আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

সবকা সাথ, সবকা বিকাশ ও আমাদের আদরের গুপী গাইন বাঘা বাইন

অর্ক দেব


পুত্রের অনুরোধ রাখতে পিতৃদেবের তৈরি করা ছবি। পারিবারিক সম্পদ তথা পিতামহের লেখা রূপকথাধর্মী গল্পের সিনেমাসৃজন, একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছোটদের ছবি, যা সব বয়সে ফিরে দেখা যায়। এই চলমান দৃশ্যমালা আজও বাঙালির ছুটির দিনে ফিরে ফিরে আসে। কেউ বলেন যুদ্ধবিরোধী ছবি, কেউ বলেন আপাদমস্তক রাজনৈতিক ছবি। কিন্তু 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' নিয়ে কথা এর বেশি এগোয় না। পঞ্চাশ পেরিয়েও সেই একই পুজোর মালা, একই বিবেচনা আর চর্বিতচর্বনে এ ছবিকে গা ধুইয়ে দেওয়া হয়। এই পাঠে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে ছবির মূল ধাঁচাকে বর্তমান ভারতের ঘটনা পরম্পরার সমান্তরালে পড়তে চাইব। আমরা খুঁজব গুপী-বাঘার সামাজিক অবস্থান, সমাজের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি গুপী বাঘার আকাঙ্ক্ষা। এই অন্বেষণের সময় আমরা বর্তমান ভারতের যে প্রচ্ছদপট এর পিছনে রাখব, প্রথমে তাকেই নির্মাণ করা জরুরি বলে মনে করি।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছিল কাশ্মীরের পুলওয়ামা অঞ্চলে জঙ্গি হামলার ঘটনা। এই হামলার প্রত্যাঘাতের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, তার রূপায়ণ সংক্রান্ত নানা রঙদার কাহিনি ভোটের মুখে মাধুকরীর উপাদান হয়েছিল। ২৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পর জনাদেশ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে বিজয়ী দল। ভোট উৎসব মিটে যায়। ভোটের আগে এবং পরে এই দেশেই অবিরত নিগ্রহের মুখে পড়েছেন প্রান্তজন। ওই বছরেই জুন মাসের ৩ তারিখ মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য কর্নাটকে প্রতাপ নামক এক দলিত আইএএস পরীক্ষার্থীকে নগ্ন করে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়। জুন মাসের ৮ তারিখ ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলায় রামচরণ মুন্ডা নামক এক আদিবাসী বৃদ্ধের মৃত্যু হয় খাদ্যের অভাবে। জুন মাসের ১৪ তারিখ গুজরাটের একটি হোটেলে নোংরা পরিস্কার করতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা যান ৭ জন হরিজন সম্প্রদায় ভুক্ত। মে মাসের মাঝামাঝি একটি সংবাদ শিরোনাম চোখে পড়েছিল, মেহেসোনার কাছে মুন্নভাই পাড়ের ছেলে মেহুল পারমার ঘোড়ায় চেপে বিয়ে করতে গিয়েছিল। দলিত কেন ঘোড়ায় চলবে এই নিয়ে সরব হয় গুজরাটের সরপঞ্চ। বর-সহ গোটা বরযাত্রী তথা গ্রামবাসীকে বয়কট করে এই সরপঞ্চ। ঘটনাপঞ্জি দীর্ঘায়িত করছি না। এই করোনা বর্ষেই ঘটেছে হাতরাসের ঘটনা। মৃতদেহ পোড়ানোর জায়গা নেই এই অবস্থাতেও উচ্চবর্ণ বলেছে ‘ছোট’ মানুষকে একই শ্মশানে দাহ করা চলবে না। আমরা এই প্রান্তজনের ইচ্ছে, পাওয়া না পাওয়া, উপরোক্ত পরিণতির সঙ্গে গুপী-বাঘার যাত্রাপথকে একবার পাশাপাশি রেখে দেখতে পারি।

