আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এবং বিজেপি বিরোধী বিকল্প শক্তির আভাস

জাদ মাহমুদ, আজাজ আসরফ এবং সোহম ভট্টাচার্য


পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন সংক্রান্ত বিশ্লেষণের আখ্যানে বহু ক্ষেত্রেই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সাফল্য এবং এ রাজ্যের ভোটারদের সংখ্যাগুরু অংশকে নানা ভাবে কাছে টানার দক্ষতার কথা উঠে আসছে। এই বিশ্লেষণের নিরিখে তাই তৃতীয় বারের জন্য নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে বিজেপি-বিকল্প শক্তি রূপে তৃণমূলের উত্থানের আমূল প্রশংসা অনেকেই করেছেন। এই বিশ্লেষণগুলির মূলত তিনটি অংশ বারংবার উঠে এসেছে। ২০১৯ পরবর্তী ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সমাজ-কল্যাণমূলক কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচি, বাংলার আঞ্চলিক অস্মিতাকে তুলে এনে কেন্দ্রীয় স্তরের মূলত হিন্দিভাযী এবং হিন্দুত্ববাদী নেতাদের আক্রমণ কৌশল, এবং সর্বোপরি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নিজেই নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে লড়াই করার কারণে অভাবনীয় নির্বাচনী সাহসের পরিচয়। তৃণমূলের এই ২০২১ সালের সাফল্যের নিরিখে এই কারণগুলিই মূলত দায়ী, এমন মনে করা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর এই অবদানকেই প্রাথমিক ভাবে একটি নির্ধারক শক্তিরূপে দেখার মধ্যে আরেকটি সুপ্ত চিন্তা নিহিত। এই বিশ্লেষণগুলি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে গণতন্ত্রের বিরাট শপিং মলের নিছক ভোক্তা হিসেবে পরিণত করছে। তাদরে কাজ যেন শুধুই কোনো বিক্রেতার বাজারদর তুলনায় বেশি ভালো, তাই নির্ণয় করা। কোনো ভোক্তা কখনো 'একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি' এহেন বাজারদর কি উপেক্ষা করতে পারে? অথচ পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু করেছে। সম্ভবত সব থেকে লাভজনক ব্যবসায়িক লেনদেন যা হতে পারত, তা-ই অগ্রাহ্য করেছে। রাজ্যের মসনদে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারকে আনতে পারলে একই সাথে একজন তথাকথিত দেশ এবং রাজ্য-দরদী, উন্নয়ন-দরদী প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ পাওয়ার অফার আগাগোড়াই অগ্রাহ্য করেছেন বাংলার মানুষ। তাই বাজার ভোক্তার সম্পর্কের বাইরে এই নির্বাচনে কোনো এক গভীর-গভীরতর বোধের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। এই নিবন্ধে মূলত সেই রাজনৈতিক বোধের আলোচনার একটি রূপরেখা তুলে আনার চেষ্টা রইল।

আলোচনার মূলে শুরুতেই তাই একটি প্রস্তাবনা আমরা রাখছি, যেখানে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সচেতনভাবে বুঝেছেন রাজ্যে কাদের প্রযোজন নেই, এবং বিজেপির লোক-ভোলানো খেলাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক জনসংখ্যার ২৭%: তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি যে বিজেপিকে ভোট দেবেন না তা নির্বাচনের অনেক আগেই নির্ধারিত ছিল। এর অর্থ বিজেপিকে জনসংখ্যার বাকি ৭৩%-এর মধ্যেই সংখ্যাগুরু অংশের ভোট নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করতে হবে। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে তাঁদের আরেকটি আশ্বাস ছিল, মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট মূলত তৃণমূল, এবং বামফ্রন্ট, জাতীয় কংগ্রেস এবং পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী'র নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান সেকুল্যার ফ্রন্টের তৈরি সংযুক্ত মোর্চার মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে।

