আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

সমসাময়িক

মোদী-মিত্রদের পৌষ মাস, জনতার সর্বনাশ


আজ থেকে ঠিক নয় মাস আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী আচমকা চার ঘন্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করে দিলেন। গোটা দেশ স্তব্ধ, অর্থব্যবস্থার রথের চাকা বন্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার, ক্ষুধার্ত। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা যারা এতদিন ছিলেন অশরীরি - পরিযায়ী শ্রমিক। দেশভাগের পরে এত বড় পরিযান ভারতের মানুষ আর দেখেনি। কিন্তু সরকার নির্বিকার। দাঁড়ি বাড়িয়ে আত্মনির্ভর হওয়ার আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই নয় মাসে দেশের কী হাল হল?

সরকারী তথ্যের দিকে আগে তাকানো যাক। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিল। অর্থব্যবস্থা ২৪ শতাংশ সঙ্কুচিত হল। পৃথিবীর সমস্ত দেশের মধ্যে ভারতে অর্থনৈতিক সংকোচনের হার সর্বোচ্চ। কিন্তু সরকার নির্বিকার। বলা হল দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থব্যবস্থা নাকি ঘুরে দাঁড়াবে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের ফলাফল বেরোলে দেখা গেল আবারো অর্থব্যবস্থা সংকুচিত হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। কিন্তু যেহেতু তা প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনায় বেশি, অতএব সরকার এবং তার পোষ্য সাংবাদিক এবং অর্থনীতিবিদরা গদগদ হয়ে বলতে শুরু করে দিলেন, অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সত্যিই কি তাই?

অর্থব্যবস্থার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-কে বলা যেতে পারে কিছু সমষ্টির যোগফল - দেশে মোট বিনিয়োগ, মোট ভোগ্যপণ্যের উপর খরচ, সরকারী খরচ, রপ্তানি। এর থেকে আমাদানিকে বাদ দিলেই আমরা মোট জিডিপি-তে উপনীত হব। ২০২০-২১ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে জিডিপি-র অনুপাতে মোট বিনিয়োগ বাড়েনি। মোট ভোগ্যপণ্যে খরচ এবং জিডিপি-র অনুপাত কমেছে। অর্থাৎ, ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২০২০-২১ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভোগ্যপণ্যে মোট ব্যয় কমেছে জিডিপি-র সংকোচনের থেকেও বেশি। এই প্রবণতা স্বাভাবিক নয়। আপনার যদি আয় কমে, তাহলে আপনার সংসার খরচ আয়ের থেকে বেশি কমবে না, কারণ সঞ্চিত অর্থ খরচ করে আপনি আগে যা সংসার খরচ ছিল সেই পরিমাণ ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। অর্থাৎ, এক বিশাল সংখ্যক মানুষ আগের তুলনায় কম খরচ করছেন ভোগ্যপণ্যে, যার মধ্যে খাদ্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধুমাত্র এই তথ্য থেকেই বলা যেতে পারে যে অংকের হিসেবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থব্যবস্থার সংকোচনের হারে কিছু উন্নতি হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে সমস্যার কোনো নিরসন হয়নি।

