আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
প্রবন্ধ
তৃতীয় পক্ষ
বোধিসত্ব দাশগুপ্ত
অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জিনিসটা যখন যে ভাবে যেখানেই দানা বাঁধুক না কেন, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ের নানা সমস্যার সমাধান প্রস্তাব নিয়ে আসাটা যদি মতাদর্শের কাজ হয়, রাজনীতির কাজ তার কর্মসূচী নির্মাণ ও রূপায়নের। কিন্তু নির্মান ও রূপায়ন দুটি পর্বে যেটা জরুরী হয়ে ওঠে সেটা হল, অনেকের হয়ে ওঠা সম্ভব এরকম একটা ভবিষ্যত দৃষ্টি। ছোটো পরিবর্তন বা বড় রূপান্তরকালের দুটিরই ঐটেই চাবিকাঠি।
এবার খুব স্বাভাবিক ভাবেই গোটা পদ্ধতিতেই একটা কালনিক্ষেপ থাকবে।
ভবিষ্যতদৃষ্টি বস্তুটা সমসাময়িকতা অনুযায়ী বদলে যাওয়া বিশুদ্ধতাবাদীদের দৃষ্টিতে আপত্তিকর হলেও অস্বাভাবিক না। সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনটিতে, মোটামুটি বলা যায় একটি অতিপশ্চাতপদ এবং ভয়ংকর এবং আরেকটি আশাব্যঞ্জক হলেও কিছুটা নির্মাণে অংশতঃ নস্টালজিয়াপন্থী ভবিষ্যতদৃষ্টি পরাজিত হয়েছে।সমসাময়িকের সংকট তীব্র হোক, আর জনগণের অকারণ উত্তেজনায় অনিচ্ছাতেই হোক রাজনৈতিক ভবিষ্যতদৃষ্টির ধারণাটিও নতুন করে ধাক্কা খেয়েছে। ফলে এই ভোট স্থিতাবস্থার পক্ষে এবং বিপজ্জনক অথবা অকারণ অতীতচারণের বিপক্ষে ঘটেছে। এবং স্থিতাবস্থার পক্ষে মানুষের মন ছিল। লোকসভার নির্বাচন একই সঙ্গে হলে, বিজেপির শক্তি বাড়তো বই কমতো বলে মনে হয় না।
বাংলায় বিজেপির নতুন উত্থান আপাতত একটি চলমান বিষয়
বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারে ২০১৯ এ কিছুটা স্বল্পোচ্চারিত, এবার একেবারে ঘোষিত দিক যেটি ছিল, সেটি সাম্প্রতিক কালে পশ্চাদপদতার ভয়ংকরতম উদাহরণ। তাঁরা সরাসরি ১৯৪৭ এ বাংলাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তারপরের ইতিহাসকে নতুন করে গড়ার অবাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে। বিজেপি অন্তহীন বাজেট নিয়ে নির্বাচন করতে এসেছিল, দীর্ঘদিন ধরেই সমস্ত ধরনের মিডিয়ায় সমস্ত ধরনের বিজ্ঞাপন চলছিল, টেলিভিসন চ্যানেল গুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল এই নির্বাচনী ঝড়ে বিজেপির অ্যাসেট হয়ে ওঠার।
সবচেয়ে লজ্জার হল, পালা পার্বনে বাঙালি জাতীয়তাবাদে গদগদ মিডিয়া সংস্থাগুলি বিজেপির প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক ও সম্পাদকীয় পক্ষপাত করছিল, অসমের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত হয়ে। উত্তরপ্রদেশের সরকারের সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনার সার্বিক ব্যর্থতা এবং উচ্চকিত সাম্প্রদায়িক প্রচারের ঘটমান বাস্তব সত্ত্বেও, বিজেপির উদ্যোগে দিল্লীর বুকে ছাত্র ছাত্রীদের উপরে আক্রমণ, সংখ্যালঘুদের, প্রতিবাদী মানুষদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা সত্ত্বেও, এবং নির্বিকার চিত্তে সম্ভাব্য সুশাসনের প্রচার চলছিল।
তবে দুটি সত্য চাপা দেওয়া কঠিন ছিল। একটি আগেই বললাম, অবাস্তব ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর পছন্দের অতীত নির্মাণ, আর দ্বিতীয়টি কিঞ্চিৎ কৌতুক উদ্রেককারী। সাম্প্রতিককালে মোটামুটি সব মিলিয়ে ১১ বার, এইবারের বাংলা ধরে বারো বার বিধান সভা নির্বাচনে অমিত শাহর জয়ের নির্ঘোষ অসার প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর আর যে কোনো চাকরি খোয়ানোর পক্ষে এই খতিয়ান যথেষ্ট।
আর সত্যি কথা বলতে কি, এলিট কথোপকথনে, রাজনৈতিক উত্তেজনার সীমানা সম্পর্কে একটা ধারণা আমাদের আছে। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ র আগে অবদি বহুবার আমরা বামেদের নিশ্চিত পরাজয়ের সম্ভাবনা, বিরোধী নেতাদের উল্কাসম উত্থান আলোচিত হতে দেখেছি। বহু ‘এবার’ সমসংখ্যায় ‘নেভার’ হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ বহুদিন ই বাম্ফ্রন্টের থেকে মুখ ঘোরান নি, যতদিন তাঁদের অধিকাংশ অংশ মনে করেছেন, রাজ্যের সরকার মোটের উপরে তাঁদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে। অতএব কাগজে বা টিভির ভাষ্যে, অসংখ্য বিমূর্ত রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণে নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে বলেই, বাংলার ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক ঐতিহ্যের হাঁটু কাঁপা উচিত এবং বিজেপির জয় অবশ্যম্ভাবী এই দক্ষিণপন্থী ভদ্রলোকীয় স্বপ্নে আমার অন্তত উৎসাহ বিশেষ ছিল না। এবং সে কারণেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর কোনো বিষয় ই বিচার্য নয়, এই রাজনৈতিক অবস্থানে আমার সাংঘাতিক আস্থা কিছু ছিল না। যে বিশ্লেষকরা নিশ্চিত ছিলেন, বামেরা শুধু ভোটে দাঁড়ানোর জন্যই, বিজেপির ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত, তাঁরাই নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে একই আত্মবিশ্বাস ও গাম্ভীর্য্যের সঙ্গে বলছেন, এ সমস্তই জানা ছিল, তৃণমূল বিজেপির লড়াই তে বামেরা যে কোনো বিষয়-ই না, সেটা আগেই বোঝা গেছিল। অতএব বামেদের নিজের বিশ্লেষণ প্রচেষ্টার উন্ননয়ন সাধন করার সঙ্গে সঙ্গে কোন সমালোচনাকে কেন আন্তরিক মনে করব, সেটা একটু বাছতেও শিখতে হবে।
অন্তহীন আর্থিক সংস্থান, কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি অপব্যবহারের সুবিধা, বশংবদ মিডিয়া ও আমলাতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও এই ব্যর্থতা এবং তদসত্ত্বেও বিজেপির বাগাড়ম্বর সত্যি ই হাস্যকর ছিল। সর্বস্তরের বাঙালির অন্ধকার অতীতে ফেরার বা আত্মহননের ইচ্ছা ছাড়া বিজেপির জয় সম্ভব ছিল না। অবশ্য নবনির্বাচিতসরকারটিকে উত্যক্ত করার, তার আইন সভার শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করার সমস্ত প্রচেষ্টাই তারা চালাবে বলেই মনে হয়।
