপ্তরের প্রতি গ্রামবাসীদের বিশ্বাসে একটা বিরাট ঘাটতি আছে।
সেচ দপ্তরের বাঁধ নির্মাণ এখনও ঔপনিবেশিক আমলের ‘বেঙ্গল এম্ব্যাঙ্কমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮২’ দ্বারা পরিচালিত। এই আইন তৈরি হয়েছিল ইংল্যান্ডের নদীগুলির স্থায়ী গতিপথের প্রেক্ষিতে। এর সাথে সুন্দরবনের নদী ও সংলগ্ন ভূমির পরিবর্তনশীল চরিত্র এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কোনো তুলনা অসম্ভব। কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা, আধিকারিকদের মানুষের মতামত গ্রহণে অনিচ্ছা ও জমির সঠিক ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ এই অঞ্চলে জীবন ও জীবিকার পুনরুদ্ধার সম্পূর্ণ নির্ভরশীল বাঁধ মেরামত ও সুরক্ষার উপর। সাধারণ মানুষের সহায়তা ছাড়া এই কাজ অসম্ভব।
ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর প্রশ্রয়ে বাঁধ কেটে নোনা জল ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ অথবা বাঁধের মাটি কেটে বেআইনি ইঁটভাটার ব্যবসা বন্ধ না হলে মানুষের জীবিকা তো বটেই সুন্দরবন বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস অনিবার্য। এক দশক আগেও ইঁটভাটার এই রমরমা ছিল না। দুর্যোগের পথে নিশ্চিত ধাবমানতা রুখতে প্রতিষ্ঠান ও মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা প্রাথমিক শর্ত। বাঁধের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করা ও সহমতের ভিত্তিতে কিছু জমি নদীকে পলি ছড়ানোর জন্য ফিরিয়ে দেওয়ার উপর। সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। দুর্গম অঞ্চলে দেখভালের কাজেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাঁধের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে।
বাঁধের প্রযুক্তি নিয়েও চর্চার অবকাশ আছে। ইয়াসের অব্যবহিত পরে প্রযুক্তিবিদদের সাথে একটি আলোচনায় অংশগ্রহণ করে বুঝলাম এ বিষয়েও দিশাহীনতা স্পষ্ট। ব্যয়বহুলতা ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে কংক্রিটের বাঁধ সমাধান নয়। বিকল্প প্রযুক্তির চিত্রটি খুব পরিষ্কার নয়। নদীর গতিপথ, পলির পরিমাণ, স্রোতের গতিবেগ ও জলতলের উচ্চতা বিষয়ে তথ্য না থাকায় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অতীতে রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে একটি সংস্থা এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করতো কিন্তু প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয়তার কালে স্বাভাবিকভাবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তথ্যের অপ্রতুলতা ও অঞ্চল ভিত্তিতে বাঁধের পারিপার্শ্বিক ভিন্ন হওয়ায় মানুষের পরম্পরালব্ধ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করাই সঠিক বলে মনে হয়। মাটি, বাঁশ ও জৈব প্রযুক্তির (জুট জিওটেক্সটাইল) মাধ্যমে স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব বাঁধ নির্মাণ সম্ভব বলেই অনেক প্রযুক্তিবিদ মনে করেন। রাজ্যের কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা এখন অনেকটাই এগিয়েছে। প্রয়োজন তার সাথে সংযোগ স্থাপন। মূল বিষয় মানসিকতার পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তার ঘেরাটোপ অতিক্রম করে স্থানীয় পরিস্থিতি উপযোগী প্রযুক্তির সন্ধান।
এবার আসি উন্নয়নের সমস্যা প্রসঙ্গে। একটা বিষয় প্রথমেই বুঝে নিতে হবে যে বিশ্বের দরবারে সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম বাদাবন বাস্তুতন্ত্র (ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম) ও জীববৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল সম্ভার। পৃথিবীর একমাত্র বাদাবন যেখানে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। ভারতবর্ষে এই অঞ্চলই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঘের বসতি ও আশ্রয়স্থল। এছাড়াও বহু বিরল ও বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির বাসগৃহ। বিশ্বসংস্থা (ইউনেস্কো) সুন্দরবনকে অন্যতম জীব পরিমণ্ডল ( বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ) ও বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই কারণে বহির্বিশ্বে এবং দেশের সরকারের কাছে প্রথম থেকেই প্রাধান্য পেয়েছে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও মানুষ চিহ্নিত