এই নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার জেরেই বিজেপি হিন্দুত্বের জিগির তোলার গিমিকে জোড় দেয়। বাংলাদেশি মুসলমানদের সীমানার এই পাড়ে 'অনুপ্রবেশ' এবং পশ্চিমবঙ্গকে "মিনি পাকিস্তান" পরিণত করার ইস্যু তাই প্রাধান্য পায়। সুতরাং মমতা ব্যানার্জির নাম দেওয়া হয় মুমতাজ বেগম। এই কারণেই নির্বাচনের সময় জুড়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসকে শুধুই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উপর জুলুম করার উদ্দেশ্যে তৈরি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি পদাতিক বাহিনী রূপে দেখানো শুরু হয়।

এই সমস্ত সত্ত্বেও বেশ পরিষ্কারভাবেই বিজেপি দ্বিতীয় স্থানেঃ তৃণমূলের প্রাপ্ত আসন ২১৩, বিজেপির প্রাপ্ত আসন ৭৭ (তৃণমূলের একজন প্রার্থী নির্বাচনের দিন মারা যাওয়ার তার প্রাপ্ত আসন সংখ্যা এখন ২১২। জঙ্গিপুর এবং সামসেরগঞ্জ-এ নির্বাচন হয়নি।)

জেলাভিত্তিক বিজেপি বিরোধী ভোট সংখ্যালঘুর ভোট নয়

ভোট শতাংশের নিরিখে তৃণমূলের সাথে বিজেপির ব্যবধান প্রায় শতকরা ১০ ভাগের। সমস্ত পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বীত বিধানসভা কেন্দ্রের মোট সংখ্যা এবং প্রাপ্ত ভোটের প্রত্যেক কেন্দ্র-ভিত্তিক হিসেব অনুযায়ী তৃণমূলের মোট ভোট শতাংশ ৪৮.৭%, বিজেপির ৩৮%, সংযুক্ত মোর্চার ৯.৮%, এবং অন্যান্য রা ২.৫%।

তৃণমূলের জয়ের ব্যাপকতার জন্য অনেক বিজেপি নেতা মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোটের একত্রীকরণকে দায়ী করেছেন। যদিও শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচিতির জন্য আক্রমণের শিকার এক সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এ ছাড়া আর ভিন্ন কি হতে পারে, সেই বিষয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করেননি। অসমের মত পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির সরকার তৈরি হলে NRC-CAA-NPR-এর ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার হতে হবে। এই আতঙ্ক যে রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অনেক বেশি কাজ করেছে তা এখন বোঝা যাচ্ছে।

বিজেপি নেতৃত্বের একটি বড় অংশ, ঠিক নির্বাচনের পরেই, তাদের পার্টির ২০১৬ সালের তিনটি আসন থেকে ২০২১-এ সাতাত্তরটি আসনে জিতে দ্বিতীয় স্থানে আসার উপলক্ষ্যকে বেশ উপভোগ করছেন। যদিও এই উন্নতির বাস্তবিক রূপ খুব একটা ভরসাযোগ্য নয়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের প্রান্ত সাফল্যের উত্থানের বদলে স্পষ্ট পতন দেখা গেছে।

২০১৬-র সাথে ২০২১-এর তুলনা করলে যদিও বিজেপির দ্রুত উত্থান স্পষ্ট। তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তুলনা করলেঃ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ১৮টি আসনের সূত্রে তাদের ১২১টি বিধানসভা আসনের থেকে কমে ২০২১-এ বিজেপির ভাগ্যে জুটেছে ৭৭টি আসন, অর্থাৎ ৪৪টি আসন হাত ছাড়া হয়েছে। উলটোদিকে ২০১৬ তে ৭৬ আসন থেকে ২০১৯-এ ৯টি আসন থেকে ২০২১-এ ১টি আসন পেয়েছে সংযুক্ত মোর্চা।

