আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্নের স্কুল ও কিছু পত্রালাপ

বিপ্লব বিশ্বাস


ভবিষ্যতের হীনদৃষ্টি আম (সাধারণ মানুষ) বর্তমানে বাঁচে বটে কিন্তু অতীতকে আশ্রয় করেই তাকে পুষ্ট হতে হয়। আজ সেই পুষ্টির সমূহ অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে আমাদের আচার আচরণে, বাক্যবাণে যা অজ্ঞতাপুষ্ট মানুষকে সহজেই বেপথু করে দেয়। তার কুফল ভয়ংকর। তাইতো মধ্যেমাঝে পাতা উলটে পেছনে যেতে হয়; বুঝে নিতে হয় কোনও পূর্বজ পুরোগামী মনীষাকে যাঁর দেখানো আলোয় পথ দেখে চলতে হয় আমাদের। নইলে অহৈতুকী হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায় পদে পদে।

এমনই এক সুবেদী সংগ্রামী দ্রষ্টা মানবী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০ - ১৯৩২), যাঁর জন্ম তথা মৃত্যুবার্ষিকী ৯ ডিসেম্বর। মুসলমান সমাজের আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিকতার চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় অবরোধকে যিনি কখনওই মেনে নিতে পারেননি তাঁকে সাধারণ মানুষ বেগম রোকেয়া বলে জানলেও ‘বেগম’ শব্দ - স্থাপনে তাঁর যে অন্তর্লীন আপত্তি ছিল তা আমরা জেনেছি। আবার স্ব-নামের সঙ্গে স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের নাম জড়িয়ে থাকলেও ১৯৩২ সালের ২৫ এপ্রিল তোসাদ্দক সাহেবকে লেখা এক চিঠিতে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, ‘আমি স্বামীর নামের কাঙাল নই। কারণ আমি জানি তাঁর সত্যিকার স্মৃতি আমার সাথেই রয়েছে ও আমার সাথেই লুপ্ত হয়ে যাবে।’ চিরকাল স্ত্রী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রোকেয়ার পাঁচখানি গ্রন্থের একটিও তাঁর পিতা বা স্বামীর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত নয়-এটাও লক্ষণীয় বিষয় বটে। এমন কি পুরুষকে ‘স্বামী’ সম্বোধনেরও বিরোধী ছিলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বে স্ত্রী - পুরুষ সমান। তাই তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘দ্বিমস্তক পুরুষ বা নাসাহীন রমণী কোন দেশে আছে?’

এইরূপ বহুবর্ণিল মানবীর কর্মপরিধি মাত্র তেইশ বছরের (১৯০৯ - ৩২) যাঁর প্রথম অসামান্য কীর্তি স্কুল- প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় কীর্তি মুসলিম মহিলা সমিতি আঞ্জুমান - ই - খাওয়াতিন (১৯১৬) গঠন আর তৃতীয় সাহিত্যচর্চা যদিও এই শেষ ক্ষেত্রটিতে তিনি বহুপ্রসবিনী ছিলেন না ; তবুও সংখ্যা দিয়ে তাঁর অগ্নিপাট দিকদর্শী রচনার মূল্যায়ন করা বাতুলতা মাত্র।

পরিসর-স্বল্পতার কারণে শুধু তাঁর প্রথম কীর্তিটিতেই আলোচনা সীমায়িত রাখব ও তদ্বিষয়ে আত্মীয় - বান্ধব - শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে লিখিত স্বল্পসংখ্যক বাংলা ( বাইশটি) পত্রাবলিতে তাঁর নিয়ত সংগ্রামের যে স্পষ্ট ছবিটি ফুটে উঠেছে, আজকের পাঠকের সামনে কিছুটা হলেও তা তুলে ধরতে প্রয়াসী হব। কেননা একজন মানুষকে অন্তর্গূঢ়ভাবে চিনতে হলে তাঁর লেখা চিঠিপত্রই সত্যসন্ধ ঢঙে প্রতীত। তবুও সামান্য ছুঁয়ে যাওয়া দরকার রোকেয়ার জীবন-পরিসর,উত্তর প্রজন্মের জ্ঞাতার্থে - যেখান থেকে উপাত্ত বিশ্বাসে বোধগম্য হয় প্রকৃত মানবের গমনপথ, তাঁর চলন - ভঙ্গিমা। উত্তরিত হতে সেই অভিজ্ঞান অতীব জরুরি।