হয়েছে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে। পৃথিবীর আরও অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো (আমেরিকার ইয়েলো স্টোন জাতীয় উদ্যান অথবা ব্রজিলের আমাজন) এখানেও সংরক্ষণ ও প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের দ্বন্দ্ব অত্যন্ত প্রকট। প্রশাসন স্থিতাবস্থার পক্ষে। আবার কখনও ‘গ্লোবাল গুড’ এর তত্ত্ব মেনে প্রকৃতিবিনাশী ও বাণিজ্যিক পর্যটনে প্রশ্রয় দিতে ব্যস্ত। বিপন্ন মৌসুনি দ্বীপে উপকূলীয় নিয়ম ভেঙে সহজেই বাদাবন ধ্বংস করার অনুমতি পেয়ে যায় কর্পোরেট পর্যটন সংস্থা। অন্যদিকে বিকল্প না থাকায় বছরে তিন মাস সুন্দরবনের মহিলারা নদীতে মীন ধরেন সংসার চালাতে। প্রান্তিক মানুষের এই জীবিকা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে বলে বিশ্বব্যাংকের ২০০৩-এর রিপোর্ট দাবি করেছে। তাই এই স্থিতাবস্থা - প্রান্তিক মানুষের সমস্যা সমাধানে চূড়ান্ত উদাসীনতা ও প্রতিদিনের ঘনিয়ে আসা দুর্যোগ।
মানুষের জীবন অনেক বেশি সমস্যা সংকুল হয়েছে আইলার পর থেকে। নোনা জলের প্রভাবে উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে কৃষি ও মৎস চাষে। বিপদজনক মাত্রায় বেড়েছে জঙ্গলের উপর নির্ভরতা। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ জঙ্গলে ঢুকেছে মধু ও কাঁকড়ার খোঁজে অথবা মাছ ধরতে। এগুলির বাজার দর বেশ ভালো। কিন্তু তার পরেও জীবনধারণের সংস্থান করতে না পেরে পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করেছে। অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। বেড়েছে মহাজনী ঋণের ফাঁদ। আর্থিক সমস্যার জেরে ঘাঁটি গেড়েছে মহিলা ও শিশু পাচারের চক্র। শেষ পর্যন্ত অনেকে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে। বর্তমানে সুন্দরবনে প্রায় ২০ শতাংশ পরিবারের একজন থাকে কেরল, মহারাষ্ট্র অথবা অন্ধ্রপ্রদেশে। যদিও দু'বার লকডাউনের ফলে অধিকাংশ শ্রমিক গ্রামে ফিরে এসেছে। একশো দিনের কাজ দিয়ে ক্ষুধা ও বেকারত্ব সামলানো যাচ্ছেনা। এই সময় পারমিট নিয়ে জঙ্গলে ঢোকা বন্ধ। পেটের দায়ে মানুষ আইন ভেঙে জঙ্গলে ঢুকছেন। বাঘের আক্রমণে মৃতের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। মহিলা ও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যহীনতা লক্ষণীয়। পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারে মহিলারা বাধ্য হচ্ছেন উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে। নদীতে মীন ধরে জীবিকা সংস্থান, বাড়ির কাজ ও শিশুদের দেখভাল করতে গিয়ে নিজেদের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই।
আমফানের পর থেকে অপরিচ্ছন্নতার কারণে হিঙ্গলগঞ্জ, মিনাখাঁ ব্লকে স্ত্রীরোগের বাড়বাড়ন্ত। ২০১৩ সালে জয়পুরের ইনস্টিটিউট অফ হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ এর গবেষণা দেখিয়েছে দুর্যোগ কবলিত পরিবারের ৪৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। পাথরপ্রতিমা ও অন্য ব্লকে প্রয়োজনের তুলনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কম। যোগাযোগবিহীন অঞ্চলে আন্ত্রিক ও জরুরি অবস্থাকালীন রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ অমিল। ৬২ শতাংশ রুগীর চিকিৎসা হয় হাতুড়ে পদ্ধতিতে। সংখ্যাটা পশ্চিমবঙ্গের অন্য গ্রামীণ এলাকার থেকে অনেক বেশি। ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রাজ্য সরকারের উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় ৩৫১টি গ্রামে ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে চলেছিল। কোনও অজানা কারণে তারপর থেকে বন্ধ। অগ্রাধিকারের সমস্যা। সমস্যা আছে শিক্ষার পরিকাঠামোতেও। সুন্দরবনের সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ। অন্য জেলার থেকে বেশি। কিন্তু শিক্ষার মান আশাব্যঞ্জক নয়।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। দু'বছর আগে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সমস্যা নিয়ে গবেষণার কাজে গিয়েছিলাম গোসাবার সাতজেলিয়া গ্রামে। সমীক্ষার সূত্রে একটি পরিবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছাত্রীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানলাম বিদ্যালয়ের পাকা বাড়ি আছে কিন্তু শিক্ষক না থাকায় বাংলার শিক্ষক দ্বাদশ শ্রেণিতে ইতিহাস পড়ান। ছাত্রীটিকে দু'সপ্তাহের জন্য অভিভাবকের সাথে নদীপথে বাসন্তীতে গিয়ে দু'সপ্তাহ বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকে পরীক্ষা দিতে হবে। দুর্গম অঞ্চলে উন্নয়নের প্রতি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা আভাস পাওয়া গেল।