২০১৪ হলে তাও কথা ছিল, ২০২১ এ এসে বিজেপিকে তাঁদের সততা ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতির জন্য, অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রাজ্ঞতার জন্য কেউ ভোট দেবে এই আশা সম্ভবত প্রধান প্রচারকও করেন না।
এই নির্বাচনকে যদি বাংলার ভ্দ্রলোক শ্রেণির নবতম সংগঠন প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হয়, জাতঘৃণা ছাড়া, আধিপত্যবাদী সংস্কৃতিতে গভীর আস্থা না থাকলে বিজেপিকে কেউ ভোট দেবে না এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। যে ২ কোটি ২৮ লক্ষ মানুষ তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁদের কর্মসূচীর এই পশ্চাদমুখীনতা এবং বিদ্বেষভিত্তি মেনেই সমর্থন জানিয়েছেন, এবং ভবিষ্যতে এই অবস্থান থেকে তাঁদের বের করে আনতে রাজনৈতিক দলগুলিকে পরিশ্রম করতে হবে।গভীর বেদনার সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশনের অধীনের বাহিনীর হাতে ভোটার খুন হবার ঘটনাও কিন্তু এই নির্বাচনেই ঘটেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি
বিজিতদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলেও, তৃণমূল কংগ্রেসের এবারের জয়, নানা ব্যাখ্যা সত্ত্বেও, আমার কাছে একটিই কারণে চমকপ্রদ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবর-ই কলকাতার মিডিয়ার অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছেন। ৭ এর দশক থেকে ১৯৮৪, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮,১৯৯৮ থেকে ২০১১ এবং ২০১১ থেকে ২০১৬ এই কয়েকটা পর্যায়ে যদি তাঁর রাজনৈতিক জীবন কে ভাগ করে নেওয়া যায়, ৮ এর দশক থেকেই প্রতিটি পর্যায়েই তাঁর রাজনীতির প্রতি, তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের প্রতি, কর্মপদ্ধতির প্রতি মিডিয়ার সমর্থন বেড়েছে। অথচ দল হিসেবে মাঝে ৯ এর দশকে একবার লোকসভা নির্বাচনে মোটামুটি ভালো ফল করে ২০০৮ থেকে তৃণমূল নানা নির্বাচনে ভাল করতে আরম্ভ করেছে। এবং বলা বাহুল্য তখন ই তাঁরা ভালো ফল করতে আরম্ভ করেছেন, যখন বড় বা ছোটো শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গ্রামীণ জনতা এক সঙ্গে নিজ নিজ কারণে তাঁদেরকেই বিকল্প ভাবতে আরম্ভ করেছেন।
আদ্যপান্ত মিথ্যাচার, প্রভূত বাহুবল ব্যবহার, গঠনমূলক রাজনীতিকে শতহস্ত দূরে রাখা, নতুন নতুন মিডিয়া তৈরি, সমাজবিরোধী দের আস্তানা দেওয়ার অভিযোগ, সরকারে ও দলে যথেচ্ছচারীতাটিকেই নিয়ন্ত্রণ হিসেবে ব্যবহার করা, রাজনীতিতে ৯ এর দশকে বিজেপির সঙ্গে সরকারে অংশ্রগ্রহণ আবার হঠাৎ সাচার কমিটি পরবর্তী বাংলায় ধার্মিক মুসলমানের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হয়ে ওঠা, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে, সরকারের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্য ধর্মাচরণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা এবং সেটাকেই জনসংযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা সত্ত্বেও, বিরোধীহীন রাজনীতির চক্ষুলজ্জাহীন প্রয়োগ সত্ত্বেও ঐতিহ্যশালী মিডিয়ার সমর্থন তাঁকে হারাতে হয়নি। কারণ একটাই, মিডিয়া একমাত্র তাঁকেই প্রকৃত বাম বিরোধী রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ তাঁদের দলের কাটমানি নেওয়া হয় নি এবং কাটমানি ফেরৎ দেওয়া হবে, দুটি ঘোষণাই সহর্ষে সমর্থন করেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষ দোষে গুণে ভরা কাছের মানুষ হিসেবেই দেখেছে, অন্য রাজনীতিবিদদের জন্য চালু মাপ কাঠির তোয়াক্কা করে নি। মিডিয়া এই দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
এবারের নির্বাচনে মমতা, জীবনে সম্ভবত প্রথমবার, বাংলা মিডিয়ার, কাগজে ও টেলিভিসন কোথাও ই, নিরংকুশ সমর্থন পান নি,বিজেপি নিজের বিজ্ঞাপণে ও ভাষ্যে, বিলবোর্ডে বাংলাকে মুড়ে রেখেছিল, এক বিলবোর্ডেই কিছুটা প্রতিযোগিতা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মমতা আগে পড়েননি, শিক্ষিত বাঙালির একটা অংশের হঠাৎ শখ গজিয়েছে, ১৯৪০ এর দশকের বীভৎসতার পরেও নতুন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সহর্ষ সমর্থন করার। এরকম বিচিত্র পরিস্থিতি অবশ্য বাংলায় ২০১৮ এর আগে আসে নি, এবং ২০১৯ এর আগে প্রকট হয় নি। সমস্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা গুলির নির্লজ্জ অপব্যবহার করেছে বিজেপি, ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের অধীনের বাহিনী গুলি চালিয়ে নাগরিক হত্যা করেছে, এবং সেই আসনেও বিজেপি জিতেছে, ঘৃণার এত জোর, তবু সব মিলিয়ে তৃণমূল জিতেছেন, বিজিতদের পক্ষ থেকেও তাঁদের অভিনন্দন প্রাপ্য।
তৃণমূলের রাজনীতির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্বের, সাফল্যের নানা ব্যাখ্যা হয়েছে। ভদ্রলোকের রাজনীতির সমালোচনা করেছেন যাঁরা, তাঁরা অসুবিধেয় পড়েছেন, মূলতঃ উচ্চবর্ণ মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক পুরুষ রাই তাঁর দলের নেতৃত্বে থাকাটাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, শুধুই নীচুস্তরের স্বৈরাচারী হিসেবে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, তাঁরা সবসময়ে স্বীকার করেন নি, তাঁর প্রশিক্ষণ হয়েইছে, ইন্দিরা এবং সঞ্জয় গান্ধী রাজনীতির ভরা কোটালের আমলে, যাঁরা তাঁকে প্রকট মুসলমান তোষণের রাজনীতির জননী হিসেবে দেখেছেন, তাঁরা মানোবন্নয়নের সমস্ত সূচকে তাঁর শাসনের আমলে মুসলমানদের পশ্চাদপদতাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। যাঁরা তাঁকে শুধুই জঙ্গলমহল ও পাহাড়ের মুক্তিদাতা হিসেবে ভেবেছিলেন, তাঁরা পরবর্তীতে এই অঞ্চলে বিজেপির উত্থান ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। যাঁরা তাঁকে নিও লিবেরাল রাজনীতির প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন, তাঁরা তাঁর সরকারের শ্রমিকের কর্মচারীর ইউনিয়ন করার অধিকারের বিরোধীতা, বিচিত্র কৃষি আইন, সরকারী কাজকর্মে চুক্তিশ্রমের অত্যধিক ব্যবহারকে ব্যাখ্যা করতে পারেননি, যাঁরা তাঁকে নারীবাদী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, তাঁরা নারী নির্যাতনের অপরাধ গুলির বিষয়ে, নারী বা কন্যা পাচারের বিষয়গুলিতে তাঁর উদাসীনতা এবং সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করার প্রবণতা ব্যখ্যা করতে পারেন নি।
