আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ এক নয়া সন্ধিক্ষণে

গৌতম লাহিড়ী


১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রমনা-অধুনা সুরাবর্দী ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আমীর আবদুল্লা খান নিয়াজী প্রায় লক্ষ ফৌজি নিয়ে ভারতের জেনারেল জগজিত সিং অরোরা এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই দিনটিই বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ২০২০ সালের দিনটি মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তি। একই সঙ্গে এই বর্ষটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। বিশ্বের ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ বলে তাঁকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন বাংলাদেশিরা। এমনই বিজয়ের মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মূর্তি (ভাস্কর্য) কুষ্ঠিয়ায় ভেঙে দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যেখানে যেখানে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি রয়েছে সেসব এখন সশস্ত্র পুলিশ প্রহরায়। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের বিজয়ের মাসে দেখতে হল। ভাবা যায়!

এটা নিছক মূর্তির উপর আক্রমণ নয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে কুঠারাঘাত। বঙ্গবন্ধু ধর্মপ্রাণ হলেও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠনের মধ্যেই ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজ স্বর্ণজয়ন্তীতে সেই স্বপ্নভঙ্গ করার ষড়যন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশে। কেবলমাত্র শোষক পাকিস্তান শাসকের কব্জা থেকে পূর্বপাকিস্তানকে পৃথক করাই বঙ্গবন্ধুর একমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। মৌলবাদী চিন্তা থেকে বাঙালি সমাজকে উদারনৈতিক সুফি ইসলাম দর্শনের রাষ্ট্রে রূপান্তিরত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। যে দর্শন লালনপালন করতেন রবীন্দ্রনাথ - লালন ফকিরেরা। আজ পঞ্চাশ বছর পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সার্বিক উন্নয়ন বিশ্বের বিস্ময়। আজ পুনরায় ‘প্রথমে বাঙালি-পরে মুসলমান’ বনাম ‘ইসলাম বাঙ্গালি’র দ্বন্দ্বের সংঘাতের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ।

প্রশ্ন হল কেন কুষ্ঠিয়াকেই বেছে নিল ধর্মান্ধরা? এই কুষ্ঠিয়ার শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির স্থান। লালন ফকিরের ভিটে। চিরন্তনী সাহিত্য ‘বিষাদ সিন্ধুর’ রচয়িতা সৈয়দ মীর মোশারেফ হোসেনের জন্মভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট কুষ্ঠিয়ায় নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে দখল করে। তারপর মুক্তিবাহিনী এপ্রিল মাসে সেই বাহিনীকে পরাস্ত করে পুর্নদখল করে কুষ্ঠিয়া। এখানকার বৈদ্যনাথতলায় প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাসিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। যার নাম পরে হয় মুজিবনগর।

কুষ্ঠিয়া শহরের পাঁচ মাথার সংযোগস্থলে নির্মিয়মান বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ৫ ডিসেম্বর ভোররাতে মুসলিম মৌলবাদীরা ভেঙ্গে ফেলে। যশোরের ভাস্কর মাহবুব জামাল শামীম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের রমনা ময়দানে প্রদত্ত ভাষণের মেজাজ - ভঙ্গির ভাবনাকেই পাথেয় করে রূপকল্প তৈরি করেন। রমনা ময়দানে দশলক্ষেরও বেশি জমায়েতে জলদগম্ভীর কন্ঠে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন - ‘এ সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এ সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ফলে এই মূর্তির উপর আক্রমণ বাংলাদেশ সৃষ্টির উপর আক্রমণ।

কুষ্ঠিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই এর পরিকল্পনা চলছিল এবং প্রকাশ্যে। গোপনে নয়। ২৪ ঘন্টা আগেই ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ের প্রবাদপ্রতিম ‘মধুদার’ মূর্তির একাংশ ভেঙে ফেলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা আন্দোলনের সময়ে এই ক্যান্টিনেই জমায়েত হত মুজিবুর রহমান সহ ভাষা আন্দোলনের ছাত্র নেতাদের। মধুসূদন দের নামাঙ্কিত ক্যান্টিনের পাশেই ভাস্কর তৌফিক হোসেন মুখাবয়ব তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর ‘অপারেশান সার্চলাইট’ অপারেশানের সময়ে মধুদাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। আজও মধুদার ক্যান্টিন বাংলাদেশের প্রাণ।