এমনটা বলা হয়েছিল যে ২০১৯-এ বিজেপির ১৮টি লোকসভা আসন (১২১টি বিধানসভা আসন) প্রাপ্তি হওয়ার মূল কারণ ছিল সংযুক্ত মোর্চার ভোটারদের একটি বড় অংশের বিজেপির পক্ষ্যে ভোট দেওয়া।

২০১৯-এ প্রাপ্ত ভোটের থেকে ২০২১-এ সংযুক্ত মোর্চা হারিয়েছে প্রায় ৩.৪% ভোট। তবে বিজেপিও হারিয়েছে ২.২% ভোট। সামগ্রিকভাবে দেখলে, ২০২১-এ সংযুক্ত মোর্চা এবং বিজেপি একসাথে মিলিয়ে প্রায় ৫.৬% ভোট হারিয়েছে এবং এই ভোটের প্রায় পুরোটাই তৃণমূলের পক্ষে গিয়ে তার প্রাপ্ত ভোট শতাংশ বাড়িয়েছে ৪৮.৭%-এ। এটা অনুমানসাপেক্ষ, কিন্তু ২০২১-এ বিজেপি যে ২% ভোট হারিয়েছে তার প্রায় পুরোটাই হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট, কারণ মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোট ২০২১ সালে নতুন ক'রে বিজেপির ভাগ্যে জুটেছে, এমন ইঙ্গিত কোথাও দেখা যায়নি।

তবে ২০২১-এ সংযুক্ত মোর্চা ঠিক কোন জায়গায় ৪% ভোট হারিয়েছে, তা নির্ণয় করা তুলনায় কঠিন। এর পুরোটাই কি মুসলিম সমপ্রদায়ের ভোট না-কি 'বিজেপি বিরোধী' ভোট যেখানে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু দুই অংশের মিলিত ভোট রয়েছে তার একটু বিচার প্রয়োজন।

উত্তরবঙ্গের কিছু জেলা, যেখানে মোট জনসংখ্য়ার প্রায় ৪৮.০২% মুসলিম, সেখানে তৃণমূলের ব্যাপক নির্বাচনী বৃদ্ধি চোখে পড়ছেঃ প্রায় ১২.৮৭%-এ বৃদ্ধি। আবার দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫.৬% মুসলিম, সেখানে তৃণমূলের ভোট বৃদ্ধি হয়েছে ১%-এরও কম। কোনো সন্দেহ নেই যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট তৃণমূলের নির্বাচনী সাফল্যের জন্য অনেকটাই দায়ী, কিন্তু রাজ্যব্যাপী শুধু সংখ্যালঘু ভোটই দায়ী এমন দেখা যায় না।

যেমন জঙ্গলমহল অঞ্চলে, যেখানে জনসংখ্যার মাত্র ৮.২% মুসলিম, সেখানেও প্রায় ৪.৭৩% হারে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। কলকাতা জেলার ১১টা বিধানসভা কেন্দ্রে, যেখানে জনসংখ্যার প্রায় ২০% মুসলিম, সেখানেও ২০২১-এ তৃণমূলের ভোট বেড়েছে প্রায় ১০%-এর হারে, অর্থাৎ উত্তরবঙ্গের ফলাফলের প্রায় সমতুল্য। তাহলে অবশ্যই এটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ অংশ ২০১৯-এর থেকে ২০২১-এ আরো ব্যাপক ভাবে তৃণমূলের পক্ষে রায় দিয়েছে।

সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিজেপি বিরোধী ভোটের একটি একত্রীকরণ হয়েছে, যা জেলা ভিত্তিক পর্যবেক্ষণে আরো স্পষ্ট হবে। মুর্শিদাবাদ জেলা, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায় প্রায় সংখ্যাগুরু, সেখানে তৃণমূল এবং বিজেপি দুইয়েরই ভোট শতাংশের নিরিখে বৃদ্ধি চোখে পড়ে। অর্থাৎ সেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ স্পষ্ট। তবে একই ভাবে মালদায়, যেখানেও মুসলিম সম্প্রদায় জনসংখ্যার প্রায় সংখ্যাগুরু অংশ এবং জাতীয় কংগ্রেসের পুরোনো ঘাঁটি, সেখানে বিজেপির ভোট কমেছে। বেড়েছে তৃণমূলের ভোট। এর অর্থ এই যে, কংগ্রেসের ভোটাররা বিজেপির বিরুদ্ধে যোগ্য বিকল্প হিসেবে তৃণমূলকেই বেছে নিয়েছে।দুই জেলাতেই সংযুক্ত মোর্চা ব্যাপক ভোট হারিয়েছে এভং স্পষ্টতই তাদের সম্প্রদায়ের ভোটারদের ব্যাপক অংশ তৃণমূলকেই ভোট দিয়েছেন।

কিন্তু এই একই যুক্তিতে এটা মনে করাই যায় যে আলিপুরদুয়ার, পুরুলিয়া, এবং ঝাড়গ্রামে, যেখানে মোট জনসংখ্যায় মুসলিম সম্প্রদায়ের হার খুবই কম, সেখানেও কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটের একত্রীকরণ হয়েছে। পুরুলিয়া এমনই একটি জেলা যেখানে ২০১৭ থেকে বিজেপির রাম নবমী যাত্রা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। সম্ভবত সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বুঝেছেন যে দীর্ঘ সামাজিক অশান্তি মানুষের জন্যই ক্ষতিকর।

সমাজকল্যাণ এবং বাংলার মানব কল্যাণের ধারণা

তৃণমূলের জয়ের অন্যান্য আরো গুরুত্বপূ্র্ণ কারণ পর্যবেক্ষণ করলে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিজেপি বিরোধী ভোটের একত্রীকরণের যুক্তি আরো সাবলীল হবে। তৃণমূলের সাফল্যের বেশিরভাগ দায় দেওয়া হচ্ছে রাজ্য সরকারের সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে। এর মধ্যে শুধুমাত্র 'স্বাস্থ্যসাথী' এবং 'দূয়ারে সরকার' ব্যতিরেকে সবকটি প্রকল্পই ২০১৯ এর আগে থেকে ছিল। এই সময়ের মাঝেই কিন্তু তৃণমূলের নির্বাচনী অবনতিও আমাদের চোখে পড়ে। সম্ভবত 'দূয়ারে সরকার' এবং 'স্বাস্থ্যসাথী'-এর প্রকল্পের কারণে কিছু মানুষ তৃণমূলের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু এর চেয়েও বড় একটি কারণ রয়েছে, যা উপেক্ষা করলে, মানুষের এই রায়কে ত্রান্ত ভাবে দেখা হবে।

আর্থ-সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্প ভিন্ন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণেই শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের ভোটারদের মধ্যেই বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার শহরতলি থেকে বাঁকুড়া গ্রামীণ অঞ্চল, অর্থাৎ যে কেন্দ্রে মূলত গ্রামাঞ্চল থেকে যে নির্বাচন কেন্দ্রে মূলত শহরাঞ্চল, এই দুই অংশেই, বিজেপির ভোট কমেছে এবং তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। পরিষ্কারভাবেই শুধুমাত্র কল্যানমূলক প্রকল্পের আঙ্গিকে তৃণমূলের সামগ্রিক সাফল্যকে মাপা ভুল হবে।

কলকাতায় দেখা যাচ্ছে যে সাধারণ মানুষ বিজেপির হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি। কাজেই ২০২১-এ ২০১৯-এর তুলনায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার প্রায় ৫% কমেছে। সংযুক্ত মোর্চার পরিণতিও একই রকম। এই দুই পক্ষেরই হারানো ভোট গেছে তৃণমূলের পক্ষে।২০১৯-এ বিজেপি কলকাতা জেলার তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিলঃ জোড়সাঁকো, শ্যামপুকুর এবং রাসবিহারী। এই কেন্দ্রগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যা হার খুব বেশি নয়। তবে ২০২১-এ এই তিনিটি কেন্দ্রেই জয়লাভ করেছে তৃণমূল, ভোট শতাংশের নিরিখে প্রায় ১৭%-এর বৃদ্ধি পেয়ে।

