আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

কোভিড ও অর্থব্যবস্থা


স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে এত বড় সংকট এর আগে আসেনি। একদিকে কোভিডের লাগামহীন সংক্রমণ, মৃত্যুমিছিল, গঙ্গায় ভেসে যাওয়া লাশ, শ্মশানে-কবরস্থানে আর্তের হাহাকার, মৃতদেহ সৎকারের জায়গাও অপ্রতুল হয়ে গেছে, অক্সিজেন ও ভ্যাক্সিনের অভাব, স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়েছে গোটা দেশে, বেঁচে থাকাই আজ হয়ে গেছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মানুষের সমস্যার এখানেই শেষ নয়, কোভিড জনিত লকডাউন আবার ফিরে এসেছে ভারতবাসীর জীবনে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। মানুষ আতঙ্কে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। ফলত, অর্থব্যবস্থারও অক্সিজেনের অভাব ঘটছে।

কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের হিসেব বলছে ২০২০ সালের লকডাউনের ফলে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতে আর্থিক সংকোচন হবে ৭.৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিক অর্থাৎ এপ্রিল-জুন মাসের মধ্যে দেশের অধিকাংশ রাজ্যে করোনা-জনিত লকডাউন ফিরে এসেছে। সেই লকডাউনের ফলে আবার ২০২০ সালের ছবি ফিরে এল আমাদের দেশে। পরিযায়ী শ্রমিকদের শহর থেকে গ্রামের অভিমুখে যাত্রা। কিন্তু এবারে যেহেতু সরকার বাহাদুর কিছুটা থতমত খেয়ে লকডাউনের ভার রাজ্য সরকারগুলির উপরে তুলে দিয়েছে, এবং সমস্ত যানবাহন বন্ধ করে দেয়নি, তাই পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রামে হেঁটে ফেরার সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে হয়নি। কিন্তু সরকার তাদের হাতে কোনো নগদ টাকা তুলে দেয়নি, অতএব তারা আগের মতই কর্মহীন হয়ে ভিড় করেছেন গ্রামের শ্রম বাজারে। কিন্তু গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় এত মানুষের কর্মসংস্থান করার কোনো উপায় নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়েছেন। অতএব, মানুষ গ্রামে ফিরে কাজ করতে পারছে না। তাই গ্রামীণ বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। বেসরকারী সংস্থা সিএমআইই জানাচ্ছে যে জানুয়ারি মাসে যেখানে গ্রামীণ বেকারত্বের হার ছিল ৫.৮১ শতাংশ তা মে মাসের ৩০ তারিখে বেড়ে হয়েছে ১০.৫৯ শতাংশ। ২০২০-২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে যে যখন অর্থব্যবস্থা গভীর খাদে পড়ে গেছে তখনও কৃষিতে বৃদ্ধির হার ছিল উল্লেখযোগ্য, কারণ করোনা ভাইরাস গ্রামে প্রসার ঘটাতে পারেনি এবং লকডাউনের প্রভাব গ্রামে অত বেশি পড়েনি। কিন্তু ২০২১ সালে গ্রামে যেই পরিমাণ করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং অর্থব্যবস্থার যা পরিস্থিতি তাতে কৃষির বৃদ্ধির হার কত হবে সে নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

