আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ছ-মাস কেটে গেল, কৃষক আন্দোলন আর কতদিন?

গৌতম হোড়


দিল্লির সীমানায় কৃষক আন্দোলন ছ-মাস পূর্ণ করল। নরেন্দ্র মোদীর সাত বছরের শাসনে এটা দ্বিতীয় আন্দোলন যা এতদিন ধরে চলল। দীর্ঘদিন ধরে চলা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত এক নম্বরে আছে সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলন। দুটি আন্দোলনই কেন্দ্রীয় সরকারের আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও তার মধ্যে চরিত্রগত কিছু ফারাক আছে। সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে শাহিনবাগের আন্দোলন ছিল মূলত সংখ্যালঘুদের এবং বিশেষত সংখ্যালঘু নারীদের প্রতিবাদ। সেটা দিল্লি সহ কয়েকটি শহরের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল।. সব চেয়ে বেশিদিন এই আন্দোলন দক্ষিণ দিল্লির শাহিনবাগেই চলেছিল। কিন্তু কৃষকদের এই আন্দোলন হচ্ছে, দিল্লির সীমানায়। সেখানে মূলত চার রাজ্যের কৃষকরা এসেছেন। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড। এছাড়া রাজস্থানের কৃষকরা আছেন। অন্য কিছু রাজ্যের কৃষকদের প্রতীকী উপস্থিতি আছে। করেনাকালেও এই প্রতিবাদ চলেছে। তবে তা আকারে কমেছে। কিন্তু প্রতিবাদ বহাল আছে। আর এই আন্দোলনের মধ্যে ছোট-বড় সব ধরনের কৃষকই অংশ নিয়েছেন। কৃষকদের অসংখ্য ছোট-বড় সংগঠন সংযুক্ত কৃষক মোর্চার ছাতার তলায় একজোট হয়ে এই আন্দোলন চালাচ্ছে। তার মধ্যে টিকায়েতদের ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন যেমন আছে, তেমনই যোগেন্দ্র যাদবের স্বরাজ পার্টির কৃষক শাখা, সিপিএমের কৃষক সংগঠন এবং প্রচুর ছোট ছোট সংগঠনও আছে।

আন্দোলনের ছ-মাস পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে গত ২৬ মে সংযুক্ত কিষান মোর্চা 'কালা দিবস' পালন করে। প্রতিবাদী কৃষকরা কালো ব্যাজ পরেছেন, বাড়িতে কালো পতাকা তুলেছেন। আর এই উপলক্ষে দিল্লিতে উইমেনস প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে মোর্চার নেতা রাজেশ টিকায়েত বলেছেন, তারা ২০২৪ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করার জন্য প্রস্তুত। দ্য টেলিগ্রাফের রিপোর্ট অনুসারে, টিকায়েত বলেছেন, ''আমরা যখন আন্দোলন শুরু করি, তখন জানতাম না, সেটা এতদিন ধরে চলবে। সরকার এই আন্দোলন ভাঙার ভরপুর প্রয়াস করেছে। কিন্তু আমরা এক থেকেছি। প্রাথমিকভাবে দুটি রাজ্যে আন্দোলন শুরু হলেও এখন তা দেশভর ছড়িয়ে পড়েছে।'' তারপরই তিনি ২০২৪ পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর কথা বলেন। ২০২৪ সালে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা।

বোঝা যাচ্ছে, টিতায়েতদের মনে একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আন্দোলন নিয়ে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেবে না। গত ২২ জানুয়ারি সরকার ও কৃষকদের মধ্যে শেষবারের মতো আলোচনা হয়েছিল। সেখানে দু-পক্ষই তাদের মতে অনড় ছিল। কৃষকরা জানিয়েছিল, সরকারকে তিনটি বিতর্কিত কৃষি বিল প্রত্যাহার করতেই হবে। আর মোদী সরকারের বক্তব্য ছিল, তারা দেড় বছরের জন্য তা স্থগিত রাখতে পারে, কিন্তু বাতিল করবে না। কৃষক নেতারা এই প্রস্তাবে সম্মত হননি। ফলে আলোচনা আর এগোয়নি। কৃষক নেতারা আবার আলোচনা চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন।

