আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

নতুন শিক্ষানীতিঃ এ কোন ঐতিহ্যের আবাহন?

উর্বী মুখোপাধ্যায়


গত ২৩ জুলাই, সামগ্রিক করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় তৃতীয় জাতীয় শিক্ষানীতি পাশ হয়ে গেল। এর আগের শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, অর্থাৎ প্রায় ৩৪ বছর আগে। গত ৩৪ বছরে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, যোগ হয়েছে নতুন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মাত্রা। প্রযুক্তিতে অন্তর্জাল ব্যবস্থা যেমন একদিকে বিশ্বধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি সোভিয়েতের পতন, বাজার অর্থনীতির উন্মুক্ত পদচারণা বিশ্ব পরিস্থিতির আমূল রূপ পালটে দিয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে ১৯৯২ সালে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়, যার ফলস্বরূপ শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে আংশিক বেসরকারি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি শিক্ষার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। এই একই কালপর্বে দেশের অভ্যন্তরেও পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। নয়ের দশকের গোড়া থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতির ধ্বজাধারী হিসেবে কংগ্রেসের গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য দল ও সরকারের মধ্যে চরম দক্ষিণপন্থী অংশ থেকে চাপ বাড়তে থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাঠক্রমে, বিশেষত ইতিহাস ও অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের পাঠক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী বিশ্লেষণ ‘পক্ষপাতপুষ্ট’ বা ‘জাতীয় অবমাননার দায়ে দুষ্ট’ বলে প্রতিপন্ন হতে থাকে। ফলে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে এই কয়েক বছরে নানান সময়ে পাঠক্রমে নানান পরিবর্তন আনা হয় যা শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের পথ প্রশস্ত করে। তবে ২০১৯-এ বিশাল জন-সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে শুধু পাঠক্রমে পরিবর্তন নয়, সমগ্র শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন সাধনের কথা বলা হতে থাকে। এই উদ্দেশ্যেই ২০১৬ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে সুব্রমনিয়ন কমিটি ও কস্তুরীরঙ্গন কমিটি নিযুক্ত হয় ও তারা দুটি রিপোর্ট পেশ করে। শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিবর্তন সাধনের জন্য, বিশেষত সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অভিন্ন পাঠক্রম ও পরীক্ষা ব্যবস্থা আনতে এই দুই কমিটিই নতুন শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তুত করার জন্য সুপারিশ করে। মূলত এই দুই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই নতুন শিক্ষানীতির খসড়া রচিত হয়।

ইতিহাসের একজন ছাত্রী, গবেষক এবং প্রায় গত দু-দশক ধরে উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত এক শিক্ষক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রেক্ষিত থেকে বলতে পারি, এই নতুন শিক্ষানীতিতে বারংবার যে জাতীয় ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণের নামে এক ইতিহাসবোধের উত্থাপন করা হয়েছে তা আমার কাছে বেশ অস্বস্তিকর ঠেকেছে। এই ইতিহাসবোধের অবতারণা নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবং আমি এই নিবন্ধে নথিটি আলোচনা করে তার সমস্যাগুলি সম্পর্কে মূলত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

এই শিক্ষানীতি প্রস্তাবনার নথির দ্বিতীয় পাতাতেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে এই নীতির পিছনে 'প্রাচীন ও শাশ্বত ভারতের উন্নত জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য আলকবর্তিকা রূপে সহায়তা করেছে।'

(১) এই প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথা তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা ও বল্লভীর নাম আদর্শ শিক্ষাঙ্গন রূপে উল্লেখিত হয়েছে । বলা হয়েছে যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সার্বিক উন্নতি প্রকল্পে বহুমুখী পাঠক্রম (multi disciplinary) প্রচলিত ছিল, যার ফলস্বরূপ চরক, সুশ্রূত, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ভাস্করাচার্য, ব্রহ্মগুপ্ত, চাণক্য, চক্রপানিদত্ত, মাধব, পাণিণি, পতঞ্জলি, নাগার্জুন, শঙ্করদেব, পিঙ্গলা বা গার্গী বা মৈত্রেয়ী বা তিরুবল্লভুর-এর মত জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার ধারা এক চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করে এবং এঁদের গবেষণা ও আবিষ্কার গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, খনিজতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, যোগ প্রভৃতি বিষয়কে সমৃদ্ধ করে।