মমতা এবং জয়ললিতার উত্থান একটু আগে পরে।সময়টাকে দেখলে বোঝা যাবে, এই সময়টাতেই দেশের রাজনীতিতে দুটি ঘটনা ঘটছে, মোটের উপরে। রাষ্ট্র পরিচালিত ক্ষেত্র গুলি থেকে রাষ্ট্র সরে আসার চেষ্টা করছে, এবং একই সঙ্গে পরিষেবার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্ববোধ ক্রমশ কমছে।আরেকটা ঘটনাও ঘটছে কিছুদিন পরে, মানোবন্নয়নের অর্থনীতিতে মানুষকে বিভিন্ন খাতে দেওয়ার জন্য ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার জনপ্রিয় হচ্ছে এবং এটাকে প্রথাগত পরিকাঠামো-অবকাঠামো ধীরে ধীরে গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ন্যুনতম আর্থিক নিরাপত্তা গড়ে তোলার ব্যাপারে এই বিষয়ে তত্ত্বায়ন হচ্ছে, কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই, এটিকে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিকভাবে প্রগতিশীল পরিবর্তনের বিকল্প না হলেও পরিবর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। মতাদর্শের জগতেও আর্থিক পুঁজির প্রভাব বৃদ্ধি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের পতন, বার্লিন দেওয়ালের পতন ইত্যাদি ঘটনার পরে এবং তার পরে পরেই, বিশ্বায়নের রাজনীতির সর্বব্যাপী প্রভাবের ফলে একটি অসম্ভব গুরুত্ত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে, সেটা হল মিডিয়া সহ সকলেই হঠাৎ মনে করতে শুরু করছেন, অর্থনীতি বিষয়ে, উন্নয়ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌছনো গেছে, আর কোন বাম-দক্ষিণ বিশেষ নেই, বিকল্প চর্চা যতটুকু সেটা প্রশাসনিক প্রকরণ পার্থক্য আর রাজনীতিবিদদের কোন্দল প্রেম মাত্র, সরকার পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ত্বের ধারণা হঠাৎ ই, ৮ ও ৯ এর দশকের শুরুর পরিচিতি সত্ত্বার রমরমার পরে হঠাৎই ধাক্কা খাচ্ছে, প্রশাসন পরিচালনা টাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে দানা বাঁধছে। পরিবর্তনের বদলে প্রবহমানতায় জোর পড়ছে বেশি। আমার কাছে এইটেই কমবেশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি।
প্রশাসনিক অবস্থান ও প্রবহমানতাই রাজনীতি হয়ে ওঠা, একাধারে বিরোধীহীন রাজনীতির প্রতি মানুষের সমর্থন এবং এই যে এখন একটা গঠনমূলক বিরোধিতার ঢল নেমেছে, এই ঘটনাগুলির সমাপতন আকস্মিক বা কাকতালীয় কোনোটাই নয়।মজাটা হল, মতাদর্শে ও রাজনীতিতে এই প্রশাসনিক ভাষ্য, শর্তহীন ঐকমত্যের জয়গান যখন চলছে, তখনই সাংস্কৃতিক, ধর্মের বিষয়ে মানুষের সংবেদনশীলতা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে যাচ্ছে, সুযোগসন্ধানী ধর্মীয় রাজনীতির দলগুলি পূর্বোল্লিখিত প্রশাসনিক ঐকমত্যকেই প্রকৃত বিকল্পের অভাব ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের হাতে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আদি সত্তার অবমাননা হিসেবে দেখাতে সক্ষম হচ্ছে।
৯ এর দশকের শেষে প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই স্থানীয় দলের নতুন নেতৃত্বের একটা উত্থান ঘটেছে, প্রশাসন ই যাঁদের মূল রাজনৈতিক মতাদর্শ, এর আগে চন্দ্রবাবু এবং জয়ললিতা এই ধাঁচের ছিলেন, এখন নীতিশ, নবীন রাই মডেল, যাঁরা রাজনীতির বিকল্প প্রস্তাবের জন্য না, প্রশাসনের গ্রহণযোগ্য প্রধান হওয়ার কারণেই জনপ্রিয়। ৮ এর দশকের ফেডেরালিজম এর সঙ্গে বিশ্বায়ন পরবর্তী সমসায়িক ফেডেরালিজমের এইটেই মূল পার্থক্য। শক্ত রাষ্ট্রের রক্ষণশীল সমর্থকদের কাছে, তথাকথিত লেফ্ট লিবেরাল রাজনীতির ও ততটুকুই গ্রহণযোগ্য, যা এই কাঠামোর মধ্যে।
এর সঙ্গে বাড়তি জটিলতা তৈরি হয়েছে ২০১৪ পরবর্তী সময়ে। অসমে এবং প্রায় গোটা উত্তরপূর্বে ফেডেরালিজম বলতে বাঙালি ও মুসলমান বিতাড়ন বোঝাচ্ছে, এবং এবং সেখানকার রাজ্যস্তরের নেতাদের একই সঙ্গে আর্যাবর্তের ধারণার সর্বময় প্রাধান্য মেনে নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অন্য দিকে নিম্নবর্গীয় জোট একটা উত্তরভারতীয় রাজ্যে ক্ষমতাশীল হলেই জাতীয়বাদ বা ভারতীয়ত্বের পশ্চাদপদ এবং সংখ্যালঘু সম্পর্কে অসহনশীল ধারণার জোর কিছু কমছে তা না। এমনকি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা যাঁরা কদিন আগেই মুজফ্ফর নগরের ঘটনার দর্শক বা সমর্থক ছিলেন, তাঁরা যদি কৃষি আইন সংক্রান্ত ক্ষোভে এবার উত্তর প্রদেশের যোগীকে পর্যুদস্তও করে ফেলেন, তাও জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ধারণাগুলির খুব নাটকীয় পরিবর্তন হওয়া বা ধরুন নারী স্বাধীনতা বা কাশ্মীর প্রসঙ্গে নতুন দিশা গড়ে ওঠা কঠিন। যদিও এবারের ঐতিহাসিক কৃষক অন্দোলনের নেতৃত্বে অভূতপূর্ব ভাবে মহিলারা এসেছেন।