কলকাতার আরো তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রঃ বালিগঞ্জ, চৌরঙ্গী, এবং ভবানীপুর। ধর্ম, ভাষা এবং আর্থিক ভাবে এই কেন্দ্রের ভোটাররা যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। উচ্চবিত্ত এবং তথাকথিত 'ভদ্রলোক' সম্প্রদায়ের মানুষ থেকে খেটে খাওয়া গরীব মানুষ, দুই শ্রেণির অস্তিত্বই এখানে মেলে। এই দুই শ্রেণির ভোটই একত্রিত হয়েছে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে।

এই কারণেই এই তিন বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের জয়ের ব্যাপকতার কারণ হিসেবে শুধুমাত্র তৃণমূলের কল্যাণমূলক প্রকল্পকে দায়ী করা পর্যাপ্ত হবে না। খুব সম্ভবত বিজেপির সস্তা ধর্মীয় মেরুকরণ-নির্ভর নির্বাচনী প্রচার হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগুরু অংশের সমর্থন হারিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে মানুষ তাদের পূর্বতন আদর্শগত অবস্থান বা অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টির প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করেছে শুধুমাত্র বিজেপি এবং হিন্দুত্বকে পর্যুদস্ত করার স্বার্থে। তৃণমূলের পক্ষে তারা রায় দিয়েছে শ্রেষ্ঠ বাজার দরের কারণে নয়। বরং রাজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি করবে এমন লেনদেন থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে।

এই উপলব্ধিই তাদের বিজেপির বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে সোচ্চার হতে ইন্ধন জুগিয়েছে। বিভিন্ন নাগরিক মঞ্চ একত্রিত হয়েছে 'No Vote to BJP, Bengal against Fascist RSS-BJP' নামক ফোরাম গঠন করে। গান, নাটক এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে বিজেপির বিরুদ্ধে তাদের প্রচার শহরাঞ্চলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। যেই সমস্ত মানুষ ভারতের ভবিষ্যৎ এবং রাজ্যের সংহতির দিকটি নিয়ে চিন্তিত এবং সজাগ, তাঁরা একত্রিত হয়েছেন, 'নিজেদের মতে নিজেদের গানে'।

এই সমস্ত চেষ্টায় মানুষের কাছে একটি ব্যাকুল আবেদন থেকেছে। বিজেপিকে একটি ভোটও নয়। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে তৈরি নানা কর্মসূচি, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রুপান্তরিত করে। এই ফলাফল আমাদের তাই সমান্তরাল ভাবে রাজনৈতিক মনস্তাত্বিক শন রোসেনবার্গ-এর কিছু কথায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তিনি লিখছেন, উপযুক্ত নাগরিকদের সচেষ্ট মদতেই গণতন্ত্র স্থায়ী হয়। অনুপযুক্ত, অলস এবং নিষ্ক্রিয় নাগরিক সমাজ, যারা কেবলই হোয়াটস্যাপের কয়েকটা নিছক ভুয়ো খবর বা হেট-স্পিচে সাড়া দিতে সক্ষম, তাদের অবস্থানে গণতন্ত্র ক্রমশই ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে।

কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বাংলার এই মানবিক চিন্তার সত্যটি হঠাৎ একজন নেতা-নেত্রী বা ব্যক্তিত্বের চারপাশে গড়ে ওঠা বিশ্লেষণে যেন হারিয়ে না যায়। মমতা ব্যানার্জীকে তার পার্টির জয়ের জন্য দায়ী করা যেতেই পারে, কিন্তু বিজেপির হারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষই দায়ী। তাই এই বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষের এই রায়কে সন্মানের দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যে সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী রাজনীতির চর্চা আবার ফিরে আসছে, মানুষ কিন্তু তেমন বাংলাকে বেছে নিতে চায়নি।