এখন যা পরিস্থিতি, তাতে আলোচনা তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন অন্ততপক্ষে কোনো এক পক্ষ তাদের দাবি বা সিদ্ধান্ত থেকে একটু হলেও সরে আসবে। কিন্তু এখনও সেরকম কোনো ইঙ্গিত নেই। তাই আলোচনা যদি আবার শুরু হয়, তা হলেও তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে গণতন্ত্রে যে কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে, আন্দোলন, বিক্ষোভের ক্ষেত্রে আলোচনাটা সবসময়ই কাম্য। আলোচনা ছাড়া সমাধানের রাস্তা খোলা সম্ভব নয়। আবার সমাধানের রাস্তা তখনই খুলবে, যখন কোনো এক পক্ষ বা দু-পক্ষই একটু নরম হবে। কৃষক আন্দোলন এখন সেই চক্রে ফেঁসে গেছে। আলোচনা হচ্ছে না। হলেও তাতে সমস্যার জট খোলার সম্ভাবনা কম। কারণ, কেউই নরম হচ্ছে না। আবার আলোচনা না হলে সমস্যার সমাধানও হবে না। তাই এখন রাজেশ টিকায়েতদের ২০২৪ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলতে হচ্ছে।

কৃষক আন্দোলন নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য দিল্লির দুটি সীমানায় আমি গেছি। গাজিয়াবাদ ও সিঙ্ঘু। দু-জায়গাতেই কৃষক আন্দোলনের নেতাদের, অংশগ্রহণকারীদের বারবার প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করেছি, কতদিন এই আন্দোলন চলবে? কতদিন এই আন্দোলন চালাতে পারবেন? প্রতি ক্ষেত্রে একই জবাব পেয়েছি, যতদিন সরকার দাবি না মানছে। যদি দাবি না মানে? তা হলে চলবে। কিন্তু কতদিন? আন্দোলন বা বিক্ষোভ কি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে? তত্ত্বগতভাবে পারে। কিন্তু তার মধ্যে তখন হতাশা আসে। মনোবল ভাঙতে থাকে। যোগদান কমে যায়। প্রথম প্রথম যে জোশ থাকে, তা কমতে থাকে। আর এই আন্দোলন চালাতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর আন্দোলনের আকার কমেছে, কিন্তু তার আগে সিঙ্ঘুতে গিয়ে দেখেছি, সে এক কার্নিভালের মতো পরিবেশ। দু-পা যেতে না যেতে লঙ্গর। তাতে সকালের জলখাবার থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত সব পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে লস্সি, ছাঁচ, ফলের রস পর্যন্ত। রাস্তার ধারে বড় বড় আর-ও মেশিন বসানো, পরিশোধিত পানীয় দলের জন্য। এই খরচ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর টেনে যাওয়া সম্ভব কি না সে প্রশ্নও থাকবে।

কিন্তু আন্দোলনরত কৃষকদের মুসকিল হলো, দাবিপূরণ না হলে তারা এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। আর নরেন্দ্র মোদী সরকারের গত সাত বছরের কাজের ধরণ থেকে একটা কথা পরিষ্কার, কৃষকদের আইন বাতিলের দাবি সরকার মানবে কি না, তা নিয়ে বড়সড় সন্দেহ আছে। একমাত্র যদি তারা দেখে, এই আন্দোলনের প্রভাব পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বিপুলভাবে পড়তে পারে, তখন তারা সিদ্ধান্ত বদল করতে পারে। না হলে, আপাতত, তারা আন্দোলনকে উপেক্ষা করতে চাইবে। টিকায়েতের অভিযোগ, সরকার এতদিন আন্দোলনে ভাঙন ধরাতে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু পারেনি। এটা নিঃসন্দেহে আন্দোলনকারীদের বড় সাফল্য। কিন্তু দাবি আদায় করতে হলে, তাদেরও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। তবে ২০২৪ সালের আগে ২০২২ সালেই কৃষকরা একটা বড় সুযোগ পাচ্ছেন।

