আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সমসাময়িক

শববাহিনী গঙ্গা


“শ্মশানের চিতা ধকধক জ্বলে বিরাম চাই যে তার,
মুছছে সিঁদুর ঘরে ঘরে শুধু বুক চাপড়ানো সার
আগুন লাগিয়ে বাঁশরী বাজায়, বাঃ রে ‘বিল্লা রঙ্গা’
সাহেব তোমার রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা”।

পারুল কক্কর গুজরাটের রোম্যান্টিক কবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে যখন লাখো মানুষ বিপর্যস্ত, অক্সিজেন, ওষুধ, ভ্যাক্সিনের জন্য হাহাকার, শ্মশানে, পার্কে, গাড়ি পার্কিং-এর জায়গায় পোড়ানো হচ্ছে মৃতদেহ, এবং গঙ্গা নদী দিয়ে ভেসে চলেছে লাশের সারি, তখন তাঁর কবি সত্তায় ফুটে উঠল ভারতের আপামর জনসাধারণের মনের কথা, ‘সাহেব তোমার রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা’।

কিন্তু আমাদের দেশের সিংহাসনে যারা আসীন রয়েছেন তারা উলঙ্গ রাজার থেকেও বেশি নির্লজ্জ। এই কবিতা ফেসবুকে লেখার পরে পারুল কক্করের বিরুদ্ধে ভয়ংকর আক্রোশে নেমে পড়ে বিজেপি-র ট্রোল বাহিনী। কিন্তু পারুল দেবী তাঁর কবিতা ফেসবুক থেকে মুছে দেননি। দেশবাসীর যন্ত্রণাকে ভাষা দিয়েছেন তিনি।

অতএব, সেই ভাষাকে গলা টিপে হত্যা করতে নেমে পড়েছে বিজেপি সরকার, আরএসএস, পুলিশ-প্রশাসন এবং আইটি সেল। সাংবাদিক বরখা দত্তের একের পর এক প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে যে উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার দুই পারে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহকে কবর দিয়ে রাখা হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছিয়েছে যে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। চলছে লাশ পোড়ানোর কাঠের কালোবাজারি, পুরোহিতরা সৎকার করার জন্য চাইছেন ২৫-৩০ হাজার টাকা। অতএব, অসহায় মানুষ বাধ্য হয়ে লাশ পুঁতে দিচ্ছেন গঙ্গা নদীর বালির চরে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে শিউড়ে উঠেছে। সহানুভূতিশীল সরকার হলে, এই মানুষগুলি কারা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করত, তাদের যথাযথ সম্মানের সঙ্গে সৎকার করার ব্যবস্থা করত। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার কঠিন, নির্দয়, দয়ামায়াহীন, জনবিরোধী। অতএব, কী করা হচ্ছে? সেই সারি সারি মৃতদেহের উপরে আত্মীয়রা যেই গেরুয়া নামাবলী বা হিন্দু ধর্মের চিহ্ন দিয়ে প্রিয়জনের উপর আদরের শেষ চাদর পরিয়ে দিয়েছেন, সেই বস্ত্রগুলি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে মৃতদের কবর থেকে, যাতে উপর থেকে ছবি তুললে বোঝা না যায় যে ওই মাটির নিচে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে কোনো বাবা-মা-ভাই-বোন-সন্তান-সন্ততি। মৃতদের এহেন অপমান, তাদের শেষ শয্যাটুকু নিয়ে এই রাজনীতি, তাদের এই ভয়াবহ শেষ পরিণতির উদাহরণ গোটা পৃথিবীতে আর আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

হিন্দু পুরাণে কথিত আছে যে জাহ্নবী গঙ্গাকে ভগীরথ স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নামিয়েছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের আত্মাকে মুক্তি প্রদান করার জন্য। আজ সেই গঙ্গায় ভেসে চলেছে অগুনতি মৃত লাশ, যাদের আসলে আগুনে পুড়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে মুক্তি পাওয়ার বিশ্বাস মনে ধরে রেখেছেন অসংখ্য মানুষ। নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে তিনি মা গঙ্গার সন্তান, যিনি মা গঙ্গার আশীর্বাদ পেতে কাশী থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। আজ সেই কাশীর ঘাটে মৃতদেহ সৎকারের স্থান অকুলান হয়ে যাচ্ছে, মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে গঙ্গায়। পবিত্র গঙ্গা আজ কোভিডে মৃত মানুষের শবের ভার বহন করতে করতে মলিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তথাকথিত হিন্দু-হৃদয়সম্রাটের এই বিষয়ে কোনো হেলদোল নেই। তিনি এখনও এই বিষয়ে একটি কথাও বলেননি।

