আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
কঃ পন্থা? বামপন্থা?
রজত রায়
না, এটা বামপন্থী রাজনীতির এপিটাফ (epitaph) লেখা হচ্ছে না। কারণ, বামপন্থীদের এই চরম বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়েও এ কথাই বলব যে যতদিন সমাজে বৈষম্য থাকবে, এক শ্রেণির মানুষের হাতে অন্য শ্রেণির মানুষের নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা অব্যাহত থাকবে, যতদিন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ, সব সামাজিক গোষ্ঠীর মানুষ দেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে পারবে না, তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততদিন বামপন্থী রাজনীতির প্রয়োজন থাকবে। কিন্তু বর্তমানের এই সঙ্কটকালে আমাদের একটু থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে, এই ঐতিহাসিক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বামপন্থী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের আকাশ থেকে ক্রমশই বিলীয়মান কেন?
এই প্রশ্নটির উত্তর নানা দিক থেকে খোঁজা দরকার। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির প্রেক্ষিতকে মাথায় রাখার সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে ভালো করে বুঝতে হবে।এবং অতিঅবশ্যই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকেও মাথায় রাখতে হবে। তার পরেই রাজ্যে বামপন্থার ধারাবাহিক অবক্ষয়ের কারণগুলি সনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। স্বল্প পরিসরে উপরোল্লিখিত নানা দিকের এই সুবিশাল প্রেক্ষিত নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করা অসম্ভব। কিন্তু এই সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সমস্যার বহুমাত্রিকতার দিকগুলি একবার করে ছুঁয়ে গিয়ে মূল প্রশ্নে পৌঁছনো যেতে পারে বলেই মনে হয়। বর্তমান নিবন্ধে সেই চেষ্টাই করা হবে।
আমরা এমন একটা সময়ে এই আলোচনা করার চেষ্টা করছি, যখন স্বাধীনতার পর এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের কোনো কমিউনিস্ট প্রতিনিধি লোকসভাতে নেই, রাজ্য বিধানসভাতেও নেই। ইতিমধ্যেই সিপিএম পলিটব্যুরো এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে কেরালায় বামপন্থীদের বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শোচনীয় পরাজয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেছে। জানিয়েছে, পরাজয়ের কারণগুলি খতিয়ে দেখা হবে। সত্যিই দেখা হবে তো? ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১১, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯ এবং সাম্প্রতিকতম ২০২১ সালে বামপন্থীরা ক্রমশই খারাপ থেকে খারাপতর ফল করতে করতে এখন মুছে গিয়েছে। অথচ, এই ক্রমাগত অধোগতির কোনো ইঙ্গিত গত ১০ বছরে পলিটব্যুরোর পর্যালোচনা থেকে মেলেনি, আরও মেলেনি কীভাবে তা ঠেকানো যাবে, সেই পথনির্দেশ। দল নিয়মমাফিক পর্যালোচনা নিশ্চয়ই করে। কিন্তু তা একান্তভাবেই দলের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন স্তরের পদাধিকারীদের নিয়ে করা হয়। দলীয় সংগঠনের বাইরে যাঁরা সমর্থক বন্ধু, তাঁদের ওই আলোচনায় অংশ নিতে দেওয়া হয় না। ফলতঃ, অনিবার্যভাবেই নেতাদের গা বাঁচিয়ে একটা দায়সারা রিপোর্ট তৈরি করেই দল তার দায় ঝেড়ে ফেলে। তাই প্রশ্নগুলি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এটা শুধু ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০২১ পর্যন্ত নির্বাচনী বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক নয়। আরও বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, সৎ পর্যালোচনার ক্ষেত্রে দলের সর্বস্তরে প্রবল অনীহা। একটু পিছিয়ে গিয়ে ১৯৯১ সালের দিকে তাকানো যেতে পারে। ওই বছরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অস্তিত্ব লোপ পায়। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থেকে গেলেও তারা অর্থনীতির ক্ষেত্রে ধনতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করে, এবং সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং স্বৈরতান্ত্রিক পথ আঁকড়ে থাকে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্নব থেকে বিশ্বজুড়ে শ্রমিক ও অন্যান্য মেহনতী মানুষের সামনে একটা নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন জন্ম নিয়েছিল, ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার বিপরীতে এক সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল, তা মাত্র ৭৪ বছরের মধ্যে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল, এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? এই প্রশ্নটি বিস্তারিত জবাব দাবি করে।
বলে রাখা ভালো, দুনিয়াজুড়ে বামপন্থীদের এই বৃহত্তম ট্র্যাজেডির পরেও ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার মতো পণ্ডিতদের সুরে সুর মিলিয়ে End of History বা সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস ধনতন্ত্রে এসেই থমকে যাবে বলে উল্লাস করার কারণ দেখি না। বরং মনে করিয়ে দিতে চাই ইতিহাসের মাপকাঠিতে এই ৭৪ (১৯১৭ থেকে ১৯৯১) বছর কোনো বড় সময় নয়। আবারও ফরাসি বিপ্লবের দিকে তাকালেই কথাটা স্পষ্ট হয়। ১৭৮৯ সালে স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী, এই তিন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভিত্তি করে সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতন্ত্রের সুচনা হয়। কিন্তু মাত্র দু'বছরের মধ্যেই Reign of Terror (১৭৯৩- ১৭৯৪), তারপর নেপোলিয়ন, নেপোলিয়নের পরে আবারও বুরবোঁ বংশের অষ্টাদশ লুই ও দশম চার্লস ক্ষমতায় থাকলেও ফরাসি বিপ্লব থেকে প্রাপ্ত স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর মূল্যবোধকে পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়া যায় নি। পরে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর থেকে সামন্ততন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি পোতা হয়, এবং ফরাসি বিপ্লবের বীজমন্ত্রকে (স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী) পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে তুলে ধরে ফ্রান্স সহ ইউরোপের অনেকাংশে ধনতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়। অর্থাৎ, ফরাসি বিপ্লব শুরুতে ইতিহাসের চোরাবালিতে পথ হারিয়ে ফেললেও নিজের পথে ফিরে আসতে ১০০ বছরেরও কম সময় নিয়েছে। তাই রুশ বিপ্নবের মূলমন্ত্র আপাতত হারিয়ে গেলেও তা আবার পুনরুদ্ধারের আশা করাটা মোটেই অযৌক্তিক নয়।
