আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ওরা বনাম আমরাঃ কৃষক আন্দোলন

ইমানুল হক


মাটি ছাড়া মানুষ বাঁচে না। কাদা না ধান হবেই না। তবু কাদা আর মাটি আমাদের আর্যম্মন্য ঔপনিবেশিক শিক্ষার কল্যাণে নেতিবাচক শব্দ। চাষা তো ব্যঙ্গাত্মক। আশায় বাঁচে চাষা। হরহামেশা লেখে লোকে। অথচ হওয়া উচিত ছিল, চাষায় বাঁচে আশা।কল্পনা করুন, একটা বিশাল আরামদায়ক প্রেক্ষাগৃহে আপনাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেখানে সব নরম এবং গরম পানীয়ের ব্যবস্থা আছে। এটিএম আছে। ডলার ইউরোও তোলা যাবে ইচ্ছা মতো। আপনার পছন্দের সব নায়ক নায়িকা হাজির। অনুষ্ঠান করছে। আড্ডাও দিচ্ছে আপনার সঙ্গে। আপনার পছন্দের সব নেতা নেত্রীও হাজির। টিভি আছে। সিনেমা আছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক অঢেল।একমাস থাকতে পারবেন।ঘরও আছে। ইচ্ছে হলে বান্ধবী বা স্ত্রী পরিবার পরিজন নিয়ে।সব পাবেন।শুধু কোনো খাবার পাবেন না।

একমাস পরে কোনো নায়ক নায়িকা সুপার মডেল - কেউ বেঁচে থাকবেন? থাকলেও হাড় জিরজিরে হয়ে যাবেন। কেউ ফিরেও তাকাবেন না।

আমাদের এই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। চাষা বলে অপমান নয়, চাষিরা হচ্ছেন অন্নদাতা। আমরা শহুরে চাকুরিজীবীরা কার্যত পরশ্রমভোগী। আমাদের দায় আছে এইঅন্নদাতাদের পাশে দাঁড়ানোর।

২০১৪তে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রতি হাতে কাজ প্রতি খেতে জল, ২৫% করে দাম কমবে, কৃষকের আয় ৫ বছরে দ্বিগুণ হবে, সবার মাথার উপরে ছাদ, প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ, দুর্নীতিমুক্ত ভারত, ১৫ লাখ টাকা করে কালা ধন ফিরবে। কালাধন ফেরে নি। কালাকানুন বেড়েছে। মানুষের নাগরিকত্ব কাড়া হচ্ছে। আসামে ডিটেনশন ক্যাম্পে বহু গরিব মানুষ। ১৯ লাখ নাগরিকত্বহীন। এর মধ্যে ১৪ লাখ বাঙালি হিন্দু, তিন লাখ অবাঙালি হিন্দু, দুই লাখ বাঙালি মুসলিম।

জিনিসের দাম ২০১৪-র তুলনায় তিন-চারগুণ বেড়েছে। চাল ডাল আটা নুন সর্ষে তেল মশলা পেঁয়াছ সব্জি - সবকিছুর দাম হাতের নাগালের বাইরে। সর্ষের তেল ছিল ৫৫-৬০ টাকা হয়েছে ১৫০-৬০ টাকা। ডাল ছিল ৫৫ টাকা এখন ১২০ টাকা। আটা ১৮ থেকে বেড়ে ৩২-৩৬ টাকা। পেঁয়াজ ১০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা। চালের দাম কিলো প্রতি ১০-২০ টাকা বেড়েছে। অথচ কৃষকের আয় বাড়েনি। ২০১৯-এ মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষি পাঁচ পয়সা কিলো দরে পেঁয়াজ বেচতে বাধ্য হন। (সূত্রঃ আনন্দবাজার ১৪.১.২০১৯)। সেই পেঁয়াজ ২০১৯ এর ডিসেম্বরে মানুষ ১৮০-২০০ টাকা কেজি দরে কেনেন। এ-বছর আলু ফলন ভালো। চাষি বেচেছেন ৩-৫ টাকা দরে। কদিন আগে কিনতে হলো ৪৫-৪৮ টাকা দরে। ২০১৬-র নোটবন্দি পরে জিএসটি এবং পরে লক ডাউনের কারণে ১৪ কোটি মানুষ কাজহীন। যাঁদের কাজ আছে, তাঁদের কম পয়সায় কাজ করতে হচ্ছে। নতুন শ্রম আইনে ১২ ঘন্টা কাজ করতে হবে। কাজের গ্যারান্টি নাই যখন খুশি ছাঁটাই। প্রভিডেন্ট ফান্ড পেনশন নাই। সুদের হার কমছে ব্যাঙ্কে স্বল্পসঞ্চয়ে। অথচ ওষুধ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম বাড়ছে।

