আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
সমসাময়িক
ভাইরাসের কবলে শিক্ষা
৩,০০,০০০ লক্ষ কোটি টাকা, অথবা ৪,০০০ কোটি ডলার। নাহ! আদানি বা আম্বানির মোট সম্পত্তির পরিমাণ নয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতের আগামী প্রজন্ম যারা বর্তমানে স্কুলে পাঠরত তারা হারাবে স্কুল বন্ধ থাকার জন্য। অক্টোবর ২০২০-তে বিশ্বব্যাঙ্কের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের তরফে একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে ভারতের ছাত্র-ছাত্রীরা আধ বছরে যা শিক্ষা পাওয়া যায় তা হারিয়েছেন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে। এর ফলে গণনা করে দেখা যায় যে আগামীদিনে এই শিশুরা কত টাকা রোজগার হারাবে। সেই সংখ্যাটিই ৩,০০,০০০ লক্ষ কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে যে হিসেবটি অক্টোবর ২০২০ সালে প্রকাশিত, যার পরে আবার এই বছরের মার্চ মাস থেকে অধিকাংশ স্কুল বন্ধ। অতএব, ভারতের ক্ষেত্রে লোকসানের পরিমাণ আরো বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু আপনি যদি মনে করেন যে শিক্ষাকে টাকার অঙ্কে মাপা সম্ভব নয়, তাহলেও এই কথা মানতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়, যে স্কুল বন্ধ থাকার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বাবা-মায়ের সন্তানেরা অনলাইন ক্লাস করতে পারছেন না, অনেকের বাড়িতে স্পার্টফোন বা ইন্টারনেট কানেকশন নেই। অনেকের বাড়িতে নিয়মিত স্কুলের পড়া করার মতন পরিবেশও নেই। অতএব, পড়াশোনা কোভিড-আক্রান্ত হয়ে আইসিইউ-তে স্থান নিয়েছে। এর ফলে শিশুদের উপর নানান ধরনের প্রভাব পড়ছে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া, মানসিক রোগের শিকার হওয়া তার একটি মাত্র দিক। অন্য দিকটি হচ্ছে এই যে বহু দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে লকডাউনের মধ্যে আয় কমে যাওয়ার জন্য রোজগারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। সবজি বিক্রি, রিকশা চালানো, মাছ ধরা ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে এক বিশাল সংখ্যক শিশুদের যাদের শৈশব কাটার কথা ছিল, স্কুলের মাস্টারমশাই, দিদিমণি এবং সহপাঠীদের সঙ্গে।
ভারত তথা রাজ্যের সরকারের অবশ্য কোনো হেলদোল নেই। অনলাইন ক্লাসের নামে শিক্ষার বিগ্রহে কিছু ফুল ছোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতভাবে শিক্ষাকে সর্বজনীনভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনো সদিচ্ছা সরকারের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না। অনেক বামপন্থীরা আবার বলছেন যে স্কুল বন্ধ রাখাই ভুল হয়েছে। কিন্তু স্কুল বন্ধ না রাখলে যে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সবার করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ত, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক নেতারা সংসদ বন্ধ করে বসে থাকবেন আর স্কুলের শিশুরা করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে স্কুলে গিয়ে ক্লাস করবে তা হয় না। তাহলে উপায়? উপায় বের করা যেত। টিভিতে রাতদিন খবরের নামে যে খেউড় চলে তাকে কিছুদিন মুলতুবি রেখে শ্রেণিভিত্তিক ক্লাস নেওয়া যেত, রেডিও-র মাধ্যমে শিশুদের জন্য ক্লাস চালু রাখা যেত। বেশি সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করে পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট জমায়েত করে শিশুদের ক্লাস চালু রাখা যেত। কিন্তু আমাদের দেশে পড়াশোনা নিয়ে মন্ত্রীরা কবেই বা মাথা ঘামিয়েছেন, অতএব, এই সমস্ত পরিকল্পনা কখনও আলোচনাতেও আসেনি। যাদের এই নিয়ে চিন্তিত থাকার কথা ছিল, সেই বামপন্থীরাও কোনোদিন এই বিষয়গুলি নিয়ে সরকারের কাছে দাবি জানাননি। রেড ভলান্টিয়ার্স, শ্রমজীবি ক্যান্টিন ইত্যাদি উদ্যোগ আমাদের রাজ্যে বামপন্থীদের তরফ থেকে দেখা গেলেও বিকল্প উপায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার মতন জরুরি উদ্যোগ তাদের মধ্যেও দেখা যায়নি। তৃণমূল, বিজেপি বা কংগ্রেস শিক্ষা নিয়ে খুব ভাববে বা তাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, এই আশাও কেউ করে না। কিন্তু বামপন্থীরা হয়ত পারতেন শিক্ষাকে কেন্দ্র করে একটি সামাজিক গণআন্দোলনের জন্ম দিতে। কিন্তু ওই যে স্কুলের শিশুরা তো আর ভোটার নয়, অতএব সবার কাছেই তারা ব্রাত্য।