শ্রীরায়ের ছবিতে প্রথমেই আমরা দেখতে পাই গুপী একটি ফেলে দেওয়া তানপুরা জোগাড় করেছে পাঁচপুকুরের বল্লভ গোঁসাইয়ের থেকে। প্রথম দৃশ্যেই দর্শকের সামনে তিনটি বর্গকে চিহ্নিত করেন পরিচালক। আমরা দেখতে পাই খেটে খাওয়া মানুষকে, গ্রামীণ চণ্ডীমণ্ডপে পাশা খেলে দিনযাপন করা অলস ব্রাহ্মণ মুরুব্বিদের এবং দেখতে না পেলেও বিবরণ পাই বল্লভ গোঁসাইয়ের। তিনি অঞ্চলের প্রধান শিল্পী। গুপী এই তিন বর্গের কোনওটিরই স্থায়ী প্রতিনিধি হতে পারবে না তাঁর ডিজায়ারের কারণে। অথচ তাঁর হয়ে ওঠার জন্য চাই গুরুর দীক্ষা, মান্যজনের স্বীকৃতি এবং নীচুতলার চাষাভূষা মানুষের অনুমোদন। মুদির ছেলে গুপী শিল্পী হতে চায় বলে গুরুর পা টিপে দিয়েছে, পাতকুয়ো থেকে জল তুলে দিয়েছে, শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়ে পেয়েছে গান ধরার যন্ত্র। বন্ধু চাষাকে সে এক আনোখা যন্ত্রের সন্ধান দিয়েই চণ্ডীমণ্ডপের অনুমোদন চাইতে আসে অর্থাৎ বিদ্যার স্বীকৃতি নিতে প্রান্তজনকে আসতে হচ্ছে ব্রাহ্মণ মুরুব্বিদের কাছে। এদিকে গুপীর গলার দৌড় শুনেই পণ্ডিতেরা বুঝতে পারেন সঙ্গীতের মত কুলীন বিষয়ে এত কম পারদর্শিতা নিয়ে প্রবেশাধিকার চাওয়ার অপরাধে দণ্ডিত করা যেতে পারে। সেই অভিপ্রায়ই গুপীকে তাঁরা রাজার বাড়ির পথ দেখিয়ে দেন। অতঃপর রাজা গুপীকে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করে গাধার পিঠে চড়িয়ে। ছবির এই প্রথম অংশটুকু আমাদের স্পষ্ট সমাজচিত্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়,বুঝিয়ে দেয় কে বাঁচায় আর কে বাঁচে। আমরা আবহমানের নিয়মটা জানতে পারি যে, প্রান্তজনের শিল্পে কোনও স্বাধিকার নেই। তাকে শিল্পে অংশগ্রহণের অধিকার পেতে গেলে একটা স্তরবিন্যাসের প্রতিটি ধাপ পার করে, প্রভুর স্বীকৃতি জোটাতেই হবে।

এখন মন্দির বলি বা শাস্ত্রীয় সংগীত, সেখানে প্রবেশাধিকার আজও অর্জনসাপেক্ষ। অথচ প্রান্তজন তাকে নস্যাৎ না করে প্রবেশাধিকার চাইবেই। বশিষ্ট-নারদের মতো এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে গেটপাস্ জোগাড়ের জন্য লড়ে যাবে। তবে নিজস্ব বৃত্ত থেকে ক্ষমতাবৃত্তে প্রবেশের অনুমোদন চাইলে ব্যক্তিকে দলছুটও হতে হয়। গ্রাম থেকে বাধ্যত চলে যাওয়া গুপী-বাঘার যাত্রাপথ একে অপরের দেখা হওয়া ইস্তক কিন্তু নিঃসঙ্গ। কোনও সঙ্গী তাদের শ্রেণি থেকে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। গুপী বাঘার দেখা হবার পরে ক্রমে সখ্য। ভাগ্য বিড়ম্বনাই তাদের বন্ধুতার সাধারণ সূত্র।

এর পরেই আমরা পাই সেই বহুচর্চিত দৃশ্য, সাড়ে ৬ মিনিটের ভৌতিক নাচ। এই দৃশ্যের প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে অতীতে নানা কথা হয়েছে। 'দর্পণ' পত্রিকায় গুরুদাস ভট্টাচার্যকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলছিলেন - “আমার ভূত বদলে দিয়েছি। চেনা ভূত এনে লাভ কি? বাস্তবকে আনা যাক না! ভেবে ভেবে চার জাতের ভূত তৈরি করলাম। রাজা-ভূত, প্রজা-ভূত, বেনে- ভূত আর সাহেব-ভূত। এদের দিয়ে একটা ছোটখাটো নাটক গড়ে তোলা গেল।”