শহরাঞ্চলে লকডাউন এবং কোভিড সংক্রমণের অভিঘাত সর্বাধিক। বিশেষ করে দিন মজুর, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সরাসরি চাকরি হারিয়েছিলেন ২০২০ সালের লকডাউনের কারণে। ২০২০ সালের অক্টোবর মাস থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দেখা যাচ্ছে যে চাকরি বা কাজের গুণগত মান কমেছে। একদিকে যারা চাকুরিজীবি ছিলেন তাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা দেখা দিয়েছে। যখন তারা কাজ পাচ্ছেন তা আর আগের মত পাকা চাকরি থাকছে না, তা অসংগঠিত ক্ষেত্রে চলে যাচ্ছে, যেখানে বেতন কম এবং চাকরির কোনো ধরনের নিরাপত্তা নেই। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী ৯৭ শতাংশ মানুষের আয় এক বছর আগের তুলনায় কমেছে। এর প্রধান কারণ একদিকে যেমন বহু মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন, অন্যদিকে যারা কর্মরত আছেন, তাদেরও মজুরি কমেছে। এই সংস্থার হিসেব অনুযায়ী কোভিড মহামারী শুরু হওয়ার আগে ভারতে ৪০.৩৫ কোটি মানুষ কর্মরত ছিলেন। গত বছরে লকডাউনের সময় ১২.৬ কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হন, যাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ডিসেম্বর ২০২০ এবং জানুয়ারি ২০২১ সালের মধ্যে আবার কাজ ফিরে পান। তবু এই সময় মোট কর্মরত মানুষের সংখ্যা প্রাক-কোভিড স্তরকে ছুঁতে পারেনি। মোট ৪০ কোটি মানুষ জানুয়ারি মাসে ভারতে কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ, প্রাক-কোভিডের তুলনায় ৩৫ লক্ষ মানুষ কম। কিন্তু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এবং লকডাউনের ফলে বর্তমানে ৩৯ কোটি মানুষ কর্মরত রয়েছেন বলে সিএমআইই সংস্থার হিসেব। অতএব বলা যেতে পারে জানুয়ারি ২০২১ এবং মে ২০২১-এর মধ্যে ১ কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১২ লক্ষ মানুষ নিয়মিত বেতনের চাকুরিজীবি। অর্থাৎ, শুধুমাত্র দিনমজুর নয়, নিয়মিত বেতনের মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবিদের একটা বড় অংশ এই সময়ে কাজ হারিয়েছেন।

একদিকে কাজ হারানো এবং আয় কমে যাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির দাপটে সাধারণ মানুষের জীবন নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। এপ্রিল মাসে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ১০.৪৯ শতাংশ। ডাল, সবজি, ভোজ্য তেল, দুধ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম। তবু কেন্দ্রীয় সরকার উদাসীন। বড় শিল্পপতি এবং ধনী ব্যক্তিদের থেকে কর আদায় করতে বিজেপি সরকারের বিপুল অনীহা, কারণ তাদের টাকাতেই দলটা চলে। অতএব, তাদের উপর কর না বসিয়ে লাগাতার পেট্রো-জাত পণ্যের উপরে কর আদায় বাড়ানো হয়েছে। ফল হয়েছে এই যে ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২০২০-২১ সালে পেট্রো-জাত পণ্যের উপর শুল্ক বাবদ সরকারের অতিরিক্ত কর সংগ্রহ হয়েছে ১৮০৭৮৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৭৭ শতাংশ বেশি। মজার বিষয় হল ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ সালের মধ্যে পেট্রোল বা ডিজেলের ব্যবহার দেশে কমেছে ১০ শতাংশের বেশি। তবু এই বিপুল পরিমাণ কর কেন্দ্রীয় সরকার আদায় করতে পেরেছে কারণ নির্দয়ের মতন তারা তেলের উপর কর বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই ধনীদের তোষণ নীতি এগিয়ে নিয়ে যেতে এতটাই বদ্ধপরিকর যে কোভিডের চিকিৎসা সংক্রান্ত সামগ্রীর উপরে জিএসটি-র হার কমাতে তারা নারাজ। জিএসটি কাউন্সিল বৈঠকে, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডুর মতন রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের জোরদার প্রতিবাদের ফলে বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনায় রাজি হয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দেশের মানুষ যেখানে অক্সিজেন পাচ্ছেন না, সেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার, কনসেন্ট্রেটার ও মাস্কের উপর বাড়তি জিএসটি চাপানোর নীতি গ্রহণ করার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার! এর থেকেই পরিষ্কার যে তারা দেশের মানুষের ভালো করতে চান না। তারা শুধু চান ধনীদের সেবা করতে।

এই নীতি সমূহ নিয়ে চলার ফলে ধনী আরো ধনী হয়েছে, কারণ তাদের উপর করের ভার কমেছে, গরীবের চাকরি গেছে কারণ লকডাউন চলছে, এবং পেট্রো-জাত পণ্যের দাম বাড়ার ফলে অন্যান্য পণ্যেরও দাম বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু কর্পোরেট ক্ষেত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং তারা ২০২০-২১ সালে যখন ভারত মন্দায় নিমগ্ন, তখন তারা বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করেছেন। ২০২০-২১ সালে যখন পায়ে হেঁটে দেশের শ্রমিকরা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের বাড়িতে ফেরার পথে রাস্তায় মরে যাচ্ছেন, যখন লাখো মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন, সেই সময় ভারতের কর্পোরেট ক্ষেত্রে মোট মুনাফার পরিমাণ হয়েছে ৫ লক্ষ কোটি টাকার বেশি, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৭.৬ শতাংশ বৃ্দ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের অর্থব্যবস্থা সংকুচিত হল ৮ শতাংশ, কিন্তু কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ল ৫৭.৬ শতাংশ! কীভাবে তা সম্ভব হল?

