আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থা আর জঞ্জালের সদগতি

অনিন্দিতা রায় সাহা


বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থা

সতেরোটি টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্যের (sustainable development goal বা SDG) মধ্যে বারো নম্বরটি বলে এক টেঁকসই অর্থব্যবস্থার (sustainable economy) কথা। সেখানে ভোগ আর উৎপাদন দুটিকেই হতে হবে টেঁকসই ধরনের (sustainable production and consumption patterns)। এর অর্থ, আমাদের ভোগ ও উৎপাদনের কাজে প্রকৃতিকে এমন ভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে তার ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে না যায়। প্রাকৃতিক সম্পদ অফুরান নয়, তার ব্যবহার সীমিত না হলে একদিন থেমে যেতে পারে পৃথিবীর চাকা। অর্থনৈতিক প্রগতির অবিরাম ধারা ব্যাহত হতে পারে কারণ পৃথিবী নামক মহাকাশযানটিতে জ্বালানি পরিমিত। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশনের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি প্রায়শই পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। পৃথিবীর জীবজগতের ওপর এইসব বিষময় প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এক কথায় বলা যেতে পারে, আমাদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও নির্বিচারে প্রকৃতি হননের অবশ্যম্ভাবী ফল হল পৃথিবী গ্রহের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সংকট। বেহিসাবী উৎপাদন আর ভোগের মাধ্যমে শুধু যে ধরিত্রীর সম্পদের ধ্বংস সাধন হয় তাই নয়, এর থেকে জন্ম নেয় আরেকটি বৃহৎ সমস্যা, যার নাম আবর্জনা (solid waste)। যেহেতু ধরিত্রীর ধারণ ক্ষমতা অসীম নয়, তাই এই বিপুল পরিমাণ আবর্জনা পুরোপুরি প্রকৃতিতে মিশে যেতে পারে না। আর তার থেকে জন্ম হয় নানারকম পরিবেশগত সমস্যা। এই উপচে পড়া আবর্জনার সঠিক ব্যবস্থাপনা (solid waste management) বর্তমান সময়ে পরিবেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। আর সেই সঙ্গে এটি বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থা (circular economy) ক্রমবর্ধমান জঞ্জালের রাশির সুষ্ঠূ ব্যবস্থাপনার দ্বারা এক টেঁকসই অর্থব্যবস্থার কথা বলে। সেখানে উৎপাদন আর ভোগের সিদ্ধান্ত এমনভাৱে নিতে হবে যাতে শেষ পর্যন্ত কোনো আবর্জনা অবশিষ্ট না থাকে। উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক উপাদান পরিবর্তিত রূপে আমাদের সামনে হাজির হয় ভোগ্য দ্রব্যসামগ্রী হিসেবে। উৎপাদন ও ভোগ দুটি স্তরেই কিন্তু তৈরি হয় প্রচুর আবর্জনা বা বর্জ্য পদার্থ। আগেই বলা হয়েছে, প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দিলেও প্রকৃতি কিন্তু এই আবর্জনা পুরোপুরি নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করতে পারে না। আর তখনই পরিবেশের দূষণ ও সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলি সৃষ্টি হয়। এই রকম আত্মধ্বংসী অভ্যাসের পেছনে আছে একটি সরলরৈখিক অর্থব্যবস্থার (linear economy) ধারণা। সেখানে যথেচ্ছ পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশন করা যায়, যে কোনো পদ্ধতিতে ধরণীর ভান্ডার খোঁড়াখুঁড়ি করা যায়, তাকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যায়, ভোগের পর উদ্বৃত্ত ও আবর্জনা যে কোনো ভাবে ফেলে দেওয়া যায় আর তার পরে আবার প্রকৃতি থেকে উৎপাদনের উপাদান সংগ্রহ করা যায়। এই ক্রমাগত সরল রেখায় দৌঁড়োনোর থেকে বাঁচার রাস্তাটি বৃত্তাকার বলে মনে করছেন পরিবেশের অর্থনীতিবিদেরা। অর্থব্যবস্থা বৃত্তাকার হলে আবর্জনার সঠিক ব্যবস্থাপনা হবে, পুনর্ব্যবহার হবে এবং ফলত প্রকৃতি হবে অবশিষ্ট আবর্জনা-মুক্ত। অনুমান করা হচ্ছে যে, এর সুফল হবে তিনটি- প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, তার যথার্থ ব্যবহার এবং পরিবেশের ওপর কুপ্রভাব হ্রাস। আজকের পরিবেশ সমস্যার জন্য প্রধান দোষীর তকমা পড়েছে অর্থনৈতিক প্রগতির ওপর। বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থার ধারণা প্রগতির এই বদনাম অনেকাংশে ঘোচাতে পারে। সীমিত ভোগ ও উৎপাদন, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিবেচিত ব্যবহার একটি সম্পূর্ণ আবর্জনা-মুক্ত অর্থব্যবস্থার (zero waste economy) মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন প্রক্রিয়া বলবৎ করতে পারে।
 