আমেরিকার ট্রাম্প সরকার পর্যন্ত ১২ হাজার ডলার নয় লাখ টাকা করে ভর্তুকি দিয়েছে প্রতি পরিবারকে। আমাদের এখানে মোদি সরকার এক টাকাও দেয় নি। চাল দিয়েছে অল্প। ডাল দেয় নি। শ্রমিকদের ৫০০ থেকে ১৫০০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে। রেললাইনে কাটা পড়ে মরতে হয়েছে। নির্মম সরকার ধনীর ছেলেমেয়েদের বিনাপয়সায় এনেছে শ্রমিকদের হাঁটিয়েছে। লাঠি পেটা করেছে। কুকুরের মতো হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছে।

করোনকালে কুপরিকল্পিত লক ডাউন ডেকেছে। আর বাণী দিয়েছে। শুধু কথা। কাজ নাই।উলটে সংসদে প্রশ্ন করতে না দিয়ে ৩০ টি আইন এনেছে প্রত্যেকটি মানুষের বেঁচে থাকার পরিপন্থী। যাঁরাই সামান্য প্রতিবাদ করেছেন জেলে পুরেছে। হিন্দু-মুসলমান, পাকিস্তান, কাশ্মীর আওড়ে লোককে ভোলাতে চাইছে।

সংসদে রাতের অন্ধকারে গায়ের জোরে মার্শাল ডেকে কাগজে ভোট না করে, মাইক বন্ধ করে গণনায় জালিয়াতি করে রাজ্যসভায় বিল কৃষি বিল পাস করেছে। পাঞ্জাবের কৃষকরা রাস্তায় নামায় পাঞ্জাবে খাদ্যসামগ্রী বোঝাই মালগাড়ি পাঠায় নি। ২৬ নভেম্বর ২০২০ শ্রমিক বিরোধী নতুন শ্রম আইন, কৃষক বিরোধী নতুন কৃষি আইন, কৃষক ও ক্রেতাবিরোধী নতুন পণ্য ও চুক্তি আইন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বদল, মাশুল বৃদ্ধিকারী নতুন বিদ্যুৎ আইন বাতিলের দাবিতে ভারত জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট হয়‌। সেদিনই পাঞ্জাব থেকে লাখ লাখ কৃষক দিল্লি অভিযান শুরু করেন।

কৃষকরা অন্নদাতা। তাঁদের প্রণাম করবে সংবর্ধনা দেবে, সম্মান দেবে - তা নয় টিয়ার গ্যাস ফাটিয়ে, লাঠিচার্জ করে, ব্যারিকেড দিয়ে, জলকামান ছুঁড়ে অত্যাচার করেছে দেশের সবচেয়ে বড় লুঠেরা পরিবার সঙ্ঘ পরিবারের সরকারের পুলিশ।২৬ নভেম্বর থেকে প্রবল শীতে লাখ লাখ কৃষক, কৃষক রমণী, এমনকি শিশুও পথে। ছয় মাসের খাবার সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছেন। ৬ বার বৈঠক করেছে সরকার। আন্দোলনে ভাঙন ধরাতে চেয়েছে। পারে নি।‌ কৃষকরা মৌনব্রতের নতুন সংজ্ঞা শিখিয়েছে দেশকে। ইয়েস অর নো - লেখা পোস্টার নিয়ে গেছেন বৈঠকে। অমিত শাহ এক কাগুজে বাঘ। গোদি মিডিয়া তাঁকে চাণক্য বলেছে। ব্যর্থ তিনিও। গায়ের জোরে পয়সার জোরে সব হয় না।

