আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
ভোট ও আমার পড়া কয়েকটি বইয়ের বিজ্ঞাপন
শুভঙ্কর দে
সবাই বলছেন আমাদের সেবা করবেন। টিভির প্রতিটা খবরের চ্যানেলে সব নেতারাই বলছেন আমাদের সেবায় তাঁদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। আমরা শুধু বোতাম টিপব। আগামী পাঁচ বছর জয়ী নেতা আমাদের উজাড় করা ভালোবাসা দেবেন আর সেবা করবেন।
শঙ্খ জেঠুর একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলাম ২০১২ সালে। গোটা দেশজোড়া জউঘর। লিখছেন -
"সবাই আমার ভালো করতে চায়।
ওরা এসে আমার ভালো করতে চাইলে
ঘর ছেড়ে এগিয়ে যাই
ওরা কেটে নেয় আমার ডান হাতখানা
ঝুলিয়ে দেয় গাছের ডালে
এরা এসে আমার ভালো করতে চাইলে
মাঠ ছেড়ে এগিয়ে যাই
এরা কেটে নেয় আমার বাঁ হাতখানা
গেঁথে দেয় আলপথে
তারপর..."
ঘণ্টাখানেক টিভি দেখতে দেখতে সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। ভোটের দিন সাত সকালেই দাদু ধুতি পাঞ্জাবি পরে তৈরি। তখন আমি নেহাতই ছোট্ট এক বালক। জেদ ধরি আমিও ভোট দিতে যাবো। সেই আটের দশকে দাদুর সঙ্গে মফস্বলের একটা স্কুল বাড়িতে প্রথম আঙুলে কালি মাখি। তখন বুঝিনি নাগরিকত্বের প্রমাণ আঙুলে কালি লাগানো।
তখন মহেশতলার ব্যানার্জিহাটে থাকতাম। বালতি বালতি জল রং। লাল হলুদ কালো। কখনো বাঘের ছবি, কখনো কোদাল, বেলচা, হ্যারকিনও মনে হয় ছিল। আর ছিল কাটা হাত ও কাস্তে সঙ্গে হাতুড়ি অথবা ধানের শীষ আর তারা। জোড়া বলদের ছবিও ছিল। এই ছবি গুলো সবই দেখতাম দেয়াল জুড়ে আঁকা। ভোরবেলার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় ওপরের দিকে থাকতো "তির্যক" নামে কার্টুন। কার্টুনগুলো এত মজার হতো, যে আমার এই ভুলো মনের মধ্যেও মনে থেকে গেছে। পরবর্তী সময়ে আজকাল পত্রিকায় প্রথম পাতায় থাকতো কুট্টির সেই বিখ্যাত কার্টুন। কুট্টির সেই কার্টুন গুলো নিয়ে আজকাল থেকে বই হলেও "তির্যক"-এর সংকলন এখনো প্রকাশিত হয়নি। দেয়াল জুড়ে ছবি আর নানান ধরণের ছড়া, তার নিচে লেখা থাকত এই চিহ্নে ভোট দিন। ছড়া গুলো ছিল বেশ মজার,
ভোট দেবেন কিসে
কাস্তে ধানের শীষে।
গড়তে দেশ রুখতে চীন
জোড়া বলদে ছাপ দিন।
আবার
জোড়া বলদের আটটা ঠ্যাং
কংগ্রেসকে মারো ল্যাং।
দিল্লি থেকে এলো গাই
সঙ্গে বাছুর সিপিআই।
এইরকম অজস্র লেখা থাকত দেয়াল জুড়ে। মিছিলে শোনা যেত "ওটা কালো হাত, ওটা বুর্জোয়া হাত। ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। এখন মিলেমিশে সব এক। এখন আর গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না এখন পাড়ায় পাড়ায় চলে ডিজে। কেউ বলে খেলা হবে, কেউ বলে টুম্পা সোনা, কেউ বলে বঙ্গে এবার বদল হবে। কি হবে না হবে জানি না আমাদের নাকি ভালো হবে।
সেই আটের দশকে একঘণ্টা, চব্বিশ ঘণ্টা এইগুলোর কোনো ব্যাপার ছিল না। ছিল একটাই ডিডি। দূরদর্শন। ভোট গ্রহণের দিন দেখাত কিনা মনে নেই তবে গণনার দিন সকাল থেকে সিনেমা দেখাত। এটা মনে আছে যে ভোটের দিন একটা ছুটির আমেজ। জেঠু মাংস রান্না করতো। সে এক মজার দিন ছিল। গণনার দিন ঘুমের ভান করে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ পিট পিট করে সিনেমা দেখা ছিল সেই ছেলেবেলার রঙিন স্বপ্ন। সিনেমার মাঝে মাঝেই কেউ একজন টিভিতে মুখ দেখিয়ে নেতাদের খবর দিত।
পেটোর আওয়াজ যত না ছিল তার থেকে বেশি আওয়াজ হয়েছিল পেটো ফাটার পরে দাদুর দোকান ঘরের টিনের চালে। একটু বড় হয়ে যখন শিয়ালদায় থাকতাম তখন শুনে ছিলাম আমাদের বাড়ির গলিতে বোম ফাটার শব্দ। যখন বইপাড়ায় থাকতে শুরু করলাম তখন কোনো এক পৌরসভার ভোটে জুনিয়ার নেতা পিস্তল হাতে এগিয়ে চলেছে তাঁর নেতাকে জয়ী করে আনতে। সেই নেতা যে, আমাদের ভালো করবে।
শঙ্খ জেঠু নিজের হাতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নব্বইতম জন্মদিন উপলক্ষে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন "নতুন কবিতার বই"। তাতে একটি কবিতা ছিল,
"আপনি কোন দলে?