অন্য এক আবার জায়গায় সত্যজিৎ বলছেন - “যারা মরেছে অ্যাকচুয়ালি, তারা যদি ভূত হয় - কতকগুলি ক্লাস অব পিপল যারা অবভিয়াসলি বাংলাদেশে ছিল - রাজা রাজড়া তো ছিলই, একেবারে বৌদ্ধ আমল থেকে এবং তারপর চাষাভুষোও ছিল - আর সাহেবরা তো প্রচুর আছে - বীরভূমে যেখানে আমরা শুটিং করেছিলাম, তার মাইল দশেকের মধ্যেই কবরখানা এবং তারা বহু মরেছে অল্প বয়সে আর কী এবং আরেকটা জাস্ট ফোর এ ভিজুয়াল কন্ট্রাষ্ট যদি একটা মোটাদের দল করা যায়। সেখানে কারা কারা থাকবেন? না, এরকম ওয়েলফেড পিপল - বানিয়া টানিয়া, ফলারের বামুন টামুন হল, কিছু পাদ্রি - এরকম নিয়ে একটা যদি গ্রুপ করা যায়। তখন চারটে ক্লাসে পরিণত হল জিনিসটা - একটা হচ্ছে রাজাদের, একটা হচ্ছে চাষাদের, একটা হচ্ছে সাহেবদের, একটা হচ্ছে মোটাদের মানে হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিদের ভূত। চারটে যখন হলো, তখন ইমিডিয়েটলি আমার একটা ক্লাসিক্যাল মিউজিক্যাল ফর্মের কথা মনে হলো... কর্ণাটকি সাউথ ইন্ডিয়ান পারকাশন ইন্সট্রুমেন্ট চালবাদ্যকাচেরি বলে তাকে - বারো রকম পারকাশন - মৃদঙ্গ, ঘটম্ মানে হাঁড়ি, খঞ্জিরা আর মুড়শৃং মানে একটা ছোটো যন্ত্র মেঁয়াও মেঁয়াও করে বাজে। এই চারটে নিয়ে অসাধারণ একটা জিনিস ওরা করে, যেটা পৃথিবীর কোনো মিউজিকে আছে বলে আমার মনে হয় না - একেবারে ইউনিক। ...আমি ভাবলাম, এই চারটে শ্রেণীর ভূতকে এই চারটে যন্ত্রের সঙ্গে যদি আইডেন্টিফাই করা যায়। মৃদঙ্গ হলো রাজার, যেহেতু মৃদঙ্গটা রিয়্যালি ক্লাসিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট। তাই নাচের ফর্মটা একেবারে ক্লাসিক্যাল রাখা হলো। খঞ্জিরা হলো চাষাভুষোর - একেবারে চাষাভুষো এবং তাদের একটু সেমি ফোক ধরণের করা হলো। সাহেবদের জন্য ঘট্টম রাখা হলো, একটু কটকটে আওয়াজ - একটু রিজিড আওয়াজ। সেইজন্য সাহেবদের আন্ডারক্র্যাঙ্ক করে তোলা হলো, অর্থাৎ সিক্সটিন ফ্রেমে তোলা হলো যাতে সমস্ত জিনিসটা একটু উডেন অ্যান্ড মেকানিক্যাল হয়ে যায়। আর মোটাদের জন্য ঐ মুড়শৃং রাখা হলো যেটা একটা ফোক ইন্সট্রুমেন্ট একেবারে। আচ্ছা এই করে তারপর ঠিক হলো তাদের ফর্মটা কি হবে। তাদের ফর্মটা হচ্ছে ধীরে ঢিমে থেকে আরম্ভ করে, চারটে যন্ত্রই সে ঢিমে লয়ে বাজলো, আস্তে আস্তে তারপর মধ্য লয়ে বাজলো - এই করতে করতে তারা পাঁচটা মুভমেন্টে লয় বাড়িয়ে একেবারে জলদে পৌঁছে যাবে। তারপর ঠিক হলো এই যে পাঁচটা মুভমেন্টের মধ্যে দিয়ে এরা যাবে - এরা করবেটা কি? মানে মুভমেন্টটা বাড়ছে কেন? কেন লয়টা বাড়বে? ...তখন ঠিক হলো যে এরা (ভূতেরা) আসুক, এরা নাচুক, এদের দ্বন্দ্ব লাগুক, পরে ভীষণ যুদ্ধ হয়ে মরে যাক। অটোম্যাটিকালি একটা ফ্রেনজিতে চলে যাচ্ছে জিনিসটা - ফাইন্যালি আমার মনে হলো একটা কোডা মতো দরকার, যেটাতে দে মাস্ট অল বি ইন হারমনি উইথ ইচ আদার - কেননা ভূতেদের ইন্টারন্যাল দ্বন্দ্ব বলে তো কিছু থাকতে পারে না, একটা অবস্থা আসবে যখন, তখন মিলনটা সহজেই ঘটবে, যেটা মানুষের মধ্যে কিছুতেই সহজে হচ্ছে না - সেটা ভূতেদের মধ্যে একটা গানের মধ্যে দিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে পুরো জিনিসটা এমার্জ করলো"।

চোখে আঙুল দিয়ে সমাজবিন্যাস ক্ষমতাতন্ত্রের প্রতীকগুলিকে একে একে দেখাচ্ছেন সত্যজিৎ। শেষমেশ বরিষ্ঠ ভূতের আশীর্বাদে গুপী-বাঘা পেল গানের দুনিয়ায় প্রবেশাধিকার। চোখ এড়ানো উচিত নয় গুপী-বাঘাকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন যে ভূতের রাজা, তার গায়ে জড়ানো পৈতে। অর্থাৎ কোনও ব্রাহ্মণের মৃত্যু পরবর্তী দশা। কাস্ট সিস্টেম বা বর্ণবাদ মৃত্যুর পরেও আমাদের পিছু ছাড়েনি। অন্যদিকে সংগীত শিক্ষার জন্য শ্রম নয়, গুপী-বাঘাকে নির্ভর করতে হচ্ছে অলীক তুকের ওপর। একজন প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে আছে অনুমোদনের ওপর। রেশনের চাল অনুমোদিত হলে রামচরণ মুন্ডা বেঁচে যেতেন।