মূলধারার উন্নয়ন সীমাবদ্ধ চিরাচরিত পরিকাঠামো - রাস্তা, বাঁধ, সেতু, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণে ও সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছানোর কাজে। উন্নয়নের সামগ্রিক ধারণা ছাড়াই চলছে প্রকল্পগুলির খণ্ডিত রূপায়ণ। যে কারণে বাঁধ নিয়ে এতো বিতর্ক। সাইক্লোন শেল্টারের স্থান নির্বাচন নিয়েও দ্বিমত আছে। পরিকাঠামো নির্মাণে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর - সেচ, ভূমি অধিগ্রহণ, পরিবেশ, বিপর্যয় মোকাবিলা ও স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সমন্বয় নেই। লোকরঞ্জনী রাজনীতির যুগে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা ও অন্যান্য প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের দৈনন্দিন টিকে থাকা ও শাসকের নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর হাতিয়ার। এই মডেল উপভোক্তা তৈরি করেছে কিন্তু উন্নয়নের লক্ষ্য ও পথ নিয়ে যৌথ বোঝাপড়ার দিকে এগোনো যায়নি। সমাজ হয়েছে বিভক্ত। বিপর্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৈধতা পেয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজের সামাজিকীকরণ। মানবসম্পদের উন্নয়ন অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। পরিকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের অংশীদারিত্বের প্রয়োজন স্থানীয় প্রশাসন ও গ্রামবাসীদের বোঝানো যায়নি। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কি?
কিন্তু এই অঞ্চলে সামাজিক উদ্যোগের ঐতিহ্য ছিল। গোসাবায় একসময় স্কটিশ ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের উদ্যোগে বিরাট অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল কৃষি সমবায়। তৈরি হয়েছিল সমবায় ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ পুনর্নির্মাণ কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ঋণ, মিষ্টি জলের পুকুর ও জৈব চাষের ব্যবস্থা। গোসাবা সমবায় সমিতির সাথে মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে গোসাবার অধিবাসীদের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। গোসাবার রাঙাবেলিয়াতেই টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে গোসাবা, বাসন্তী ও ক্যানিং ১ নং ব্লকে ১২৩টি গ্রামে চলে সুসংহত গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প। লবনাক্ত জমি ও পুকুরে কৃষি ও মৎসচাষ, প্রাণীজ সম্পদ বিকাশ, মহিলা স্বনির্ভরগোষ্ঠী, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য এবং বাদাবন সংরক্ষণের বিকল্প মডেল নিয়ে চার লক্ষ মানুষের মধ্যে বিস্তৃত এক বিরাট সামাজিক পরীক্ষাগার। আরও বেশ কিছু সংস্থা স্থানীয়ভাবে মূল স্রোতের বিপরীতে বহুমুখী উন্নয়নের ধারণাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ গোষ্ঠীর চাপে বিশ্ব ব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড তাদের ২০১০-১১ সালের রিপোর্টে ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের ৬টি ব্লক থেকে ৩৫৭টি গ্রামের ১৫ লক্ষ মানুষকে অন্যত্র স্থানান্তরিত (ম্যানেজড রিট্রিট) করার নিদান দিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে তারা নেদারল্যান্ড ডেল্টা পরিকল্পনার সাফল্যকে তুলে ধরছে। এই সুপারিশের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। নেদারল্যান্ডের ও সুন্দরবনের সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় এক হলেও সেখানকার নদী, ভূমি গঠন ও পলি সঞ্চয়ের সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ। আর্থ সামাজিক অবস্থার কোনো তুলনা চলেনা। সুন্দরবনের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জল-জঙ্গল ভিত্তিক মরশুমি জীবিকার পুনর্বাসন মোটেই সহজ কথা নয়। সুন্দরবন ও সংলগ্ন কলকাতা মহানগর ভারতবর্ষের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। ক্ষয়প্রবণ ঘোড়ামাড়া দ্বীপ থেকে এর আগে সাগরের বঙ্কিম নগরে স্থানান্তরিত পরিবারগুলি দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। ফলে বিপন্ন ওই দ্বীপের পাঁচ হাজার মানুষকে কিছুতেই পুনর্বাসনে রাজি করানো যাচ্ছে না। তার অর্থ এই নয় যে পুনর্বাসনের একেবারেই প্রয়োজন নেই। