আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮
সম্পাদকীয়
দেশদ্রোহিতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা
“১২৪-এ ধারা (দেশদ্রোহিতা), যার ভিত্তিতে আমি আনন্দের সঙ্গে অভিযুক্ত, তা ভারতীয় দণ্ডবিধির রাজনৈতিক বিভাগের মধ্যে রাজপুত্র। এই ধারা তৈরি করা হয়েছে নাগরিকের স্বাধীনতাকে দমন করার উদ্দেশ্যে। (সরকারের প্রতি) অনুরাগ কখনই আইনের মাধ্যমে তৈরি করা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি কারো মনে কোনো ব্যক্তি বা ব্যবস্থার প্রতি অনুরাগ না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত তার বীতরাগকে প্রকাশ করার, যতক্ষণ না তিনি হিংসার কথা বলছেন বা হিংসা করছেন। কোনো প্রশাসকের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনো রাগ নেই। কিন্তু আমি মনে করি যেই সরকার ভারতের সমস্ত পূর্বতন ব্যবস্থার তুলনায় মানুষের বেশি ক্ষতি করেছে তার বিরুদ্ধে বীতরাগ প্রকাশ করা আমার পুণ্য কর্তব্য”।
মাননীয় পাঠক, উপরের উক্তিটি দেখে চমকিত হবেন না। সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে কেউই দেশদ্রোহিতার দায়ে এখনও অবধি অভিযুক্ত হননি। অতএব উক্তিটি আমাদের নয়। উক্তিটি মহাত্মা গান্ধীর। ঔপনিবেশিক শাসনের ভারে ক্লান্ত ভারতীয় জনগণের উপর যখন জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা সংঘটিত হল, তখন মহাত্মা গান্ধীকে দেশদ্রোহের দায়ে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। সেই মামলায় মহাত্মা এই অবিস্মরণীয় উক্তিটি করেন। বুঝিয়ে দেন যে দেশদ্রোহিতার আইনের স্বরূপ এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার তাঁর অদম্য প্রত্যয়।
অত্যন্ত দুঃখের যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারায় অভিযুক্ত হয়ে মহাত্মার এই উক্তির পরেও, তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতবর্ষে এখনও আমরা এই ধারাকে অবলুপ্ত করতে পারিনি। আপাতত তাই এই ধারা শাসকের নিকৃষ্টতম অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। দেশদ্রোহিতা শব্দটি নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। আপনি সরকারের বিরোধিতা করলেই আপনাকে 'দেশদ্রোহী' তকমা লাগিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেবে পুলিশ-প্রশাসন। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল দেশের সংবিধান, মুখে ছিল ‘জয় হিন্দ’, এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। তবু বহু আন্দোলনকারীকে জেলে পাঠিয়েছে অমিত শাহের দিল্লি পুলিশ এবং যোগীর উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।
সাংবাদিক বিনোদ দুয়া-র বিরুদ্ধে গত বছর রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়। কেন? কারণ তিনি তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে করোনার প্রকোপ সামলাতে নরেন্দ্র মোদীর ব্যর্থতার কথা বলেন। সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করে কারণ তিনি হাথরসের ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ এবং সত্য রিপোর্ট করছিলেন। আপাতত, প্রবল অসুস্থতা নিয়ে তিনি জেলে পচছেন। খুব সম্প্রতি, লাক্ষাদ্বীপকে কেন্দ্র করে মোদী ও অমিত শাহের হিন্দুত্ববাদের বিভৎস মুখ আবার প্রকাশিত হচ্ছে। লাক্ষাদ্বীপে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করছেন সেখানকার ফিল্ম নির্মাতা আয়শা সুলতানা। আপাতত তাঁর বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদোহিতার মামলা রুজু করা হয়েছে। এরকম অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে দেশের প্রায় সমস্ত বিজেপি শাসিত রাজ্যে, যেখানে সরকারের বিরোধিতা করলেই আপনি দেশদ্রোহী। মহাত্মা যেই আইনের বিরোধিতা করে গেছেন, সেই আইনকে ব্রিটিশদের মতন ব্যবহার করে চলেছে, মহাত্মার আততায়ীর ভাবাদর্শে দীক্ষিত হিন্দুত্ববাদীরা, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনোদিন অংশগ্রহণ করেনি।
