আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সমসাময়িক

অলীক কুনাট্য বঙ্গে


অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে আছে বাংলার রাজনীতি। গত ১৭ মে সিবিআই দ্বারা তৃণমূল সরকারের তিনজন নেতা মন্ত্রী ও প্রাক্তন মেয়র, চারজনের নারদা মামলায় গ্রেপ্তার আর তার পরবর্তী অশান্তি, যার রেশ এখনও পর্যন্ত চলছে, এই সমস্তই প্রমাণ করছে যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের গণতন্ত্র বা সংবিধান দিয়ে কিছু এসে যায় না। নির্বাচনে জনাদেশ তাদের গালে বিরাশি সিক্কার চপেটাঘাত করলে কী হবে, পেছনের দরজা দিয়ে প্রতিহিংসা নেবার খেলা অথবা অশান্তি সৃষ্টি করে নির্বাচিত একটি সরকারকে ফেলে দেওয়া, তাও আবার অতিমারির মধ্যে, এসবে বিজেপি পিছপা নয়। তৃণমূলও দিব্যি সেই সুযোগটা নিয়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না।

সিবিআইকে ব্যবহার করে যেভাবে শুধুমাত্র তৃণমূলের চারজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ও কেস সাজানো হয়েছে, সেটা ন্যক্কারজনক তো বটেই, আপাদমস্তক ফ্যাসিবাদী একটি সরকারের বৈশিষ্ট্য। শীর্ষ আদালত যে প্রশ্ন এক্ষেত্রে তুলেছে, চার্জশিটে যাঁদের নাম আছে তাঁরা বেশি প্রভাবশালী না কি যাঁদের নাম নেই তাঁরা বেশি প্রভাবশালী, সেটাই সিস্টেমের মাথা হেঁট করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। শুভেন্দু অধিকারী বা মুকুল রায় কোন জাদুবলে ছাড়া পেয়ে গেলেন কেউ জানে না। একটা মহল থেকে যুক্তি দেওয়া হল যে তাঁরা সাংসদ, তাই স্পিকারের অনুমতি ব্যতীত এঁদের ধরা যাবে না। তাহলে শংকুদেব পাণ্ডা? তিনি তো সাংসদ নন! তাঁকে কেন গ্রেপ্তার করা হল না, নারদা মামলাতে নাম থাকা সত্বেও? তার মানে বিজেপিতে ঢুকলেই অতীতের সমস্ত কেলেঙ্কারি থেকে হাত ধুয়ে ফেলা যাবে, এটাই তাহলে দস্তুর? আর যাঁরা বিজেপি-তে যাবেন না, তাঁদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হবে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি? মনে রাখতে হবে যে ২০১৭ সাল থেকে এই মামলা চলছে, কিন্তু ২০২১-এর মে মাসের আগে সরকারের মনে হয়নি যে সিবিআইকে এত সক্রিয় হতে হবে। নির্বাচনে হেরে এভাবে আক্রোশ ফলানোটা কোনো রাজনীতি নয়, সেটা দিনের শেষে অক্ষমের আস্ফালনই হয়ে থাকে।

এই আক্রোশের আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যখন শত মামলা ছেড়ে দেশের সলিসিটর জেনারেল এই মামলা নিয়ে বাড়তি সময় দেন, যখন রাতের অন্ধকারে কলকাতা হাইকোর্টে জামিন বাতিলের আর্জি দাখিলও হয় এবং মঞ্জুরও হয়। তারপরেও কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতি অভিযুক্তদের গৃহবন্দী থাকার নির্দেশ দিলে সিবিআই, হাইকোর্টের পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির আগেই ছোটে সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে হালে পানি না পেয়ে তারা আবার ফিরেছে কলকাতা হাইকোর্টে, যেখানে আপাতত চার অভিযুক্তদের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর হয়েছে। দোষীদের নিশ্চই সাজা দিতে হবে। কিন্তু তাই বলে চার্জশিট হয়ে যাওয়ার পরেও কেন অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে জেলে রাখতে হবে এই প্রশ্ন কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট তুলেছে। আসলে, দোষীদের শাস্তি দেওয়া এখানে উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য যেনতেনপ্রকারেণ রাজ্য সরকার এবং শাসক দলকে অপদস্ত করা।

আর এই কেন্দ্র রাজ্য সংঘাতের নবতম অধ্যায় হল মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে টানাপোড়েন। ৩১শে মে তাঁর অবসর নেবার দিন, সেটাকে তিন মাস এক্সটেন্ড করবার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিল কেন্দ্রই। তারপর আচমকা তাঁকে দিল্লিতে এভাবে ডেকে পাঠানোর মানেই হল, রাজ্যকে শিক্ষা দিতে চায় বিজেপি সরকার। রাজ্যের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করেই এভাবে নোটিশ দিয়ে আলাপনকে ডেকে পাঠানো গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রীতিনীতিরই পরিপন্থী। এমন নয় যে আলাপনের এর আগে কেন্দ্রে কাজ করবার অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে কারণ কলাইকুণ্ডাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী সহযোগিতা করেননি, করেননি সাংবিধানিক আচরণ। সিবিআই লেলিয়ে দেওয়াটা কতটুকু সাংবিধানিক ছিল? একটা নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসনের জন্য উঠেপড়ে লাগাটা কতটা সাংবিধানিক? গণতন্ত্র বা সংবিধান সম্বন্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ড খুব মধুর নয় ঠিকই, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীদের কাছ থেকে সংবিধান শিক্ষার দায় অন্তত এই ভারতবর্ষের কোনও শিক্ষিত নাগরিকের নেই। এই রাজায়-রাজায় যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজ্যের আমলাতন্ত্র এবং সাধারণ মানুষ।

