আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বাবরের প্রার্থনা

পল্লব বরন পাল


রাক্ষসটা মুখ হাঁ করতেই হিংস্র এক লকলকে ক্ষুধার্ত জিভ হড়াৎ করে বেরিয়ে এলো। আপামাথা শৈশবশুভ্র-শ্বেত পোষাকে সম্রাট তাঁর অভিজাত ভঙ্গিতে সামনের সমুদ্রকে নমস্কার জানিয়ে সটান শুয়ে পড়লেন সেই আগুন-জিভ শয্যায়। ধীরে ধীরে জিভ ঢুকলো ভিতরে। হাঁ-মুখ বন্ধ হলো।

একটি গল্পের শেষ।
অন্য অনেক গল্পের শুরু।

ক্যামেরা আলো আর হাত-মাইক - ঘুরছে তিনশো ষাট ডিগ্রি - যেন ঘড়ির কাঁটা - কুচিকুচি কাটছে সময়। বিভিন্ন আকাশ থেকে পিলপিল নক্ষত্রেরা নেমে আসছেন। মানুষের চুলমাথা আর গাড়ির টাকমাথায় ঘেঁটে-ঘ-থিকথিক নগরপথ। সদ্যসমাপ্ত গল্প ঘিরে অনেকে ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছেন। কারোর প্রসাধনে অকালঝড়ের নিপুণ নিখুঁত পরিপাটি সাজের সঙ্গে মানানসই পোষাক। সত্যি, বিপর্যয়েরও কতো বাহারি রঙ আর স্টাইল! আবার কারো মুখ-চোখ-পোষাকে সত্যিকার দুর্যোগপীড়ন। উশকোখুশকো এলোমেলো বিপর্যস্ত। গোটা চত্বর জুড়ে স্তব্ধ স্থাপত্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শোকের শপিং-মল।

এক নম্বর শট্‌।

বিচিত্র শোকপালন। অদ্ভুত বিলাপ সংকীর্তন। অনর্গল শুধু বিভিন্ন ডেসিবেলে শব্দ ছুঁড়ে ছুঁড়ে কবিতা পাঠ - কখনও একা-স্বর, কখনও সবাই-স্বর -‘আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা,/ লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে’ শেষ হতেই উত্তরকোণ থেকে -‘জরাজটিল অরণ্যে তার ঠাঁই হলো না, ঠাঁই হলো না ভালোবাসার আকাশে। সে নেমে থাকল মধ্যপথের অজস্র শূন্যের মাঝখানে।’অপেক্ষাকৃত আলগা ভিড়ের মধ্য থেকে এবার এক বয়স্ক কন্ঠ - ‘দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার/ ভেসে-ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো?’কোথা থেকে কে বলছেন, কার পরে বলছেন - কেউ জানে না, শুধু উচ্চারিত সারিবদ্ধ শব্দগুলি এই অন্ধকারে জোনাকির মতো আলোকণা হয়ে উড়ে উড়ে সারা আকাশ জুড়ে এক বিরাট আলোর মালা নির্মাণে ব্যস্ত।‘সব তো ঠিক করাই আছে। এখন কেবল বিদায় নেওয়া,/ সবার দিকে চোখ,/ যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম।/ কী নাম?/ আমার কোনো নাম তো নেই, নৌকো বাঁধা আছে দুটি,/ দূরে সবাই জাল ফেলেছে সমুদ্রে -/ ছুটি, প্রভু, ছুটি!’
হঠাৎ সবাই-স্বর -‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে।’

যেন সন্ধ্যাহ্নিক সেরে প্রার্থনাসভা বসেছে মাঝ সমুদ্রে।

এই সমুদ্রের মধ্যে আবার এমন অনেক প্রাণীও আছে, যারা বারংবারমাথা তুলে ক্যামেরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ছটফট করছেন। সম্রাটের কাছের মানুষ হিসেবে আজ মিডিয়ায় মুখ দেখাতে পারলে প্রচুর পয়েন্ট।
টিআরপি-অঙ্কটা জটিল হলেও মাথায় তো রাখতে হয়! তাই দুর্যোগের মধ্যেও চোখেমুখে শোক মেখে এই রাক্ষস দর্শনে আসা।

ফেড্‌ আউট।

দুই নম্বর শট্‌।

সানাইতলা মহাশ্মশান থেকে বলছি। মানুষের ঢল - শোকস্তব্ধ - দেখতেই পাচ্ছেন, এই দুর্যোগরাত উপেক্ষা করেও জড়ো হয়েছেন প্রিয় সম্রাটকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। আমার সঙ্গে আছেন সম্রাটের স্বনামধন্য নিকট স্বজনেরা। নমস্কার সংস্কৃতিবাবু, সম্রাটের এই মৃত্যুকে আপনি কীভাবে দেখছেন আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে?