সুপ্রিম কোর্ট অনেক দিন পরে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। বিনোদ দুয়া-র বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মহামান্য বিচারপতিরা খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন যে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রয়েছে, তাদের মতন করে সরকারের সমালোচনা করার। ১৯৬২ সালের কেদার নাথ সিংহ বনাম ভারত সরকারের বিখ্যাত মামলার রায়ের উল্লেখ করে বিচারপতিরা বলেছেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা তখনই গ্রাহ্য হবে যখন সরাসরি বক্তব্যের মাধ্যমে হিংসার প্ররোচনা দেওয়া হবে যা গণপরিসরে অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে। এই নিয়ম ব্যতিরেকে, যেখানে হিংসার কোনো প্ররোচনা নেই, সেই ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে আপনি যাই বলুন না কেন, তা কখনই রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে না। দেশের সুপ্রিম কোর্টের ৫০ বছরের পুরোনো রায়েই সেই কথা বলা রয়েছে। ১৯৯৫ সালে এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আরো একটি রায় দেন। দুইজন ব্যক্তি খালিস্তানের নামে স্লোগান তোলায় তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রুজু করা হয়। এই মামলাতেও সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে, দুটি-একটি স্লোগান দেওয়া হলেই তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয় না, যদি না সেই স্লোগানের ফলে হিংসা হয়।
এই সমস্ত রায় থাকার পরেও বারবার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয় তাদের ভয় দেখানোর জন্য এবং তাদের হেনস্থা করার জন্য। সরকারে যেই থাকুক, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারা তাদের হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয় প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ রেখে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করার। অতএব, মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ মেনে এই ধারার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি আজকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি মুখ্য দাবি হওয়া উচিত।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারার অবলুপ্তির দাবি কোনো নতুন দাবি নয়। সংবিধান তৈরি হওয়ার সময় সংবিধান পরিষদেও এই নিয়ে বিতর্ক হয়। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে সংবিধান পরিষদে কে এম মুন্সী, একটি সংশোধনী পেশ করেন, যেখানে তিনি দাবি করেন যে ‘দেশদ্রোহিতা’ বা sedition শব্দটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না, কারণ সরকারের সমালোচনা করাই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। সংবিধান পরিষদ এই দাবিকে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে গ্রহণ করলেও পরে সুপ্রিম কোর্ট ১২৪-এ ধারার ব্যাখ্যা প্রদান করার সময় আবার ‘দেশদ্রোহিতা’ শব্দটির সংজ্ঞা আরোপ করেন। বিখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ জি নুরানির মতে দেশদ্রোহিতা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হলেও সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় ১২৪-এ ধারায় তাকে পুনরুজ্জীবিত করে। তাই যখন মহামান্য বিচারকরা দেশদ্রোহিতা নিয়ে পুনরায় ভাববার সময় এসেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন, আমরা আশা করব সংবিধান পরিষদের আলোচনার সারমর্মকে মান্যতা দিয়ে ১২৪-এ ধারাকে তাঁরা বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করবেন।