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ঢাকার দোলাইপারের চকে বঙ্গবন্ধুর এক বিশাল মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। গত অক্টোবর মাসেই বেশ কয়েকটি ইসলামিক সংস্থা এই মূর্তি স্থাপনের বিরোধিতা শুরু করে। এঁদের যুক্তি ইসলামে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ। এঁদের বোঝানো হয় পূজার জন্য মূর্তি হয়। এটা হবে ভাস্কর্ষ। পূজার জন্য নয়। এতেও সন্তুষ্ট নয় এইসব মৌলবীরা। ইসলামিক সংগঠন হেফাজত ইসলামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মূর্তি প্রতিষ্ঠার আপত্তি করে। হেফাজত সহ আরো কয়েকটি ইসলামিক সংস্থার মিলিত সংগঠন খিলাফৎ মজলিস এতে সুর মেলায়। মৌলবাদী এই দক্ষিণপন্থী ইসলামিক নেতা মামুনুল হক ঘোষণা করে যদি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে তারা সেই মূর্তি উচ্ছেদ করে বুড়িগঙ্গার জলে ফেলে দেবে। এরপর হেফাজতের নবনির্বাচিত ‘আমীর’ জুনেদ বাবুনগারি তাকে সমর্থন করে হুমকি দেয়, ঢাকা সহ সব শহর থেকে সব ধরণের মূর্তি হঠাতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামিক সংগঠনের প্রভাব রয়েছে। আওয়ামি লিগের প্রতিদ্ধন্দ্বি বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি-র রাজনৈতিক শরিক ছিল উগ্রবাদী জামায়েত-এ-ইসলামি। যারা পাকিস্তানের সমর্থক। বাংলাদেশ সৃষ্টিকে কখনই মেনে নেয়নি। এদের বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি কেড়ে নেয় ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে। পাছে ইসলামিক সংগঠনগুলি শেখ হাসিনার বিরোধি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক রণকৌশল হিসাবে আওয়ামি লীগ গোপনে সমঝোতা করে ফেলে হেফাজত ইসলাম নামে আরেক ইসলামিক সংগঠনের সঙ্গে। চট্টগ্রামের এই সংগঠনের সঙ্গে একদা জামায়েতের সম্পর্ক ছিল। এটা আওয়ামি লীগের নেতারাই বলতেন। এর আগে ২০১৩ সালে শাহবাগের ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত যখন মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সর্ম্পূণ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার তখনই এই হেফাজত আন্দোলন গড়ে তোলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য।

রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে শেখ হাসিনা এদের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেন। এমনকি হেফাজতের বিশাল জমায়েতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ভাষণ দেন। এরাই ২০১৭-তে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ন্যায় বিচারের গ্রীক দেবী থেমিসের মূর্তি হঠানোর দাবিতে আন্দোলন করার পর সেই মূর্তি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় হাসিনা সরকার। ধীরে ধীরে এরা হাসিনা সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে থাকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি-তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটিও নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। পাঠ্যপুস্তকে ‘ইসলাম বিরোধী’ বলে বিষয় বাদ দেওয়া হতে থাকে। শেখ হাসিনা সরকার কৌমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে স্নাতক ডিগ্রির মর্যাদা দেন। সেই ডিগ্রিধারীরা বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনে সমমর্যাদায় নিযুক্ত হয়। পরিবের্ত এরা হাসিনাকে ‘কৌম মাতা’ আখ্যা দেয়।