দাঁড়িয়ে? পারছি না, বসি? - চোখ থেকে নামিয়ে চশমাটা সাদা রুমালে নীল সুতোর শঙ্খ-নকশাটা সন্তর্পণে বাঁচিয়ে মুছে নিতে নিতে হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন - তারপর প্রাণপণে মুখ ফুটে কিছু বলবার চেষ্টা করলেন, প্রত্যেকবারেই ভাঙা গলার কান্নাসুর টপকে অন্য কোনো শব্দ বেরোলো না - অবশেষে চশমাটা ফের চোখে লাগিয়ে মাথা নিচু করে অশীতিপর কন্ঠে ফিসফিস করে উঠলেন -
    ‘নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী
    আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা -

বলতে বলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সবাই ‘এই এই’ করে হামলে পড়লো। পিছন থেকে পরিজনদের কোনো ভিড়-মুখ বাকিটুকু বলে উঠলেন -
    মাটি আকাশ বাতাস যখন তুলবে দুহাত, আমার হাড়ে
    অস্ত্র গোড়ো, আমায় কোরো ক্ষমা।’

কাট্‌।

তিন নম্বর শট্‌।

এক্ষুনি গাড়ি থেকে নামলেন মাননীয় শ্রীরাষ্ট্র। বাঁ-হাত ওপরে তুলে নাড়তে নাড়তে ভিড় ঠেলে সোজা এগিয়ে আসছেন। এদিকেই। নমস্কার স্যার -

এ কি! বডি কই? ঢুকিয়ে দিলে? আমি আসার আগেই? - দু’পাশে দেহরক্ষীর দেয়াল ছুটিয়ে ক্রমাগত ভিড় ভাঙতে ভাঙতে রণংদেহী বেশে দৌড়ে এলেন। - আরে, আমাকে একবার জানালেও না কেউ? কে পার্মিশন দিলো? শ্মশানমন্ত্রী কই? এই যে, অকম্মার ঢেঁকি, কিসের তাড়া এতো তোর? বৌকে নিয়ে নাইটশো যাবি? শালা, তোর ন্যাকড়াপনা বের করছি, দাঁড়া। আমি কোথায় সব কাজকম্মো ফেলে গানস্যালুট দেবো বলে - তখনই খবর এলো - গানে ওনার নাকি অ্যালার্জি! কী পিকিউলিয়র পাব্লিক! যাই হোক, নো পব্লেম, কিন্তু তাহলে আমাকে নাচস্যালুট আয়োজনের মিনিমাম সময়টা দিবি তো, নাকি? ঠিকঠাক সম্মান-টম্মান না দেখালে লোকে কী বলবে আমার সম্পর্কে? এ সব বুঝিস হতভাগা? এ তো দেখছি গভীর ষড়যন্ত্র, আমার বিরুদ্ধে! আরে, আমারই খাবি, আমারই পরবি, আবার আমারই পেচোনে …? না না, আমি আজ কিছু বলবো না। নাচের ছেলেপুলেরা আসছে, ওদের হাতে পেটোটেটো থাকলে আমি জানিনা, তোমরা সামলিও। এ্যাই মিডিয়া, হট্‌ শালা। আমি অপমানিত। মানুষ আমার এই অপমানের বদলা নেবে।

চারদিকে হৈহৈ। লোকজন হাঁউমাউ। ঠেলাঠেলি, জিন্দাবাদ, লণ্ডভণ্ড। হঠাৎ প্রায় দু’শো ছাপ্পান্ন ডেসিবেলের বজ্রকন্ঠ -
    ‘চুপ করো, শব্দহীন হও।’

কাট্‌।

চার নম্বর শট্‌।

ডিনারটা আজ জম্পেশ। ইদানিং খাবারদাবার, বলতে নেই, জুটছে ভালোই। একের পর এক এসেই যাচ্ছে। ঢেকুর তোলারও সময় দিচ্ছে না। তবে এটা স্পেশাল। এটার হাড়গোড়গুলো একটূ ভোগাচ্ছে ঠিকই, তবে ভিআইপি মাংসের স্বাদই আলাদা। চারদিক ঘিরে এতো লোকজন - সবাই হাঁ, তাকিয়ে আছে - যেন জামাইষষ্ঠীর ভোজের আয়োজন!

খুব মন দিয়ে সম্রাটকে খাচ্ছে রাক্ষসটা।

ভিড়ের ভরকেন্দ্র সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। লোকজন জড়ো হচ্ছে পিছনের দরজায়, সম্রাটের নাভিকুণ্ড সংগ্রহ করে গঙ্গায় ভাসাতে হবে। পরিবারের লোকজনরা ব্যস্ত প্রার্থনা গানে, তাদের এসব দিকে খুব একটা হুঁশ নেই। এই সুযোগে নাভির সঙ্গে যদি একটা সেলফি - উফফ্‌, আরো টিআরপি! গঙ্গার ধারে ভিড় ক্রমশ ভ-এ হ্রস্ব-ইকার থেকে দীর্ঘ-ঈকারে বদলে যাচ্ছে। মুহুর্মুহু। কেটলি বসানো প্লাস্টিকের বালতি নিয়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে চা, লেবু চা, কফি। বাড়ছে লেঠেল পুলিশ।