গুপী-বাঘার বর চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাক। আব্রাহাম মার্সলো নামক সমাজতাত্ত্বিক 'হায়ারার্কি অফ নিড' নামক একটি পিরামিড তত্ত্ব অবতারণা করেছিলেন। সেখানে তিনি দেখান, মানুষ চাহিদার ধাপে ধাপে এগিয়ে এক একটি অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবেই পূর্ণতর হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু পিরামিডের প্রতি ধাপ আগের তুলনায় ছোট অর্থাৎ খাদ্যের অধিকার যত মানুষের, বাসস্থান তারা সবাই পাবে না। বাসস্থান যারা পাচ্ছেন তারা সকলেই বস্ত্র পাবে না। এই পিরামিডের শীর্ষে রয়েছে self-actualization বা নিজেকে জানা ও চেনা। গুপী বাঘা ভেবেচিন্তে তিন বর চেয়েছে তথা খাওয়াপরা, ঘুরে বেড়ানো এবং গানের অধিকার অর্থাৎ অন্ন বস্ত্রের ভাগ হওয়ার পরেই যে কোনো সাধারণ মানুষের মনেই আসে, “থাকি ঘরের কোণে সাধ জাগে মোর মনে অমনি করে যাই চলে যাই নতুন নগর বনে”, এই ভাবখানা। আর শেষে ওই self-actualization বা শিল্পের মধ্যে দিয়ে নিজেকে জানা ও চেনা। এই অধিকার সকলে পান না। আমাদের গুপী-বাঘা পেল। ছবির এই অংশে পর্যন্ত কোথাও কোনো যুদ্ধের দামামা নেই আমাদের ব্যক্তিজীবনে হায়ারার্কি অফ নিডেও কোথাও জীবনযুদ্ধ ব্যতীত আর কোনো যুদ্ধ নেই। তবে যুদ্ধ এক আফিম গোলির মতো।

মুর্শিদাবাদ নদিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে গেলে দেখা যাবে, নামাজি মৌলানা না-নামাজির সঙ্গে যুদ্ধ করছে। বাইরের প্ররোচনায় হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। ক্ষণিকের উত্তেজনা যা বাইরে থেকে অনুঘটক প্রবেশ করিয়ে নিস্তরঙ্গ জীবনে তরঙ্গের সঞ্চার করানোর জন্যই যেন করানো হয় আর পুতুল নাচের মতো করে নাচেন কিছু মানুষ, জড়িয়ে পড়েন, মনোযোগ দেন, অংশ নেন। সেনাকর্মীরা পেশার সূত্রে এই বর্গের মধ্যেই পড়েন। এত ট্যাংকার, এত কামান, এত কার্তুজ, গুলিগোলা ২৪ ঘন্টা যুদ্ধ করার জন্য নয়, সেনা মজুদ করে রাখা হয় সময় এলে বিপক্ষকে শক্তি প্রদর্শনের জন্য, মানুষকে যুদ্ধের আফিম খাওয়ানোর প্রয়োজন অনুভব করলে, রাজনৈতিক শত্রুতার একটি আবহ তৈরি করে ফেলা হয় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে। ভারতবর্ষ বা পাকিস্তানই নয়, দেখুন রাশিয়া-ক্রিমিয়া, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন। এটাই আধুনিক রাষ্ট্রের গঠনগত দিক। পুলওয়ামা-বালাকোট ঘটনার সময় ভারতবর্ষের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন একুশ দিন ধরে পাকিস্তানের নৌ-সীমান্তে চাপ তৈরি করে রেখেছে। অন্যদিকে, ক্ষুধার্ত মানুষ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সমস্ত অনাচারের অন্যায়ের সমাপ্তি চায়। এই সংখ্যাটা পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার নিরিখে অনেক অনেক বেশি। তারা ভায়োলেন্ট যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত যখন তখন। আমাদের গুপী-বাঘা ঘুণাক্ষরেও যুদ্ধের কথা ভাবে না, গান তাদের অস্ত্র। কোনো হিংসা কোনো আগ্রাসন দ্বারাই তাদের মগজ আর দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত নয়।

আরও একটি বিষয় আমাকে ভাবায়, গুপী-বাঘা সম্ভবত ক্ষমতার অংশ হতে চায়, বলা চলে উন্নতিকামী রাষ্ট্রের একজন প্রতিনিধি হতে চায়, রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে চায়, কিন্তু রাজা হতে চায় না। যুদ্ধ নয়, তার মন গভর্নেন্সে - সুশাসনে। গোটা ছবি জুড়েই তাঁরা বারবার দুটি রাষ্ট্রের মূল সমস্যাটিকে চিহ্নিত করতে চায়। মানুষের মৌনীভাব দূর করা অর্থাৎ প্লুতস্বরকে মান্যতা দেওয়া, অন্য দিকে যুদ্ধবাজদের শ্রমিকের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা। এই দুই চাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে উন্নতিকামী রাষ্ট্রের সাফল্যের চাবি। গুপী বাঘা যেমন অনেকেই বলেন গুপী-বাঘা ততটা নয়, হীরক রাজার দেশে অনেক বেশি রাজনৈতিক ছবি। কিন্তু এই যুদ্ধের পরাভবে বন্দি অবস্থায় আমি গুপী গাইন ও বাঘা বাইনকে ভারতবর্ষের বর্তমান সময়ের নিরিখে প্রবলভাবে রাজনৈতিক মনে করি।