(২) লক্ষণীয়, এই দীর্ঘ তালিকায় অধিকাংশ নামধারীই তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য উল্লেখিত হননি। পাণিণি বা চাণক্য, আমরা সবাই জানি, কোনোভাবেই বিজ্ঞানসাধনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, অথচ তাঁদের প্রসিদ্ধির বিষয়গুলি বিস্তারিত ভাবে উপস্থাপিত হয়নি। অন্যদিকে, উল্লেখিত নারীরাও সে অর্থে উল্লেখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রত্যক্ষ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাননি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, সরকারি দলিল বা রিপোর্টে এই ধরনের ইতিহাস-গোলানো উক্তি প্রথম নয়। বস্তুতপক্ষে এমন বিভ্রান্তিমূলক অতীত আবাহন কস্তুরীরঙ্গনের করা খসড়ায় থাকায় তার তীব্র সমালোচনা করেন ঐতিহাসিক কুমকুম রায়। তিনি এইভাবে অতীতের অবতারণা যে আদতে ইতিহাসবোধ পরিপন্থী সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক করে দেন।

(৩) কিন্তু তা সত্ত্বেও এইভাবে এক প্রাচীন ভারতের গৌরবনির্মাণ প্রকল্প চলতেই থাকে। প্রশ্ন জাগে, সেই প্রাচীন যুগে তো নারী বা জাতিব্যবস্থায় অন্তেবাসীরা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে ছিলেন। শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশের শাস্তিস্বরূপ একলব্য বা শম্বুকের পরিণতিও আমাদের অজানা নয়। নতুন শিক্ষানীতি কি তাহলে সেই ঐতিহ্যও নির্বিকল্পভাবে অনুসরণ করবে? ঐতিহ্য অবতারণায় মত্ত এই নথিতে সে প্রশ্নের উত্তর কোথাও দেওয়া হয়নি। নথিতে এর পাশাপাশি এই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে পাঠক্রম এমন হওয়া উচিত 'প্রাচীন ও আধুনিক ভারতের উন্নত, বহুমুখী ঐতিহ্য সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ছাত্রসমাজকে গর্বিত করে তুলবে এবং সেই ঐতিহ্যের প্রতি তার এক অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র (rootedness) স্থাপিত হবে'।

(৪) এছাড়াও বলা হয় প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতি মেনে সার্বিক বিকাশের জন্য সে সময়ে যেভাবে বিষয় বা discipline-এর ভাগ না করেই বিদ্যাদান করা হত, সেটাই নতুন শিক্ষা নীতির কাছে আদর্শ শিক্ষা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত।

(৫) সত্যি বলতে কী, প্রাচীন ভারতের শিক্ষাদান পদ্ধতিকে ঠিক আধুনিক অর্থে multi disciplinary বলা সঙ্গত হবে কিনা তা এক বিচার্য বিষয়। কারণ discipline-এর ধারণা আধুনিক বিদ্যাব্যস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং নিরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য এক চূড়ান্ত বিশেষীকরণ পদ্ধতি প্রয়োজন হয়ে পড়লে এই ধরনের discipline ও তার সঙ্গে সংযুক্ত methodology শিক্ষা ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে পড়ে। অর্থাৎ এক ধরনের উদ্ভুত প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই ধরনের বিষয়-বিভাগ উপস্থিত হয়েছে। বিষয়গুলির মধ্যে অবশ্যই সেতুবন্ধ গড়া চলে, এবং অবশ্যই কাম্য। কিন্তু তার মানে তা নয় যে সব বিষয়ই একই প্রক্রিয়া বা methodoly মেনে চলতে পারে। কিন্তু এই ধরনের সমস্যা সম্পর্কে কোনো সচেতনতা বা নিদেনপক্ষে স্বীকৃতির উল্লেখ আলোচ্য নথিতে নেই। Multi discipline কথাটি তাই মনে হয় খানিকটা ফ্যাশনের মতো উপস্থাপনা করা হয়েছে। পাশাপাশি সমস্যা বা সমাধানের কোনো বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত না দিয়ে multi-disciplinary approach-কে এক প্রাচীন পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করায় চূড়ান্ত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলা যায়, এক সমসত্ত্ব ঐতিহ্য নির্মাণে এই ধরনের অতীত আবাহন শুধু মাত্র ভ্রান্ত নয়, বিপজ্জনকও বটে।

শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে এই নথিতে বলা হয়েছে যে আধুনিক বিশ্বে ‘ইন্ডিয়া যা কিনা ভারত’, তাকে ‘অন্যতম সুপার পাওয়ার’ করে তোলা।

(৬) এই নথিতে লক্ষ্য করলে দেখবেন এইরকম ‘প্রতিশব্দ’ আকছার ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকই কি এই শব্দগুলি প্রতিশব্দ, নাকি এক বিকল্প জাতিসত্তা নির্মাণের শব্দ-বাহক? একই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এই শিক্ষা নীতির মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে তাদের মৌলিক দায়িত্ব ও সাংবিধানিক গুরুত্বের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের প্রতি তাদের সংযোগ ও দায়িত্ববোধ নির্মাণও লক্ষ্য হবে।

(৭) আপাতভাবে এই গোটা বাক্যটি শিক্ষার মাধ্যমে এক গালভরা জাতিনির্মাণ প্রকল্প বলে মনে হলেও, খেয়াল রাখবেন, এখানে সাংবিধানিক দায়িত্ব আর দেশের প্রতি সংযোগ দুটি পৃথক বাক্যবন্ধের মধ্যে উল্লেখিত হয়েছে। শুধু এখানেই নয়, খেয়াল করে দেখবেন যেখানেই সাংবিধানিক ভাবধারার কথা উল্লেখিত হয়েছে, তার আশেপাশেই ভিন্ন বাক্যবন্ধে জাতীয় বা দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা বা সংযোগ-নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনেকগুলি রাজনৈতিক অনাস্থাই সাংবিধানিক মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে। বারংবার সরকারের নীতি বিশেষত সাম্প্রাদায়িকতা প্রসঙ্গে সাংবিধানিক নীতির পরিপন্থী বলে সমালোচিত হয়েছে। এই গোটা নথিতে একবারও সাংবিধানিক নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজম বা অসাম্প্রদায়িকতা শব্দটি নেই। সে কারণেই কি সাংবিধানিক প্রসঙ্গ এলেই পাশাপাশি এক বিকল্প জাতি-প্রকল্পের চিহ্নধারী দেশজ সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য প্রসঙ্গের অবতারণা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে?

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেশীয় বা আঞ্চলিক ভাষা এই নতুন শিক্ষা নীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। শুধু মাত্র প্রাথমিক স্তরে নয়, উচ্চ শিক্ষায়ও মাতৃভাষা শিক্ষা প্রসারে কার্যকরী রূপ গ্রহণ করতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত নথির ১৪ পাতার ৪.১৬ নং অনুচ্ছেদটি থেকে। এখানে বলা হয়, যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত' প্রকল্পের অন্তর্গত রূপে অধিকাংশ দেশীয় ভাষার সংস্কৃতসহ ধ্রুপদী ভাষার উৎস সম্পর্কে ছাত্রদের অবগত করতে হবে।

(৮) এই শিক্ষানীতির মতে এই সচেতনতা শিক্ষার্থীদের ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও বিভিন্নতার উৎস সম্পর্কে সচেতন করবে, এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য অঞ্চলের লোকেদের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক মিলন সম্ভবপর করবে।

(৯) সংস্কৃতর পাশাপাশি অন্যান্য ধ্রূপদী ভাষার উল্লেখ থাকলেও আদতে যে এই নির্দেশিকায় সংস্কৃতই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা পরের অনুচ্ছেদ থেকেই প্রতিভাত হয়ে ওঠে। স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয় যে সংস্কৃত ভাষা শুধু মাত্র প্রাচীন এক ভাষা নয়, ঐতিহ্যশালী বহুমুখী জ্ঞানচর্চার আধার।