মানুষের সমস্যার যে বিশেষ কোনো সুরাহা হয়নি তা প্রমাণ করার জন্য আপাতত দুটি তথ্য দাখিল করা যেতে পারে। প্রথমত, বেসরকারী সংস্থা CMIE যারা ভারতে একমাত্র মাসিক কর্মসংস্থানের সমীক্ষা করে হিসেব প্রকাশ করে, তারা জানাচ্ছে যে অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে দেশে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কমেছে। অক্টোবর মাসে কাজ হারিয়েছেন ৬ লক্ষ মানুষ, নভেম্বর মাসে যা বেড়ে হয়েছে ৩৫ লক্ষ। অর্থাৎ, বিগত দুই মাসে দেশে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ৪১ লক্ষ মানুষ। দ্বিতীয় তথ্যটি এই সমস্যার গভীরতাকে আরো বেশি প্রকট করে। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের পক্ষে লকডাউনের ৬-৭ মাস পরে ১১টি রাজ্যের ৪০০০ সামাজিকভাবে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ চাল খাচ্ছেন আগের থেকে ২৫ শতাংশ কম। ৬৪ শতাংশ মানুষ আগের তুলনায় অনেক কম ডাল খাচ্ছেন এবং ৭৩ শতাংশ মানুষ আগের তুলনায় সবজি খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যারা আমীষ তাদের মধ্যে ৭১ শতাংশ ডিম বা মাংস খেতে অপারগ। ৫৬ শতাংশ মানুষ এখনও কোনো আয় করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে যারা অর্থব্যবস্থার ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলছেন তাঁরা মানুষকে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন অথবা তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বসবাস করেন।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির থেকে সুরাহা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল সরকারী সদিচ্ছা এবং রাজকোষ থেকে খরচ। আত্মনির্ভর প্যাকেজের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এর প্রমাণ রয়েছে সরকার প্রকাশিত দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের রিপোর্টে। দেখা যাচ্ছে আগের বছরের তুলনায় সরকারী খরচ এবং জিডিপি-র অনুপাত হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ, সরকারী খরচ জিডিপি-র থেকেও বেশি কমেছে। যখন কোনো অর্থব্যবস্থায় ব্যাপক বেকারত্ব এবং আর্থিক মন্দা থাকে তখন সরকারের কাজ হওয়া উচিত খরচ বাড়ানো যাতে মানুষের হাতে টাকা আসে এবং আর্থিক বৃদ্ধিও বাড়ে। কিন্তু মোদী সরকার ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের গল্প শোনালেও আসলে টাকা খরচ করেনি। বরং দেখা যাচ্ছে যে সরকারী খরচ কমানো হয়েছে। একদিকে ভোগ্যপণ্যের খরচ কমা এবং বিনিয়োগ অপরিবর্তিত থাকায় এবং সরকারী খরচ কম হওয়ার ফলে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার কমা স্বাভাবিক। যেহেতু গোটা পৃথিবীজুড়েই মন্দাবস্থা চলছে তাই রপ্তানি বাড়িয়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার আপাতত বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই আর্থিক বৃদ্ধির রথের চাকা আটকে রয়েছে।

কতটা কাদায় এই চাকা আটকেছে তা আপাতত বলা মুশকিল। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে লোকে লকডাউনের পরে সেইসময় খরচ না করা টাকা কিছুটা খরচ করেছে। তদুপরি, উৎসবের মরসুম থাকার ফলেও মানুষের খরচ বেড়েছে। এই দুটি অনুকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও আর্থিক বৃদ্ধির বাড়া দূরস্থান, ভোগ্যপণ্যে মোট ব্যয় কমে গিয়েছে। অতএব এই দুই প্রবণতার প্রভাব তৃতীয় ত্রৈমাসিকে কমে গেলে আর্থিক বৃদ্ধির হার আরো কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সেই সম্ভাবনা যে বেশি তা অক্টোবর এবং নভেম্বরের বাড়তে থাকা কর্মহীনের সংখ্যার দ্বারা প্রমাণিত।

তবু সরকার নির্বিকার। ইন্টারনেটে ব্যঙ্গচিত্র ঘুরছে আপাতত দেশে একটি বস্তুরই বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে তা হল প্রধানমন্ত্রীর দাঁড়ি। তিনি কিন্তু অবিচল। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ভাষণ দিচ্ছেন, বলছেন দেশে নাকি অর্থব্যবস্থা এমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে গোটা বিশ্বের সামনে তা উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের এত সমস্যা তথ্যের আকারে তাঁর সামনে হাজির হলেও তিনি তাঁর এই বক্তব্যে অবিচল। কিন্তু কেন?

কারণ আর কিছুই নয়, ভারতের ধনী শ্রেণিরা এই কোভিডের মধ্যেও তাদের সম্পদ ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দুই ঘনিষ্ট বন্ধু মুকেশ আম্বানি এবং গৌতম আদানির সম্পদের বৃদ্ধি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত। জুন থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে গৌতম আদানির সম্পদ বেড়েছে ৩.৫ গুণ। এই একই সময় মুকেশ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ১.৩ গুণ। বর্তমানে মুকেশ আম্বানি এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তির শিরোপা পেয়েছেন। তবে শুধু আদানি-আম্বানি নয়। ভারতের ধনীদের পৌষমাস হল বর্তমান কোভিড অতিমারি। ৫ কোটি ডলার বা তার বেশি সম্পদের মালিক ব্যক্তিদের সংখ্যা ভারতে জানুয়ারি এবং জুন ২০২০-র মধ্যে বেড়েছে ৮৫। মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে প্রায় তিন মাস দেশে লকডাউন চলছিল। কিন্তু তাতে ভারতের পুঁজিপতি ও ধনীদের সম্পদ বাড়াতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। অতএব প্রধানমন্ত্রীর পুলকের কারণ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাঁর মিত্রদের আপাতত পৌষ মাস চলছে, বাকিদের যদি সর্বনাশ হয় তাতে ওনার কী যায় আসে। জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রীর ইয়ার-দোস্তদের উন্নতিই আত্মনির্ভর ভারতের আসল লক্ষ্য।