আগামী বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচন আছে। উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং উত্তরাখণ্ড। পাঞ্জাবে এমনিতেই বিজেপি-র শক্তি সীমিত। তারা এতদিন অকালি দলের হাত ধরে চলেছে। কৃষক আন্দোলনের ফলে অকালি দলও এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় পাঞ্জাবে তারা ভাল ফল করবে, এমন স্বপ্ন বিজেপি-র কোনও অতি বড় সমর্থকও দেখেন না। কিন্তু বাকি দুটি রাজ্যে তো বিজেপি-র সরকার। উত্তর প্রদেশের সদ্যসমাপ্ত পুর ও পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, যোগী আদিত্যনাথের দল সেখানে খুব শক্ত জমিতে নেই। করোনা ও কৃষক আন্দোলন তাদের জনপ্রিয়তায় থাবা বসিয়েছে। যার জেরে তাদের এখানে হারতে হয়েছে। কোনো আন্দোলন না করে, রাস্তায় না নেমে, সেভাবে সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়িয়েও সমাজবাদী পার্টি উল্লেখযোগ্যভাবে ভাল ফল করেছে। বিএসপি-ও খারাপ করেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ পর্যন্ত বেশ কিছু আসনে জিতেছে। এরপর বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেছেন। উত্তর প্রদেশ কীভাবে হাতে রাখা যাবে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছে। মোদী-শাহ এবং যোগীর প্রয়াস সত্ত্বেও যদি উত্তর প্রদেশ হারাতে হয় তো, বিজেপি-র বড় ধাক্কা। আর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে পর্যন্ত কৃষক নেতারা প্রচার করে এসেছেন। ফলে তারা উত্তর প্রদেশে ভরপুর প্রচার করবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার ও বিজেপি-কে চাপে ফেলতে এমন সুবর্ণ সুযোগ তারা ছাড়বেন না। উত্তরাখণ্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি।

ফলে ২০২৪ সালের আগেই মোদী-শাহের বিজেপি-র সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের নেতাদের বড় টক্কর দেখা যাবে এই তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে। এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন যখন হয়, তখন একে অপরের উপর চাপ সৃষ্টির কোনো সুযোগই কোনো পক্ষ ছাড়ে না। যেমন করোনাকালেও বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার পর সরকার ও বিজেপি-র অভিযোগ ছিল, কৃষকরাই করোনা ছড়াচ্ছেন। এর জবাবে টিকায়েত বলেছেন, তাঁরা এই ধরনের অভিযোগ শুনে অভ্যস্ত। তাদের খালিস্তানি থেকে শুরু করে কীই না বলা হয়েছে।

এ সব হলো চাপে রাখার চেষ্টা, ধারণা তৈরির প্রয়াস। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে যে বড় প্রশ্ন রয়েছে্, তা হলো আন্দোলনের কী হবে? তার জবাব হলো, ২০২২ কৃষক আন্দোলন তথা বিজেপি-র রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। গোড়ায় এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের নির্বাচনের বাইরে বছর শেষে গুজরাতের ভোটও আছে। ফলে আগামী বছর সংঘাতটা দিল্লির সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তা এই সব রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে। তাতে কে কার উপর কতটা চাপ দিতে পারে, তার উপর নির্ভর করছে, কে কার দাবি মানবে। ২০২২-এর চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হলে তখন ২০২৪ পর্যন্ত আন্দোলন টানার জন্য প্রতিশ্রুতি নিতে হবে টিকায়েতদের। অসফল হলে, সরকারের মনোভাব বদল হতেই পারে।