কেন রাশিয়া ও চিনের বিপ্লব ব্যর্থ হল, তা নিয়ে পশ্চিমী দুনিয়ায় নানা গবেষণা হয়েছে। রাশিয়া ও চিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের যে মডেল বিশ্বের সামনে হাজির করা হয়েছিল, যাকে অর্থোডক্স বা গোঁড়া মার্কসবাদীদের চিন্তার ফসল বলে অনেকেই খারিজ করেছেন। একটা বিষয়ে বেশিরভাগই একমত, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে পুরোপুরি ক্ষমতাসীন চক্রের হাতে সমর্পণ করার ফলে সমাজে যে ক্ষোভের বাষ্প জমছিল, একসময় সেটাই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গোটা ব্যবস্থাকে ভিতর থেকে ধ্বসিয়ে দেয়। পার্টি ও জনগণের উপর লৌহকঠিন নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিয়ে সবরকম বিরুদ্ধমতকে কোণঠাসা করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া রাশিয়ায় স্তালিনের নেতৃত্বে এবং চিনে মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, সেটাই তাদের অনুগামী বিশ্বের অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়। এই কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে সমষ্টির স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার নামে ব্যক্তির অধিকারকে পদদলিত করার নীতির উপর। এ ব্যাপারে তাদের সহায়ক হয়ে ওঠে মার্কস এবং লেনিনের দুটি তত্ত্ব - শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব (Dictatorship of Proletariat)এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা (Democratic Centralism)। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র যে কার্যত অচিরেই প্রথমে সর্বহারার দলের একনায়কতন্ত্রে (এ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি) পরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে দলের ক্ষমতাসীন চক্রের একনায়কতন্ত্রে পর্যবসিতহয়ে যায়, তা রাশিয়ায় স্তালিনের নেতৃত্বে এবং চিনে মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে দেখা গিয়েছে। এই সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের আর একটি অমোঘ হাতিয়ার বিপ্লবী ন্যায় (Revolutionary Justice) এর নামে নিজের দেশের নাগরিকদের (তারা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারে, না-ও হতে পারে) বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য কালা কানুন চালু করা। স্তালিনের আমলে রাশিয়ায় যার বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ হত, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব নিতে হত, আর পুলিশ অত্যাচার করে যে স্বীকারোক্তি আদায় করত, আদালত সেটাই অম্লান বদনে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করত। স্তালিনের সমসাময়িক বলশেভিক নেতাদের অনেককেই এ ভাবে বিচার করে (মস্কো ট্রায়াল ১৯৩৬- ১৯৩৮) হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের দেশেও হুবহু না হলেও এরকম কিছু আইন (যেমন UAPA এবং Sedition Act) রয়েছে, যেখানে বিনা বিচারে বন্দী করা ও নিরপরাধ প্রমাণের দায় অভিযুক্তের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী পার্টির মধ্যে এ নিয়ে সত্যিকারের চিন্তাভাবনা হয়েছে কি? বলতে বাধ্য হচ্ছি, - না হয়নি। সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমী দুনিয়ার চক্রান্তের তত্ত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু যেটা স্বীকার করা হয় না তা হল, কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রের ফাঁসে কী করে দেশের মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক ও অন্য মেহনতি মানুষের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের দলদাসে পরিণত করা হয়েছিল। স্বীকার করা হয় না, রাশিয়ায় "সমাজতন্ত্র নির্মাণের" নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কীভাবে বন্দী করে সাইবেরিয়ায় খনিতে, জঙ্গল থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করতে দাসশ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, কী ভাবে প্রচন্ড শীতের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, এবং পার্টির বিরোধিতা করার মিথ্যা অভিযোগে অসংখ্য নেতা ও কর্মীকে গুপ্তপুলিশ হত্যা করেছিল, সে ব্যাপারে ইউরোপের কমিউনিস্টরা অবহিত থাকলেও এ নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট মহলে কোনো চর্চাই হয়নি।
বিস্ময়কর হলেও কোনো সন্দেহ নেই যে ফরাসি বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব, তারপরে চিন বিপ্লব, - মানবসভ্যতার ইতিহাসের অগ্রগতির পথ। কিন্তু কী করে রুশ বিপ্লবে পৌঁছে মানুষ ফরাসি বিপ্লবের অর্জিত অধিকার (ব্যক্তি স্বাধীনতা) হারিয়ে বসল, তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করতে বা ভাবনাচিন্তা করতে কমিউনিস্টদের দেখা যায়নি। একটা বিপ্লবের অর্জিত সুফল (এক্ষেত্রে, ব্যক্তিস্বাধীনতা) পরের বিপ্লবে যদি হারিয়ে যায়, সেটা কি অগ্রগতি? নাকি, পশ্চাদপসরণ? লেনিনের "এক পা আগে, দুই পা পিছনে"র এরকম অমোঘ উদাহরণ আর পাওয়া কঠিন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার পরে পরে দিল্লিতে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা সাংবাদিকদের নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁদের কাছে এটাও জানতে চাওয়া হয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজব্যবস্থার ভিতরে ভিতরে যে এত পচন ধরেছে, তা তাঁরা নিয়মিতভাবে ঘন ঘন রাশিয়া গিয়েও বুঝতে পারলেন না কেন? সিপিএমের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, "আর কখনও কনডাক্টেড ট্যুরে যাব না।" এই কনডাক্টেড ট্যুরেই বার বার সোভিয়েত রাশিয়া দেখে এসে পদাতিকের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন "সব পেয়েছির দেশে" ঘুরে আসার কথা। এরকমই কনডাক্টেড ট্যুরে চিন ও উত্তর কোরিয়াতে আমাদের কমিউনিস্ট নেতারা বার বার গিয়েছেন। কোনো প্রশ্ন তোলেন নি এই দুই দেশের সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের নামে চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে। এমনকি সমাজতান্ত্রিক চিন ও রাশিয়া নিজেদের মধ্যে ১৯৬৯ সালে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে, এবং চিন ভিয়েতনামকে আক্রমণ করলে ভারতীয় কমিউনিস্টদের মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না!