তৎকালিক পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে সাবের জমিদার পরিবারে ১৮৮০সালের ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম। তখন দেশজুড়ে উর্দু ভাষার প্রতি অনুরাগ ( রোকেয়ারও পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু),বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষ আর স্ত্রী শিক্ষার প্রবল বিরোধিতা বর্তমান। এই প্রতিকূল প্রেক্ষিতে দিদি করিমুন্নেসার সাহায্যে তিনি বাংলা শিক্ষালাভ ও তার ইউরোপীয় গভর্নেসের কাছে ইংরেজি অক্ষর পরিচয় করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বড় ভাই আসাদ মোঃ ইব্রাহিম সাবেরের অতুলন আগ্রহী সহায়তাও উল্লেখ্য। যদিও আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করার সুযোগ তিনি পাননি। সে তো রবীন্দ্রনাথেরও ছিল না।

এখানে উল্লেখ্য, উনিশ শতকের নবজাগরণ ছিল মূলত নাগরিক হিন্দু সমাজের জাগরণ। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, কেশবচন্দ্রের পাশাপাশি কোনও মুসলমান মনীষার তখনও জন্ম হয়নি। নবাব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলীর আবির্ভাব ঘটে দেরিতে। উক্ত শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত দেশের হিন্দু - মুসলমান উভয় সমাজেই নারীশিক্ষা অকল্যাণকর তথা ধ্বংসাত্মক বিবেচিত হত। নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলছেন, ‘প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে নারী - পুরুষের সম্পর্কের মহত্তম উদ্দেশ্য ছিল সন্তান কামনা। গোটা সংস্কৃত সাহিত্যে দাম্পত্য প্রেমেরও স্থির লক্ষ্য ছিল প্রজনন, বংশরক্ষা তথা বংশবৃদ্ধি। লেখাপড়া শিখলে হিন্দুনারী বিধবা হয়, এমন অন্ধ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল উনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকেও।’ হিন্দু সমাজেরই যদি এমত নির্বিন্ন দশা হয় তাহলে মুসলমান সমাজের চিত্রটি যে আরও করুণ হবে তা বলাই বাহুল্য। কেননা আপামর মুসলমানদের দারিদ্র ছিল শিক্ষার পথে প্রধান অন্তরায়। উপরন্তু হিন্দুরা যেখানে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলে সনাতন প্রথানুযায়ী, ধর্মীয় আদেশের বশবর্তী হয়ে নয়, সেখানে মুসলমান সমাজ নিস্তার দানকারী বিশ্বাস বা ধ্যানধারণাকে ধর্মীয় ও স্বর্গীয় আদেশ রূপেই পালন করে থাকে। এ কারণেই ইসলামে গোঁড়ামি প্রকটভাবে দেখা দেয় আর তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দৃঢ়তা অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হয়। আজকের একুশ শতকী অগ্রগতির যুগেও উভয় সমাজেরই উপাত্ত বিশ্বাস বা অবস্থানে আপাতবদল আসলেও অন্তর্গত মানসলোকে পূর্ণালোক বিচ্ছুরিত হয়েছে, বলা যাবে না। যাই হোক, সাধারণভাবে ১৮৭০এর দশককে মুসলমান মানসের নবজাগরণের কাল বলে নির্দেশ করা যায়। তাহেরান নেসারকে প্রথম মহিলা গদ্যলেখিকা বলে ধরা হয়। যদিও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একমাত্র উল্লেখ্য মুসলমান মহিলা সাহিত্যিক হিসাবে নওয়ার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর (১৮৫৮ - ১৯০৩) নাম অবশ্য - গ্রাহ্য তবুও তার ‘রূপজালাল’ উপন্যাস ব্যক্তিক ব্যর্থ জীবনের দীর্ঘশ্বাস - আকীর্ণ। সেখানে অত্যাচারিত নারীদের অবস্থান্তরিত উত্তরণের কোনও দিশা নেই যা স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় রোকেয়ার রচনা সামগ্রীতে। সে আলোচনা এখানে নয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে উনবিংশ শতকের শিক্ষা বিশেষত মুসলমান নারীশিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রণী মহিলা হিসাবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামই সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সময়ের তুলনায় তিনি যে যথেষ্ট অগ্রগামী ছিলেন তা তার লেখালিখি তথা কর্মক্ষেত্র বিবেচনা করলেই উপলব্ধ হয়। বাঙালি মুসলিম মহিলাদের আধুনিক, আত্মনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী করতে ও তাদের শিক্ষাসহ সামাজিক চেতনা - জাগরণের জরুরি ক্ষেত্রে তিনি আত্যন্তিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর ‘মোতিচূর’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’, ‘Sultana’s Dream’, The Educational Ideals of Modern Indian Girls’ ইত্যাকার রচনার সান্দ্র পাঠে ছত্রে ছত্রে স্বচ্ছ ও বিদ্রোহী ভাবনার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। রোকেয়ার বাংলা ইংরেজি হস্তাক্ষর অতীব সুন্দর তথা স্পষ্ট - ঠিক তাঁর জাগ্রত মননের সঠিক প্রতিফলন। এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে তাঁর Sultana’s Dream সম্পর্কে তৎকালীন প্রখ্যাত শিখা গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার আবুল হুশেন মন্তব্য করেছিলেন, ‘পুস্তকখানি যেরূপ সুমার্জিত বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় রচিত সেরূপ ভাষা আয়ত্ত করা আমাদের অনেক ইংরিজি শিক্ষিত যুবকের পক্ষে কঠিন।’

