আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
জীবনের আয়নায়
যশোধরা বাগচি
এটি 'তীর্থ'র বকলমে ডাঃ গৌরীপদ দত্তের আত্মজীবনী। লেখাটি পড়লেই বুঝতে পারবেন স্নেহের জালে জড়াতে গৌরীদার জুড়ি নেই। তাই তাঁর স্নেহের তাগিদে এই ভূমিকাটি লিখতে বসেছি। এই কাজটি করতে গিয়ে কুন্ঠার কোনো সীমা নেই। এই জীবনীটি বিশ শতকের অধিকাংশ দশকগুলিতে পশ্চিমবাংলায় রাজনৈতিক চেতনা, বিশেষ, করে বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ, এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যদিয়ে তার বেড়ে ওঠার কাহিনি। এর পটভূমিকা বিশ শতকের পরিবর্তনশীল রাজনীতি। সুতরাং এই ধরনের সামাজিক পরিব্যাপ্তির মধ্যে যখন সমাজবাদী চেতনা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, তখন আমার মতো এক অনভিজ্ঞ পাঠেকর পক্ষে এই বইয়ের ভূমিকার অবতারণা করা, এক অত্যন্ত গুণী ব্যক্তির কথায় 'বামনের চন্দ্রস্পর্শাভিলাসে'র যোগ্যতর বক্তব্য নয় কি?
কিন্তু উপায় কি? ডাঃ গৌরীপদ দত্ত, আমাদের গৌরীদাকে না বলার সাধ্য কি আমার আছে? বিশেষ করে বন্ধুবর নলিনী চক্রবর্তীর সম্পাদিত কালপ্রতিমা'র কল্যাণে 'তীর্থ' তো আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছেন। কাজেই তার রাজনৈতিক জীবনের দোলাচল আমাদের পক্ষে বিশেষ অনুধাবনের বস্তু। আরও একটি বিশেষ কথা হচ্ছে তীর্থ তার রাজনৈতিক জীবনে দাঁড়িয়েছে তার পেশার মধ্য দিয়েও। এ জিনিষটা সচারাচর আমরা দেখতে পায়ই না। বিশেষ করে ডাক্তারির মতো অর্থকরী এবং সময়সাপেক্ষ-পেশা বামপন্থী আন্দোলনের লেজুড় হয়ে না থেকে সেই আন্দোলনটিকে এক বিশেষ দিকে চালিত করবে, এই অভিজ্ঞতা বামপন্থার ইতিহাসেও প্রায় বিরল। ডাক্তারি পেশার জায়গা থেকে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের স্বরূপ এবং যাথার্থ্য উপলব্ধি করবার জন্য তীর্থর কেবল রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব নয়, তার ওপরে কাজ করেছিল বাঁকুড়ার গ্রামের বাড়িতে শৈশবে এবং কৈশোরে যেসব অবহেলিত, শোষিত, বিশেষকরে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ধুলো মেখে খেলা করে তিনি বড় হয়েছেন, তাদের দারিদ্র্য, অপুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব, তীর্থকে তখন থেকেই গভীরভাবে বিচলিত করেছিল। সেই অভিজ্ঞতাই তাকে টেনেছিল সক্রিয় রাজনীতির দিকে, কিছু রকমফের সত্ত্বেও।
দুই
এক বর্ধিষ্ণু সুবর্ণবণিক পরিবারে জন্ম - বেশ কয়েক প্রজন্মে লালিত চিকিৎসা শাস্ত্রে দক্ষতা - তীর্থ নানাবয়সী মানুষকে গল্পের ফাঁদে ফেলে নিজের জন্মভূমি, বিরাট একান্নবর্তী পরিবার, গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলো - সকলের সঙ্গে তার মাখামাখির শরিক করে নেয় আমাদের সকলকে। গল্পকার ও কবি গৌরীপদ দত্ত 'তীর্থ'কে গড়ে পিঠে তোলেন। তীর্থ ছাড়া এ বইতে কাল্পনিক কিছু নেই, সবই বাস্তবানুগ। কোনো অলীক অবাস্তবতার আস্তরণ প্রয়োজন হয় না এই