যেহেতু দেশে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছিল ২০২০-২১ সালে, তাই কর্পোরেটদের পণ্য বেশি বিক্রি হয়নি। কিন্তু মন্দার দরুন তাদের কাঁচা মালের দাম কমে গেছে, এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা তাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা দেওয়ার ফলে তাদের পুঁজির উপর সুদের খরচ কমেছে; তদুপরি, ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে এবং শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে কর্পোরেট ক্ষেত্র নিশ্চিত করেছে যে তারা এই মন্দাবস্থার মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারে। এহেন পুঁজিবাদী উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই দেশে আর্থিক বৈষম্য বাড়াবে, কারণ মুনাফা বাড়লেও সাধারণের মজুরি তথা ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। এই ক্রয়ক্ষমতার সংকট অচিরেই দেশের অর্থব্যবস্থার আরো ক্ষতিসাধন করবে।

আপাতত, দেশের সমস্ত সূচকই আশংকাজনক অর্থব্যবস্থার বার্তা দিচ্ছে। বাড়ছে শুধু শেয়ার বাজারের সেনসেক্স। এর দুটি কারণ রয়েছে। একদিকে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি বেঁধে রেখেছে। অন্যদিকে এই দেশগুলিতে সরকারী খরচ বিপুল পরিমাণে বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষ তথা কর্পোরেটদের হাতে অর্থ এসেছে, যা অধিক মুনাফার লোভে ভারতের মতন দেশের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আবার আমাদের দেশের এক শ্রেণির মধ্যবিত্ত এবং ধনীদের হাতে কিছু বাড়তি টাকা এসেছে, কারণ তাদের দৈনন্দিন খরচ কমেছে। সেই টাকা মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এই দুই প্রক্রিয়ার ফলে শেয়ার বাজারের সেনসেক্স এই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও হুহু করে বেড়ে চলেছে। কিন্তু গোটা বিষয়টি আসলে একটি বুদবুদ যার সঙ্গে দেশের অর্থব্যবস্থার বাস্তব পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই। একদিন এই বুদবুদ ফাটতে বাধ্য। যেদিন তা হবে তখন অর্থব্যবস্থার সংকট আরো ঘনীভূত হবে, কারণ ধনী ও কর্পোরেটরাও তখন সংকটে পড়ে যাবে। মোদী সরকারের বর্তমান অর্থনৈতিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল এই যে কোনো অবস্থাতেই যাতে শেয়ার বাজারে ধস না নামে। এই লক্ষ্যে এলআইসি, সরকারী ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু শেয়ার বাজার নির্ভর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি একটি মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতন পুঁজিবাদের পীঠস্থানে যেখানে শেয়ার বাজার নির্ভর আর্থিক উন্নয়নের মডেল ভেঙে পড়েছে, আমাদের মতন দেশেও তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। তাই কোভিড সংকট শুধু নয়, দেশের অর্থব্যবস্থা এবং শ্রমজীবি মানুষ এক গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা ধাক্কা লাগলেও ভারতের অর্থব্যবস্থা সেই খাদে পড়তে বাধ্য।

মোদী সরকারের বিগত সাত বছরে অবশ্য শুধু অর্থব্যবস্থা নয়, দেশের সংবিধান, মানুষের অধিকার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা, চাকরি সবই খাদের কিনারে চলে গিয়েছে। সাধারণ মানুষকে যদি বাঁচতে হয় তবে মোদী সরকারকে গণতান্ত্রিক উপায়ে ধাক্কা দিয়ে গদিচ্যুত করতে হবে। তা না হলে, ভারত আরো অন্ধকারে ডুবতে থাকবে।