আবর্জনার রকমফের, নিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনা

দিল্লি শহরের মধ্যিখানে যে আবর্জনার স্তূপগুলি আছে, তার মধ্যে একটি হল গাজীপুর। সাম্প্রতিক হিসেবে দেখা গিয়েছে, এর উচ্চতা শিগগিরই কুতুব মিনারকে ছাড়িয়ে যাবে। মুম্বাইতে সমুদ্র, কলকাতায় ধাপার মাঠ, এ সব জায়গা ময়লা ফেলার জন্য দেদার ব্যবহার করা হয়। নানা রকমের আবর্জনা কলকারখানা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এইসব জায়গা থেকে মিলেমিশে একাকার হয়ে আসে আস্তাকুঁড়ে (garbage dump) । এর মধ্যে আছে জৈবিক এবং অজৈবিক বর্জ্য পদার্থ, যার মধ্যে প্রথমটি মাটিতে মিশে যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয়টি পড়ে থাকে অনন্তকাল।

প্লাষ্টিক প্রদূষণ আজ সকলের অতি পরিচিত একটি সমস্যা। আমাদের দেশে দৈনিক ২৫,৯৪০ টন প্লাষ্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৪,০৫৯ টন আসে কেবল ৬০টি বড় শহর থেকে। সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন ভারতবর্ষে মোট যে পরিমাণ প্লাষ্টিক বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়, তার ৩০% আসে কেবল বিভিন্ন প্রকার ব্যাগ থেকে। এর মধ্যে আছে খুচরো বেচাকেনা, জামাকাপড়, উপহার সামগ্রী, খাবার, এমন কি আমাদের বাড়ির ময়লা ফেলার ব্যাগও। এই বিপুল পরিমাণ প্লাষ্টিক বর্জ্য পদার্থের প্রায় অর্ধেক আর কোনো কাজে লাগে না, ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়ে চারপাশে পড়ে থাকে। সাম্প্রতিক অতিমারীর সময়ে আরেক ধরনের প্লাষ্টিক বর্জ্য পদার্থের জন্ম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘কোভিড ওয়েস্ট’। ডাক্তারি সামগ্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিপুল পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি। এই সুরক্ষা কবচগুলি মূলত বিভিন্ন ধরণের প্লাষ্টিক ও পলিপ্রোপিলিন জাতীয় না-বোনা কাপড় দিয়ে তৈরি। সাধারণ অবস্থায় ভারতবর্ষে দৈনিক প্রায় ৫৫০ টন মেডিক্যাল বর্জ্যপদার্থ উৎপন্ন হয়। এই পরিমাণ ২০২২ সালের মধ্যে বেড়ে ৭৭৫ টন হবে এমন অনুমান করা হয়েছিল। অথচ গত কয়েক মাসেই এর পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে ছয় গুণ । এছাড়াও করোনার দিনগুলিতে অন্যান্য অজৈবিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। সরকারের ব্যর্থতার ফলস্বরূপ খাদ্যবন্টনের দায় অনেকটাই বর্তেছে সমাজ ও বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার ওপর। শুকনো বা রান্না করা খাদ্যসামগ্রী দুঃস্থ মানুষের হাতে তুলে দিতে প্লাষ্টিক প্যাকেট আর এলুমিনিয়ামের বাক্সের বিকল্প নেই। আমাদের ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবনের আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল অনলাইন কেনাকাটা। আর তার মানেই প্যাকিং আর প্লাষ্টিক। কাজ হারানো অনেক মানুষ রান্না করা খাবারের ব্যবসা শুরু করেছেন। তাতেও অ্যালুমিনিয়াম, সেলোফেন আর প্লাষ্টিক। সব দিক থেকে বেড়েই চলেছে অজৈবিক আবর্জনা।

