আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
প্রবন্ধ
রাজ্য রাজনীতিঃ টুকরো ভাবনার বৃত্ত
প্রবুদ্ধ বাগচী
মে মাসের দু-তারিখের পরে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নিউ নর্মাল। যে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে সারা দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরেই যে বিজেপি দল, রাজ্যে তারা দুশোর বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসছে বলে উল্লসিত প্রচার করতে শুরু করেছিল এবং পরের পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে তাদের হাতে মজুত সমস্ত রকমের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শক্তিকে এই রাজ্যের ভোট জেতার জন্য তারা নিয়োগ করেছিল তার সামগ্রিক যোগফল একটি বড় শূন্য বলে প্রমাণিত হয়ে গেছে। একদিকে যেমন সমস্ত হিসেব-নিকেশ উলটে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন, অন্যদিকে, লক্ষ্যণীয়ভাবে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম রাজ্যের বিধানসভায় বামপন্থী শক্তির একটাও আসন জোটেনি, বরং বিজেপি মূল বিরোধীদলের জায়গাটা সাংবিধানিকভাবেই দখল করে নিতে পেরেছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতার পদটি, ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান মর্যাদার - সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে বিজেপি বিধায়ক। ফলে সংসদীয় সীমানার মধ্যে রাজ্যের বামপন্থীদের কন্ঠ আর আমরা শুনতে পাব না, যা বিগত সত্তর বছরে ঘটেনি। বিপরীত পক্ষে, একটি আপাদমস্তক জনবিরোধী দক্ষিণপন্থী দল যখন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের আসনে এসে বসে, সেটাও রাজ্যের নাগরিকদের কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সবটা মিলিয়েই নিউ নরম্যাল।
সদ্য ঘটে যাওয়া বিধানসভা ভোটে বামপন্থী শক্তি কেন এমনভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ল তার ময়নাতদন্ত তারা তাদের মতো করে করবেন, হয়তো সেই প্রক্রিয়া আরম্ভও হয়ে গেছে - সেই বিষয়ে আমাদের কিছু বলবার এক্তিয়ার নেই। কিন্তু আপাতভাবে এটা বোঝা যায় রাজ্যে বিজেপির আগ্রাসী,অনৈতিক ও শালীনতাহীন প্রচারের বিরুদ্ধে তৃণমূল দল যে একেবারে নীচের তলা থেকে জনমত তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিল এই সত্য আদৌ বামপক্ষীয়রা বুঝতে পারেননি। এর পেছনে ক্ষমতায় টিকে থাকার মরিয়া প্রয়াস থাকলেও আদপে সেটা বিজেপি-বিরোধী মনোভাবকে সংহত করার একটা ইতিবাচক প্রকাশ। এই প্রবণতাকে স্বীকৃতি না দিয়ে তারা ‘বিজেমূল’ নামক একটা কাল্পনিক শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেদের শক্তিক্ষয় করেছেন, যা রাজ্যের মানুষ বিশ্বাসই করেননি। তৃতীয়বার ক্ষমতায় বসার দিন থেকে যেভাবে রাজ্য সরকারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেন্দ্রীয় সরকার উত্যক্ত করে চলেছে তাতে আরও এটা প্রমাণ হয়ে যায় আদপে তৃণমূল ও বিজেপি দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তি, নাহলে এমন কুৎসিতভাবে দিল্লির সরকার তাদের নখ দাঁত বার করে একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকারের পেছনে লাগত না। সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী রাজ্যের প্রধান বাম দলটি নাকি এখন বুঝতে পারছেন, এইভাবে তৃণমূলের একতরফা বিরোধিতা করা আদপে তাদের পক্ষে শুভ হয়নি। মুশকিল হল, সর্বোৎকৃষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের