আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
সমসাময়িক
শব্দ বদল জমানায়
শব্দ বদল হয়। শব্দের অর্থ এবং ভূমিকাও। 'মহাজন' ছিল মহৎ জন হয়ে দাঁড়াল সুদখোর। নেতা ইত্যাদি একটা শব্দও তার শ্রদ্ধার অর্থ হারাতে বসেছে।
'ত্রাণ' শব্দের আদি অর্থ ছিল উদ্ধার। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবন দাস 'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে প্রথম 'ত্রাণ' শব্দ ব্যবহার করেন। লেখেন, 'জয় দুষ্ট ভয়ঙ্কর জয় শিষ্টত্রাণ'। এখানে 'ত্রাণ' মানে উদ্ধার। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার লিখেছেন, রাক্ষস হইতে ত্রাণ করিয়া প্রাণদান দিলা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, প্রায় ১০০ বছর পরে, দ্বার ছুটায়ে, বাধা টুটায়ে মোরে করো ত্রাণ।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ত্রাণ শুধু উদ্ধার নয় সহায়তা অর্থেও ব্যবহার হতে থাকে। এখন ত্রাণ মানে যতো না উদ্ধার তার চেয়ে বেশি সহায়তা। বা রিলিফ দেওয়া।
সরকারি দপ্তর আছে, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর। ১৯৭৮ এর ভয়াল বন্যায় ত্রাণ কাজের এক নতুন চেহারা প্রত্যক্ষ করে নবজাগ্রত বাংলা।বন্যা ভয়ঙ্কর, ক্ষয়ক্ষতি বিশাল, কিন্তু বামপন্থী ছাত্রযুবদের নেতৃত্বে লাখো লাখো মানুষ সামিল হন, ত্রাণকাজে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। চারজন ছাত্রযুব নেতা উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দেন। তবু থামেনি কাজ। এর ফলে বাংলায় বন্যার পর সাপের ছবি নিয়ে ভিক্ষা করতে আসা লোকজন আর দেখা যায়নি। ১৯৮০তেও মানুষ ত্রাণে সামিল হয়েছেন। চলচ্চিত্র অভিনেতা উত্তমকুমারের নেতৃত্বে শিল্পীরাও সংগ্রহ করেছেন ত্রাণ।
১৯০৭-এর মহামারী, ১৯১৮-এর প্লেগেও মানুষ জীবন বিপন্ন করে ত্রাণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গ'র জ্যাঠামশাই, শরৎচন্দ্রের 'গৃহদাহ'-র সুরেশরা ঝাঁপিয়েছেন জাতি ধর্ম না দেখে প্লেগের সময় বিপন্ন মানুষের সেবায়।
১৯৪৪-এ ব্রিটিশ সৃষ্ট মহামারীতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সমর্থকরা এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, জনস্বাস্থ্য কমিটি লঙ্গরখানা খুলে প্রাণ বাঁচান বহু মানুষের। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যা হয়েছিল। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহের বহু এলাকা দু'মাস তিন মাস ধরে প্লাবিত ছিল। কিন্তু প্রচারমাধ্যম মাথা ঘামায়নি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ম্যানমেড বন্যা। কলকাতার নাগরিক সমাজকে সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়নি ত্রাণে। ১৯৯৯-এ ওড়িশা ত্রাণে যদিও সাড়া দিয়েছিল বাংলা।২০০৯-এ আয়লা। কিছু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ত্রাণ কাজ করলেও বৃহত্তর নাগরিক সমাজ ছিল নীরব।
২০২০-তে করোনাকালে আমফান ঝড়ে বাংলা প্রত্যক্ষ করে ত্রাণের কাজে নাগরিক সমাজের এক বিপুল বিস্ফার। শত শত নতুন পুরাতন সংস্থা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ত্রাণকে এক গণআন্দোলনে পরিণত করে। গড়ে ওঠে শ্রমজীবী ক্যান্টিন, অজস্র গণ রান্নাঘর। ২০২১-এ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন অক্সিজেন, ওষুধ নিয়ে চোরাবাজারি - হাসপাতালে শয্যা অমিল, লুঠ চলছে চিকিৎসা ব্যবস্থায়, মানুষ একা মরে পড়ে থাকছেন তখন লাল স্বেচ্ছাসেবক সহ বহু মানুষ এগিয়ে আসেন। তৈরি হয় নানা সেফ হোম, বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন ওষুধ খাবার পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বহু মানুষ চলে গেছেন। তার মাঝে এসেছে ঘূর্ণিঝড় - ইয়াস। জলোচ্ছ্বাসে বহু ঘর ধ্বংস। আশ্রয়হীন মানুষ। কিন্তু ইয়াসে প্রাণহানি হয়নি সরকারি তৎপরতায়। যদিও সরকারি ত্রাণ বিতরণ নিয়ে বহু অভিযোগ। এবার পঞ্চায়েত পুরসভা নয় সরকারের আমলারা দায়িত্বে ত্রাণের। তবু ত্রিপল ছাড়া কিছু মেলেনি - এমন অভিযোগ বহু এলাকায়। তার মাঝেই সরকার শুরু করেছে 'দুয়ারে ত্রাণ' প্রকল্প। দেখা যাক কতোটা মেলে। এর মাঝে প্রধানমন্ত্রী মোদী ঘুরে গেছেন বাংলা। রাজ্য সরকার বলছে, ২১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি। কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। বাংলা ২৫০ কোটি ঝাড়খণ্ড ২৫০ কোটি। অথচ গুজরাট পেয়েছিল ১০০০ কোটি টাকা। তেমন ক্ষতি না হওয়া সত্ত্বেও।
আজ পর্যন্ত জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করা হয়নি ইয়াস ঝড়ের অভিঘাতকে। গুজরাটে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও করা হয়েছে। এই বৈষম্য দূর হোক।
ইয়াস বিপর্যস্ত এলাকায় বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছেন। রান্নাঘর চালাচ্ছেন। গ্রাম দত্তক নিচ্ছেন। কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনাও ঘটছে। ত্রাণের নামে পর্যটন। কিন্তু মন্দ কম। ভালো বেশি। সেটাই সুখের কথা।
তবে মনে রাখতে হবে, শুধু ত্রাণ দিয়ে হবে না। স্থায়ী সমাধান খোঁজা জরুরি। সুন্দরবন বাঁচাতে, উপকূলীয় এলাকা বাঁচাতে। ম্যানগ্রোভ বা লবণাম্বু উদ্ভিদের জঙ্গল বাড়াতে হবে। কংক্রিটের বাঁধ সাময়িক সমাধান মনে হলেও জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর স্থায়ী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। ত্রাণ করা সহজ নয়, পরিত্রাণের পথ আরো কঠিন। বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা জরুরি।