পা যেদিকে চলে।"
টিভিতে নেতাদের দৌড়দৌড়ি দেখে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই লাইন দুটো মনে পড়ছিল। এক চ্যানেল থেকে আর এক চ্যানেল, সকালে একের পর এক খবরে কাগজ দেখতে দেখতে সুভাষ জেঠুর আর দুটো লাইন মনে পড়লো,
"কেবল ওল্টাবেন,
কিন্তু পাল্টাবেন না।"
কলকাতার তিনশ বছর, সেই প্রথম কোনো মিছিলে হেঁটেছিলাম। তারপর! কয়েক বছর আগে স্যার অপূর্ব বিশ্বাসের নেতৃত্বে হিন্দু স্কুলের দুশো বছরে হেঁটেছি। আর হেঁটেছি বইমেলার সময় "বইয়ের জন্যে হাঁটুন"। আর কোনো মিছিলে হাঁটিনি কখনো। পাঁচ কিলোমিটার দূরে নেতাদের সভায় না গেলেও নেতারা কী ভাষায় বলছেন তা সবটাই শোনা যায় ঘরে বসে। নেতাদের সুরেলা সুভাষিত কণ্ঠস্বর শোনা যায় তখন বলতে ইচ্ছে করে,
"হাতুড়ি কোদাল কাস্তে।
দাদু ঘুমোচ্ছেন, আস্তে।।"
এই বৈশাখী রোদে নেতাদের কী কষ্ট। কেউ আসছেন দিল্লি থেকে কেউবা ত্রিপুরা আবার কেউ ছুটেছেন হুইল চেয়ারে গ্রাম বাংলা। বাংলা আমার চাই। বাংলার মানুষের উন্নতি করবো, সব নেতার মুখে একই কথা। আমরাও দেখি আমাদের ভালো হবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছড়া পড়ি,
"ক্ষমতা গেলে মমতায়।
মমতা ফেলে ক্ষমতায়।।"
সেই কবে লিখেছিলেন,
"যদি
অটল হন মোদি
বইবে রক্তনদী
অথবা
মোদি অটল
হা রাম! তোবা তোবা
দেশ তুলবে পটল।।"...
ফোন করলে এখনো শোনায় কোভিড কো রোখনে কে লিয়ে দো গজ কি দুরি রেখে। তাবড় তাবড় নেতারা ডাক দেয় আমাদের ভালো করবে বলে।
"...আর সেই ডাক শুনে
ছুটে আসতে থাকে আরো সবাই আমাদের ভালো হবে বলে
খুবই আমাদের ভালো হতে থাকে
সবার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে ফিনকিতোলা
রক্ত
আর তারই রসে
ঝুলে-থাকা খাড়া-হওয়া কাটা হাতে হাতে
ভরে উঠতে থাকে চারিদিকে জমিজমা জঙ্গল শহর।"
এটা কিন্তু পড়ে ভাববেন না যেন কোনো রাজনৈতিক নিবন্ধ। এই সময়ে এটা নিছক কয়েকটি বইয়ের বিজ্ঞাপন মাত্র।
১) গোটা দেশ জোড়া জউঘর - শঙ্খ ঘোষ
২) নতুন কবিতার বই - সুভাষ মুখোপাধ্যায়
৩) ছড়া সংগ্রহ - সুভাষ মুখোপাধ্যায়
৪) ভোটের ছড়া ও অন্যান্য - কিন্নর রায়
সব শেষে
"সরকারকে সেলাম।
না করলে গেলাম।।"