অনুগামী একটি দল কেন রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতাকে বিচার করতে বারবার ভুল করেন এবং অতলান্ত খাদের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে ভুলের হদিশ পান সে এক মস্ত বিস্ময়। ভোটের প্রচারে তারা যেভাবে একতরফা ভাবে তৃণমূলের বিরোধিতা করে নাম-কা-ওয়াস্তে বিজেপির বিরুদ্ধে দু-চারটে কথা বলতেন তখন তাদের শুভার্থীরাও এ বিষয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন, তারা পাত্তা দেননি। কারণ, তারা যা বোঝেন সেইটাই নাকি শেষ কথা।
এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্ষমতায় থাকা বিজেপির চেয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়া বিজেপি-র বিষদাঁত ভোঁতা হয়ে গেছে এমন ভাবার কারণ নেই। সারা দেশজুড়ে তাঁদের জনবিরোধী অমানবিক নীতি নিয়ে তারা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মাটিতে দাঁড়িয়ে এখন কয়েকটা বিষয় খেয়াল করে দেখবার। প্রথমত হল, রাজ্যের শাসকদল ধারাবাহিক ও ঐতিহাসিক জয়ের পর কী ভূমিকা নেয়। পরের বিষয়টা হল, সেই সরকারের কাজকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ভূমিকা কেমন হতে পারে। আর তৃতীয় হল,রাজ্যের বিরোধীদল হিসেবে বিজেপি তার বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতিকে কতদূর পর্যন্ত বিস্তারিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির বাধ্যতাকে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে চাইছে সারা দেশেই, সর্বত্রই তারা কায়েম করতে চায় তাদের একাধিপত্য। তাই রাজ্যের নিজস্ব দাবি দাওয়া, আর্থিক পাওনা ইত্যাদি নিয়ে তারা যে খুব সদয় হবে না তার ইঙ্গিত এর আগেও আমরা দেখেছি, এইবারেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।
এই অবস্থায় শাসক ও বিরোধী দলের বাইনারির বাইরে দাঁড়িয়ে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে কীভাবে বামপন্থী শক্তি মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারে সেটা একটা গভীর চর্চার ব্যাপার। এই বিষয়েই কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করা যেতে পারে। যার একদম প্রথম অ্যাজেন্ডা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর টিকিয়ে রাখা। নির্বাচনে জেতার কৌশল হিসেবে গত বিধানসভায় ‘ডাবল ইঞ্জিন’ নামের একটা লব্জ চালু করেছিল বিজেপি। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রে আর রাজ্যে একই দলের সরকার প্রয়োজন, নইলে কিছুই মিলবে না - এটা ছিল সম্পূর্ণ ভাবে একটি বিষাক্ত প্রচার যা সরাসরি আঘাত করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূলে। এই প্রচারকে নির্বাচনের মঞ্চে পরাজিত করার জন্য অন্য নানা বিজেপি-শাসিত রাজ্যের তুলনা আমরা বারবার টেনে এনেছি। কিন্তু এই বিপজ্জনক ধারণাকে প্রতিহত করার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট নয়। কারণ, আসলে এই হুজুগ তোলার পেছনে ছিল নির্দিষ্ট একটা মনোভাব যা কেন্দ্রীয়ভাবে বিজেপি নেতৃত্ব মতাদর্শগত ভাবে বিশ্বাস করে। স্পষ্টত তারা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মানে না ও একে ধ্বংস করতে চায়। সংবিধান প্রণয়নের সময় আরএসএস প্রত্যক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনার বিরুদ্ধতা করেছিল অথচ যে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে উপনিবেশ থেকে আধুনিক ভারত রাষ্ট্রের উদ্ভব সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনা ছিল একেবারে সঠিক। গত সাত বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজেকর্মে বারে বারে এর প্রকাশ ঘটেছে এবং ইদানিং গত এক-দেড়বছরে তা প্রায় বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে বলা যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজ্যগুলির ওপর জমিদারিসুলভ মানসিকতা, প্রতি বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্রের কনসেপ্টটাকেই সঙ্কীর্ণ করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষি প্রতিটি বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইন এনে রাজ্যের ভূমিকাকে লঘু করে দেওয়ার বারবার চেষ্টা হয়েছে, সম্প্রতি এমনকি বাড়িভাড়া আইনও কেন্দ্রীয় স্তরে প্রণয়ন করে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, দিল্লিশ্বররাই দেশের মালিক। এই প্রেক্ষাপটে, কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে নতুনভাবে চর্চা হওয়া বিধেয়।
আমরা জানি, একসময় প্রথম ও দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা তৈরির পরিসর প্রশস্ততর করা হয়েছিল। পরে কোনো কারণে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। কিন্তু আজ এই বিষয়ে নতুন মাত্রায় মন্থন জরুরি। মাত্র একমাসের মধ্যেই রাজ্যের তৃতীয় তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের জুলুমবাজির শিকার হয়েছে। রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া গত কয়েকবছর ধরেই অবহেলিত হচ্ছে। অবস্থাটা সব রাজ্যের ক্ষেত্রেই কমবেশি এক, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিও যে ফুলে ফলে টইটুম্বুর এমন ভাবার কারণ নেই। কিন্তু সংগত কারণেই তারা এনিয়ে সরব হওয়ার জায়গায় নেই। ফলে অবিজেপিরাজ্যগুলির উদ্যোগে সারা দেশে এনিয়ে শোরগোল তোলা দরকার। বিজেপির রথের ঘোড়া আটকে দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ আছে। এই বিতর্ককে বৃহত্তর মাত্রা দেওয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের একটা সদর্থক পক্ষ নেওয়ার অবকাশ আছে। কারণ, কেরালার মতো রাজ্যে তারা এখনো ক্ষমতায় এবং এই কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাচারিতার শিকার। আর বাংলার বামপন্থী মহল থেকেই যেহেতু একসময় এই ইস্যুটাকে বড় মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং যার ফল হিসেবে সারকারিয়া কমিশন তৈরি ও তাদের ইতিবাচক সুপারিশ সামনে এসেছিল তাই এই নিয়ে বাংলা একটা নতুন দিশা দেখাতে পারে। আরও খেয়াল করা যেতে পারে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক তথা ফেডারালিজম-এর বিপন্নতা আগামী লোকসভা নির্বাচনে অন্যতম বড় ইস্যু হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সেখানে দুটি তিনটি রাজ্যে দীর্ঘ শাসনের অভিজ্ঞতা বামেদের বড় পুঁজি। তাছাড়া বিধানসভা নির্বাচনে যেভাবে ভুলভাল ইস্যুর প্যাঁচে জড়িয়ে বামপন্থীরা নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তুলেছেন তার থেকে সম্মানজনক নির্গমনের একটা পথ হতে পারে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গকে আবার জীবন্ত করে তোলা।