কথা বলেছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। দিল্লিতে পোস্টার সাঁটা হয়েছে, ‘মোদীজি কেন আমাদের বাচ্চাদের ভ্যাক্সিন বিদেশে বেচে দেওয়া হল’? এই পোস্টার লাগানোর অভিযোগে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে অমিত শাহের ভৃত্য দিল্লি পুলিশ। উত্তরপ্রদেশে এক সাংবাদিক তুলে ধরেছিলেন সেখানকার কোনো হাসপাতালের করুণ দশা। যোগীর পুলিশ তাকেও গ্রেপ্তার করেছে। যখন চারিদিকে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার চলছিল, তখন যোগী ঘোষণা করে দিলেন যে তাঁর রাজ্যে অক্সিজেনের কোনো অভাব নেই। একটি বেসরকারী হাসপাতালের সুপার বললেন তাঁর হাসপাতালে অক্সিজেন নেই। এই কথা বলায়, তাঁকে অপদস্ত হতে হল। জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে যোগীর কাছে কিছু আর্জি জানাতে গিয়েছিলেন কয়েকজন ডাক্তার। তাদের পুলিশ তুলে নিয়ে চলে যায়। বেশ কয়েকজন ডাক্তার এই অতিমারির মধ্যেও সরকার ও নেতাদের অপমান সহ্য করতে না পেরে ইস্তফা দিয়েছেন। তবু যোগী অজয় সিংহ বিস্টের সরকারের কোনো হেলদোল নেই। আপাতত, বিজেপি-র বিরোধীতা করলে আপনাকে জেলে যেতে হতে পারে। কিন্তু অক্সিজেনের জোগান যারা নিশ্চিত করল না, বা যারা পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাক্সিন মানুষের হাতে তুলে দিতে পারল না, তারা জেলের বাইরে বসে সরকার চালাবেন, এবং সত্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকবেন।

নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌ একটি প্রতিবেদনে হিসেব করে দেখিয়েছে যে ২৪ মে অবধি যেখানে সরকারীভাবে কোভিডে মোট মৃতের সংখ্যা ৩০৭২৩১ বলা হচ্ছিল, সেখানে অন্তত ৬ লক্ষ মানুষ মৃত হয়েছেন বলে এই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এই সংখ্যা ১৬ লক্ষও হতে পারে। ইকনিমিস্ট পত্রিকার হিসেব অনুযায়ী সরকারী হিসেবের থেকে অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন কোভিডে। সাংবাদিক এবং বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে গুজরাটের আহমেদাবাদ, বারোদা, জামনগর থেকে আমাদের কলকাতায় সরকারী হিসেবের থেকে বহু গুণ বেশি মানুষ কোভিডে মৃত। অনেক বিশেষজ্ঞ এতদূর অবধি বলছেন যে সরকারী হিসেব হিমশৈলীর চূড়া মাত্র। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো হেলদোল নেই।প্রধানমন্ত্রী দাবোসে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে ভারত করোনাকে জয় করেছে। এই ভ্রান্ত ধারণা, দম্ভ এবং বোকামোর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রধানমন্ত্রী এখনও অবধি একবারের জন্যও বলেননি যে তাঁর ভুল হয়েছিল এহেন দাবি করা, সাধারণ মানুষের দুঃখের ক্ষতে সহানুভূতির পরশ দেওয়ার কোনো চেষ্টা করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যদিকে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সত্য আড়াল করার চেষ্টা করতে সরকার সবরকম চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু মহান নদী গঙ্গায় ভেসে আসা লাশের সারি সরকারের মিথ্যার উপর থেকে পর্দা সরিয়ে নিয়েছে। আপাতত আমরা সেই দিনের প্রতীক্ষায় থাকব যখন সরকারের অবিমৃশ্যকারিতা, মিথ্যা ভাষণ এবং দম্ভের বিচার হবে জনতার দরবারে।