গুপী গাইন বাঘা বাইন রূপকথার কিনো রূপান্তর। তার শরীরে লেগে আছে রূপকথার দোষ-গুণগুলি। আমরা আলাদা করতে পারি না তাকে। রূপকথার মৌলিক চরিত্রের কারণেই ছবিতে কিছু বৈশিষ্ট্য আপনা থেকেই যোগ হয়েছে। তৈমুর রেজা ‘ঠাকুমার ঝুলিঃ একটি পাঠ’ নামক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ দেখাচ্ছেন, ঠাকুমার ঝুলির অন্তরঙ্গটি দাঁড়িয়ে আছে অন্যান্য রূপকথার মতো, অভাব-যাত্রা-আরোপণ-প্রতিপক্ষ এই চারটি স্তম্ভের উপর। আমাদের প্রোটাগনিস্ট প্রথমে গরিব প্রান্তিক সন্তান, ভাগ্য দোষে অনির্ণেয় যাত্রা তাদের। ঠাকুমার ঝুলির শুকপাখির মতো দৈবশক্তি হিসেবে তাঁদের নতুন যাত্রা শুরুয়াত করে ভূতের রাজা। সহজেই চিহ্নিত হয় ভালোর প্রতিপক্ষই গুপী ও বাঘার প্রতিপক্ষ। তবে আমাদের ছবিতে আরোপণের ক্ষেত্রটি অন্যরকম। গুপী-বাঘা কলাবতী রাজকন্যা মতো নয়, তারা ভাবনাচিন্তা করে কোনো ভুলের পথে পা বাড়ায়নি, বরং তাদের অভিপ্রায় অন্য। গুপী বাঘাকে প্রতিপক্ষকে হত্যা করে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়নি। তারা আক্ষরিক শান্তিকামী। হিংসা এ গল্পের বুনিয়াদই নয়। ছবিতে বারবার রূপকের আড়ালে পাখি ফিরে আসে। যে হাল্লার রাজা কুশপুত্তলিকার পেটে বর্শা বিঁধে আনন্দ পান মন্ত্রীর শয়তানিতে, তিনিই অবসরে আবার পাখি বানান।

আমরা একটু পিছনে তাকালেই দেখব, বাংলা রূপকথার প্রতিটি রাজকুমার যেমন আসলে রাজ সিংহাসনের প্রতি আসক্ত। বিত্ত আর ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার সেই আসক্তি নেই গুপী-বাঘার। গুপী-বাঘা ক্ষমতা চায় না, কিন্তু ক্ষমতাবৃত্তকে মান্যতা দেয়, বলা চলে প্রান্তজনের ঘর থেকে আসা একজন, সদস্য হয়ে ক্ষমতাবৃত্তে অংশগ্রহণ করে। গুপী-বাঘা একধরনের দায়িত্বহীন ক্ষমতার ভোক্তা, যদিও তাঁদের দায় আছে, অনেকটা সাংসদদেরই মতো। আবার একথাও সত্য গুপী-বাঘা অপু নয়। তাঁদের গ্রামে ফিরে যাওয়ারও সেই তাড়না নেই। তাহলে, একটি গোটা ছবির মধ্যে দিয়ে কি একটি ভাল প্রশাসকের হাতে আরোপিত নির্ভার জনতার বাসযোগ্য আধুনিক রাষ্ট্রের রূপকল্প নির্মিত হচ্ছে না? অনেকটা যেন পুরনো গ্রিসের মতো। গ্রিক নাটকের মতোই এখানে গান একটি ক্যাথরসিস টুল। গায়ক এবং বাজনদার নবরত্ন সভার অলংকার, তারা মানুষকে গানে গানে দুঃখ দুর্দশার কথা ভুলিয়ে দেবে, একই সঙ্গে রাজাকে স্মরণ করিয়ে দেবে তাঁর ভুলের কথা। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতের চারণের ভূমিকার সঙ্গে, ব্রিটিশ শাসনে বিশ্বাসী রামমোহনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু জেমস সিল্ক বাকিংহাম-এর একইসঙ্গে রাজ আনুগত্য এবং রাজবিরোধিতার সঙ্গে গুপী-বাঘার কিছু মিল রয়েছে। গুপী-বাঘা ক্ষমতার মধ্যে থেকেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে চায়। ফকিরদের মত নিজস্ব কৌমের মধ্যেই গানে গানে অজানা দেশের সন্ধান করতে চায় না। আবার গুপী-বাঘাকে বলা চলে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সাংবাদিক। ‘যত চালাকি তোমার জানতে নাইকো বাকি আর’, এই বাক্যবন্ধে সেই ক্ষিপ্র ক্রাইম জার্নালিজম আর প্ৰশ্ন করার মনটির ছবিই ধরা রয়েছে।