বিগত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে অপ্রমাণিত নানা অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার হয়ে তারা প্রায় বিজেপির সঙ্গে এক সুরে নিজেদের বেঁধে ফেলেছিলেন। তাদের যে স্বতন্ত্র কোনো সত্ত্বা আছে এটা আমরা টেরই পাইনি। অথচ রাজ্যে দীর্ঘ কোভিডকালীন লকডাউন আরও অনেক সামাজিক সমস্যা ডেকে এনেছে। মানুষের কাজ হারানোর সমস্যা অবশ্যই তার প্রধানতম। এই সমস্যায় অসংগঠিত শিল্পে কাজ হারানো মানুষকে কীভাবে রোজগারের পথে ফেরানো যায় সেটা একটা বড় দুশ্চিন্তা। অসংগঠিত ক্ষেত্রে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন কতদূর শক্তিশালী তা নিয়ে আমরা সন্দিহান এবং মাঝারি মাপের নিয়োগকর্তা নিজেও যেহেতু আর্থিক বিপর্যয়ের শিকার তাই তাদের সঙ্গে কতটা দর কষাকষি করা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। কিন্তু পাশাপাশি ক্যাব-চালক, অনলাইন কোম্পানির ডেলিভারি পার্সন, বিভিন্ন ক্ষেত্রের চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মী ইত্যাদি এঁরা সমাজের একটা নতুন ধরনের শ্রমজীবী মানুষ যাদের চাকরির নিরাপত্তা নেই, স্থায়ী কাজের সম্ভাবনা নেই, নিজেদের দাবি দাওয়া জানানোর ইউনিয়ন নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট কাজের সময়। এঁদের নিয়ে কি বামপন্থীরা ভাবতে পারেন না ? তাদের হয়ে কথা বলার একটা মঞ্চ তৈরি হতে পারে না? তাঁদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে তাঁরা একশো দিনের কাজের পরিসীমা বাড়িয়ে দেড়শো দিনের করার কথা বলেছিলেন। একশো দিনের কাজের স্কিম তৈরির সময় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষে যে সমীক্ষা হয়েছিল তাতে গ্রামীণ দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে দুশো দিনের কাজ একটা মোটামুটি সমাধান বলে জানানো হয়েছিল। যদিও স্কিম চালু হওয়ার পরে আর এই নিয়ে পুনর্বিচার হয়নি। সেক্ষেত্রে দেড়শো দিনের কাজ অন্তত মন্দের ভাল। এই নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যেতেই পারে। যদিও কেন্দ্রের স্কিম যেহেতু একশো দিনের তাই বাড়তি শ্রম দিবসের টাকা রাজ্যকেই দিতে হবে, সেই পরিমাণ অর্থ রাজ্যের পক্ষে বরাদ্দ করা সম্ভব কি না সেটাও বিচার্য। এক্ষেত্রে আবারও কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের প্রশ্নটা সামনে চলে আসে। তবু এটা নির্দিষ্টভাবে মানুষের জন্য দাবি, এখানে বামপন্থীদের উপস্থিতি দরকার। দরকার হলে কেন্দ্রের থেকে বাড়তি দাবি আদায়ের প্রশ্নেও বামপন্থীরা সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেন।
কোভিড বিপর্যয়ের আরেকটা অভিঘাত পড়েছে এরই পাশাপাশি অন্য কিছু ক্ষেত্রে। স্কুল শিক্ষা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, গ্রামীণ পড়ুয়ারা যারা সেইভাবে অনলাইন পড়াশোনার সুযোগ নিতে অপারগ তারা কার্যত স্কুলছুট। কোভিডকে মেনে নিয়েই বিকল্প কিছু কিছু চেষ্টা হচ্ছে না এমন নয়, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এখানে কি শিক্ষক সংগঠন কিছু ভূমিকা নিতে পারেন? মিড ডে মিল নিশ্চয়ই দরকার, তার ব্যবস্থা নিয়মিতই হচ্ছে, পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রে এই যে বিপুল ঘাটতি হয়ে গেল যার শিকার গরিব ঘরের পড়ুয়ারা তাদের জন্য কিছু ইতিবাচক ভাবনা দরকার। চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায় রাজ্যের স্বীকৃত বিরোধী দল এইসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করবে না কারণ গরিব ঘরের পড়ুয়াদের নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই, থাকার কথাও নয়। এই গরিব পড়ুয়াদের সাইকেল দেওয়া নিয়ে এতদিন বামপন্থীরা ভ্রান্ত সমালোচনা করে পড়ুয়া ও তাদের পরিবারগুলিকে অপমান করেছেন। আজ ভিন্ন কিছু ভাবনা নিয়ে অপমানে ‘তাদের সমান’ হওয়ার কথা বলা কি খুব অন্যায়?