লক্ষ্যণীয়, এই পুরোটাই হয়েছে এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে যখন সাইক্লোন ও কোভিডের জোড়া ফলায় বিপর্যস্ত রাজ্য। যখন দরকার প্রশাসনিক স্তর থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, চিকিৎসা ও ত্রাণকার্যে দ্রুত সরকারী পদক্ষেপ। সেই সময়ে মেয়র ও মুখ্যসচিবকে এভাবে তুলে নেওয়া মানেই হল সরকারের কাজে বাধা দেওয়া শুধু নয়, দুর্গত ও বিপর্যস্ত জনজীবনের প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি না থাকার প্রতিফলন। বিজেপি অবশ্য কোনোকালেই মানুষের মূলগত দাবিগুলির পাশে থেকেছিল এই অপবাদ তাদের পরম মিত্রও দেবে না। তবে এরকম নগ্নভাবে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করবার কাজে লেগে গিয়ে নিজেদের মুখোশটুকু পুরোপুরি খুলে ফেলল, এটুকুই যা ভাল ব্যাপার। এদের স্বরূপ চিনে নিতে এবার আর বিশেষ বিভ্রমের অবকাশ থাকা উচিত নয়।

তবে তৃণমূল কংগ্রেসকেও এই ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না। বিজেপি তাদের পেছনে লেগেছে ঠিকই, কিন্তু অস্ত্র তো তারাই তুলে দিয়েছে কেন্দ্রের হাতে। নারদা হোক বা সারদা, কোনো অভিযোগই মিথ্যে নয়, এবং অভিযোগগুলির এখনও অবধি কিনারা হয়নি। সিবিআই যখন চারজনকে তুলে নিয়ে গেল, মুখ্যমন্ত্রী কোন হিসেবে নিজাম প্যালেসে গিয়ে বসে থাকলেন, কেনই বা অতিমারির সময়ে ওরকম জমায়েত করতে দিলেন, রাজনৈতিক হিংসাতে মদত দিলেন, বোঝা দায়। স্বচ্ছ প্রশাসনের স্বার্থে, অথবা দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তির খাতিরেই তাঁর উচিত ছিল আরও নমনীয় অবস্থান নেওয়া। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যরা আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে জেনেও তিনি তাঁদের মন্ত্রীত্বে বজায় রেখেছেন। এবং সেই কারণেই তাঁরও খুঁটি বাঁধা রয়েছে বিশেষ কোনো স্থানে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি ভেবে থাকেন যে দুর্নীতিগ্রস্ত চোরদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, তাহলে সেটা তাঁর অলীক কল্পনামাত্র। বিজেপি একটা ভোটে পরাজিত হয়েছে, কিন্তু তার পরেও সে প্রধান বিরোধী দল, তার ঝুলিতে আছে ৭৭ জন বিধায়ক ও ১৮ জন সাংসদ। সবথেকে বড় কথা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও ধর্মীয় হিংসা এখনও পুরোমাত্রায় ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নিজেদের পায়ের তোলার মাটি যদি নড়বড়ে হয়, যদি অসংখ্য দুর্নীতির মামলার ব্যাগেজ বহন করতে হয়, তাহলে যে কোনোদিন বিজেপি আবার ঝাঁপাবে, এবং তখন হয়ত সফলও হয়ে যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যদি সততা থাকেই, যেমন তিনি দাবি করেন, তাহলে তাঁর উচিত সারদা ও নারদা মামলার যথাযথ তদন্ত, কারণ অসংখ্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদেরও তিনি মুখ্যমন্ত্রী। দুঃখের বিষয়, তিনি সেটা করবেন না, যেহেতু সারদার বা নারদার সুবিধাভাগ মূলত পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাই ভবিষ্যতেও বিজেপি আবার এই জুজু দেখাবে, এবং রাজনৈতিক টানাপড়েন অব্যাহত থাকবে। এটা বুঝতে হবে যে বিজেপি কোনোভাবেই চায় না এই মামলাগুলির নিষ্পত্তি হোক। তারা চায় এগুলোকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি।

কাজেই, এই অলীক কুনাট্য আপাতত চলতেই থাকবে। মানুষ যতদিন না এই তৃণমূল বনাম বিজেপি বাইনারি থেকে বেরিয়ে একটা স্বচ্ছ প্রগতিশীল তৃতীয় বিকল্পের দিকে ঝুঁকবেন, দুর্গতি কমবে না। দুঃখের কথা, সেই তৃতীয় বিকল্প নির্মাণের দায়িত্ব যেই বামপন্থীদের উপরে ছিল তারা কমতে কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। আপাতত তাই বঙ্গে এই কুনাট্য সহজে সমাপ্ত হওয়ার নয়।