সহজ আত্মকথনে। কিন্তু পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে আমাদের দেশ, সমাজ, তার রাজনীতি, অবদলিত মানুষদের বেঁচে থাকার সংগাম। স্বাধীনতা সংগ্রামের যে পটভূমিতে তীর্থ বড় হয়ে ওঠে, স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে তার সীমাবদ্ধতা তাকে কীভাবে বামপন্থী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিলো - তীর্থর সহজ জবানীতে তা' আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কিন্তু তীর্থর কৌতূহল শুধুমাত্র ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আটকা থাকে না। মল্লভূমির প্রাক্ ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, এইসব থেকে যে ঐতিহাসিক বিবর্তন লুকিয়ে রয়েছে নানারকম স্থানিক নামগুলির মধ্যে, তীর্থ প্রথমেই আমাদের ঢুকিয়ে দেয় এই স্বল্পজ্ঞাত বিবর্তনের মধ্যে। এর মধ্যে যেটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা' হচ্ছে যে আদিবাসী সভ্যতাকে প্রান্তীকৃত করে যেভাবে তথাকথিত ভারতীয় (পড়ুন হিন্দু) আর্যসভ্যতার আধিপত্য কায়েম করল তারই নমুনাগুলি আমাদের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা।
তীর্থ তাঁর শৈশব এবং কৈশোরে বাঁকুড়া জেলার জয়পুর গ্রামে যেসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ও মানুষীর সাহচর্য এবং বয়োজ্যেষ্ঠ/জ্যেষ্ঠাদের অকুন্ঠ ভালোবাসা পেয়েছিলো, তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য যে তাদের কাছে ঋণী - জীবনের সায়াহ্নে 'তীর্থ'র এই সহজ সরল স্মৃতিচারণা তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশের কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে এই উপেক্ষিত মানুষগুলোর প্রতি ঋণস্বীকারও বটে। কল্পিত না হয়ে আমাদের সমকালের একটি খন্ডিত চিত্রও বটে এই কাহিনিটি। তীর্থ এই আত্মকথনের একটি কৈফিয়ৎ দেয়, 'আত্মপ্রচার নয়, ঋণ স্বীকার। তার ...কাহিনি তার জন্মস্থান এক অখ্যাত গ্রামের কথা লিখে রাখা তার সেই অঞ্চলের অবজ্ঞাত অবহেলিত মানুষদের ভালোবাসার অতি অকিঞ্চিত প্রতিদানের প্রচেষ্টা। (পৃঃ ৩১০)
তীর্থর জীবনের এই প্রথম পর্যায়টি পাঠকদের নিঃসন্দেহে মুগ্ধ করবে। দু'রকম টানা-পোড়েনের মধ্যে এই ছোট ছেলেটির জীবনটি সংগঠিত হয়। একদিকে জঙ্গলের লাগামছাড়া জীবন অন্যদিকে কঠোর ন্যায়নিষ্ঠ ডাক্তার পিতা, যিনি স্বাধীনতা-সংগ্রামের সূত্রে কংগ্রেসের একজন উঁচুদিকের স্থানীয় নেতা। তীর্থ বড় হয়েছে সেই পুরোনো আমলের একান্নবর্তী পরিবারে যেখানে নিজের আখের গোছানোর কোনো রেওয়াজ নেই, মাতৃত্ব যেখানে নিজের গর্ভজাতদের ছাড়িয়ে অনেক দূরে বিস্তৃত। ছোটবেলায় আহরণ করা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই নিবিড় সাযুজ্যবোধ তীর্থকে উদ্বুদ্ধ করেছে সারা জীবন। বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি তাঁর আনুগত্যের পেছনে কাজ করেছে তার শৈশবে এবং কৈশোরে কাছে থেকে চেনাজানা এই খেটে-খাওয়া অবহেলিত মানুষগুলির বেঁচে থাকবার সংগ্রাম।