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে ৬টি ব্লকের ৬০টি গ্রাম উপর্যুপরি দুর্যোগের কবলে পড়ছে। পরিকল্পনা করে নদীগুলির পলি ছড়ানোর ব্যবস্থা ও মানুষের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে এদের পুনর্বাসনের চিন্তা শুরু করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনার সুযোগ ব্যবহার করে কম জায়গায় বিকল্প প্রযুক্তিতে পুনর্বাসন সম্ভব। ভূমিকম্পের পর গুজরাটের ভুজে সাফল্যের সঙ্গে এই ধরনের সুসংহত গোষ্ঠী পুনর্বাসনের কাজ হয়েছে। তথ্যের ভিত্তিতে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা করতে পারলে এগুলি হয়ে উঠতে পারে বিপর্যয় সহনশীল এক একটি আদর্শ গ্রাম। ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা। প্রয়োজন স্থানীয় প্রশাসন, সরকারি দপ্তর ও গ্রামবাসীদের মতবিনিময়। আরও একটি বিষয় বোঝা প্রয়োজন। কিছু মানুষ কাজের খোঁজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কলকাতা ও ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। কারণ সেখানে কাজের সুযোগ আছে। সেই সুযোগ সুন্দরবনের নিকটবর্তী গ্রামীণ শহর - ক্যানিং, মথুরাপুর, কুলতলী বা জয়নগরে তৈরি করা সম্ভব হলে মানুষ সেখানেও স্বেচ্ছায় আসবে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিপর্যয় সহনশীল ও সুযোগসমৃদ্ধ মাঝারি ও ছোট শহর গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের সমস্যা সমাধানের রাস্তা দেখাবে।
২০০৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে জাপানে আয়োজিত বিপর্যয় মোকাবিলা সংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনে আলোচনার মূল বিষয় ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষত স্থানীয়ভাবে বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থা ও ক্ষমতা গড়ে তোলা। সাম্প্রতিক কালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ- জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ এবং আমাদের দেশে ছোট রাজ্য কেরালা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ তৃণমূলস্তরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষা ও সক্ষমতা তৈরির একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যানঃ ২১০০’। কেরালায় সমস্ত পঞ্চায়েত ও পুরসভা বিপর্যয় মোকাবিলায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পনা তৈরি করেছে। আমরা সেখান থেকে অনেক দূরে। উপর্যুপরি বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রকৃতি বিনাশী বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের দাপটে সুন্দরবনে মানুষের জীবিকা ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার মুখে। সমস্যার গভীরতা ও সমাধান নিয়ে বহুমত রয়েছে। কারণ তথ্যের অভাব। অবিলম্বে কয়েকটি কাজ করা প্রয়োজন।
এক, দুর্যোগপ্রবণ দ্বীপ ও গ্রামগুলিতে নদীর গতিপ্রকৃতি, বাঁধের পরিস্থিতি, ভূমিক্ষয়, বাদাবনের অবস্থা, সামাজিক-অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে হবে। তথ্য প্রস্তুতে বিভিন্ন সময়ে তোলা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উপগ্রহ চিত্রের সাহায্য নেওয়া সম্ভব। এতে সমস্যার বহুমুখী চরিত্র ও প্রবণতা বিশ্লেষণে সুবিধা হবে। তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ণের দরজা খুলবে।
দুই, সুন্দরবন ও সন্নিহিত অঞ্চলে মাঝারি ও ছোট শহরগুলিকে বিপর্যয় সহনশীল, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও উন্নত পরিষেবা প্রদানের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ কমাতে ও আগামী প্রজন্মকে বিকল্প জীবিকার সন্ধান দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে এই শহরগুলি।
তিন, আইলা ও আমফানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নোনা প্রতিরোধী দেশীয় প্রজাতির ধান, মাছ ও সবজি চাষের ব্যবস্থা করা সম্ভব। গোষ্ঠীভিত্তিক বীজ ভান্ডার ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ আশু প্রয়োজন। মৎস্য সমবায় গড়ে তোলায় নজর দিলে বেআইনি ভেরির বিস্তারে রাশ টানা যাবে।