এই রোকেয়া সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৫৮-১৯০৯) সঙ্গে উদ্বাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁর ষোল বছর বয়সে। অবাঙালি বিপত্নীক সাখাওয়াত সাহেবের বয়স তখন আটত্রিশ (অথচ মোশফেকা মাহমুদের ‘পত্রে রোকেয়া পরিচিত’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে বিবাহের সময় রোকেয়ার বয়স ছিল আঠারো আর হোসেন সাহেবের চল্লিশ। বাংলা একাডেমী,ঢাকা প্রকাশিত গ্রন্থে অবশ্য আগের তথ্যেরই স্বীকৃতি আছে।)। তিনি হুগলি কলেজের ছাত্র তথা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র মুকুন্দদেবের সতীর্থ ছিলেন। ১৮৮০ সালে হোসেন সাহেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন, পরে বিলেত থেকে কৃষিতে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তৎকালিক বিহারের ভাগলপুর নিবাসী হোসেন সাহেব ১৮৯৯ সালে ভাগলপুর কমিশনারের পি এ নিযুক্ত হন। ১৯০৯ সালে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হলেও ভাগলপুরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই মানুষটি ছিলেন কুসংস্কারমুক্ত, উদারচেতা, শিক্ষানুরাগী। তাঁদের দ্বৈত জীবনে কোনওরূপ বোঝাবুঝির অভাব না থাকলেও তা দীর্ঘস্থায়ী কিংবা সুখময় ছিল না। কমবেশি মাত্র তেরো বৎসরের সাংসারিক জীবনে রোকেয়া যে কী পরিমাণ ক্লিষ্ট ছিলেন তার উল্লেখ আছে ৩০.৪.১৯৩১ সালে পরম স্নেহাস্পদা মোহসেনা রহমানকে লেখা তাঁর এক চিঠিতে যেখানে তিনি স্বাবমাননায় বলেছেন, ‘...আমার মত দুর্ভাগিনী, অপদার্থ বোধ হয়, এ দুনিয়ায় আর একটা জন্মায় নি। শৈশবে বাপের আদর পাই নি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ Urine পরীক্ষা করেছি। পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দুবার মা হয়েছিলুম - তাদেরও প্রাণ ভরে কোলে নিতে পারি নি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই বাইশ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি।’