যেটা লক্ষ্যণীয়, রাশিয়ায় যে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের নামে ক্ষমতাসীন চক্রের একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়েছিল, পার্টির সদস্যদের ও সাধারণ নাগরিকদের (অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণিরও) সবরকম প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সে ব্যাপারটা ইউরোপের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশের নজরে পড়লেও ভারতীয় কমিউনিস্টদের নজরে পড়েনি। আসলে যুক্তিবিচার ও প্রশ্ন করার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার অনুশীলন করার বদলে অন্ধবিশ্বাস ও ভক্তি (অনেকটা মৌলবাদী ধর্মীয় চিন্তার মতো) গোঁড়া মার্কসবাদীদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তাই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে কলকাতায় পোস্টার ও দেওয়াল লিখনে দাবি করা হয় - মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা বিজ্ঞান। মার্কসবাদ সত্য, কারণ ইহা বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের প্রতি এই ভক্তিপূর্ণ আস্থা এবং মার্কসবাদকেও একটা বিজ্ঞান বলে দাবি করার আগ্রহে (যেন, একবার বিজ্ঞানের তকমা লাগালেই মার্কসবাদ সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে যাবে) যেটা কলকাতার মার্কসবাদীরা খেয়ালই করলেন না, তা হল, একটা দর্শনকে বিজ্ঞানের তকমা দেওয়াটা হাস্যকর প্রমাদ। বহুদিন আগেই অষ্ট্রিয়-ব্রিটিশ দার্শনিক কার্ল পপার এই ভ্রান্ত ধারণার গলদটি দেখিয়ে দিয়েছেন। বিজ্ঞানের গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা যে ক্রমাগত আগে পাওয়া জ্ঞানকে সংশোধন বা খারিজ করে নতুন জ্ঞান প্রাপ্ত করে থাকে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে কার্ল পপারের বক্তব্য, বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত মাত্রই কখনও না কখনও ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে পারে (falsifiability criterion), একমাত্র অ-বিজ্ঞান ভ্রান্ত প্রমাণ হয় না। অর্থাৎ, মার্কসবাদকে বিজ্ঞান বলে দাবি করলে তা যে ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, সে কথাও মেনে নিতে হয়। অন্যভাবে দেখলে বলা যায়, দর্শন এবং অধিবিদ্যা (metaphysics)র মতো বিষয়ে চর্চার ক্ষেত্রে তা ভ্রান্ত বা অভ্রান্ত কিনা সেই বিচার অর্থহীন। যে অর্থে গণিতশাস্ত্রে ২+২=৪ হতে বাধ্য, বা বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষার পরে একটা 'সত্যে' তখনকার মতো পৌঁছনো সম্ভব (যেমন, সুইচ টিপলে আলো জ্বলবে) সেই নিশ্চয়তাকোনও দার্শনিক চিন্তা (সেটা মার্কসবাদও হতে পারে) কখনইদিতে পারে না, দর্শনের কাছে সেই দাবি করাটাই অর্থহীন। কোনো দার্শনিক চিন্তা বা মতবাদ কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কারও কাছে না-ও হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের তকমার আড়াল নিয়ে সেই দর্শনকে রক্ষা করার চেষ্টা হাস্যকর।
গোঁড়া মার্কসবাদীদের সমাজতন্ত্রের মডেল রাশিয়া ও চিনে কেন ব্যর্থ হল, তা অবশ্যই সবিস্তার আলোচনার দাবি করে। কিন্তু এখানে তার অবকাশ নেই। শুধু এ ব্যাপারে সিপিএমের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ইঙ্গিত করে একটি ঘটনার উল্লেখ করে প্রসঙ্গান্তরে যাব। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষিজমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে বামফ্রন্ট সরকারের তখন নাভিশ্বাস উঠছে। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আগ্রহাতিশয্যে রাজ্য সরকার রবীন্দ্র সদনে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। বিষয় ছিল - পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন কোন পথে? বক্তা ছিলেন অমর্ত্য সেন, প্রণব বর্ধন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অমিয় বাগচি এবং অমিত মিত্র। গোটা হলজুড়ে সিপিএম দলের নানান স্তরের নেতৃবৃন্দ, ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠনের নেতানেত্রীরা বসে। অমর্ত্য সেন তাঁর ভাষণের মধ্যে কথাপ্রসঙ্গে একবার বললেন যে ছাত্রজীবনে তিনি বামপন্থী ছিলেন। রবীন্দ্র সদন হাততালিতে ফেটে পড়ে। তাঁর পরের কথা, পরিণত বয়সেও তিনি নিজেকে বামপন্থী বলেই ভাবতে ভালোবাসেন। আবারও হাততালি। এর পরেই অমর্ত্য সেনের সংযোজন, কিন্তু সিপিএম কেন এতদিনেও স্তালিন সংক্রান্ত প্রশ্নগুলির মীমাংসা করে উঠতে পারল না, তা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। এবার গোটা হল নিস্তব্ধ। তার পর আরও ১২ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু সিপিএম এখনও এরকমই কিছু গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ও সত্যের মুখোমুখি হওয়ার বদলে এড়িয়ে যেতে বা ধামা চাপা দিতে আগ্রহী।