রাজনীতি নিয়েই যখন কথা হচ্ছে, গুপী-বাঘার গানের রাজনীতি - না-রাজনীতি নিয়েও কথা বলতে হয়। একটি মেসেজ ছবিতে গানের যে কার্যকারিতা থাকে, গুগাবাবাতেও তাই রয়েছে। মিউজিক্যাল ছবি, সত্যজিৎ সর্বার্থেই তাকে গানের মালায় সাজিয়েছেন। গানগুলি সহজ, দাদরা-কাহারবায় বাঁধা, মধ্যম বা দ্রুত লয়ের, লোকায়ত নির্যাসে ভরপুর। সত্যজিতের নিজস্ব কথায় ‘সেমি ফোক’ ব্যবহৃত হয়েছে এই ছবিতে। দেখা যাচ্ছে, গুপী এবং বাঘা গানকে তিনটি কারণে ব্যবহার করে। ১. শিল্পে অনুরাগ। গান দিয়ে তারা নিজেদের এবং লোকের মনরঞ্জন করতে চায়। ২. পরিস্থিতি ব্যক্ত করতে গুপী-বাঘা গানের শরাণাগত হয়। ৩. গান দুঃখহরা। গান শুনে মোহিত মানুষ পাথরও হয়ে যায়, এই গুপী-বাঘাই কিন্তু বোবাকে বাঙ্ময় করেছিল। এই দুঃখহরণের জায়গাটিকে আমরা গ্রিক নাটকের আদিসূত্র ধরেই পড়ছিলাম। ক্যাথরসিস শব্দটি প্রাথমিক ভাবে এসেছে একটি চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে জড়িত একটি শব্দবন্ধ থেকে। প্রাচীন গ্রিসে প্লেটোর নেতিচিন্তার বিপক্ষ যুক্তি হিসেবে ক্যাথারসিস ব্যবহার হত। প্লেটো দেখান শিল্প মানুষের মধ্যে কতগুলি আবেগ বাইরে থেকে সঞ্চার করে, যা আমাদের জীবনের আবেগ নিয়ন্ত্রণের জৈবিক বাঁধকে ভেঙে দেয়। শিল্পের মোহগর্তে পড়ে মানুষ আকুল হয়ে কাঁদে, বাধভাঙা হাসে। অনেকটা অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের তুঙ্গ মুহূর্তগুলির মতো যেন। এরই প্রতিযুক্তি ক্যাথারসিস। ইডিপাস রেক্স-কে সামনে রেখে দেখানো হয় এই ধরনের নাটক মানুষকে দৈনন্দিনের ফিয়ার সাইকোসিস বা বাস্তবিক ভয়-ভীতি থেকে মুক্তি দেয়। কলের জলে জমাট বাধা রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলার মতো ব্যাপারটা। ট্র্যাজেডি ব্যক্তির ব্যক্তিগত দুঃখবোধকে উপড়ে ফেলে একটি আরোপিত সমস্যার আবহে এসে পড়ে, ব্যক্তি ক্রমে সমষ্টি হয়ে যাবে। আধুনিক নাট্যকার ব্রেশট এই পন্থার তীব্র বিরোধিতা করেন। দর্শককে রাজনীতিবিমুখ অনুগত করে দেওয়া বুর্জোয়া থিয়েটার বলে একে চিহ্ণিত করেন ব্রেশট, এখানে কালেক্টিভকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি মোডাস অপারেন্ডি কাজ করে, রাষ্ট্রেরই মিনিয়েচার। আমাদের গুপী-বাঘাও তো মুশকিল আসান, গানে গানে সে দুঃখহরা ঔষধি ফেরি করে। আমাদের দাঁত নখ ক্রমে ভেঙে যায়।