চার, প্রতিটি ব্লকে গ্রামবাসীদের দক্ষতা ভিত্তিক বিকল্প জীবিকা ও খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা নিতে হবে। পানীয় জলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের সহায়তায় পরিকল্পনামাফিক বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা আরও বাড়ানো সম্ভব।
সুসংহত উন্নয়ন এক বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মানানসই নীতির ভিত্তিতে জীবন, জীবিকা, পরিকাঠামো ও পরিবেশ সংরক্ষণের সামগ্রিক পরিকল্পনা, প্রকল্পের ভাবনা, রূপায়ণ, মূল্যায়ন এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নীতি, পরিকল্পনা ও প্রকল্পের পরিমার্জন। সুন্দরবনের জটিল ও ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রে উন্নয়নের সাথে যুক্ত সব অংশীদারের কাছে উন্নয়নের ধারণা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন নির্ভর করবে প্রশাসন ও সরকারি সংস্থাগুলির আমলাতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির পরিবর্তন ও সমন্বয়ের উপর।
ধারাবাহিক বিপর্যয় প্রমাণ করেছে ত্রাণ দিয়ে আর বাঁধ মেরামত করে সুন্দরবনকে বাঁচানোর দিন শেষ। অনুদান দিয়ে উন্নয়নের দায় এড়ানো যাবেনা। প্রয়োজন রূপান্তরমুখী পরিবর্তন ও তার জন্য পরিকল্পনা। যার কিছু উদাহরণ এখানে আলোচনা করা হয়েছে। পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রান্তিক মানুষের উন্নত জীবনযাত্রার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উৎপাদন ব্যবস্থার এক সমন্বিত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে গেলে চাই স্থায়ী সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও তার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এই পরিবর্তনের প্রাথমিক শর্ত প্রশাসন ও সুন্দরবাসীর সমস্যা ও আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে খোলাখুলি মতবিনিময়। স্থানীয় মানুষকে তার নিজের, প্রতিবেশীর ও সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা প্রকাশ করার পরিসর তৈরী করে দিতে হবে। এই আলোচনায় সাফল্যের পূর্বশর্ত মানুষের আর্থিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সুনিশ্চিত করা। তাই, ভাবা দরকার পঞ্চায়েত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কি করে দায়বদ্ধ করে তোলা যায়। উন্নয়নের নামে খয়রাতি ও লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির আবহে এ বড়ো কঠিন কাজ। কিন্তু সুন্দরবনকে বাঁচানোর অন্য কোনও সহজ রাস্তা নেই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
● “লিভিং ডেল্টাস রিসার্চ হাব ২০১৯-২০২৩” প্রকল্প সহায়তা ইউ . কে. আর. আই.
● “ইকো-ডেভেলপমেন্ট এন্ড বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশানঃ সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ২০১১-২০১২” প্রকল্প সহায়তা উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া
তথ্যসূত্রঃ
● Danda, A. A., Sriskanthan, G., Ghosh, A., Bandyopadhyay, J. and Hazra, S. (2011) Indian Sundarbans Delta: A Vision, New Delhi: World Wide Fund for Nature-India
● Ghosh, U. Bose,S. and Bramhachari,R. (2018) Living on the Edge: Climate Change and Uncertainty in the Indian Sundarbans, Sussex: STEPs Centre, Institute of Development Studies, University of Sussex, UK
● Ghosh, T., Bhandari, G. and Hazra, S. (2003) 'Application of a ‘bio-engineering’ technique to protect Ghoramara Island (Bay of Bengal) from severe erosion', Journal of Coastal Conservation 9.2: 171-178
● Iqbal, I. (2006) 'Towards an environmental history of colonial East Bengal: paradigms and praxis', Journal of the Asiatic Society of Bangladesh 50.1-2
● Jana, D. (2004) Ed. Sreekhondo Sundarban, Kolkata: Deep Prakashan
● Mukhopadhya, A. (2009) Cyclone Aila and the Sundarbans: An Enquiry into the Disaster and Politics of Aid and Relief, Kolkata: Mahanirban Calcutta Research Group
● Rudra, K. (2010) 'The proposal of protecting Sunderban by the stronger embankment: Myth and Reality', Refugee Watch 35: 86-92
● WWF (2010) Sundarbans: Future Imperfect Climate Adaptation, New Delhi: World Wide Fund for Nature