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টদের সমস্যাটা নিছক কিছু ভ্রান্ত কৌশল গ্রহণ করার জেরে নির্বাচনে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার বিষয় নয়। সমস্যার শিকড় আরও গভীরে, এবং তা তাদের চিন্তার ভ্রান্তির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনের সমাজতন্ত্রের মডেলকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা, সেই সব দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু থাকছে না জেনেও বিচলিত না হওয়া, পৃর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক শিবির (আসলে রাশিয়ার প্রভাবাধীন দেশগুলি) অটুট রাখার জন্য ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে এবং ১৯৬৮ সালে চেকশ্লোভাকিয়াতে (এখন চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি দেশে বিভক্ত) সোভিয়েত সামরিক বাহিনী অভিযান করে সেখানকার গণবিদ্রোহ নির্মম হাতে দমন করলে, চিনে ১৯৮৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্রযুবদের আন্দোলনকে সেনা পাঠিয়ে দমন করার মতো ঘটনা ঘটলেও এই তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক মডেলের প্রতি ভক্তি অটুট রাখা থেকেই বোঝা যায়, সমস্যাটা চিন্তার দারিদ্র্য থেকে জন্ম নিয়েছে।
এবার আসা যাক স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যগুলির প্রসঙ্গে। আগেই জানিয়ে রাখি, মার্কসবাদীদের অনুসরণে দেশের ক্ষমতাসীন শক্তির শ্রেণিচরিত্র কী হতে পারে, বুর্জোয়া-সামন্ততান্ত্রিক শক্তির জোট কিনা, জাতীয় বুর্জোয়া, নাকি মুৎসুদ্দি, নাকি রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন crony capitalists-দের নিয়ন্ত্রণে, এসব প্রশ্ন নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না, কারণ, আমি এই বিষয়ে চর্চা করার অধিকারী নই। কিন্তু সাদা চোখে দেখা দুয়েকটা বৈশিষ্ট্যের কথা না বললেই নয়। স্বাধীনতার আগে ১৯৪৩ সালে বাংলার মন্বন্তরে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, স্বাধীনতার সমসাময়িককালে তেলেঙ্গানা ও তেভাগার সুবাদে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের চেষ্টা ও চাষের ফসলে কৃষকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল গুরুত্বপুর্ণ। প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নেহরু সরকার একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠার সুবাদে দেশে শিল্পপ্রসারের ভিত্তি এবং সেচব্যবস্থার প্রসারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যসুরক্ষা অর্জনের চেষ্টা হয়। তারপরে ১৯৬৭-১৯৭২ নকশালবাড়ি আন্দোলনের সুবাদে গ্রামভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে যাওয়ার দিকে নজর ফিরে অসে, এবং কৃষিজমি ও কৃষকের আন্তঃসম্পর্ককে পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে ধরে। ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে সরতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে অন্য একটি বৃহৎ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় - ভারতের মাটিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ, ভারতের মাটিতে চিনের মডেলে সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব এবং রাশিয়ার ধাঁচে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত নয়। মাওবাদীরা মধ্যভারতের পাহাড় জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায় যতই সশস্ত্র সংগ্রামের চেষ্টা চালাক, তাদের ওই roving guerrilla squad-গুলি প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে করতে অচিরেই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অসাধু উপায়ে টাকা আদায়ের (প্রধানত খনিমালিকদের কাছ থেকে) পথে হাঁটতে বাধ্য। এক কথায়, ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের আবহে (তা যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন) সংসদের ভিতরে ও বাইরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বামপন্থীদেরও জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হওয়া ছাড়া অন্য পথ নেই।