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হরেক রকম জঞ্জাল। ক্রমাগত নগরায়ণ, নির্মাণকার্য, হোটেল ও পর্যটন শিল্প ইত্যাদিতে তৈরি হয়ে চলেছে অঢেল আবর্জনা। মধ্যরাতে ভাঙা বাড়ির চুনবালি ইঁট সিমেন্টের ঢের চুপি চুপি শহরের এক কোণে ফেলে আসার দুষ্কর্মটি (midnight dumping) চলে নিয়মিত। ফল-সবজির বাজার, ফুটপাথের হকার, ঘন বসতিপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর এলাকা- সব জায়গা থেকেই আসে আবর্জনা, যার মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বর্জ্য পদার্থ আলাদা করা থাকে না । ফলত, জৈবিক বর্জ্য মাটিতে মিশে গেলেও অজৈবিক পদার্থগুলি এখানে ওখানে থেকে যায়। শিল্পাঞ্চলের অবশিষ্ট আবর্জনার পরিমাণ ও প্রকৃতি অনিয়ন্ত্রিত। পরিবেশ আর স্বাস্থ্যের পক্ষে তা ভয়াবহ। আরেকটি সাম্প্রতিক সংযোজন হল বৈদ্যুতিন অবশেষ (e waste) । বিভিন্ন প্রকার বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির ব্যবহার যেমন বর্তমান দুনিয়ায় দ্রুত বেড়ে চলেছে, তেমনি সৃষ্টি হচ্ছে এই বৈদ্যুতিন আবর্জনা। আজকের সময়ে বিশ্বজোড়া ভোগ ও অপচয়ের এক প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি এই জাতীয় অবশেষ। সাধারণভাবে বোঝা যায় না এমন আরেক শ্রেণির বর্জ্য পদার্থ আসে ঘর গৃহস্থালি থেকে। একে বলা হয় বিপজ্জনক গার্হস্থ্য আবর্জনা (hazardous domestic waste) যার মধ্যে আছে পুরোনো বালব, টিউবলাইট থেকে শুরু করে ডায়াপার,স্যানিটারি ন্যাপকিন, মশামাছি মারার ওষুধ ইত্যাদি অনেক কিছু । হরেক রকম সদস্য নিয়ে পৃথিবীর বুকে আবর্জনার সাম্রাজ্যটি বৃহৎ এবং বর্ধমান।

এর পরের প্রশ্নটি বর্জ্য নিষ্কাশনকে ঘিরে। ভারতবর্ষে প্রথম থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবর্জনা নিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনার কথা ভাবা হয়েছে কি? না। কোনো ক্ষেত্রেই আবর্জনা আলাদা করা এবং নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা আমাদের অভ্যাসে নেই। ভারতের এমনিতেই ভঙ্গুর আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনাকে আরো চাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমবর্ধমান বর্জ্যপদার্থের উৎপাদন। আমাদের সমস্যাগুলি মোটামুটিভাবে এই রকম -ক) আবর্জনা পৃথকীকরণের পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, খ) বেআইনি অঞ্চলে কর্পোরেশনের নিয়মবহির্ভূত উপায়ে বসবাসের প্রচলন, গ) বেআইনি কলকারখানা গজিয়ে ওঠা, ঘ) নগর পরিকল্পনার অভাব, ঙ) বাজারহাট, পথঘাট ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার অভ্যাস, চ) আবর্জনার সঠিক পরিমাপ সম্পর্কে তথ্যের অভাব , ছ) আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গার অভাব, জ) নাগরিক চেতনার অভাব এবং ঝ) সরকারি নিয়মের শিথিলতা।