অন্যদিকে রাজ্যে মা ও শিশুদের জন্য যে পুষ্টি পরিষেবা কেন্দ্রগুলি আছে, পরিস্থিতির চাপে সেগুলো দেড় বছর বন্ধ। বিকল্প পদ্ধতিতে গত এক বছর সেগুলিতে প্রাক-প্রাথমিকের কিছু পরিষেবা দেওয়া হলেও নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য বিতরণ স্থগিত হয়ে আছে। রেশনের মাধ্যমে যে খাদ্য দেওয়া হচ্ছে তার পুষ্টিমূল্য প্রার্থিত মাত্রার নয়।এই পরিস্থিতির ফলে শিশুদের ও মায়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা, প্রতিষেধক প্রদান ব্যহত - ঠিক কী অবস্থায় তারা রয়েছেন, শিশুদের বৃদ্ধির হার কেমন এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলছুটের সম্ভাবনা থাকায় বাল্যবিবাহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। একদিকে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ অন্যদিকে সার্বিক আর্থিক বিপর্যয়ে পরিবারগুলি অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন না তা হলফ করে বলা মুশকিল। গত বছর লকডাউনের পরেই কলকাতাতেই এইরকম কিছু ঘটনা শোনা গেছে যা শেষ মুহূর্তে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বন্ধ করা গেছে। প্রত্যন্ত গ্রামের কী অবস্থা তা আমরা জানি না। নতুন করে ইয়াস-উত্তর পরিস্থিতি গ্রামের বহু অবিবাহিত মেয়েদের বিপন্ন করে তুলতে পারে। এইসব ক্ষেত্রে বামপন্থী সংগঠন গুলিকে কী নির্দেশ দেওয়া হবে, আমরা জানি না - কিন্তু এইসব জরুরি ক্ষেত্রগুলিতে প্রথাগতভাবে পুরোনো বামপন্থীদের আমরা ইতিবাচক ভূমিকায় দেখেছি। তাই আমাদের প্রত্যাশার মাত্রাটা একটু অন্যরকম। কী করবেন তা নব্য নেতারাই জানেন।
আসলে একটা কথা না বলে পারছি না। বিষয়টা হল, কোভিড-পর্যায়ে আগের বছরেও (২০২০) আঞ্চলিকভাবে বামপন্থীনেতা কর্মীরা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তার সবটাই আসন্ন ভোটের কথা মাথায় রেখে ঠিক হয়েছিল, এমন আমরা মোটেও ভাবছি না। কিন্তু ভোটের সদ্য বিপর্যয়ের পরে নানা মঞ্চে ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ দের কথা গত একমাস ধরে যেভাবে বেশি প্রচার করা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ওই পরাজয়ের তেতো প্রসঙ্গ যাতে আর সামনে না আসে তার জন্য এটা একটা পরিকল্পিত আয়োজন। বামপন্থী কর্মীরা মানুষকে সারভিস দিচ্ছেন নিশ্চয়ই তাকে নিঃশর্ত কুর্নিশ জানাতে দ্বিধা নেই। কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে একটা রাজ্যের এতদিনের বামশক্তির শোচনীয় রাজনৈতিক পরাজয়ের একমাত্র টোটকা এই ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’। বাস্তব হল, আরও অনেক সংস্থাই নানাভাবে পথেঘাটে আছে, সাধ্যমতো তারাও পরিষেবা দিচ্ছেন, হয়তো তাদের তেমন প্রচার করার সংগতি নেই যা আছে রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকা ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ দের। তাছাড়া মানুষের বিপদে আপদে বামকর্মী ও সমর্থকদের এই প্রথম আমরা পথে দেখছি এমন তো নয়। কিন্তু আমাদের ধারণা, এই কোভিড-পর্ব একদিন শেষ হয়ে যাবে আর তার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যাবে ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ পরিষেবা। তারপর? আর সেই অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই কি প্রস্তুত রাখতে হবে না নিজেদের? আবারও নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করছি, কি যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো বিষয়ক বিতর্ক কি শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা সামাজিক সঙ্কট বিষয়ক ইসু - কোনো ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়া অপশক্তি কোনো সদর্থক ভূমিকা নেবে এটা একটা বাতুল ভাবনা। তাই সেইখানেই বামপন্থীদের আবারও প্রাসঙ্গিক ও ইতিবাচক হয়ে ওঠার সুযোগ ও যোগ্য পরিসর। একটি রোগাক্রান্ত মানুষের কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া যতখানি দরকারি তার থেকে কি কম প্রয়োজন কাজহারা শ্রমিকের হাতে কাজ জুগিয়ে দেওয়া, তার দাবি দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হওয়া কিংবা শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে কিছু ন্যায্য দাবিকে সামনে নিয়ে আসা অথবা একটি অসহায় গ্রামের কিশোরীর অকালে বিয়ে হয়ে যাওয়া রুখে দেওয়া?