(১০) তাই সংস্কৃত ভাষা আদতে এক জ্ঞানব্যবস্থা বা Knowledge system এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাষা।

(১১) তাই এই ভাষার গুরুত্ব সর্বাধিক। অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষাকেই জাতীয় সংস্কৃতির আধার রূপে প্রতিষ্ঠার হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পটি এই নির্দেশিকার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রকল্প অনুসরণ করলে যে আদতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বা দক্ষিণে এক বিরাট অঞ্চল সেই বৃত্ত থেকে নিজেদের দূরত্ব বোধ করবে তার প্রতি এই নির্দেশিকা উদাসীন।

পরের অনুচ্ছেদে বিবৃত হয়েছে যে সংস্কৃত ছাড়া অন্যান্য ধ্রুপদী ভাষা যেমন তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়লাম, ওড়িয়া, পালি, ফার্সি এবং প্রাকৃত ভাষাগুলিও স্কুল স্তরে গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নেওয়া আবশ্যিক করতে হবে, তাহলেই এই ভাষাগুলি 'সঞ্জীবিত ও প্রচলিত থাকবে।'

(১২) এই ধ্রুপদী ভাষার মধ্যে অনেকগুলি এখনও প্রচলিত কথ্য ও ব্যবহারিক ভাষা হওয়া সত্তেও এই মন্তব্যের কারণ পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে, এই ভাষাগুলিও যে অতীতে ব্যাপক জ্ঞানচর্চার ভাষা ছিল এবং সে কারণে সংস্কৃত ভাষার মতোই পালি, তামিল, প্রাকৃত, বা ফার্সি যে এক জ্ঞান ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, তা নিয়ে কোনো মন্তব্যই করা হয়নি। সংস্কৃত-কেন্দ্রিক প্রাচীন ভারত যে জাতীয় ইতিহাস বা ঐতিহ্য নির্মাণের একমাত্র ভিত্তি তা আরও পরিষ্কার হয়ে যায় স্কুল পাঠক্রমের অন্তর্গত knowledge of India শীর্ষক আলোচনায়।

(১৩) প্রতিবারই ইতিহাস প্রসঙ্গ অবতারণাকালে প্রাচীন ভারতের উল্লেখ করা হয়েছে এবং পক্ষান্তরে মধ্যকালীন ভারত সম্পর্কে এক নৈঃশব্দ বজায় রাখা হয়েছে। কিন্তু বারংবার একই নৈঃশব্দের পুনরাবৃত্তি এক সময়ে তাই সচেতন বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রূপে একাধিকবার যোগ, দেশীয় চিকিৎসাকে পাঠক্রমের অন্তর্গত করার কথা বলা হয়েছে। এবং একে 'Indian Knowledge System' বলে উল্লেখ করে তাকে মাধ্যমিক স্তরে ঐচ্ছিক বিষয় রূপে পরিবেশনার কথাও বলা হয়েছে।

(১৪) শুধু তাই নয়, উচ্চ শিক্ষা পাঠক্রমেও দেশীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার ধারার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে এই ধরনের বিষয় পড়ানো আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

(১৫) বলা হয়েছে যে সার্বিক উন্নয়ন ও জাতীয় ঐতিহ্য নির্মাণের জন্য এই ধরনের বিদ্যাশিক্ষা আবশ্যিক।

অর্থাৎ ভবিষ্যৎ ভারতের সার্বিক উন্নতির জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ছাত্রসমাজকে সচেতন করবে এমন এক পাঠক্রমের পরিবর্তে যে শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠক্রমের মাধ্যমে এক অতীত ঐতিহ্যের অবতারণায় এক সংকীর্ণ সজাত্যবোধ নির্মাণ প্রকল্পই এই শিক্ষানীতিতে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এই প্রকল্প আরও স্পষ্ট হয়ে যায় কিছুদিন আগের এক সরকারী সিদ্ধান্তে। গত ১৪ই সেপ্টেম্বর লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে সংস্কৃতি ও পর্যটন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল তাঁর লিখিত উত্তরে জানান যে ভারতের বারো হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য অনুসন্ধানে এক ষোলো সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই কমিটির অনুসন্ধানের কাজ সম্পন্ন হলেই এই প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের কাল ও চরিত্র সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূরীভূত হবে।