সুতরাং এ থেকেই অনুমিত হয় তাঁর খিন্ন দাম্পত্য জীবনের রেখাচিত্র। এই বিষয়টি প্রাজ্ঞ হোসেন সাহেব বুঝতেন। তাই মৃত্যুশয্যায় তিনি রোকেয়াকে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বাতলে দেন। তার অমল ভাবনায় রোকেয়া যদি একটি মেয়েদের স্কুল চালান তাহলে তাঁর জীবনের তথা সমাজের উভয় লক্ষ্যই পূর্ণ হবে। এই উদ্দেশ্যে সাখাওয়াত সাহেব তার সঞ্চিত অর্থ থেকে দশ হাজার টাকা স্কুল চালাবার জন্য আলাদা করে দেন।

এই স্বপ্ন বুকে বেঁধেই ০৩.৫.১৯০৯ তে অর্থাৎ সাখাওয়াত সাহেবের প্রয়াণের পরপরই পয়লা অক্টোবর ভাগলপুরের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আব্দুল মালেকের সরকারি বাসভবন ‘গোলকুঠি’তে রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন যার পাঁচজন ছাত্রীর মধ্যে চারজনই মালেক সাহেবের কন্যা। ওই ছাত্রীরা রোকেয়াকে ‘স্কুল কি ফুপ্পি’ বলে ডাকত। এরপর ১৯১০ সালের তেসরা ডিসেম্বর বিপদাপন্ন অবস্থায় ভাগলপুর ত্যাগ করে রোকেয়া কলকাতায় মালেক সাহেবের ছোটো ভাই সৈয়দ আবদুস সালেকের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু স্কুল! নানান প্রচেষ্টান্তে পরের বছর ১৬ই মার্চ ওয়ালিউল্লাহ লেনের ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে স্কুল পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে হয় আট।