অন্যদিকে তার জীবনের আদর্শ তাঁর বাবা ডাঃ যতীন্দ্রনাথ দত্ত - যাঁকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন সকলের চাইতে বেশি, এবং হয়তো সেই কারণেই তাঁর সঙ্গে সংঘাতের পক্ষ বেছেছেন সব চাইতে বেশি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া ন্যায়নিষ্ঠতাই তীর্থকে টেনে দেয় সাম্যবাদের দিকে - পার্টিগত ভাবে প্রথমে আরএসপি ও পরে সিপিএমের দিকে। বাবার অমতে তাঁকে জীবনে অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রতিবারই তাঁকে অমান্য করেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা তিনি দেখিয়েছেন, সেটি তীর্থর ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ আকর্ষণ। পিতা পুত্রের মধ্যে যে আপাত সংঘর্ষপূর্ণ বিশ্বাস ও 'মান্যতা'র (তীর্থর এটা খুব পছন্দের কথা) সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা এই বইটির একটি বিশেষ আকর্ষণীয় দিক।
কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা তীর্থ পেয়েছিল বাবা এবং মায়ের কাছ থেকে। সাধারণতঃ মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষের আত্ম-জৈবনিক আখ্যানের মধ্যমণিরুপে পাওয়া যায় আদর্শায়িত কোনো মাতৃমূর্তি। কিন্তু তীর্থর মা এর ব্যতিক্রম। লাহোরে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ের এইভাবে বাঁকুড়া জেলার জয়পুর গ্রামের এক একান্নবর্তী শ্বশুড়বাড়িতে মিলেমিশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সচরাচর দেখা যায় না। গ্রামের ছেলে তীর্থর গ্রাম্যতা-দোষমুক্ত হওয়ার পেছনে তার মায়ের আন্তঃরাজ্য দৃষ্টিভঙ্গী কতখানি কাজ করেছিল সেটি সত্যিই ভেবে দেখবার কথা। এর সঙ্গে তীর্থ তার স্ত্রী ডাঃ গৌরী দত্তকে তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি রূপে তুলে ধরেছে।
সাহিত্যরস ও বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে দোদুল্যমান, নিবিড়ভাবে সমাজ-মনস্ক এই চরিত্রটি, পশ্চিমবাংলার সমাজে বিশ শতকের ছ'দশকেরও ওপরে, এবং একবিংশ শতাব্দীর গোড়াটা ধরে রেখেছে নিজের জীবন প্রবাহের ঢেউগুলির মধ্যে। একটি ছোট ছেলে কীভাবে চল্লিশের দশকের 'ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি'তে কমিউনিস্ট হয়ে উঠলো তার একটি বিরল বিবরণ আমরা পাই তীর্থের জীবনের গোড়ার দিকে -
এত বিদ্রোহ দেখেনি কখনো কেউ
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্য তারই ঢেউ।
সেই বিদ্রোহকে তীর্থ নিয়ে গেল চিকিৎসা বিদ্যাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে। ছাত্র ধর্মঘট সংগঠিত করে তীর্থ চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে এক আসনে বসালো। এই সংযোগের প্রচেষ্টা কিন্তু তীর্থ কে সারাজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালো। কিন্তু তার মধ্যে যে সূক্ষ্ম ন্যায়বিচারের ভিত্তি ছিলো, তার যথার্থ বহিঃপ্রকাশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনও-দিনই ঘটলো না।