১৯৯০ সালে ভারতের বুকে দুটি বিশাল আন্দোলন হয় - রামজন্মভূমিআন্দোলন ও মণ্ডল আন্দোলন। প্রথমটি যদি ধর্মীয়-রাজনৈতিক চরিত্রের হয়, তা হলে পরেরটি অবশ্যই সামাজিক- রাজনৈতিক চরিত্রের। এই দুই আন্দোলনের অভিঘাত এতটাই গভীর হবে যে তা অচিরেই ভারতীয় রাজনীতির গতিপথের আমূল পরিবর্তন করে দেবে।
মন্ডল কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে জাতপাতের রাজনীতি উত্তর ভারতের হিন্দিবলয়ে প্রথম ধাক্কা দেয় বর্ণহিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্যবাদকে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের আঁতাত ভারতীয় সমাজের মধ্যে নিম্নবর্ণের উপর যে আধিপত্য হাজার হাজার বছর ধরে বজায় রেখেছিল, তাতে ফাটল ধরতে শুরু করল। যাদব (মুলায়ম, লালুপ্রসাদ), নীতীশ কুমার (কুর্মি), কল্যাণ সিংহ ও উমাভারতী (লোধি), মায়াবতী (তফশিলভুক্ত)রা উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারে ক্ষমতার শীর্ষে বসতে শুরু করলেন। বাবু জগজীবন রামের মতো এক আধ জনকে প্রতীকি অর্থে জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়ার বদলে এবার থেকে নিম্নবর্ণের জাতপাতের সমীকরণকে উপেক্ষা করে কোনো রাজনৈতিক জোট আর উত্তর ভারতে করা সম্ভব নয়। কাঁশিরামের নেতৃত্বে যে বহুজন সমাজ পার্টি মাথা তুলেছিল, মায়াবতী তাকে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতার আসনে নিয়ে যেতে সফল হলেন। এই যে জাতপাতের রাজনীতি, তা একটু একটু করে ১৯৯০ এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও শিকড় জমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কথাটি প্রণিধানযোগ্যঃ এ রাজ্যে ওসব (জাতপাত) নেই। জ্যোতিবাবুর এই দাবি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সমাজেও যে জাতপাতের সমীকরণ ভালোভাবেই রয়েছে, তা সংবাদপত্রে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে যথেষ্ট সোচ্চারে ঘোষিত। ১৯৯০ এর দশকের শেষদিক থেকে রাজ্যে মিড ডে মিল কর্মসূচি চালু হওয়ার সময়ই দেখা গেল, বহু স্কুলে বর্ণহিন্দু ছাত্ররা নিম্নবর্ণের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে খেতে নারাজ। এ ব্যাপারে তাদের অভিভাবকদেরও সম্মতি রয়েছে। আর একটা ব্যাপারও ঘটে। মণ্ডল কমিশনের রায় কেন্দ্র মেনে নেওয়ার পর থেকেই এ রাজ্যের বহু সামাজিক গোষ্ঠী ওবিসি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন জানাচ্ছিল। শেষে রাজ্য সরকার ১৯৯৩-৯৪ নাগাদ ওবিসি কমিশন বসায়। সেখানে শতাধিক সামাজিক গোষ্ঠী নানা তথ্য্ দিয়ে ওবিসি স্বীকৃতির দাবি পেশ করে এবং শেষ পর্যন্ত সম্ভবত ৬৯টি গোষ্ঠীকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করা হয়। এখন তো মতুয়া থেকে শুরু করে রাজবংশী, কামতাপুরি, গোর্খা, মাহাতো, বাউরি প্রভৃতি নানা পরিচয়কেন্দ্রিক ও জাতপাতকেন্দ্রিক রাজনীতি এ রাজ্যে জাঁকিয়ে বসেছে।
তাই জাতপাত ও ধর্ম যে ভারতীয় সমাজের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এবং শ্রেণি-সংগ্রাম তীব্র করলেই এই সব ভেদাভেদ মুছে গিয়ে গোটা সমাজ শ্রেণির ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে নিজের নিজের শ্রেণিগত অবস্থানের ভিত্তিতে লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে পড়বে, এরকম ভাবনা ভিত্তিহীন আকাশকুসুম কল্পনা। যত তাড়াতাড়ি এই সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলা যায় তত মঙ্গল। সেই সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণাটাও দলের তরফে খতিয়ে দেখা দরকার। নির্বাচনে বিপর্যয় চৃড়ান্ত হওয়ার পরে দলের মধ্য থেকে কিছু প্রশ্ন, কিছু সমালোচনা উঠে আসতে শুরু করেছে। প্রাক্তন বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যের একটি কথা তলিয়ে দেখা দরকার। তিনি দলের নেতৃত্বের সমালোচনা করে বলেছেন, পার্টির কর্মসূচিতে সংসদীয় গণতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও পার্টির একদল নেতা অহংকারের সুরে বলে থাকেন "আমরা ভোটের রাজনীতি করি না, আমরা রাস্তায় থাকি।" তন্ময়বাবুর মন্তব্য, যারা ভোটের রাজনীতি করে, তারাই ভোট পেয়েছে। আর রাস্তায় থাকা নিয়ে গর্ব করা নেতাদের হাতে (মানুষ) একটা ফুটো বাটি ধরিয়ে দিয়েছে।