আবার দেখুন গুপী-বাঘার গানে লোকায়ত সুরের বহতাটুকুই নেওয়া হয়েছে, বলাই বাহুল্য সত্যজিত অনেক পরিব্যাপ্ত সঙ্গীতের টুকরো টাকরা এই ছবির মেরুদণ্ড তৈরি করতে ব্যবহার করেছেন। লোকায়ত জ্ঞানকাণ্ডটিকে এই গান বহন করে না। কায়িক শ্রম লাঘবে, কোনো বিশেষ উৎসব, আচার অনুষ্ঠানে, কোনো বিশেষ সাধনার অঙ্গ হিসেবে উঠে আসে না গুপী-বাঘার গান। সত্যজিৎ প্রান্তজনের বলিয়ে হিসেবেই আনলেন গুপী-বাঘাকে, কিন্তু তাঁদের বলার কথায় কৌম পরম্পয়রার চিহ্ন নেই এতটুকুই। কিন্তু এই গানে কোনো লোকাল চিহ্ন নেই। কোনো কৌমের পরম্পরার সূত্র নির্দেশ করে না। গুপী-বাঘার গানকে বাইনারি অপজিশন অর্থাৎ ধ্রুপদী গানের পালটা হিসেবে দাঁড় করানো হল। ছবিতে দেখানো হল গান হল দুই রকম, যথা রাজসভার গান ও হাটমাঠের গান। কিন্তু গুপী-বাঘার গান হাটমাঠের গানের আবেশ, শহুরে নির্যাসীকরণ। ছাদ পেটাই, ধান ভাঙার মতো শ্রমের গান, তিন্নাথ বা মনসা ভাসানের মতো ধর্মীয় গান, ফকির বা বাউলের মতো সাধনার গান কোনওটিই নয় গুপী-বাঘার গান। বলা যায় লোকায়ত সুরের চলনটিকে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক, এই মাত্র। যখন রাজার কার্যসিদ্ধিতে (ভাল) এই গান ব্যবহৃত হয়, তখন সরকারি প্রকল্পে পটুয়া বা বাউল শিল্পীকে ব্যবহারের প্রবণতার সঙ্গে একে মিলিয়ে পড়া যায়। আধুনিক রাষ্ট্রের নিয়মই এই, বড় শক্তি ছোট শক্তির গুণগুলিকে ব্যবহারিকভাবে কাজে লাগাবে। এতে প্রান্তের ক্ষতি হয়। অন্তত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সাপেক্ষে বহু লোকায়ত শিল্পী তাদের নিজের গান ভুলে যাচ্ছেন সরকারি প্রকল্পের গান গাইতে গাইতে। বহু পটুয়া দীর্ঘ পট আঁকা ও তাদের গান ধরার ক্ষমতাকে হারিয়ে ফেলছেন। আবার অন্যদিকে বিহারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেন না রাজ্যে এনকেফেলাইটিসের ফলে মৃত্যু আটকানোর উপায়, জানেন না কেন মৃত শিশুরা নিম্নবর্গেরই (দরিদ্র মুসলমান এবং দলিত পরিবারের শিশু) একেকটি প্রাণ। আমাদের রাজ্যের পালক বা কন্যাশ্রী-রূপশ্রী প্রকল্পের প্রচারকরা জানেন না ২০১৯ সালের ১২ জুন পুরুলিয়ায় রাস্তার ধারে মারা যাওয়া এক মহিলার স্তনবৃন্তে মুখ রেখে দুধ খাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করা শিশুগুলির নাম-পরিচয়, ওই মায়ের মৃত্যুর ধারাবিবরণী। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন্দ্রের প্রতিনিধি হয়ে প্রান্তের কতটা কাছে পৌঁছনো যায়, একজন কেন্দ্রের প্রতিনিধি আদৌ প্রান্তের রক্ত ঘামের চিহ্নগুলি আর বহন করতে পারে কিনা। এই নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা যাবে অন্য কোনো লেখায়। আপাতত ব্যক্তিসিদ্ধান্ত স্বরূপ এইটুকু বলার, নাগরিক-আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাজসভার গানের পালটা স্বরটিকে রূপায়ন করেছেন সত্যজিৎ রায়।

পরিশেষে একটি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যেতে চাই। এই ছবিতে মণিমালা, মুক্তামালা ব্যতীত কোনো নারী নেই। গুপী-বাঘা কার্যসিদ্ধি করার ফলস্বরূপ তাদের পাবে। রাজাও মনে করেন না, গুপী-বাঘাও মনে করে না মণি-মুক্তোর নিজস্ব বয়ান রয়েছে। সত্যজিৎ ছোটদের শিল্পী, দশকের পর দশক ধরে তিনি ছোটদের মোহাবেশে আবিষ্ট করে রেখেছেন। বড়রা বার কয়েক সেই ছোটগল্পে বা গোয়েন্দা গল্পে নারী চরিত্রের অনুপস্থিতি নিয়ে অনুযোগ জানায় লেখালেখিতে। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে সেই অনুপস্থিতিকে অবমাননাকর লাগে না, গল্পকারের সীমাবদ্ধতা থাকবেই, সত্যজিৎ সেই সীমার মধ্যেই ছোটদের গল্পে তুঙ্গস্পর্শী। কিন্তু এই ছবিতে রূপকথার আবহমান ধারাটিকে দৃষ্টিকটূভাবে মান্যতা দেয়। হিলারি এস ক্রিউ 'Spinning New Tales from Traditional Texts: Donna JoNapoli and the Rewriting of Fairy Tale' নামক প্রবন্ধে ফেয়ারি টেল বা রূপকথাকে ফেলে দিয়ে, নয়া লিখন দাবি করেন। বহু নারীবাদী লেখাজীবীই ডিজনি হোক বা অন্য রূপকথা, দোষগুলিকে চিহ্নিত করেছেন। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি রূপকথাতেই আদর্শ মহিলা একজন রানি বা রাজকন্যে। অথবা সে একজন ইবলিশ বা শয়তান, ডাইনি। যে ছোট মেয়েটি এই রূপকথা দেখবে, তার জন্যে রানি বা রাজকন্যে হতে চাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো পথ নেই। পারিপার্শ্বিকের মধ্যেও যে বা যারা রানির মতো নয়, তারা যে শয়তান বাদ দিয়েও অন্য কিছু হতে পারে, সেই চেতনার পথে অন্তরায় এই ধরনের রূপকথা। একই সঙ্গে এই সব রূপকথাতেই দেখানো হয় মণিমালা-মুক্তামালারা এক পুরুষের রোমান্টিক চেতনায় অভিসারিকার মতো। একজন শিশুকে (মেয়ে) ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে এই অভিসারিকা হয়ে উঠতে হবে, আর নয়ত সে অভিসারিকার জন্যে নিজেকে তৈরি করবে। আবার, মানুষের নৈতিক মূল্যায়নের চাবিকাঠি যে অর্থ এবং একমাত্র অর্থই তাও বুঝিয়ে দেয় রূপকথাই। অর্থবান মান্যতা পাবে, দীনজন পাবে না, প্রান্তজন প্রান্তবাসী হয়েই থাকবে, কেননা সে তাৎপর্যহীন। রূপকথার আমূল সংস্কার করতে পারে/পারত সিনেমা। করেনি এ যাবৎকাল। সত্যজিৎ রায়ও বিষয়টিকে তলিয়ে ভাবেননি সম্ভবত।