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল এর উত্থানের সময় থেকেই আমার মনে হয়েছিল, মধ্য নব্বই পরবর্তী রাজ্য সরকারগুলির মূল বৈশিষ্ট হল, রাষ্ট্রকে শুধুই কতগুলি পরিষেবার সমষ্টি হিসেবে উপস্থাপন করা অথচ রাষ্ট্রের মূল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অভিমুখগুলিকে খুব বড় কিছু বদল না করা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্দিষ্ট কতগুলি দেওয়া-নেওয়ায়, গণতান্ত্রিক অধিকারের, সমালোচনার অধিকারের স্বীকৃতিতে নয়। অন্তর্ভুক্তির, ক্ষমতায়নের রাজনীতির গুরুত্বটা, পরিষেবার রাজনীতি দিয়ে কিছুটা কমানো। রাজনীতিকেও সম্পূর্ণ ট্রানসাকশন হিসেবে দেখাটিই এখন চালু প্রশাসনিক লিবেরালিজম এর রীতি। বিশ্বায়ন পরবর্তী স্থিতাবস্থার এইটেই সর্বজনগ্রাহ্য রূপ। রাজনীতি ও প্রশাসন দুটোকেই ইদানীং বহুসংখ্যক নিষ্পত্তিযোগ্য বোঝাপড়া (transaction) হিসেবে দেখাটাই রীতি বলেই, বিজেপি র সঙ্গে সরকারে থাকা বা গুজারাট দাঙ্গার পরে মোদীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার বিস্ময়কর বিচারবুদ্ধির ইতিহাসের জন্য মমতাকে প্রশ্ন করা হয়নি। মমতাকেও কিছুই আড়াল করতে হয়নি। বাংলার ধার্মিক মুসলমানদের দুর্ভাগ্য আজ অব্দি তাঁদের বলা কথা, প্রতিবাদ, অন্তর্ভুক্ত হবার প্রচেষ্টা, বাংলার বৌদ্ধিক ঐতিহ্যে তাঁদের অবদান সব কিছুকেই তাঁদের সংখ্যার থেকে ছোটো করে দেখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা যাতে না হয়, সেটা বামেদেরই দেখতে হবে। মমতার পক্ষে এই বিষয়ে প্রশ্নহীন অগ্রগতি অবশ্যই মিডিয়া নির্মিত, এবং আজ সংবেদনশীল নাগরিকের সঙ্গী হওয়ার ভান করা মিডিয়ার সঙ্গে মমতার অন্ধ এবং রোগগ্রস্ত বামবিরোধীতার ঐক্য ছাড়া এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সামাজিক বিপ্লব কেউ আশা করছে না, কিন্তু ধরুন অতিমারী না হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নতুন উদ্যোগে সামাজিকীকরণের প্রস্তাব উঠতো না, এখনো তাতে কিন্তু পরিচিত কোণগুলি থেকেই প্রাইভেট সেকটরের সমর্থনে ভাষ্য সংযোজন করার প্রচেষ্টাও চলছে, বৃহত্তম মিডিয়া গুলিতে, তার কোন লক্ডাউন নেই। কৃষিতে বিমা চলবে, কিন্তু খাদ্য সুরক্ষার সর্বজনীন প্রসার ঘটানোতে টালবাহানা করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি ভাবে কৃষক ঋণের দায় কমানোর কোনো পরিকল্পনা না হলেও চলবে, এমনকি শুধু জমি না, কৃষি পদ্ধতি, বিপণন সর্বত্রই যখন কর্পোরেটের দখলবৃদ্ধিকেই উৎসাহিত করা হবে।কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক বলতে লোকে বুঝবে স্পেশাল প্যাকেজের মাপকে, এবং সে প্যাকেজ ভালো থাকলে, ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে যে কোনো আক্রমণের উপরে মিডিয়া সমর্থনের শীলমোহর পড়তে অসুবিধা হবে না, রাজ্যস্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে জেলাস্তরের নেতৃত্বের সম্পর্কের ভিত্তিও হবে বিরোধীহীনতার গ্যারান্টির বিনিময়ে উন্নয়নের প্যাকেজ। এটি ই আপাতত প্রশানিক লিবেরালিজম এর ব্যবহারিক রূপ। রাষ্ট্রের কাছে মানুষ কি চাইতে পারে, রাষ্ট্রের কর্তব্য স্মরণ করাতে কি করতে পারে, তাকে মাপে ছাঁটা ছাড়া এর আর কোনো উপযোগিতা বিশেষ নেই।
লেফট লিবেরাল রাজনীতি
এবারের ভোটে ধর্মনিরপেক্ষ লিবেরাল দের প্রভাব, 'নো ভোট টু বিজেপি' ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে সেই কথার অনেকটাই সম্পূর্ণ অকারণে বামপন্থীদের বিংশশতকীয় অভ্যন্তরীণ বিতর্কের উষ্মা সঞ্জাত।
এ বিষয়ে খুব সংক্ষেপে বলা যায়, এই সংগঠন কখনো দাবি কর নি, তার বামপন্থী দের সমর্থন করার জন্য ময়দানে নেমেছে। অতএব সংযুক্ত মোর্চা সমর্থক বামপন্থীদের মধ্যে এঁদের সমর্থন পাওয়ার জন্য কেন এত আকুলি বিকুলি লক্ষ্য করা গেছে সেটা আমার বোধগম্য হয় নি। লিবারেশন সহ অন্যান্য নকশাল নেতা, ক্ষেত্রেও একই কথা, ১৯৬৭ থেকে যাঁরা সিপিএম এর বিরোধিতা করছেন, তাঁরা হঠাৎ ২০২১ এ এসে সিপিএম এর সুবিধে করে দেওয়ার জন্য শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা বলবেন কেন, মানে এই আশা টি ই হাস্যকর। সারা পৃথিবীতে, দেশে, রাজ্যে, বুদ্ধিজীবি বলতে মূল ধারার বামপন্থী বুদ্ধিজীবি বোঝানো হত, সেটা কিন্তু সব মিলিয়ে ইতিহাসের খুব ছোটো একটা সময়। ধরুন বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের নতুন আধুনিকতা উত্থানের সময় থেকে, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রতিরোধ আন্দোলন এবং শান্তিকালীন, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কাঠামো তে লিবেরাল গণতন্ত্রগুলি প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত, মেরে কেটে আর কুড়ি বছর, তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব জুড়েই পিছু হটা পর্যন্ত। ৫ ও ৬ এর দশক থেকেই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মধ্যে মতবিরোধ প্রবল হয়, আর পশ্চিমের কল্যানমূলক উদার গণতন্ত্রগুলির স্থিতাবস্থাও সাম্রাজ্যবাদের অতীত বিষয়ে মতানৈক্য এবং নারীবাদের, অন্যান্য পরিচিতি সত্ত্বার, বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী, পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ের আন্দোলনের প্রশ্নের সম্মুখে পড়তে থাকে।
আমাদের বাংলায়, বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পরে, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের শিবিরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, একদল জাতীয়বাদী রাজনীতিতে, বাংলাদেশ সংক্রান্ত ভারতীয় বিদেশ নীতির প্রভাবেই আস্থা রাখতে শুরু করেন, আরেক দল, যাঁরা ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমস্যা গুলি কে সমালোচনার চোখেই দেখতে থাকেন, তাঁরা প্রকোষ্ঠিভুক্ত হন, বামপন্থী পরিমন্ডলে।
লেখালিখির নিজস্ব নিরীক্ষা, নারীবাদী হস্তক্ষেপগুলি নিজের পথ বেছে নেয়, যার সঙ্গে সর্বদা দলীয় রাজনীতির যোগাযোগ বিশেষ ছিল না। এই ঘটনার পরে ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, সেদিন থেকেই সিপিআই সিপিএম এর রাজনীতির সমালোচনা যাঁরা করে এসেছেন, এবং কালে কালে মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে সারা দেশ জুড়েই প্রতিনিধিত্বমূলক পরিসর অর্জন করে সংবাদমাধ্যমগুলি সৃষ্ট চিন্তাশীল মরীচিকাকে ঐতিহাসিক যাথার্থ্য দিয়েছেন, তাঁরা আজ হঠাৎ করে কেনই বা সিপিএম-এর উদ্যোগে তৈরি হওয়া সংযুক্ত মোর্চাকে সমর্থন করবেন, সুতরাং এতে অবাক করার মত কিছু ঘটেনি।