অন্যদিক থেকে ভেসে আসছে আকাশ মাথায় করা মন্ত্রোচ্চারণের নির্ঘোষ -
    ‘আমার শরীরে কোনো গান নেই
    কাঠুরেরা আসে
    একে একে কেটে নেয় মরা ডাল গুঁড়ি ও শিকড়
    তার পরে ফেলে রাখে মাঠের পশ্চিম পাশে, আর
    দূরের লোকেরা এসে ধুলোপায়ে বেচাকেনা করে।’

আকাশে জ্বলছে কাব্যজোনাকীরা, আর অনতিদূরে গঙ্গার ঘাটে জ্বলছে উশখুশে গাঁজার কল্কে। ইতিউতি।

ফেড্‌ আউট।

পাঁচ নম্বর শট্‌।

    ‘শুয়ে আছি শ্মশানে। ওদের বলো
    চিতা সাজাবার সময়ে
    এত বেশি হল্লা ভালো নয়।’

আপনি কে বলছেন? দয়া করে ক্যামেরার সামনে আসুন।

সব চড়াইপাখি। এলোপাথাড়ি মাথা ঘুরছে এদিকওদিক। কে? কে? কে বললো? - সকলের মুখে চোখে একই প্রশ্ন। উত্তর নেই। সবাই ত্রস্ত ও আতঙ্কিত! অনর্গল শুধু এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ক্যামেরা অনুসরণ করছে অসংখ্য মুখের জিজ্ঞাসাচিহ্নদের। পরিবার পরিজনেরাও দিশেহারা। সেই পিচ্‌, সেই মডিউলেশন - লক্ষবার শোনা সম্রাটের নিজের কন্ঠে। হুবহু সেই কন্ঠস্বর!

কিন্তু কে?

একটি ছেলে, বছর বাইশের, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে একটা বই - কী বই, গদ্য না কবিতার, নাকি বই নয় - লিটল্‌ ম্যাগাজিন - দূর থেকে ঠাহর হচ্ছে না - চুপচাপ কুঁজো হয়ে একদৃষ্টে যন্ত্ররাক্ষসটার দিকে তাকিয়ে বসেছিলো। হঠাৎ শিরদাঁড়া টানটান উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে বলে উঠলো -
    ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
    নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
    জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর...’

হঠাৎ শিউরে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলো - ওই তো, ওই তো!

ক্যামেরা ওর দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে তাক করলো রাক্ষসের মাথার কাছে। আলোর মালা পরা আকাশ। সবাই এ-ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে হঠাৎ সমস্বরে প্রতিধ্বনি করে উঠলো - ওই তো, ওই তো!

কিন্তু কই, কিছুই তো...

কাট্‌।

ছয় নম্বর শট্‌।

রাক্ষসটা উপন্যাসোপম দীর্ঘ একটা ঢেকুর তুললো। ভোজন সম্পূর্ণ। সবাই দৌড়েছে গঙ্গার ঘাটে। আত্মীয় পরিজন, ক্যামেরা, আলো মিডিয়াও। মুহূর্তে সামনের চাতালটা ন্যাড়া বেলতলা।

শুধু বাইশ বছর দাঁড়িয়ে আছে। একা। কাঁধে ব্যাগ, হাতে ধরা - হ্যাঁ, এবার দেখা যাচ্ছে - ডিমাই মাপের লিটল ম্যাগাজিন - নাম ‘যমুনাবতী’।

একলা বাইশ।

ল্যাম্পপোষ্টের মতো - ঠায়।

হঠাৎ রাক্ষসের মুখ ফের হাঁ হলো।
ভেতর ধিকিধিকি আগুন।
আবার বাইরে বেরিয়ে এলো সেই লকলকে জিভ।

জিভের ওপর ভস্মফুলের আলপনা।
তার মধ্যিখানে চকচক করছে একটা আস্ত শিরদাঁড়া।

ছেলেটি চমকে উঠলো। তারপর নিচু হয়ে প্রণাম করলো। আশেপাশের নিঝুম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

তারপর অনেকক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করলো ঐ শিরদাঁড়াটিকে। না, ওটা মোটেই ছাই নয়। আদি অকৃত্রিম ঋজু হাড় গাঁথা অস্ত্র - শিরদাঁড়া। বাঁহাতের লিটল ম্যাগাজিনটি সন্তর্পণে কাঁধের ব্যাগে ভরে নির্ভয়ে এগিয়ে গেলো সেই উদ্ধত জিভের দিকে। দু’হাত বাড়িয়ে শিরদাঁড়াটি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো।

গঙ্গার ওপার থেকে একটা হাওয়ার হল্লা ধেয়ে এলো। রাক্ষসের মাথার ওপর রুদ্র নটরাজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সম্রাট। অন্ধকার দুর্যোগে রাতআকাশের নিচে সেই শৈশবশুভ্র-শ্বেত পোষাক ফুলে ফুলে উঠছে - ক্রমশ বড়ো হতে হতে ঢেকে দিচ্ছে তাঁর প্রিয় স্বদেশকে - হাওয়ায় দ্রবীভূত হয়ে যেতে যেতে সম্রাট ঘোষণা করলেন -
    ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
    আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

ধীর পায়ে অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে বড়রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছে বাইশ।

ফেড্‌ আউট...