প্রান্তজনের ডিজায়ার, প্রতিস্পর্ধা, ক্ষমতার প্রতি বাইরে থেকে প্রশ্নের তরবারি প্রদর্শন, সর্বোপরি প্রান্তে থেকেই উলগুলান রচনার রাজনীতি আমাদের প্রিয় গুপী-বাঘা প্রদর্শন করেনি। বারীন সাহা 'চিত্রভাষ' পত্রিকার ২৭-২৮ নং সংখ্যায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, “গুপী গাইন বাঘা বাইন ওর সব ছবির সেরা ছবি। ভীষণ স্পন্টেনিয়াস ছবি। এটা একেবারে রক্ত-মাংস থেকে বেরিয়ে আসে। ভীষণ এন্টারটেইনিং এর গান কি অসাধারণ! একটা ইরেশনাল ব্যাপার যে ইরেশনাল নয় এটা সিনেমাতে সিনেমার মতো তুলে ধরা এটাই এর চমৎকারিত্ব। এটা আমার কাছে খুব বড় ব্যাপার। এটা ফ্যান্টাসির একটা লেভেলে যায় অথচ ফ্যান্টাসি নয়। 'হীরক রাজার দেশে'ও তাই। তবে গুগাবাবা অসাধারণ এই ছবিতে কোন বিদেশী প্রভাব আছে বলে মনে হয় না এটা পুরোপুরি একেবারে দিশি ছবি। সুকুমার রায়ের ছেলে উপেন্দ্রকিশোরের নাতির পক্ষেই সম্ভব এই ছবি করা। এই ছবিতে যেন সত্যজিৎ নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। পথের পাঁচালী-তে তবুও অনেক চেষ্টাকৃত ব্যাপার আছে। অন্য পরিচালকদের কাজের বিষয় ভাবা হয়েছে, যারা এমন ছবি করেছেন কিন্তু গুগাবাবা-তে তা নেই এটা বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিদেশীরা হয়তো এর মজা নিতে পারবে না তেমনভাবে তবে আমাদের কাছে এটা সম্পদ। এমন ছবি আমাদের এখানকার কোনও পরিচালক কোনদিন করতে পারবেন না। সত্যজিৎ হাইলি অরিজিনাল এটা উনি সিনেমা করব ভেবে না করেও সিনেমাই হয়েছে এতে যে সেন্স অফ হিউমার তা পরম্পরার জন্যই সম্ভব হয়েছে। এটা একটা নিখুঁত ছবি। এই ছবি সিরিয়াস নয়, একটা হাসিখুশির ভাব সবসময় আছে। ছবিতে কোন বাঁধন নেই, একেবারে স্বতস্ফূর্ত, দর্শকরা হয়তো তাই ভাবেন। শুধু ইন্টেলেকচুয়াল বোধহয় অন্যরকম ভাবেন। এটা পুরোপুরি উপভোগের ব্যাপার ছবিতে মাথা খাটানোর দরকার নেই আট থেকে আশি সবাই একসঙ্গে উপভোগ করতে পারবেন। আমার এখনকার উপলব্ধি, সিনেমাতে অত মাথা ঘামানো থেকে স্বতঃস্ফূর্ততা উপভোগ্যতা অনেক বেশি জরুরি, যেন সাধারণ লোক বুঝতে পারে।” আবাল্য চেনা পরিচালকের যাত্রাপথের ধারে মাইলফলক রচনা করে গিয়েছেন অন্য একজন, এক ছবিতে প্রান্তজনের জীবনকাব্য লিখে ক্যামেরা নামিয়ে রাখা কিনো ক্ষ্যাপা। তাঁর এই উক্তির মধ্যেই আমাদের প্রশ্নের উত্তরটি রয়েছে। আপাতত আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এই ছবিকে মাথা খাটিয়েই পড়লাম।