যখন ভূমি সংস্কার ইত্যাদি কর্মসূচী রূপায়ন হছিল, তখন এই পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল এতে নতুন জোতদার তৈরী হবে, আর শিল্পায়ন বিতর্কের সময়ে বলা হয়েছে গ্রামের ভদ্রলোকশ্রেণির ক্ষতি করেছে বাম্ফ্রন্ট, এবং তদুপরি জমি ভাগ হবার কারণেই আজ শিল্পায়নে অসুবিধা হচ্ছে। এই পরষ্পর বিরোধী ভাষ্যগুলির মধ্যে সিপিএম বিরোধিতা ছাড়া বিশেষ সহমত্য নেই এবং সেটিই আপাতত রাজনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি। এতে অবাক হবারও কিছু নেই, বড় দলের বিরোধিতা লোকে নানা কারণেই করবে।
অন্য দিকে এনারসি পরবর্তী ভারতে, সারা দেশ জুড়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অল্পবয়সী রা, নানা প্রজ্ন্মের মানুষ নিজের মত করে রাজনীতিতে ফিরেছেন, বিশ্বায়ন পরবর্তী ঐকম্ত্যের ধারণাকে নিজের মত করে মোকাবিলা করেছেন, তাঁদের সম্মান না করার কোনো কারণও নেই। তাঁদের কাছে বামপন্থীরা খুব সংগঠিত সমর্থন পাবেন না এটাই স্বাভাবিক।
আরেকটা কথাও যোগ করে দেই। বিশ্বায়ন পরবর্তী পৃথিবীতে, পরিষেবা ব্যবসার ব্যাপকতা বৃদ্ধির ফলে, আমাদের দেশের সরকারী অর্থনৈতিক নীতিতে গত পঁচিশ তিরিশ বছরের আনুকুল্যের ফলাফল হিসেবে তৈরি হওয়া নতুন প্রজন্ম আর আমেরিকা বা ব্রিটেনের লেফ্ট লিবেরালদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। পশ্চিমের লেফ্ট লিবেরাল আর আমাদের দেশের লিবেরাল দের মধ্যে স্থানমাহাত্মের কারণেই অনেক পার্থক্য আছে।
সরকারী নীতির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অসাম্যের মোকাবিলায় পজিটিভ ডিস্ক্রিমিনেশন, অস্ত্যর্থক পার্থক্যীকরণের ভূমিকা, সে দেশের লেফ্ট লিবেরালরা যতটা সহজে স্বীকার করবেন, এখানে ঐতিহাসিক কারণেই তা করবেন না। বিশ্বায়নে কাজ হারানো শ্রমিক আর অথবা অভিবাসনের, নাগরিক সহাবস্থানের প্রাতিষ্ঠানিকতার সুফল পাওয়া আর্থিক বা মিডিয়া পরিষেবা ক্ষেত্রের সফল পেশাদারের মধ্যে শুধু বর্ণবিদ্বেষ বিরোধিতার কারণে, বা শ্রমের সম্মানের শিল্পবিপ্লবীয় ঐতিহ্যের কারণে যে শর্তহীন সৌভ্রাতৃত্বের ঐক্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে, তার মৌলিক চরিত্র আর আমাদের রাজ্যে ভাষা সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে এক হওয়া বুদ্ধিজীবিরা, তরুণদের আলগা নাগরিক সংগঠন এক কি করে হবে। এতেও অবাক হবার কিছুই নেই। সফল ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি যারা তাদের আধিপত্যবাদী বিদেশ নীতিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আলোচনার বাইরে রেখে একধরনের গণতন্ত্র পরিচালনায় দীর্ঘদিন সফল হচ্ছিল, অথবা বর্ণবিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা গেছে বলে আত্মশ্লাঘায় ভুগছিল, সেখানে লিবেরাল রাজনীতিকে সর্ব অর্থেই নতুন করে অর্থনৈতিক সাম্যের, স্বাস্থ ব্যবস্থার সামাজিকীকরণের, পরিবেশ বিষয়ের সচেতনতার রাজনীতিকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণেই সেটা সম্ভব হচ্ছে।
আমার অবস্থান হল, একটা রাজ্য নির্বাচনে রাজ্য সরকারকে লেসার এভিল বলে আলোচনার বাইরে রাখবো কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু নো ভোট টু বিজেপি সংগঠন টি যে স্বয়ং লেসার এভিল এ ব্যাপারে আমার সমস্য নেই। নতুন নতুন লোকজন রাজনীতি করছে,, এমন একটা আমলে করছে, যখন পার্টিশনে ক্ষতিগ্রস্তদেরথেকে তাদের উত্তরসূরীরা বেশি মুসলমান বিরোধী হয়ে উঠেছে, এটাতে অখুশি হবার কি আছে। সবাই তো বাম সমর্থক হবে না, সেটাই বা নতুন কি। সংগঠনটি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করার অভিযোগ সত্যি হলেও, এ ব্যাপারে আমার কোনো সংশয় নেই। রাজনৈতিক আলোচনায় সংবেদনশীল লোকের অংশগ্রহণ সবসময়েই স্বাগত। নেতৃত্ব দের বিরোধিতা করতেই পারি, কিন্তু যে সব অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা করছেন, তাঁদের সঙ্গে তর্ক অবশ্যই করব, কুতর্কে না জড়ানোই ভালো। অবশ্য নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন মৌখিক মালসাটে আর তেমন ক্ষতি কি।
আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বিরোধিতার তত্ত্বায়নের ইতিহাস সংক্রান্ত আরেকটি সমস্যাও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ইউরোপ ও আমেরিকার বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে সরকারের বা রাষ্ট্রের সমালোচনা যা উঠে এসেছিল, ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে তার মূল উপযোগিতাটা ছিল, অভ্যন্তরীণ শ্রমিক শ্রেণির পক্ষে পরিচালিত কল্যানমূলক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ সংশোধন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং রাজনৈতিক আলাপে, প্রগতিশীল সামাজিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার।
কিন্তু একেবারে হালে ট্রাম্প বা ব্রেকসিট পন্থী আর ইউরোপীয় নতুন দক্ষিণপন্থী দের নব্য আধিপত্যবাদ কিন্তু ঐ ৬ এর দশকের অভ্যন্তরীণ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিরোধিতার ধারণাকে, লব্জকেও কোনঠাসা করে ফেলেছিল। সম্প্রতি ট্রাম্পকে হারাতে গিয়ে এমন অনেক মানুষ একসঙ্গে এসেছেন যাঁরা দীর্ঘদিনের বিরোধী। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। তিনি প্রচার পর্বে জো বাইডেনের সমালোচনা করেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর সযত্ন লালিত কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির প্রতি বন্ধুত্বের সমবেদনার ছবিটি নিয়ে, তার সত্যাসত্য নিয়ে।