চাষিরা শ্লোগান তুলেছে - বয়কট আদানি আম্বানি। জিও সিম থেকে শুরু করে সব পণ্য, পেট্রোল পাম্প, মিডিয়া - বয়কট।

কৃষকরা বুঝেছেনদেশের সরকার আর জনগণের চৌকিদার নয়, আদানি আম্বানিসহ লুঠেরা কর্পোরেটৈর পাহারাদার।সবার আয় কমেছে। আদানি আম্বানির আয় বেড়েছে ৭৩%।এশিয়ার সবচেয়ে বড় ধনী এখন আম্বানি।আদানি আম্বানির কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের টিকি বাঁধা।অত্যাবশ্যক পণ্য আইনে চাষি মরবেন, মরবেন ক্রেতাও। কমদামে কৃষিপণ্য কিনে যা খুশি দামে বেচবে। কারণ সরকারের নতুন আইনে সহায়ক মূল্য নাই। আবার মজুত করার একটা সীমাছিল। নতুন আইনে তা নাই। ইচ্ছে মতো মজুত করে ইচ্ছে মতো দাম বাড়াবে।পেট্রল ডিজেলকে সরকারি বিধিমুক্ত করে বলেছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে এখানেও কমবে। বিশ্ববাজারে বিনাপয়সায় তেল পাওয়া গেলেও এখানে তেলের দাম ৮৫-৯০ টাকা। ২৩ টাকা কর ছিল আগে। এখন ৬০ টাকা।

লোকে না খেয়ে মরছে। মোদির ফূর্তির জন্য ৮৪০০ কোটি টাকায় বিমান কিনেছে। ৯০০ কোটি দিয়ে নতুন বাসভবন বানাচ্ছে। ২০ হাজার কোটি দিয়ে দিল্লি সাজাচ্ছে। অথচ চাষি ও ক্রেতার বেলায় ভর্তুকি নাই। তেল গ্যাসের দাম বাড়ছে। অধিকাংশ লোকাল ট্রেন বন্ধ। স্পেশাল বানিয়ে ভাড়া বাড়াচ্ছে। সরকারি ব্যাঙ্ক তুলে কর্পোরেট ব্যাঙ্ক আনছে।

সবার জন্য এই প্রবল ঠান্ডায় অন্নদাতারা দিল্লির রাস্তায়।‌ তাঁদের সমর্থনে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ থেকে কৃষকেরা দলে দলে যাচ্ছেন। টাকা পাঠাচ্ছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী দুই রাজ্য - পাঞ্জাব ও বাংলা। আজ পাঞ্জাব বীর লড়াকু ভূমিকা পালন করছে।আমাদেরও করতে হবে। খুচরো ব্যবসা, সব্জি ব্যবসা, জমি তথা কৃষিক্ষেত্র, রেল, পরিবহণ, বিদ্যুৎক্ষেত্র, বিমানবন্দর, কৃষিক্ষেত্র, ব্যাঙ্ক, বীমা - সব আদানি আম্বানি ও কর্পোরেটকে বেচে দিচ্ছে। মানুষের জীবন জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে। নীল চাষের মতো চুক্তি চাষ চালু করতে চাইছে। মানুষকে না খাইয়ে মারার ও দাস বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরা হচ্ছে। মিথ্যের বন্যায় দেশ ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আত্যহত্যা বাড়ছে। বাড়ছে বেকারি ও তীব্র মন্দা।