এবার এরা যখন একেবারে শিয়রে চেপে বসতে চাইছে তখন শেখ হাসিনাকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে। স্বস্তির কথা হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি এক বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে আওয়ামি লীগ বিচ্যুত হবে না। আজ বাংলাদেশ আবার এক আদর্শগত মুক্তিযুদ্ধের সন্ধিক্ষণে। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠার পরে পুলিশ কুষ্ঠিয়ার স্থানীয় মাদ্রাসার মৌলবী শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেফতার করে। এদের বয়স ১৯-২৭। এরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, হেফাজত নেতাদের মূর্তি বিরোধি উসকানিতে উৎসাহিত হয়েই ভাস্কর্য ভেঙেছে।

এরপরে দেশের প্রধান মৌলবী বা আলেমরা ঢাকার যাত্রাবাড়িতে এক বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন। শর্ত হলো - আল্লাহর ৯৯ টি নাম খচিত মিনার তৈরি করে দিতে হবে। এখনও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় দেননি। ইতিমধ্যে এদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা মঞ্চ দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করে সংঘাত প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। আবার এক মেরুকরণের পথে বাংলাদেশ। ঢাকার আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার অভিযোগে তদন্ত করতে। পরবর্তী শুনানির দিন স্থির হয়েছে জানুয়ারি মাসে।

কাকতালীয় হলেও ঠিক যে সময়ে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সার্বিক উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে, তখন এই মৌলবাদী হামলা নিশ্চিতভাবে অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। এদের এই হামলার নেপথ্যে কতটা ইসলামিক দর্শন কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। হামলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর মূর্তির উপর। ইসলামের দোহাই দিয়ে। অথচ বিশ্বের অন্য ইসলামিক রাষ্ট্রে বহু মূর্তি রয়েছে, সেসব দেশের মূদ্রায় প্রতিকৃতি রয়েছে তাই নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগে ইবন বতুতা, আল্ বেরুনির মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের মিউজিয়াম। যেখানে জেনারেলের দন্ডায়মান বিশাল মূর্তি রয়েছে। সেখানে কেন কোনো হামলা হচ্ছে না? হামলা বঙ্গবন্ধুর উপর। এটাই কি রাজনৈতিক গেমপ্ল্যানের গূঢ় রহস্য নয়?

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশ যখন সবে গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখনই বঙ্গবন্ধুর হত্যা। তারপর দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাস। ১৯ বার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে শেষ ১৫ বছরে। এখনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির শিকড় গভীর হয়নি। তারমধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্প উন্নত দেশের তকমা কাটিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা আগামী ২০ বছর অর্থাৎ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করা। এই যাত্রা শুরু ২০২১ সাল থেকে।

আপাতভাবে মনে হতে পারে এই ঘোষণা এক রাজনৈতিক নেত্রীর কল্পবিলাস। আগামী বিশ বছরের নীলনকশা তিনি তৈরি করেছেন। তিনি দীর্ঘায়ু হন - এটাই সকলের কামনা। কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম। এখন তার বয়স ৭৩। ফলে তাঁকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এখন থেকেই তৈরি করে যেতে হবে। তার ভাবনা নিশ্চয় রয়েছে। কে হবেন উত্তরসূরী? এই নিয়ে জল্পনা রয়েছে। কিছুদিন আগে ভয়েস অব আমেরিকায় এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেছিলেন - এবার তিনি অবসর নিতে চান। তাই নিয়ে ঢাকায় শোকবিহ্বলতা দেখে তিনি নিজেই মন পরিবর্তন করেন। এটা অনস্বীকার্য - বাংলাদেশের অর্ন্তনিহিত দর্শন এবং ভবিষ্যত নেতৃত্বের উন্মেষের এক সন্ধিক্ষণে। তাই হয়তো এক অভ্যন্তরীণ মন্থনের মধ্যে রয়েছে বাঙালি সমাজ-জনগোষ্ঠী। এক নতুন বাংলাদেশের উত্থানের মুখোমুখি এই উপমহাদেশ। বাংলাদেশ আবার একাত্তর পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে নাকি ২০২১ থেকে নয়া উত্থানের পথে এগোবে। সেই সন্ধিক্ষণে আমরাও সকলেই।