তিনি ই আজ রাষ্ট্রপতি বাইডেনের প্রধান সহকর্মী, স্বয়ং উপরাষ্ট্রপতি। এটা আমার কাছে একটা অপৎকালীন ব্যবস্থা এবং এই মহা ঐক্যকে অনেক পরীক্ষা সেদেশেও দিতে হচ্ছে ও হবে, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের আন্দোলনের ভবিষ্যতের পথ শুধু এই ঐক্যের জন্য অতিরিক্ত মসৃণ হবার সম্ভাবনা কম।
আমাদের এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে বিহারের মহাজোটের উদাহরণটি বহুল ব্যবহৃত, মজাটা হল, বিহার আর বাংলার মৌলিক পার্থক্যটাই ছিল, বিজেপি সেখানে সরকারে অংশ, তাই নীতিশ সরকারের নানা নাটক ও ব্যর্থতার দায় তাদেরও ছিল, তারা শুধুই বহিরাগত ছিলেন না। সুতরাং তাঁদের বিরুদ্ধ জোটে পৌছনো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে, এছাড়া লালু যাদবের আমলের আইন শৃংখলার মহা দুর্দিনেও, পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি, বিরোধী দল কে সম্পূর্ণ নিকেশ করার রাজনীতি তাঁকে করতে হয়নি, বা যা অত্যাচার যেখানেই করুন না কেন। তাঁর জাতি বিষয়ক রাজনীতির কারণেই, মেডিয়া তাঁর যে কোনো কৃতকর্মকেই নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দেয়নি।
বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে মহাজোট অসম্ভব ছিল, বিশেষত তৃণমূলের দিক থেকে জোট রাজনীতির কোনো প্রয়োজন না থাকায় এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাস থাকায়। এটা তখনই সম্ভব হবে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই বলছি, যখন সত্য ও সংহতি কমিশনের ধাঁচে পুরোনো ফৌজদারী বিষয়গুলির একটা সমাধান সূত্র বেরোবে, উদ্যোগটা তৃণমূল দলকেই নিতে হবে। কিন্তু তাঁদের আপাতত যা শক্তি, তাতে তাঁরা ভীষণ অশক্ত বিরোধীদের কাছে পাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন বলে মনে হয় না, তবে লোক সভা নির্বাচনে, কংগ্রেস, তৃণমূলের কাছে আসা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এবারেই কংগ্রেস কেন তৃণমূলের সঙ্গে যায়নি, আমার কাছে তার কোন বস্তুনিষ্ঠ উত্তর নেই।
সংযুক্ত মোর্চা ভবিষ্যতের প্রগতিশীল রাজনীতির একটি আপাতত ব্যর্থ সূচনা মাত্র
সংযুক্ত মোর্চা এবং বামফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার অল্পবয়সীদের হাতে অনেকটাই ছিল বলেই আমার খানিকটা আশ্চর্যই লেগেছে, যূথবদ্ধতার, স্বপ্ননির্মাণের প্রচেষ্টা আন্তরিক হওয়া সত্ত্বেও, রাজ্যের ক্ষেত্রে তরুণ বামেদের বক্তব্যে কখনো জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রীত্ব কখনো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যর মুখ্যমন্ত্রীত্ব - এ দুটি সময়ই বার বার নির্মাণযোগ্য ভবিষ্যতের একমাত্র এবং কখনো কখনো পরষ্পর বিরোধী মডেল হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এটা অস্বাভাবিক না, অতীত সংযোগের একটা দায় থাকে, তবে একটা ফেলে আসা সময়কেই সোনালী ভবিষ্যৎ বলে দেখার একটা প্রবণতা আমাকে একটু অবাকই করেছে, এবং মনে হয়েছে ভবিষ্যতের প্রগতিশীল নিরীক্ষা সম্পর্কে সংশয়ের সেটা একটা ইঙ্গিত। স্বল্পশিক্ষিতের কর্মসংস্থান, গ্রামাঞ্চলে অকৃষি পেশার ভবিষ্যত নির্ধারণ, ক্যাশ ট্রান্সফার সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত ইত্যাদি প্রসঙ্গে বামেদের ইস্তেহারে স্পষ্টতার একটা অভাব ছিল। একই সঙ্গে আইএসএফ-এর সঙ্গে মোর্চা গড়ার সিদ্ধান্তকে চমৎকার এবং সাহসী মনে হয়েছিল।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে, দেশভাগের আদি পাপের বিষয়টির গোটা দায়টাই মুসলমানদের উপরে চাপানো হয়ে থাকে বলে, মুসলমানের রাজনৈতিক দল গড়ার নানা সমস্যা আছে, যদিও পরিচিতি সত্তার অন্যান্য প্রকাশের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনের স্বাভাবিকতা অপেক্ষাকৃত ভাবে প্রতিষ্ঠিত। বহুদিন ধরে চলা স্বাধীনতা আন্দোলনে, তারও আগে জাতি রাষ্ট্রের আকাংঙ্ক্ষা প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে, যতবার বিভিন্ন ভারতীয়ত্ব নির্মাণ প্রচেষ্টা হয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরণের প্রান্তিকতা নির্মাণ হবে তাতে আর আশ্চর্য্ কী? আর ১৮৫৭ র মহা বিদ্রোহের সময়কার ভারতীয়ত্বের ধারণা তার দুটি অনস্বীকার্য সীমানাও পরবর্তীতে ভারতে ধরমনিরপেক্ষতার রাজনীতিতে ভারতীয় মুসলমানের অন্তরভুক্তিতে সমস্যা তৈরি করেছে। প্রথমটি উত্তর ভারতীয় ভৌগোলিক সীমানা, দ্বিতীয়টি হল, সাংস্কৃতিক দিক থেকে বলতে গেলে কৃষিজীবি মৎসজীবি, এবং অন্যান্য নিম্নবর্গীয় পেশার সঙ্গে মুসলমানী কৌমের সম্পৃক্তি কখনই ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ক্যালেন্ডার প্রিন্টে জায়গা পায়নি। তার কারণ সেই ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি সঙ্গতভাবেই, কলোনী পূর্ব নাগরিকতার।
এছাড়া ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের পদ্ধতি অনুসৃত হওয়ার ফলে একটা সমস্যা হয়েছে, দেশে এতদিন পরে, ভারতীয় মুসলমানের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনো বড় দলের মাইনরিটি সেল এর গন্ডীতে সীমাবদ্ধ। আসাদুদ্দিন ওয়েসির দলটির বাড়তি সমস্যা হল, তাদের স্বীকৃতির মূল অস্ত্র, কলোনী পূর্ব বা কলোনীর সমসাময়িক অভিজাতবর্গের ঐতিহাসিক সংযোগ। অসমের আইইউডিএফ দলটির প্রাসঙ্গিকতায় কৃষক মুসলমান আছেন বটে তবে নানা ঐতিহাসিক কারণে সেখানেও আশরফি সংস্কৃতির ঐতিহ্য রয়েছে। ফলত একেবারেই যেটা বিস্ময়ের নয়, যত দিন যাবে, ততই সারা দেশ জুড়ে মুসলমানরা সহ নানা প্রান্তিক মানুষ নানা রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করবেন, এবং পশ্চিমবঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থা দুটো ঐতিহ্যকেই সেই আকাঙ্ক্ষার সামনে বাধা হিসেবে ব্যবহার করার ভদ্রলোকের রাজনীতির অবস্থান, বেশিদিন চলবে কিনা বলা কঠিন। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের দিন শেষ, ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্রই ভবিষ্যতের সহাবস্থানপন্থী সুন্দর বাংলার মূল মন্ত্র হবে। অবশ্যই ক্ষমতা বিন্যাস ও বদলাবে।