বেহিসেবী উৎপাদন ও ভোগের সঙ্গে জড়িত বেশুমার আবর্জনার সমস্যা টেঁকসই উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থায় তাই সঠিক নিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার থেকেও প্রাথমিক স্তরে বলা হয়েছে আবর্জনার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার কথা। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে আছে five R minimisation principle বা পাঁচটি R-এর নীতি। এগুলি হল reduce, reuse, recycle, residual, recovery । এর মধ্যে প্রথম তিনটি অনেকদিন থেকেই শোনা যায়। শেষ দুটি সাম্প্রতিক সংযোজন। সাধারণভাবে শিল্পের কার্যধারাকে বলা যেতে পারে একটি বিপাকীয় পদ্ধতি (industrial metabolism) যার দ্বারা জৈবিক ও ভৌতিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের উপাদান রূপান্তরিত হয় চূড়ান্ত দ্রব্যসামগ্রীতে। বৃত্তাকার উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্ভূত অবশিষ্ট একটি নির্দিষ্ট স্তরের বাইরে যাবে না এবং এই অবশিষ্ট বর্জ্য পদার্থ পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হবে (recycling)। অন্যদিকে চলতে থাকবে অবশিষ্ট (residual) থেকে শক্তি উৎপাদন (waste to energy recovery)। তবে সবচেয়ে বাঞ্ছনীয় হবে একই জিনিষকে বারবার ব্যবহার করা (reuse) এবং তার চেয়েও প্রথমে ব্যবহারের পরিমাণ কম করা (reduce)। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, উৎপাদনের মাত্রা আর অবশিষ্ট আবর্জনার সৃষ্টি, তিনটিকেই রাখতে হবে যথার্থ সীমার মধ্যে। ফলে শেষ অবধি কোনো আবর্জনা পড়ে থাকবে না এই অর্থব্যবস্থায়। প্রকৃতির মধ্যে নিয়ত বয়ে চলা কার্বন, নাইট্রোজেন ও জলীয় বৃত্তগুলির মতো করে গড়ে তুলতে হবে অর্থনৈতিক কাজের বৃত্তকেও। এক কথায় এটিই বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থার মূল তত্ত্ব।
 

আবর্জনার নিয়মকানুন ও তার প্রয়োগ

ভারতবর্ষে এই বিষয়ে সর্বশেষ প্রামাণ্য দলিল হল ২০১৬ সালের আবর্জনা ব্যবস্থাপনা আইন। এই নীতি প্রণয়নের আবশ্যকতা বোঝাতে সরকারিভাবে কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। ভারতবর্ষের বাৎসরিক বর্জ্য পদার্থ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৬২ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে ৫.৬ মিলিয়ন টন প্লাষ্টিক, ০.১৭ মিলিয়ন টন চিকিৎসা সংক্রান্ত আবর্জনা, ৭.৯ মিলিয়ন টন বিপজ্জনক আবর্জনা এবং ০.১৫ মিলিয়ন টন বৈদ্যুতিন আবর্জনা। এই বিপুল পরিমান আবর্জনার প্রায় ৮০% নিয়মিত সংগৃহিত হয় অথচ তার মাত্র ২০-২২% আবর্জনার সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। প্লাষ্টিক বর্জ্যেরও মোটামুটি ৬০% পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। এই হারে সারা দেশে কী পরিমাণ আবর্জনা অব্যবস্থায় পড়ে থাকছে আর তার থেকে কী ভয়ঙ্কর পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তা সহজেই অনুমেয়। অতএব নিয়ম করে একে কমাতে হবে, ব্যবস্থাপনা করতে হবে আর তাতে সুরক্ষিত হবে আমাদের নিজেদেরই ভবিষ্যৎ।

উপরিউক্ত কানুনটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে এর মূল লক্ষ্যগুলি পরিষ্কার হবে। এগুলি শুরু হচ্ছে একেবারে ঘরের দোরগোড়া থেকে। প্রতিটি গৃহস্থালি থেকে শুরু করে শিল্পাঞ্চল, হাট-বাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়া সব কিছুই এর আওতায় পড়ে। কার্যপ্রণালীটিও সহজ এবং সব ক্ষেত্রে মোটামুটি এক।