শুধু তাদের পরীক্ষা নিয়ে সবার মাথাব্যথা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার পরীক্ষা নিচ্ছি নেব করে অবশেষে তা বাতিল করে দিল। রাজ্য সরকারও সেই পথে হেঁটে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করল। নিঃসন্দেহে যা পরিস্থিতি গোটা দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিল, সেখানে লক্ষ্য লক্ষ্য ছাত্র-ছাত্রীকে পরীক্ষার হলে ডেকে পরীক্ষা নিতে হলে বিপদ বাড়ত। কিন্তু এক বছরের উপর যে সময় নীতি নির্ধারকরা পেয়েছিলেন, সেই সময়ে তাঁরা কী করলেন? বিকল্প পথে কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব, পরীক্ষা না নিতে পারলে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে তাঁরা কোনো মাথা ঘামালেন না। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল।
একই অবস্থা উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও বিরাজমান। ক্লাস হচ্ছে না, যাও বা হচ্ছে তা অনলাইন হচ্ছে। ব্যবহারিক বা প্রাক্টিকালের কী হবে কেউ জানে না। নতুন ক্লাসে উত্তরণের মাপকাঠি কী, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিত্যক্ত। এক সময় ছাত্রদের কলরবে যেই প্রাঙ্গন ভরে থাকত সেখানে যেন এখন শ্মশানের শান্তি। অতিমারি আর কিছুকে মারতে পারুক আর না পারুক শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রার ব্যবস্থা করেছে।
আমরা বিদেশ থেকে যত ফালতু বিষয় আছে, তার অক্ষম অনুকরণ করে থাকি। কিন্তু তাদের যে ভালো বিষয়গুলি সেগুলির প্রতি আমাদের কোনো মনযোগ নেই। লকডাউনের মধ্যেও ব্রিটেনে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে স্কুল চালু রাখা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস। কারণ সেখানকার নীতি নির্ধারকরা জানতেন যে স্কুল বন্ধ থাকলে তা ছাত্র-ছাত্রী তথা সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি করে দেবে। ভ্যাক্সিন বাজারে আসার পরে জরুরি ভিত্তিতে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হল। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে বাড়িতে বসে করোনা নির্ধারণের জন্য কিট দেওয়া হল, যাতে তারা সহজেই টেস্ট করে বুঝতে পারে তাদের সংক্রমণ হয়েছে কী না। এই অবস্থায় ব্রিটেনে অফিসের কাজকর্ম ১০০ শতাংশ শুরু না হলেও স্কুল পুরোদমে চলছে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ ভ্যাক্সিন পেয়ে যাওয়াতে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও লাগাতার কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তাকিয়ে দেখুন। ভ্যাক্সিন নেই, অক্সিজেন নেই। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই বিপদের মধ্যে স্কুলে পাঠানো যায় না। তাই ভবিতব্যের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নেতারা নিশ্চিন্তে রয়েছেন।
আসলে আমাদের সমাজে শিক্ষা নিয়ে বড় বড় কথা বলা হলেও, তা নিয়ে সচেতনতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলনের অভাব রয়েছে। শিক্ষাকে গণপরিসরে সর্বজনীন করে তোলার লড়াই শহুরে মধ্যবিত্তরা বহুদিন হল পরিত্যাগ করেছেন। তাদের সন্তান-সন্ততিরা দিব্যি অনলাইনে ক্লাস করছে, কোনো সমস্যা নেই। বাকিদের কী হল তা নিয়ে মধ্যবিত্তদের মাথাব্যথা কোথায়! আর যারা নিম্নশ্রেণির মানুষ, তাদের পেটের ভাত জোগাড় করার চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে। সেখানে বাচ্চারা স্কুলে গেল কি না, বা অনলাইনে তারা ক্লাস করতে পারছে কি না, তা নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। ভাবলেও পরিস্থিতি পরিবর্তন করার মতন রসদ তাদের হাতে নেই। যাদের হাতে সেই রসদ ছিল, সেই বামপন্থী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরাও মানুষকে এই প্রশ্নে রাস্তায় নামানোর চেষ্টাটুকুও করেনি। দিনের শেষে তাই ছাত্রদের হাতে পড়ে রয়েছে ভাঙা পেন্সিল, ভগ্ন হৃদয় আর স্কুলছুট হওয়া। আর আমাদের জন্য রয়েছে বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব - ৩,০০,০০০ লক্ষ কোটি টাকার লোকসান হবে ভারতের অর্থব্যবস্থার, স্কুল বন্ধ থাকার দরুন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের অকর্মণ্যতা ক্ষমা করবে না।