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার হিলের অবিস্মরণীয় একটি প্রবন্ধ (এবং বক্তৃতা) মনে পড়ল। শিরোনাম ছিল, “Some Intellectual Consequences of the English Revolution”।
ইংল্যান্ডের সপ্তদশ শতকের বিপ্লব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খানিকটা হতাশার সঙ্গে রক্ষণশীল ঐতিহাসিক ট্রেভর-রোপারের বক্তব্যের কথা বলছেন। ট্রেভর-রোপার মনেই করতেন না, ১৬৪১ খ্রীষ্টাব্দে ইংলান্ডের বাস্তবে এমন কিছু ছিল, যেটা কতিপয় পক্ককেশ পুরুষ একটা টেবিলের চারধারে বসে মিটিয়ে নিতে পারবেন না। রক্ষণশীল প্রশাসনিক ভাষ্য ইতিহাসকে সবসময়েই স্থিতাবস্থাকে দীর্ঘায়িত করার একটা নিরন্তর পদ্ধতি হিসেবে দেখে। সেই দৃষ্টিভঙ্গী বাংলার ভবিষ্যতের পক্ষে যথেষ্ট হবে কিনা, সেটা তো এখন থেকে বলার কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষে, ভবিষ্যতের বাংলায় যদি অপেক্ষাকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়, তার সমস্ত পরিবর্তনটাই, টেবিলের চারধারে পক্ককেশ কিছু ক্ষমতাশালীর দেওয়া নেওয়ার খেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা, তা ভবিষ্যৎ বলবে।
প্রসঙ্গত আইএসএফ পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ধার্মিক মুসলমান ও আদিবাসী নেতৃত্ত্বর দল না, প্রচুর এরকম দল রয়েছে, তারা কেউ ব্যর্থ,কেউ অতি প্রান্তিক, কেউ নির্দল হিসেবে লড়ছেন নির্বাচনে, কেউ বড় দলের সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে অতি সম্পৃক্ত থাকায় সাংস্কৃতিক বা সামাজিক মতাদর্শের জায়গায় নিজস্ব পরিসর নির্মাণে ব্যস্ত। বলে রাখা ভালো সাচার কমিটির রিপোর্টের পরে ধর্মীয় নেতাদের সংগঠন না গড়ে ওঠাটাই যেমন অস্বাভাবিক হত, সিদ্দিকুল্লার রাজনৈতিক উত্থান সেই সময়কার রাজ্য রাজনীতির ফল মাত্র, তেমনই, সমসাময়িক অনুরূপ সংগঠনগুলি বড় দলে সম্পৃক্ত হলে, বাংলায় এনারসি পরিকল্পনা হলে, তার অভিঘাতে নতুন সংখ্যালঘু সংগঠন না হওয়াটাই অস্বাভাবিক, লিবেরা দের মধ্যে আইএসএফ-এর সঙ্গে বামেদের নির্বাচনী বোঝাপড়ার পরে যে আপত্তি উঠেছিল, সেটা নেহাতই অনভ্যাসের বিষয়।
সিদ্দিকীর রক্ষণশীলতা আলোচনার বিষয় বস্তু হল বটে কিন্তু লিবেরালদের অভ্যন্তরীণ যে বিতর্ক যে বিষয়টা নিয়ে হওয়া উচিত ছিল সেটা তাদের রক্ষণশীলতার ফলেই তেমন দানা বাঁধলো না। সেটা হল, রাজনীতিতে আসতে গিয়ে মূল ধারার মুসলমান যুবক কে গুড মুসলিম হয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হচ্ছে, সে বার বার করে কর্ম সংস্থানের, শিক্ষার বিষয়ে সর্বজনীন দাবিগুলোর সঙ্গে একাত্ম বোধ করার খবর দিলেও, মসজিদকর্মী ভাতার সমালোচনা করা সত্ত্বেও, তাকে লিবেরাল মিডিয়ার সংঘবদ্ধ আক্রমণ সইতে হল এটাই বিস্ময়কর।
আমার পরিষ্কার অবস্থান হল, বামেদের যে সব সমর্থক রা, আইএসএফ-এর সঙ্গে বামেদের নির্বাচনী ফ্রন্ট গড়ার জন্য বামেদের ভোট দিতে পারেন নি, নতুন দিনের নতুন বাম রাজনীতিতে তাদের সমর্থনের ভরসায় বিশেষ না থাকাই ভালো। হাস্যকর যুক্তি দেওয়া হয়েছে নানা রকম। তৃণমূল সরকার ভীষণ সংখ্যালঘু তোষণ করেছে, এই ভিত্তিহীন অভিযোগ যাঁরা করেছেন, তাঁরাই সিদ্দিকীর অংশীদারিত্বের রাজনীতির উচ্চারণে অথবা অতীত নারী বিরোধিতায়, পোষাকে ভাষায় সাম্প্রদায়িকতায় ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে সেই তৃণমূলকেই সমর্থন করে ফেলেছেন, এরকম যদি ঘটেও থাকে, তাহলে বলতে হবে, আমাদের রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম এবং রক্ষণশীল ছুৎমার্গ আক্রান্ত নাগরিক রাজনীতি তার জন্য সরাসরি দায়ি।
গণতন্ত্রের ইতিহাসে নানা কর্মসূচী মাঝে মাঝেই পরাস্ত হয়, সব পরাজিত কর্মসূচী সম্পর্কেই হীনমন্যতার অবকাশ নেই। এটুকু বলা যেতে পারে নানা গোত্রের নিম্ন্বর্গীয় দের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন এই প্রথম ঘটেনি, এই শেষও না, এবং ভবিষ্যতে তাদের স্পষ্টতর অংশীদারিত্বের দাবি ওঠাটাই স্বাভাবিক হবে। এমনকি সেটা আইএসএফ, রাষ্ট্রীয় সেকুলার মজলিস পার্টির হাত দিয়ে না হলেও। সারা দেশে বহুদিন ধরেই নিম্নবর্গীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। সবর্ত্র সেই সংগঠনগুলি শাসক গোষ্ঠীর অংশ না হতে পারলেও স্বাভাবিক। এবং সংখ্যালঘু যে কোনো সংগঠনকেও এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে, কোন সংগঠনই যে কোনো ধরনের সংখ্যালঘুদের একমাত্র প্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন বিশেষ না দেখাই ভালো। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু সবারই একাধিক নানা প্রকারের সংগঠন থাকাটাই গণতন্ত্রে স্বাভাবিক, এবং ভারতে কৃষিজীবি বা বিভিন্ন অন্ত্যজ পেশায় নিয়োজিত মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক এক বা একাধিক সংগঠন ভবিষ্যতেও হবে। বিশ্লেষণে বিজিতদের দৃষ্টিভঙ্গীর যাথার্থ্যের স্বীকারোক্তি, সেটাও বামপন্থীদের দায়।
তথ্য ভাষ্য ও বার্তা