ক) উৎসস্থল থেকে বিভিন্ন প্রকার আবর্জনাকে আলাদা করে বের করতে হবে। এর জন্য পরিষ্কার শ্রেণীবিভাগ করা আছে- জৈবিক/সিক্ত, অজৈবিক/শুকনো আর বিপজ্জনক।

খ) প্রতিটি আবাসীয় পরিসর, শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট রঙের (সবুজ, নীল, লাল ইত্যাদি) ডাস্টবিন ব্যবহার করতে হবে।

গ) এ কাজে স্থানীয় সংগঠনের ভূমিকা শীর্ষস্থানীয়। এর মধ্যে পড়ে আবর্জনা সংগ্রহের শিক্ষণ থেকে শুরু করে দৈনিক তত্ত্বাবধান পর্যন্ত সব পর্যায়ের কাজ।

ঘ) নিয়ম না মানার জন্য জরিমানা করার ক্ষমতাও এই আইনে আছে।

এতো স্পষ্ট নিয়ম থাকা সত্ত্বেও সমস্যার সমাধান কিন্তু হচ্ছে না। শুধু ভারতবর্ষেই নয়, এই সমস্যা সারা পৃথিবীর। উন্নত দেশে কম, আর উন্নয়নশীল দেশে হাজারো সমস্যার সাথে যুক্ত এটি একটি অতিরিক্ত সমস্যা। আমাদের মতো গরীব দেশে আবর্জনার ব্যবস্থাপনা অনেকটাই চলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এই কাজে নিযুক্ত আছে বহু প্রান্তিক মানুষ, যাদের আমরা কুড়াওয়ালা, কাবাড়িওয়ালা ইত্যাদি নামে জানি। এদের বাদ দিয়ে আবর্জনার কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ভাবা যায় না, এদেরকে বাদ দিয়ে স্বচ্ছ ভারত বানানো যায় না। তাই পরিকল্পনার মধ্যে এদের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থাকা দরকার। কাগজে কলমে থাকলেও এই শ্রেণির কর্মীদের প্রকৃত ভূমিকা বা পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা এই আইনে আলোচিত হয়নি। অন্যান্য ক্ষেত্রের নিয়ম ও নির্দেশগুলি অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট। শিল্পের ক্ষেত্রে আবর্জনার ব্যবস্থাপনা, পুনর্নবীকরণ এবং শক্তি উৎপাদন বাধ্যতামূলক। এই উদ্দেশ্যে মোট জমির ৫% নির্দিষ্ট করতে হবে এবং মোট শক্তির ৫% আসবে এইভাবে উৎপন্ন শক্তি থেকে। এ ছাড়া, যে সমস্ত শহরে জনসংখ্যা ১০ লক্ষের কম, কিংবা যে সব স্থানীয় এলাকায় জনসংখ্যা ৫ লক্ষের অধিক, সেখানে আলাদা আবর্জনা ফেলার জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। এই জায়গাগুলির দূরত্ব হবে লোকবসতি ও বড়ো রাস্তা থেকে ৫০০ মিটার, নদী থেকে ১০০ মিটার, পুকুর থেকে ২০০ মিটার এবং বিমানবন্দর থেকে ৫০ মিটার। সেই সঙ্গে আছে জৈবিক বর্জ্য থেকে সার তৈরির প্রস্তাব। এই ব্যবস্থা গৃহস্থ বাড়ি কিংবা সামূহিক কেন্দ্র, সর্বত্রই স্থাপন করা যায়। সবুজ রসায়নের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত বড়ো মাত্রায় কম্পোস্টিং যেমন হতে পারে, তেমনি প্রতিটি রান্নাঘরের ফল সবজির বর্জ্য থেকে অতি সহজে সার তৈরি করা যেতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির আবর্জনা আলাদা করে বের করা মোটেই কঠিন নয়। বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে, তারা কাগজ, প্লাষ্টিক, লোহালক্কড় কিংবা বৈদ্যুতিন অবশিষ্ট সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং করতে পাঠায়। প্রয়োজন শুধু আমাদের চেতনা, অভ্যাস আর উৎসাহ।