সমস্যা অবশ্য শুধু দেশদ্রোহিতার আইনেই সীমাবদ্ধ নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকার ইউএপিএ এবং এনআইএ আইনের সংশোধন করার মধ্য দিয়ে সেই আইনে অভিযুক্ত হলে জামিন পাওয়া অসম্ভব করে দিয়েছে। অতএব, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তরা বছরের পর বছর জেলে পড়ে আছেন বিচার এবং জামিন ছাড়াই। সুধা ভরদ্বাজ, আনন্দ তেলটুম্বডে, গৌতম নভলাখা, ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতন দীর্ঘদিনের বুদ্ধিজীবি, সমাজকর্মীরা জেলে পচছেন কারণ তাঁরা মোদী সরকারের নীতির বিরোধিতা করে গেছেন। অন্যদিকে, আখলাক-জুনাইদের খুনীরা নির্বিঘ্নে দিন কাটাচ্ছে, কপিল শর্মার মতন ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে দাঙ্গার উস্কানি দিয়েছেন অথবা শাহীন বাগ বা জামিয়ায় গুলি চালনাকারীরা বিজেপি সরকারের মদতে বহাল তবিয়তে ঘুরছেন। শুধু মোদী বিরোধী হলেই আপনি দেশদ্রোহীর তকমা পাবেন।
স্ট্যান স্বামীর মতন অসুস্থ ব্যক্তি যিনি পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত, তাঁকে জামিন পেতে, চিকিৎসা পেতে কোর্টের দোরে দোরে ঘুরতে হচ্ছে। অন্যদিকে, সিএএ-র বিরুদ্ধে যারা জেলে বন্দী, নাতাশা নারওয়াল যাদের অন্যতম, তিনি নিজের পিতাকে শেষ দেখাটুকুও দেখতে পারলেন না। আপাতত, দিল্লি হাইকোর্ট অবশ্য তাঁকে জামিন দিয়েছে। সেই জামিনের নির্দেশে দিল্লি হাইকোর্ট পরিষ্কার ভাষায় বলেছে যে ভিন্নমতকে দমিয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত সরকার সাংবিধানিকভাবে বিধিবদ্ধ প্রতিবাদের অধিকারকে উগ্রপন্থী কার্যকলাপের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। কিন্তু মহামান্য বিচারপতিগণ, আপনারা যদি তাই-ই বিশ্বাস করেন তবে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই দেশের প্রতিবাদীদের সামনে কত বড় খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে! সরকারের অভিসন্ধি যদি প্রতিবাদকারীদের উগ্রপন্থী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা দেশদ্রোহিতা নয়, দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ উদাহরণ। আর যেই সরকার নিরীহ মানুষকে প্রতিবাদ করার জন্য দেশদ্রোহী প্রমাণ করতে চায়, তারাই প্রকৃত দেশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত।
ইউএপিএ আইনে যেই সংশোধনগুলি করা হয়েছে, তা মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে খর্ব করে দেওয়ার লক্ষ্যেই গঠিত। যেমন, ইউএপিএ-র নতুন সংশোধন অনুযায়ী একজন ব্যক্তিকেও উগ্রপন্থী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, তিনি কোনো উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য না হলেও। অর্থাৎ সরকারের অপছন্দ হলে যেকোনো ব্যক্তিকে উগ্রপন্থী বলে দাগিয়ে দিয়ে তাকে জামিনহীনভাবে জেলে ফেলে রাখা যাবে। সংঘ পরিবারের তরফ থেকে, ‘আর্বান নকশাল’, ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ আবিষ্কৃতই হয়েছে ব্যক্তিদেরকে উগ্রপন্থী বলে দাগিয়ে দিয়ে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে। তাই শুধুমাত্র এই শব্দবন্ধগুলির বিরোধিতা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিরোধী এই আইনকে বিলুপ্ত করা। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট আইন রয়েছে, প্রয়োজনে আরো তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু পোটা-র মতন ভয়ানক আইনের যেমন কোনো প্রয়োজন নেই, তেমনি ইউএপিএ-র মতন আইনেরও মানুষের উপর অত্যাচার করা ব্যতিরেকে কোনো স্বাতন্ত্র প্রয়োজনীয়তা নেই।
দেশদ্রোহিতা আইন, ইউএপিএ-র মতন আইন কোনো গণতান্ত্রিক দেশে থাকতে পারে না। একদিকে এই দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবি তোলা জরুরি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন কোভিড পরিস্থিতিতে জেলে বন্দীদের সংখ্যা কমানো আবশ্যিক। একান্ত জরুরি না হলে গ্রেপ্তার না করার কথাও বলা হয়েছে। অথচ, সুধা ভরদ্বাজ, স্ট্যান স্বামীদের মতন অসুস্থ ব্যক্তিদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার এহেন উপায়ে খর্ব করার বিরুদ্ধে পথে নামা ছাড়া গতি নেই। আমরা আশা করব দেশের বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ এই প্রশ্নে নিরন্তর লড়াই করবেন।