দেশের জিডিপি মাইনাস ২৩.৯%।গরিব মানুষকে মাসে ৭৫০০ টাকা করে দিচ্ছে না। অথচ এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা আদানি আম্বানিদের করছাড় দিচ্ছে। সাধারণ মধ্যবিত্তের আয় ১০ লাখ ছাড়ালে কর ৩০% আদানি আম্বানিদের ২২%। আদানি আম্বানি কর্পোরেটদের ছয় লাখ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করেছে। সেই টাকায় দেশের সমস্ত অল্প আয়ের পরিবারকে মাসে ৭৫০০ করে টাকা দেওয়া যেতো। এতে বাজারে চাহিদা বাড়তো।‌শিল্পোৎপাদন বাড়তো। নতুন কারখানা খুলতো। বেকাররা চাকরি পেতো। ১৪ কোটি কাজহারা মানুষ কাজ ফিরে পেতো।দেশের ঋণ বাড়িয়েছে বিলাসিতা করে, বিদেশ ভ্রমণ করে, আদানি আম্বানিদের তোষণ করে। দেশের ঋণ ৪৯ হাজার কোটি ছিল ২০১৪ তে। এখন এক লাখ এক হাজার কোটি টাকার বেশি।দেশ বেচে দিচ্ছে আদানি আম্বানিদের কাছে।

এর বিরুদ্ধে নিজেদের স্বার্থেই রুখে দাঁড়াতে হবে।ধর্মের চেয়ে পেট বড়।ধর্মের চেয়ে মানবিকতা বড়।বিদ্বেষের চেয়ে ভালোবাসা বড়।ভীরু কাপুরুষের মতো ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে প্রতিবাদ করে লড়াই করে মরা ভালো।চলুন, প্রতিবাদ করি।

ওরা যা চায় ।।

এক দেশ এক সংস্কৃতি ।। মনুবাদী
এক দেশ এক ভাষা ।। হিন্দি
এক দেশ এক দল ।। বিজেপি
এক দেশ এক ধর্ম ।। মনুবাদ
এক দেশ এক নেতা ।। মোদি/...
এক দেশ এক খাদ্য ।। নিরামিষ
এক দেশ এক বাজার ।। আদানি, আম্বানির
এক দেশ এক বক্তা ।। মোদি/...
এক দেশ এক সিম ।। জিও
এক দেশ এক আইন ।। এক দল বা অতি ধনীর


দাবি তুলতেই হবেঃ

১। নতুন নীলকর আইন/ চুক্তিচাষ ও কৃষি খামার পরিষেবা আইন বাতিল করতে হবে।
২। কৃষিপণ্যের বাণিজ্যসংক্রান্ত কৃষি ও কৃষক বিরোধী আইন বাতিল করতে হবে।
৩। অত্যবশ্যকীয় পণ্য সংশোধনী আইন বাতিল করতে হবে।
৪। বিদ্যুৎ মাশুল বৃদ্ধিকারী নতুন বিদ্যুৎ আইন বাতিল করতে হবে।
৫। কৃষি ও খুচরো বিপণনক্ষেত্রে পরিবহণ ব্যাঙ্ক বীমা রেল বিমানবন্দর ওষুধ শিক্ষা স্বাস্থ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার মতো কোম্পানি রাজ চালু করা চলবে না।