এইসব নিয়ম লাগু করা ও সুবিধাগুলি তৈরি করার জন্য ৪-৫ বছর সময়সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। অর্থাৎ ঠিকমতো কাজ হলে আজ ২০২০ সাল পর্যন্ত এর ৮০% কাজ পুরো হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কোভিড কিছু সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিকই, তবে এতদিনে ব্যবস্থাপনা আশানুরূপ হয়ে থাকলে সেই সমস্যাটাও বর্তমানের চেয়ে কম হত, সামলানো যেত। আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় আমরা হতাশাজনকভাবে পিছিয়ে আছি, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই দোষে দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ, সকলেই দোষী।
 

নাগরিক দায়বদ্ধতা

পরিবেশ সচেতনতা একটি নাগরিক দায়িত্ব। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো সমস্যাকে এড়িয়ে চলা, দেখেও না দেখা আর যতদূর সম্ভব অস্বীকার করা। কিন্তু পরিবেশ সংকট আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এই সব ভাবনাকে আর বিলাসিতা বলা চলে না। কেবল গবেষণাপত্র, আলোচনা আর ভাষণেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি নাগরিককে। তার জন্য চাই শিক্ষা, সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ নাগরিকসমাজ, রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তি, এই তিনে মিলে এগোতে হবে একসাথে। একদিকে অপরিমিত ভোগের মহাযজ্ঞ চলছে আজকের মানুষের জীবনযাপনে, অন্যদিকে দেখা যায় সরকারি স্তরে উপযুক্ত পরিবেশনীতির অনুপস্থিতি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে সাধারণ মানুষ পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা পুনর্নবীকৃত জিনিস কিনতে বিশেষ আগ্রহী হয় না। দামের বিশেষ সুবিধা থাকলে যদিও বা হয়, পরিবেশগত কারণে কিন্তু অবশ্যই নয়। পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে, নিজেদের ভবিষ্যত বাঁচাতে হলে আর বৃত্তাকার পথে এগোতে হলে মানুষের সামগ্রিক পরিবর্তন দরকার,ভাবনায় এবং আচরণে। সরকারি নিয়ম যেমন আছে, তেমনি আছে ফাঁকফোকর। আইনের যথাযথ প্রয়োগ চাই। চাই এর অপব্যবহার রোধ। কৃষি-শিল্প-নির্মাণ-শক্তি, অর্থব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে পরিবেশ-বান্ধব নীতি, করতে হবে তার যথাযথ প্রয়োগ। তেমনি এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি নাগরিককে। রাষ্ট্রের ইচ্ছাশক্তি থাকার যেমন দরকার, তেমনি আমাদের প্রতিটি নাগরিকের দায়বদ্ধতা থাকারও প্রয়োজন। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি টেঁকসই সমাজ গড়ে তোলা খুব কঠিন নয়। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই একটি বৃত্তাকার অর্থব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। প্রকৃতি আমাদের এই পথ চিরকাল দেখিয়েছে। আজ সময় এসেছে, আমরা সেই পাঠ গ্রহণ করি, টিঁকে থাকার চেষ্টা করি একটি স্বচ্ছ পৃথিবীর বুকে, দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য সামনে নিয়ে।


তথ্যসূত্রঃ

● https://www.google.com/amp/s/
● www.indiatoday.in/amp/mail-today/story/mountain-of-coronavirus-related-waste-raises-alarm-in-delhi-1692419-2020-06-25
● https://www.investindia.gov.in/team-india-blogs/bio-medical-waste-management-during-Covid-19
● Ministry of Environment, Forest and Climate Change Notification (2016). Government of India.
● http://moef.gov.in/wp-content/uploads/2019/10/Solid-Waste-Management-Rules-2016.pdf
● Murray, A., Skene, K. and Haynes, K., 2017. The circular economy: an interdisciplinary exploration of the concept and application in a global context. Journal of business ethics, 140(3), pp.369-380.
● Winans, K., Kendall, A. and Deng, H., 2017. The history and current applications of the circular economy concept. Renewable and Sustainable Energy Reviews, 68, pp.825-833.