তিন
নিজে পেশায় ডাক্তার হয়েও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রবক্তা তীর্থ সাধারণ মানুষের সুস্থতা এবং স্বস্তির ওপরে জোরটা কোনো দিনই চিকিৎসাশাস্ত্রের নতুন নতুন কলাকৌশল বা নিত্য নতুন ওষুধের আবিষ্কারের ওপরে ছেড়ে দিতে পারে নি। বরঞ্চ তার দৃষ্টি ছিল ভেষজ ওষুধের দিকে, যেগুলি গ্রামের সাধারণ মানুষের আওতার মধ্যে, সহজ-সহজলভ্য এবং অনেক সময়ই আদিবাসী সমাজের মা-ঠাকুমার জ্ঞানফল। চিকিৎসার কেরামতি অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য, অনেক সময়েই গ্রামের সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তাই, আমাদের মতো শোষিত উপনিবেশোত্তর তৃতীয় বিশ্বের সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যের প্রকৃত অর্থ চিকিৎসা-শাস্ত্রের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি এবং 'পাঁচতারা' হাসপাতালের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি তা হতে পারে না। সাধারণ মানুষকে সুস্থ রাখতে হলে তার পরিবেশকে জানা প্রয়োজন, তার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য-সচেতনতাকে তাদের নিজেদের জন্য উপযুক্ত এবং কার্যকরী করে তোলার প্রচেষ্টা তীর্থর কাছে অনেক বেশি জরুরি হয়ে ওঠে। বাম আন্দোলনের স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে তীর্থ তার বাম রাজনীতি এবং সহযোদ্ধা কমরেডদের কখনও রেয়াত করে নি। যখনই সুযোগ ঘটেছে, সে তার সমালোচনা তাদের সামনে উপস্থাপিত করেছে। সিপিএম পার্টির সদস্য হিসাবে এই কাজ করা সব সময়ে খুব সহজ ছিল না। কিন্তু ন্যায়বোধ এবং মানুষের মঙ্গলময় রূপের ওপরে এক ধরনের দুর্বার বিশ্বাস তাকে বার বারে টেনে নিয়ে গেছে জন-স্বাস্থ্যের এই সব স্বল্প-আলোচিত প্রসঙ্গে। আইএমএ (Indian Medical Association) অথবা শাসকদল সিপিআই(এম) এর সভা, তা প্রকাশ্যই হোক, অথবা ছোট বিশেষ সভাতেই হোক, তাঁর বক্তব্য তিনি পেশ করেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। এ বিষয়ে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন পি সুন্দরাইয়ার মতো সিপিএমের সর্ব ভারতীয় নেতার, আবার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছেন ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের মতো দিকপাল নেতার।
নিজেকে 'মধ্য মেধার' মানুষ বলে বারে বারে উল্লেখ করেছেন তীর্থ। এবং বারে বারেই সে অবাক বিস্ময়ে দেখে যে রাজনৈতিক এবং চিকিৎসাবিদদের উচ্চতম পর্যায়ে কীভাবে তার কথা গ্রাহ্য হয়, বিভিন্ন সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য শোনবার আগ্রহে আমন্ত্রিত হন - এগুলি তীর্থের কাছে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বিধায়কপদের জন্য মনোনীত হয়ে এমনকি নির্বাচিত হয়েও তীর্থের মনে অবাক বিস্ময়বোধ!
বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালে তিনি প্রথমে 'ক্রেসিডা'নামক এনজিওতে কাজ করবার অভিজ্ঞতা এবং যোজনা পর্ষদ (Planning Board) এ থাকার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই তীর্থর স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে কতো ফারাক ছিল। যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন তিনি দেখে গেছেন সারা জীবন, বাস্তবে তার রূপায়ণে কতরকমের বাধা। তীর্থর সমাজতন্ত্রের রূপায়ণ যে কেন সোজা ছিল না, সে'টি বুঝতে এই আখ্যানটি অনেক কাজে দেবে। এই প্রক্রিয়াটির মধ্যে তীর্থর চেষ্টাগুলি সত্যিই মন কাড়ার মতো। এবং মতাদর্শ, মানসিকতা এবং শ্রেণিচেতনার বেড়াজাল ডিঙিয়ে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা যে কত দুরূহ ব্যাপার এবং তথাকথিত বাম নেতৃত্বের উচ্চতম পর্যায়েও এই আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা কীভাবে ঠোক্কর খেতে পারে তীর্থর জবানীতে আমাদের কাছে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
চার
আখ্যানটির মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অংশগুলি চিত্তাকর্ষক। 'মধ্য মেধা' এবং ঋণ স্বীকারের আতিশয্য-দোষ স্খালন করতে পারে এই অংশগুলি। আখ্যানের শেষ অংশটিতে তীর্থর বিভিন্ন বিদেশ যাত্রার ভ্রমণগুলি তাঁর বন্ধুপ্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন। এতসব রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং সেগুলি কাজে রূপায়িত করবার দায়িত্বভারে ভারক্রান্ত নয় এই অংশগুলি। বরং তীর্থর আত্মকথনের কথকতার অংশগুলি এইসব জায়গায় অনেকখানি ভারমুক্ত ও স্বচ্ছন্দ।
আড্ডাবাদ তীর্থ, গল্পকার তীর্থ এইসব জায়গায় কলম ধরতে জানে। খ্যাতির বিড়ম্বনা থেকে এইসব অংশে তীর্থ অনেকখানি মুক্ত। আমরাও অনেক সহজে আমাদের প্রিয় দাদা গৌরীপদ দত্তকে পেয়ে যাই।
উপসংহার/শেষের কথা,
ব্যাকরণ না জানা এই 'হাঁসজারু' আখ্যানের মুখবন্ধটি এক অর্থে বলা যায় আমার ঋণ স্বীকারের সামান্য প্রচেষ্টা। বাম রাজনীতিতে সংকীর্ণ দলাদলির ঊর্ধ্বে থেকে যিনি প্রথম দিন থেকে যে প্রান্তীকৃত মানুষগুলির বন্ধুত্বের টানে সমজতন্ত্রের লক্ষ্যের দিকে পৌঁছোবার জন্য পথ হেঁটেছেন, সেই গৌরীদা তার সেই যাত্রাপথে আমাদের জন্য এক সঙ্গীকে উপহার দিয়েছেন, যার নাম 'তীর্থ'। এই তীর্থর পিছু পিছু এই আশ্চর্য জীবনের যাত্রাপথ আমরা অতিক্রম করেছি, সেখানে একদিকে থেকেছে সাবেকি জীবনযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে সমাজের আসল চাহিদাগুলি চিহিৃত করে, প্রতিষ্ঠানগুলির তোয়াক্কা না করে আসল লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হওয়ার সাহসিকতা। এই দু'ইয়ের সংমিশ্রণে তীর্থের জীবনের যাত্রাপথকে কুর্ণিশ জানাই। তাৎক্ষণিকভাবে এর সাফল্য চোখে না পড়লেও নিশ্চয়ই জানি একদিন না একদিন এর জয় হবেই , কারণ ইতিহাসের পাতায় এঁরাই তো প্রকৃত তীর্থপথিক।
O, deep in my heart, I do believe
We shall overcome some day.
______________________________
বিখ্যাত ডাক্তার এবং বামপন্থী সমাজসেবী ডাঃ গৌরীপদ দত্তের আত্মজীবনী ‘আমি কখন বাহির হলাম’-এর জন্য অধ্যাপক যশোধরা বাগচিকে একটি মুখবন্ধ লেখার অনুরোধ করেন ডাঃ দত্ত। কিন্তু তার মধ্যেই যশোধরা বাগচি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর কিছু কাগজপত্রের মধ্যে এই লেখাটি পাওয়া যায়, যা তিনি ডাঃ গৌরীপদ দত্তের বইয়ের জন্য লিখেছিলেন, কিন্তু যার অস্তিত্ব এর আগে কারো জানা ছিল না। আমরা অধ্যাপক যশোধরা বাগচি এবং ডাঃ গৌরীপদ দত্তের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই নিবন্ধটি ছাপলাম।