তন্ময়বাবু রাজ্যের একজন অভিজ্ঞ নেতা। মনে করতে অসুবিধা নেই, তাঁর কথা দলের আরও অনেকের মনের কথা। কিন্তু ভাবনার হল, এখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ও রাস্তার আন্দোলনের পথকে দুটি স্বতন্ত্র ও পরস্পরবিরোধীপথ হিসাবে দেখা হচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্র মানে যেন শুধুই পার্লামেন্ট ও বিধানসভার ভিতরে বসে ভাষণ দেওয়া, বাদবিতন্ডায় অংশ নেওয়া এবং ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়াটাই কাজ, আর নির্দিষ্ট সময়ে ভোটদাতাদের কাছে ভোট চাওয়াটা আর একটি কাজ। অন্য পথটি হল রাস্তায় নেমে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। যেন সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্টে বা বিধানসভায় নির্দিষ্ট ইস্যুতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বাইরে রাস্তায় নেমে গণআন্দোলন করলেই তা সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যাওয়া হবে। সংসদের ভিতরের লড়াই এবং বাইরের গণআন্দোলন যে একে অপরের পরিপৃরক, সে কথাটা কোন মার্কসীয় তত্ত্ব দিয়ে খারিজ করা হল? ১৯৬২ সালে চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের পরে দেশজুড়ে যে প্রবল দেশাত্মবোধের আবেগের বন্যা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথা তোলে, তাতে বামপন্থী কমিউনিস্টরা (চিনাপন্থীরা) রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। জ্যোতি বসু সহ নেতাদের অধিকাংশই ভারতরক্ষা আইনে কারাবন্দী হন। ওই সময় ১৯৬৬ সালের গোড়ায় প্রবল খাদ্যসঙ্কটের কারণে পশ্চিমবঙ্গের রেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। উত্তেজিত মানুষদের বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ একাধিক জায়গায় গুলি চালায়, রাজ্যে প্রবল খাদ্য আন্দোলন শুরু হয়। ওই আন্দোলনের সময় বামপন্থীরা রাস্তায় নেমে সাধারণ দরিদ্র মানুষের পাশে থেকেছিল। ফলে, মাত্র চার বছর আগে চিনের দালাল ও দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত বামপন্থীরা আবার সাধারণ মানুষের নয়নের মণি হয়ে গেলেন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের পরে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার স্থাপিত হল। গণআন্দোলন ও সংসদীয় রাজনীতি কীভাবে একে অন্যের হাত ধরে চলে, তা এই নজির থেকে স্পষ্ট।
ধর্ম, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতীয় সমাজের পরতে পরতে কীভাবে জড়িয়ে আছে, তা এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ধর্মের প্রভাব মানুষের মনের কত গভীরে শিকড় চারিয়ে রাখে, সে কথা আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা বোঝার চেষ্টা করে উঠতে পারলেন না। ধর্মের যে কী প্রচন্ড শক্তি, তা রামজন্মভুমি আন্দোলনের প্রসার দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের এর চাইতে ভালো নজির আমার জানা নেই। মার্কস তাঁর 'A contribution to the Critique of Hegel's philosophy of Right' বইয়ের ভূমিকায় ধর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন, "Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people". ধর্মের এই অভিধায় মার্কস কিন্তু আদৌ নেতিবাচক দিকের কথা বলেননি। বরং ধর্ম যে ভাবে নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়ে থাকে, সেই বৈশিষ্ট্যের কথাই মনে করিয়ে দিতে আফিমের উপমা ব্যবহার করেন। এখানে আফিম মোটেই মাদক হিসাবে নয়, ব্যথার উপশমকারী (পেইনকিলার) হিসাবে ব্যবহৃত। অথচ, ভারতীয় মার্কসবাদীরা শুধু আলাদা করে "ধর্ম গরিব মানুষের আফিম" (এখানে মাদক অর্থে) ব্যবহার করায় গোটা অর্থটাই পালটে যায়। ধর্ম সম্পর্কে দূরত্ব বজায় রেখে চলার নীতি আঁকড়ে থেকে (বিপ্লব হলে ধর্ম বিলোপ পাবে) যে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির মোকাবিলা করা যায় না, সেটা আশা করি এতদিনে বোঝা গিয়েছে। বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় প্রথম চার বছরের গৃহযুদ্ধে বলশেভিকরা জয়ী হওয়ার পরে নিজেদের হাতে ক্ষমতা সংহত করার প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার প্রধান ধর্ম গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের বিরুদ্ধে কড়া দমনপীড়ন চালায়। বহু চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস থেকে রাশিয়ার মানুষকে মুক্ত করা যায়নি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার পরে চার্চের পুনরুজ্জীবন ঘটে। মানুষ আবার দলে দলে চার্চের উপাসনায় অংশ নিতে শুরু করে। মাঝের প্রায় ৭৫ বছর চলে গেছে, তৃতীয় প্রজন্ম এসে গেছে, যাদের বেশির ভাগের জন্মই বিপ্লবের পরে। তা হলে এই ধর্মবিশ্বাস তাদের মনের কোন গভীরে এতদিন সঞ্চিত ছিল?