এই বিদ্যালয় স্থাপনে রোকেয়ার অবদান প্রসঙ্গে উদ্বোধনের দিন The Musalman পত্রিকায় ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয় যে কলকাতায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শহরকেন্দ্রিক নবজাগরণের কেন্দ্রভূমির সঙ্গে মুসলিম সংযোগের একটা ক্ষীণ যোগসূত্র স্থাপিত হল। অবশ্য এটাই কলকাতায় প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় নয়। যাই হোক, স্কুলের সূচনার অর্থই হল রোকেয়ার নতুনতর সংগ্রামের শুরু। প্রথমেই সাখাওয়াত সাহেবের দেওয়া অর্থ যে ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছিল সেই বার্মা ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হওয়ায় তা নাশ হল। পরবর্তীকালে ফরিদপুর সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকেও রোকেয়ার বেশ কিছু গচ্ছিত অর্থ মার যায়। তা সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপর সে যুগে যা মোটেও সামান্য ছিল না। এখনকার প্রজন্ম হয়তো এই ব্যাঙ্ক দেউলিয়ার বিষয়টা ঠিক বুঝবে না। এতে যে কত মানুষের সর্বনাশ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যাহোক, সহমর্মীদের মতো রোকেয়া ভেঙে না পড়ে নতুন উদ্যমে শুরু করলেন। সমান্তরাল ঢঙে চলতে লাগল অর্থ ও শিক্ষিকা সংগ্রহের নিবিড় প্রচেষ্টা। আর চলল স্কুলের ঠিকানা - বদল। ১৯১৩তে স্কুলের ঠিকানা যদি হয় কম. আব্দুল হালিম লেন (বর্তমান) ১৯১৫তে তা হয়ে যায় ৮৬/এ, লোয়ার সার্কুলার রোড। ছাত্রীসংখ্যাও বাড়তে বাড়তে আট থেকে ২৭,৩০,৩৯,৮৪ হয়ে যায়। সরকারি সাহায্য থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত অর্থ- সাহায্যও আসতে থাকে। তবুও সেই সহায়তায় একদেশদর্শিতা লক্ষ করে The Musalman পত্রিকা ১৯৩২ সালে মন্তব্য করল, ‘Had it not been a muslim institution, then there would have been no want of funds.’ কেননা ওই সময়েই অ - মুসলিম বিদ্যালয়গুলিকে ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত নিয়মিত সাহায্য করা হত। এই স্কুলে প্রথমে ছিল শুধু উর্দু মাধ্যম। ১৯১৭তে বাংলা শাখার প্রবর্তন হল যা ১৯১৯-এ ছাত্রীর অভাবে বন্ধও করে দিতে হয়েছিল। পরে আবার তা চালু হয়। ১৯২৭-এ সাতজন ছাত্রী নিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ( তখনকার ফোর্থ ক্লাস) শুরু হয় উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। এই স্কুলের নানাবিধ অসুবিধা দূর করতে নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা ও লেডি শামসুল হুদার অবদান অনস্বীকার্য। সুদূর রেঙ্গুন থেকেও অর্থ সহায়তা পেয়েছিল এই বিদ্যালয়। ১৯১৬তে ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে হয় ১০৫। নানা পাকদণ্ডী চড়াই - উতরাই মাড়িয়ে রোকেয়া এগোতে থাকেন। তাঁর জীবনপ্রবাহ আর স্কুলের অগ্রগমণ একাকার হয়ে যায়। আঘাত আসে ধনী শরীফ সম্প্রদায় তথা মোল্লাদের দিক থেকে যারা কখনও তাঁকে এতটুকু সাহায্য করেননি। তাঁর এই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের তুলনা করে বলা হয়েছিল, ‘সমাজের সহিত রোকেয়া জোয়ান অব আর্কের ন্যায় যুঝিয়াছেন - গৃহশত্রুর সঙ্গে চাঁদ সুলতানার ন্যায় লড়িয়াছেন।’

রোকেয়ার কাছে তাঁর স্কুল ছিল বাঙালি মুসলিম নারীজাগরণের সূতিকাগার। মানবিক প্রজ্ঞাবশত তিনি তাঁর বিদ্যালয়ে সকল ধর্মাবলম্বী ছাত্রী ভর্তি করেছেন। এরমধ্যে তাঁর অপর বড় কাজটি হল ১৯১৬ সালে আঞ্জুমান -ই - খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপন করা। অনগ্রসর মুসলমান মেয়েদের স্বাবলম্বন ও আত্মনির্ভরতার শিক্ষাদানের কাজে এই সংগঠনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। নিজের স্কুলের ঝাড়ুদারের স্ত্রী - কন্যাকেও তিনি পরম যত্নে পড়াতেন। নারীর অধিকার বিষয়ে পরিপূর্ণ ইতিহাসচেতনা নিয়ে তিনি নারী সমাজের মঙ্গল তথা মুক্তিসাধনের কাজে আত্মনিয়োগ করাকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির চাইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি শিক্ষাকে সম্পূর্ণ জীবনোপযোগী ও বিপ্লবাত্মক করতে চেয়েছিলেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্র -সাযুজ্য লক্ষণীয়।