একনজরে কৃষি আইনের সর্বনাশা কয়েকটি দিক -
১) আইনটি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার আগে দেশের সমস্ত কৃষক সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা হয়নি। অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
২) কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উল্লেখ নেই।
৩) মজুতদারিকে আইনসম্মত করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে মজুতদার-কালোবাজারিরা দাম বাড়াবে।
৪) কোনও পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হলেও সরকার হস্তক্ষেপ করবে না।
৫) চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনও প্রভাব থাকবে না। কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছেমতো চলবে।
৬) দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকা নেই। অ্যাপিলেট অথরিটির নিচের স্তরে থাকবেন মহকুমা শাসক, তার উপর থাকবেন জেলাশাসক।
৭) কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলাশাসক ও মহকুমা শাসকদের, রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক।
৮) নিরক্ষর, প্রায় নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত চাষির পক্ষে তো বটেই, উচ্চশিক্ষিত আইনজ্ঞ নন, এমন মানুষের পক্ষেও চুক্তি মুসাবিদা করা, চুক্তিতে উল্লিখিত শর্ত ও ধারাগুলি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সংস্থার পক্ষে আইনজ্ঞ নিয়োগ সম্ভব। কিন্তু চাষির সেই সাহায্য প্রয়োজন হলেও সামর্থ্যে কুলোবে না। ফলে চুক্তিচাষজনিত বিবাদের মীমাংসায় চাষিরা ন্যায় বিচার পাবে না।
৯) ভারতে কৃষি এখনও অনেকাংশে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বন্যা, খরা, কীটের উৎপাত কিংবা পতঙ্গের হামলায় ফসল যদি মাঠেই নষ্ট হয়, তখন কৃষককে চুক্তিভঙ্গকারী বলার সম্ভাবনা থাকছে।
১০) বিচারে চুক্তিভঙ্গকারী সাব্যস্ত হলে ফসল হারানো কৃষক ক্ষতিপূরণ দেবে কোথা থেকে?
১১) চাষি ও ক্রেতা সংস্থা উভয়ের তরফেই বিমা প্রয়োজন হবে। এইসব বাবদ ব্যয় হবে যেমন বাণিজ্যিক ক্রেতার, তেমনই চাষির। এই ব্যয় নিশ্চয়ই ফসলের দামে যুক্ত হবে এবং বাজারে ফসলের দাম বাড়াবে।
১২) চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে বিচারে আইনজ্ঞের সাহায্য লাগবে। অর্থবলে বলীয়ান বাণিজ্যিক সংস্থা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। ফলে চাষি ন্যায় বিচার পাবে না।
১৩) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি ৮৬ শতাংশ। তাদের হাতে জমি ৪৭ শতাংশ। ১৪ শতাংশ চাষির হাতে আছে বাকি ৫৩ শতাংশ জমি। এই ৮৬ শতাংশ চাষি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক এবং এঁরাই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এঁদের কী পরিণতি হবে?
১৪) যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি এবং মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই সরকার মজুতদারি এবং দাম নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করবে বলেছে। আজ মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক হলেও হস্তক্ষেপ করছে কোথায়?
১৫) স্বয়ং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী করোনার তাণ্ডবকে আখ্যা দিয়েছেন ‘দৈব দুর্বিপাক’। এটা কি অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়?
১৬) আইনের কোনও না কোনও ফাঁকে ঋণগ্রস্ত অসহায় কৃষকের জমি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলিও কুক্ষিগত করবে।
১৭) এই আইনের ফলে ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়বে। মুষ্টিমেয়ের জোতের পরিমাণ বাড়বে। অসংখ্য ছোট চাষির সঙ্গে চুক্তি করার চেয়ে অল্প সংখ্যক বড় চাষির সঙ্গে চুক্তি করলে পরিশ্রম কমে, খরচ কমে, মুনাফা বাড়ে। আইন কর্পোরেটদের সেই সুবিধা করে দেবে।
১৮) ভারতে কৃষি উৎপাদন উদ্বৃত্ত। তা সত্ত্বেও দেশে এখনও ২৭ কোটি ক্ষুধার্ত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ক্ষুধা সমস্যার সমাধানে ১১৭ দেশের মধ্যে ভারত ১০৩ নম্বর দেশ। উদ্বৃত্ত শস্য ক্ষুধা-সমস্যা সমাধানে ব্যবহারের কোনও দিশা নেই।
১৯) দেশে মাথাপিছু খাদ্যশস্যপ্রাপ্তির নিরিখে ১৯৪৮ সালের তুলনায় বর্তমানে কোনও অগ্রগতি ঘটেনি, বরং ১৯৯১ সালের তুলনায় মাথাপিছু খাদ্যশস্যপ্রাপ্তি কমেছে।
২০) সাধারণ মানুষের পুষ্টির তিন-চতুর্থাংশ আসে চাল-গম-বাজরা ইত্যাদি খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন ডাল থেকে। সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইনে আর অত্যাবশ্যক নয়।



______________________________
(সূত্রঃ ডিজিটাল গণদাবী - ৭৩ বর্ষ ১২ সংখ্যা; ১১ ডিসেম্বর, ২০২০)