ধর্মের কথা বললেই ধর্মকে কেন্দ্র করে সংকীর্ণ রাজনীতির কথা আসতে বাধ্য। বামপন্থীরা কি তাদের সঙ্গে আপস করে চলবে? ২০০৭ সালের নভেম্বরে তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর জামায়েত উলেমা ই হিন্দ এবং ইদ্রিস আলিদের আর একটি সংগঠন কলকাতার রাস্তায় নেমে দাঙ্গা বাধাবার উপক্রম করলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরই মধ্যে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু টিভি চ্যানেলে বলে দেন, যাঁকে কেন্দ্র করে এত গণ্ডগোল, তাঁর রাজ্য ছেড়ে যাওয়াই ভালো। পরের দিনই বেড়াল পার করার মতো করে তসলিমাকে জয়পুরে রাজস্থানের বিজেপি সরকারের আশ্রয়ে পাঠানো হয়। আরও পরে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দিল্লিতে রাখার ব্যবস্থা হয়। উগ্র ধর্মীয় নেতাদের কাছে এ ভাবে নতিস্বীকার করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ার এই নীতি গ্রহণের কোন ব্যাখ্যা বামপন্থীরা দেবেন, তা জানার আগ্রহ রইল।
জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীদের এ হেন দুর্বলতার শিকড়ও কিন্তু তাদের চিন্তার দুর্বলতা থেকেই আসছে। এই প্রসঙ্গে কিছুটা দুর্বল হলেও একটা প্রতিতুলনা মনে আসছে। সিপিএমের রাজনৈতিক সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ২০০৪ সালে দলের মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ২,৭৪,৯২১। একই সময়ে রাজ্যে সিপিএমের গণসংগঠনগুলির মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সভা, মহিলা, যুব এবং ছাত্র সংগঠনের মিলিত সদস্যসংখ্যা ছিল তিন কোটি ১৯ লক্ষের বেশি। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারী, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের ধরা হয়নি। এই পরিসংখ্যানের মধ্যে কিছুটা অতিশয়োক্তি থাকার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ, যিনি ছাত্র, তাঁকেই যুব ফ্রন্ট, মহিলা ফ্রন্টের সদস্য হিসাবে বার বার নথিভুক্ত করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একই ব্যক্তির নাম বারবার নথিভুক্ত হওয়ার বিপদ এড়াতে বাম গণসংগঠনগুলির মোট সদস্য্ সংখ্যার অর্ধেক কমিয়ে ধরা যেতে পারে, তিন কোটি ১৯ লক্ষের বদলে এক কোটি ৫৯ লক্ষ ধরে এগনো যেতে পারে। ২০০১ সালের জনগণণা অনুযায়ী তখন পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ছিল আট কোটির সামান্য বেশি। অর্থাৎ, ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষই সিপিএমের প্রভাবে প্রভাবিত এবং সক্রিয় ছিল। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পরে সিপিএমের প্রভাব ২০০৪ সালেই সবচেয়ে বেশি ছিল। লোকসভায় সিপিএম সদস্য ৪৩, অন্য বামদলগুলির ১৮ সাংসদ মিলে লোকসভায় বামপন্থীরা ৬১ জনের একটা ব্লক। রাজ্যসভায় সিপিএমের ১৪ জন সদস্য। কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার বামপন্থীদের উপর কিছুটা নির্ভরশীল।
অথচ, সিপিএমের প্রাপ্য ভোটের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এই কর্মীসমর্থকদের একটা বড় অংশই সিপিএমকে ভোট দেয় না। ২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১,৪৬,৫২,২০০টি (37.13%), অর্থাৎ (২০০৪ সালের হিসাবের ভিত্তিতে) পার্টিসদস্য্, গণসংগঠনগুলির কর্মীসমর্থকদের মিলিত শক্তির চাইতেও বেশ কম ভোট পেয়েছিল। এই প্রবণতা ধারাবাহিক। ২০১৫ সালের সিপিএম সাংগঠনিক রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে পার্টি এবং গণসংগঠনগুলির (ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সভা, মহিলা, যুব ও ছাত্র সংগঠন) মিলিত শক্তি এক কোটি ৭৯ লক্ষ। অথচ, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে নির্বাচনে সি পি এমের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা যথাক্রমে ১,১৭,২৩,১৬৬ (২২,৯৬%) এবং ১,০৮,০২,০৫৮ (১৯,৭৫%)। এই নিম্নগতি আরও বেগ সঞ্চয় করে ২০১৯ সালে ৩৫,৯৪,২৮৩ (৬.৩৪%) এবং ২০২১ সালে ২৮,৩৭,২৭৬ ভোটে (৪.৭০%) নেমে আসে।
এই পরিস্থিতি থেকে দুটি বিকল্প সিদ্ধান্তে আসা যায়। এক, নিজেদের শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে সিপিএম ধারাবাহিকভাবে অতিরঞ্জিত রিপোর্ট দিয়ে আসছে। অথবা, দুই, যদি অতিরঞ্জিত না হয়, তা হলে বুঝতে হবেএই বিশাল সক্রিয় কর্মীবাহিনীর অনেকেইআদতে বামপন্থার প্রাথমিক মতাদর্শে দীক্ষিত নন। তাই নয়াউদারনৈতিক পরিবেশে তাঁরা সহজেই দিগভ্রান্ত হন, বা তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাতে বিজেপিকে মদত জোগান। গোড়াতেই বলেছি, বামপন্থীদের সঙ্কটের চরিত্রটা কৌশলগত ত্রুটির কারণে হয়নি, হয়েছে চিন্তার দারিদ্র্যের কারণে। আর এই চিন্তার দারিদ্র্য জন্ম নিয়েছে একেবারেই যান্ত্রিকভাবে মার্কসবাদকে (ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে) অনুসরণ করতে গিয়ে। তাদের সঙ্কটের অন্যতম মুখ্য কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ গোঁড়া মার্কসবাদীদের নেতৃত্বাধীন গোটা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অবলুপ্তির যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দিতে না পারার মধ্যে (যার কেন্দ্রে রয়েছে স্তালিন সংক্রান্ত প্রশ্ন)। আগে রাশিয়া, চিন সহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভিতরের জীবনযাপন, ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব সম্পর্কে তেমন তথ্যপ্রমাণ ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার কাছে থাকলেও ভারতের মতো তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলিতে আসত না। তাই, এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি তরুণ প্রজন্মকে সহজেই বিপ্লবের স্বপ্ন ফেরি করতে পারত। রাশিয়া, চিনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলতে পারত ওই যে "সব পেয়েছির দেশ" রয়েছে। আমাদের দেশেও বিপ্লব হবে, আমরাও রাশিয়া ও চিনের পথে গিয়ে সব পেয়েছির দেশে পৌঁছব। ১৯৯১ সালের পর থেকে সেই স্বপ্ন ফেরি করা কঠিন। এখন আর "বিপ্লব হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে" এবং "বামফ্রন্ট সরকার তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে রাজ্যের মানুষকে কিছু রিলিফ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে" জাতীয় কথাবার্তা শোনা যায় না। অথচ ১৯৮০-র দশকে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও দলের রাজ্য সম্পাদক সরোজ মুখার্জির মুখে এই ধরণের কথা নিয়মিত শোনা যেত।
এখন আর বিপ্লব হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বা এখন সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সাধারণ মানুষকে কিছুটা রিলিফ দেওয়ার কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। বরং, প্রতিদ্বন্দিতামূলক সংসদীয় গণতন্ত্রের (competitive democracy) আবহে, যা এখন ক্রমশই জনপ্রিয়তাবাদী (populist) রাজনীতির দিকে সরে যাচ্ছে, তার সঙ্গে বামপন্থীদেরও পাল্লা দিতে হবে বৈকি। কেরালার দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, ১) ওদের বিরোধী দলকে নিয়ে চলার ক্ষমতা, ২) সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের পথে হেঁটে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে জোরদার করা ও পার্টিতন্ত্র তৈরি হতে না দেওয়া এবং ৩) কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল ভাবনার মধ্যে বামপন্থাকে খোঁজার চেষ্টা রয়েছে। তাই কেরালা ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটেনি।
পশ্চিমবঙ্গেও সংসদীয় গণতন্ত্রের নিজস্ব শর্ত মেনে বামপন্থীদেরও এখন সংসদের ভিতরে ও বাইরে সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়ার আন্দোলনকে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, বামপন্থা কোনোস্থবির চিন্তার ফসল হয়ে থাকতে পারে না। তাকে নিয়ত উদ্ভাবনের মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে পালটাতে প্রস্তুত থাকতে হয়। এই মুহূর্তে বিপ্লবের স্বপ্ন ফেরি করার বদলে সাধারণ মানুষের আশু সমস্যার সমাধান কী ভাবে করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে বামপন্থীরা দিশা দেখাতে পারে। যেমন, গত ৩০ বছর ধরে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আবহে শিল্পক্ষেত্রে "হায়ার অ্যান্ড ফায়ার" নীতি বলবৎ হয়ে গেছে। অধুনা শ্রম আইন সংস্কার করে সেটাকেই সরকার সিলমোহর দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু ছাঁটাই শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা নীতিকে ভালভাবে বলবৎ করার জন্যেও সরকারের উপর চাপ বাড়াতে হবে। সেই চাপ বাড়াতে শুধুই চিৎকার না করে একটা সুসঙ্গত সামাজিক সুরক্ষা নীতির খসড়া তৈরি করে জনমত গঠনের কাজ শুরু করতে পারলে ভালো হয়। বিশেষ করে দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিকই যখন অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত হওয়ার কারণে সামাজিক সুরক্ষার ন্যূনতম সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। মুশকিল হল, বামপন্থীদের মধ্যে শিকড় গেড়ে রয়েছে একটা ধারণা যে এই সব কাজ সংস্কারবাদী চিন্তার ফসল, তাই পরিত্যাজ্য। বামপন্থীরা যে হেতু ভবিষ্যতের দিকে (বিপ্লবের দিকে) তাকিয়ে চলে, তাই তাদের কাছে এ সবের গুরুত্ব নেই। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৮৮ সালে ১ মে সংবাদপত্রে প্রকাশ করার লক্ষ্যে বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকদের জন্য একটা তহবিল গড়ার ভাবনা সম্পর্কে বামপন্থীদের প্রতিক্রিয়া চাওয়া হয়। ছোট বাম দলের নেতা যতীন চক্রবর্তী এক বাক্যে সাড়া দিলেন। কিন্তু সিপিএমের বিধায়ক এবং প্রতিষ্ঠিত নেতাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি তীব্র ব্যঙ্গ করে জানিয়ে দেন যে এ সব সংস্কারবাদী চিন্তা নিয়ে তিনি সময় নষ্ট করতে আগ্রহী নন। তার তিন বছর পরে ১৯৯১ সালের বাজেটে (নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ছায়ায় তৈরি) মনমোহন সিংহ বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকদের জন্য জাতীয় পুনরুজ্জীবন তহবিল (Natinal Renewal Fund) গঠন করে প্রথম বছরের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। বাজেট ভাষণে বলা হয়, ওই টাকায় কাজ হারানো শ্রমিকদের Re-training এবং Re-deployment করা হবে। বাস্তবে অবশ্য তা হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের কিছু বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ভিআরএস দিয়ে বিদায় করতে ওই টাকা খরচ হয়েছিল। আরও নজির দিয়ে লাভ নেই। শুধু এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে পুরনো বুলির মাছি না তাড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতির দিকে খোলা চোথে তাকাতে হবে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার দোহাই দিয়ে দলের মধ্য থেকে উঠে আসা সমালোচনা ও বিরোধী কন্ঠস্বরকে শৃঙ্খলাভঙ্গের নোটিশ ধরানোর বদলে আলোচনার মধ্যে টেনে আনতে পারলে তবে পথের দিশা দেখা দিতে পারে। অন্যথা, নয়।