১৯১৫ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত যে স্কুলটি তিনি তিলে তিলে গড়েছিলেন তৎসংশ্লিষ্ট সুমহান সংগ্রামের সুস্পষ্ট পরিচয় বিধৃত আছে তাঁর লেখা ও প্রাপ্ত বাইশটি বাংলা চিঠিতে ( ইংরেজি চিঠি এখানে আলোচিত হয়নি) যা লিখেছিলেন কতিপয় আত্মীয় - বান্ধবকে। তারই সামান্য এখানে তুলে ধরছি।

তিনি লিখেছিলেন মরিয়ম রশীদ, মামলুকুল ফাতেমা খাতুন, কবি মুহম্মদ খান মঈনুদ্দীন, মোহসেনা রহমান, মো. বাবর আলী খান, খানবাহাদুর তসদ্দুক আহমদ, মোমেনাতুল ফাতেমা ও শামসুন নাহার মাহমুদকে। প্রতিটি চিঠির পরতে পরতে রোকেয়ার স্কুলকেন্দ্রিক পরিশ্রম, লড়াই, ভাবনা, যন্ত্রণা বিজড়িত যা এক আন্তরিক বয়ান বলেই মনে হয়। ০৮.৯.১৫তে মরিয়মকে লেখা প্রথম চিঠিতেই তিনি তাঁর স্কুল বিষয়ক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর উল্টোদিকে ছিদ্রান্বেষীদের আক্রমণের ইঙ্গিত দিয়ে বলছেন, তাঁর ‘ভাঁড় লিপকে হাত কালা’ হয়েছে। অথচ পরবর্তী বছরেই তাঁর অপরিচিত সরোজিনী নাইডু অসুস্থ অবস্থায় সুদূর হায়দরাবাদ থেকে চিঠি লিখে রোকেয়ার কর্মকাণ্ডের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। আবার এই মরিয়মকেই (মেরী) ১৯২৬ সালে লেখা চিঠিতে আলীগড়ে নারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রচেষ্টায় আপ্লুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় এমনটি হচ্ছে না বলে আফশোস করছেন। এই বছরেই মামলুকুলকে লেখা চিঠিতে নিজেকে নগন্য বলে দেগে বলছেন, ‘ ‘‘কুকুরের কাজ নাই, দৌড় ছাড়া হাঁটা নাই’’ - আমি সেই নিষ্কর্মা কুকুর’। এর আগে দুটি চিঠির উল্লেখ করেছি। আবার দেখি ১৯২৯-এ মোহসেনাকে লেখা একটা ছোট্ট চিঠিতে তাঁর স্কুলের জন্য আকুতি পরিস্ফূট হয় যখন তিনি লেখেন, ‘তুমি কাসন্দ না দিয়ে যদি স্কুল ফান্ডে চার পাঁচটা টাকা পাঠাতে তাতে আমি বেশী সুখী হতুম।’

এইরকম অনেক আত্মিক যন্ত্রণার কথা উঠে আসে তাঁর পত্রাবলিতে যার বিস্তৃত বিবরণ এই পরিসরে অসম্ভব।

মাত্র বাহান্ন বৎসর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর তিনি চলে গেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তথা প্রতিপালিত এই স্কুলটি সরকার অধিগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর। বর্তমানে ১৭ নং লর্ড সিনহা রোডের স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত স্কুলটির বর্তমান নাম সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গভ. গার্লস হাইস্কুল। এটি একটি উচ্চমাত্রার বালিকা বিদ্যালয়। শতবর্ষ অতিক্রান্ত এই বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কেউ কি একটিবারও পেছনের পথে হাঁটবেন না? খুঁজে দেখতে চাইবেন না এর প্রতিষ্ঠাত্রী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সংগ্রামময় জীবনেতিহাস!


তথ্যঋণঃ
১) রোকেয়া রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
২) পত্রে রোকেয়া পরিচিতি, মোশফেকা মাহমুদ।
৩) রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনঃ জীবন ও সাহিত্যকর্ম, মুহম্মদ শামসুল আলম।
৪) অন্যান্য আলোচিত সূত্র।