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে, এই নির্বাচনে অন্যতম মজার দিকটি অবশ্য হল, মানুষের অভিজ্ঞতা, সঞ্জিত তথ্য, রাজনৈতিক ভাষ্য ও ছবি, এবং রাজনৈতিক বার্তার মধ্যে পার্থক্যগুলির একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৈরি হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আলোচনার নির্যাসে যেকোনো বিপণন বিজ্ঞাপণের বার্তার বাইরে খুব কিছু অবশিষ্ট না থাকা। স্থিতাবস্থা নির্মাণের, এর চেয়ে ভালো অস্ত্র আর কী থাকতে পারে। এমনিতে নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্যের কিছু সমস্যা আছে। নির্বাচন কমিশন যে ডেমোগ্রাফিক তথ্য সংগ্রহ করে তা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে প্রকাশ করে না। নির্বাচনবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, পেশাদারী ভাষ্যকার বা অন্যান্য বিশ্লেষকরা নিজেদের কাজের জন্য, নির্বাচনি ইস্যু নির্ধারণ বা ফলাফলে প্রকাশিত নির্বাচকের দৃষ্টিভঙ্গী অনুধাবন করার জন্য প্রথাগত সুমারি বা অন্যান্য প্রতিনিধিত্ত্বমূলক সমীক্ষার উপরে নির্ভর করেন এবং মজাটা হল যে ব্যাপারটা একেবারে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে, নির্বাচকের মানসিকতা বোঝার জন্য অর্থনৈতিক বা পেশাগত বর্গগুলির ব্যবহার মোটামুটি বর্জিত হয়ে থাকে। তো রাজনৈতিক সমদূরত্ত্বের এবং সুস্থ প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ আলোচনার দাবিদার লিবেরাল কর্পোরেট মিডিয়া সমীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি,এতদ্বারা মেরুকরণের সুবিধা করে দিচ্ছেন কিনা সেই প্রশ্ন অসংগত নয়।
অতঃকিম
বামপন্থী রা যখন থেকে ভারতে রাজনীতি করতে শুরু করেন, তখন তাঁদের পক্ষে ৫৯ লক্ষ ভোটার ছিলেন না। আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন, অতএব আমি অন্তত বামেদের, বিশেষতঃ তরুণ তরুণী রাজনৈতিক কর্মীদের ভেঙ্গে পড়ার কোনো কারণ দেখছি না। অনেকে শক্ত সংগঠন, আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গী ইত্যাদি ওষধি বাতলাচ্ছেন বটে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে, খুব সহজ করে বলতে গেলে, একটা সময়ের চাবিকাঠি কোন ধরনের মানুষের হাতে রয়েছে সে সম্পর্কে বিশ্লেষণই বাম রাজনৈতিক দলকে সাফল্য দিতে পারে। স্বাধীনতার পরে, বামপন্থীদের বুদ্ধিজীবি আর রাজনৈতিক সংগঠকদের সঙ্গে কালে কালে কৃষক, শ্রমিক, নিম্নবিত্ত, বেকার, সামাজিক প্রগতিতে আগ্রহ রাখা বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা এসেছিলেন। ৭ এর দশকে এসে কৃষি মজুর, সংগঠিত হওয়ার ইচ্ছা রাখা শ্রমিকেরা, সাম্যের স্বপ্ন দেখা ছাত্র ছাত্রীরা, কর্মপ্রার্থীরা, ছিন্নমূল মানুষেরা, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের প্রসার দেখতে চাওয়ায়,বামপন্থীদের তাঁদের কাছের লোক মনে করেছিলেন। ৯ এর দশকে নাগরিকরা যখন কর্মহীন বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে, তখন শহরগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে উঠছেন বটে, কিন্তু অর্থনৈতিক নীতির যে প্রয়োগের কারণে কর্মহীন বৃদ্ধির ঘটনাটি প্রবল হচ্ছে, তার জন্য তৃণমূলকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু ক্ষমতায় আসার জন্য সেটা তৃণমূলের পক্ষে যথেষ্ট হচ্ছে না। কৃষকের সংকট ও অনিশ্চয়তা তীব্র হলে, রাজ্যের যেসব অঞ্চলে কৃষি মূল পেশা না, অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিন পশ্চিমে, সেই অঞ্চলগুলিতে অভিজ্ঞতার ব্যাপক পার্থক্য সত্ত্বেও বাম সরকার বিরোধী ব্যাপক প্রচার মানুষের ক্ষোভ কে সংহত করছে এবং তৃণমূল নেতৃত্ব একই সঙ্গে ক্ষুদ্র কৃষকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরাপত্তার অভাবের আর বিশ্বায়নের পরিবর্তনে পাশে পড়ে থাকা নাগরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছেন, এবং শিল্পায়নে বাধা পড়লেও, উন্নয়ন বলতে অনির্দিষ্ট কখনো পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছে, কৃষি প্রধান জেলাতেও, হয়তো জমির বিনিময়েই পাচ্ছে। একই সঙ্গে কৃষির অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত,অথচ অকৃষি পেশাগুলি অসংগঠিত ভাবেই গড়ে উঠেছে।
এর পরে ভদ্রলোকদের নব্য পুনর্গঠন প্রচেষ্টা দুঃখজনকভাবে প্রবল দক্ষিণগামী হয়েছে। এই ভয়ানক প্রকল্প থেকে রাজ্যের মানুষকে জীবন জীবিকার রাজনৈতিক আলোচনায় ফিরিয়ে আনতে, বিদ্বেষের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে বামপন্থীদের ভূমিকা থাকবে, গত দশ পনেরো বছরে সারা রাজ্য জুড়ে যে সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলো ঘটে গেছে, তাতে যে নতুন করে বিপুল মানুষ অসাম্যের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে নতুন বন্ধু খুঁজে পাওয়ার কাজ যেহেতু কখনোই থামেনি, ধাক্কা খেয়েছে মাত্র, তাকে নতুন উদ্যমে তৈরি করা ছাড়া আর বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ কি। তবে ঐ জিনিসটা হয়তো ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, ভবিষ্যতে এই রাজ্যের বাম আন্দোলনের সাফল্য, সাম্প্রতিক বা অতি সাম্প্রতিক অতীতের সফল রাজনৈতিক মঞ্চগুলির মত দেখতে শুনতে হবে না, কারণ সময়টা এবং সমাজটা প্রতিদিন বদলাচ্ছে। একটা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ব্যাপক সামাজিকীকরণের পক্ষে জনমত বাড়বে বই কমবে না, আজ যাদের শিবজ্ঞানে জীবসেবা করার জন্য হাস্যাস্পদ করে তোলা হচ্ছে, সেই বাম স্বেচ্ছাসেবকদের তাতে একটা ভূমিকা থাকবে। আজকের যুবসংগঠনগুলি ই নতুন দিনের নতুন পেশার বা নতুন ধরনের কর্মবিষয়ক অনিশ্চয়তার সামনে নতুন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিত্তি হয়ে উঠলেও, এবং পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির নতুন রূপ বামেদের হাত ধরেই এ রাজ্যে এলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। এখনকার ব্যবস্থায় বিপুল সংখ্যক মানুষের ব্যক্তি প্রতিভা বিকাশ যে ভাবে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে স্রেফ সরকারী নীতির কারণে পদদলিত হচ্ছে, তার প্রতিরোধে বামপন্থীদের বা সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে এবং নতুন জোট নির্মাণে আগ্রহী বামপন্থীদের কোনো ভাবেই কোনো ভূমিকা থাকবে না এটা ভাবার মত কোনো কারণ এই নির্বাচন অন্তত দেয়নি।