(১৬) প্রথমত, প্রাচীন ভারতের বারো হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যাপারটি কী ঐতিহাসিক হিসেবে সে ধারণা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। প্রাক-হরপ্পা পর্যায়ের মেহেরগড় সংস্কৃতিও দশ হাজার বছরের চেয়ে বেশি প্রাচীন নয়। দ্বিতীয়ত, লক্ষণীয়, এই ষোলো জন সদস্যের সবাই-ই উত্তর ভারতের, হিন্দী-ভাষী এবং উচ্চবর্ণীয় হিন্দু পুরুষ। এঁদের মধ্যে ১৪ সদস্যই প্রাক্তন সরকারি আধিকারিক এবং পদাধিকার বলে এই কমিটির সদস্য। এঁদের মধ্যে একাধিক জন ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক। এ ছাড়াও পাঁচ জন সদস্য সংস্কৃতচর্চার সঙ্গে যুক্ত। অথচ পালি, প্রাকৃত, তামিল বা ফার্সি গবেষক এঁদের মধ্যে কেউ নেই। এছাড়াও দুজন সদস্য ভূতত্ত্ব ও একজন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, এঁদেরকে বারো হাজার বছরের পুরনো কোনো সাংস্কৃতিক নিদর্শন যথা পাকিস্তানে প্রাপ্ত হরপ্পা সভ্যতা থেকেও প্রাচীন মেহেরগড় সংস্কৃতিকে আদৌ ভারতীয় সংস্কৃতি বলা যায় কিনা প্রশ্ন করলে তার সদোত্তর দিতে পারেননি। তবে অন্যতম সদস্য ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন আধিকারিক সন্তোষ কুমার শুক্লা এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ভারতে হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্য লক্ষ লক্ষ বছরের পুরোনো। সেই সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারই আমাদের প্রকল্প।

(১৭) গত ২৪শে সেপ্টেম্বর লোকসভায় এই কমিটির উদ্দেশ্য ও সদস্যদের সংগঠন ও যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্য সত্বর এই কমিটি বাতিল করার আবেদন জানান। তাতে মাদুরাই থেকে নির্বাচিত সদস্য সু ভেঙ্কাটেশন এই কমিটির সদস্য নির্বাচনকে সরাসরি সমালোচনা করে বলেন যে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সন্ধানের জন্য গঠিত এই কমিটিতে কোনো দক্ষিণ ভারতীয় সদস্য বা বিশেষজ্ঞের না থাকাটা প্রমাণ করে দেয় যে এই কমিটি তথা দেশের বর্তমান সরকার একমাত্র সংস্কৃত-কেন্দ্রিক উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারেই আগ্রহী। সেখানে সমগ্র ভারতের বিশেষত দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বা অহিন্দু, বা দলিত ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুল্লেখিতই থেকে যাবে।

(১৮) ঐতিহাসিক কুমকুম রায় তাই এই অতীতের অবতারণাকে আদতে ভারতের প্রাচীন ইতিহাসধর্মী নয় বরং বিশ্লেষণহীন অতীতচারী এক ইণ্ডোলজি বা ভারততত্ত্বের আবাহন বলেই নির্দেশ করেছেন।

(১৯) এই অতীতচারণ বৈজ্ঞানিক ইতিহাসচর্চার পরিপন্থী । বরং বলা যেতে পারে, এই নথিতে বর্ণিত অতীত প্রসঙ্গ প্রাচীন ভারতের অতীত কালকে এক নিরবিচ্ছিন্ন গৌরবগাথায় পর্যবসিত করেছে। সেই অতীতের মনুবাদী সংস্কৃতির কঠোর জাতিভেদ প্রথা অথবা কট্টর পিতৃতান্ত্রিকতা বিচার-বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে এক আদর্শ সমাজ প্রকল্প রূপে এই নথিতে উল্লেখিত হয়েছে। আমার মতে এই ধরনের অতীত আবাহন শুধু ভ্রান্ত নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে বাহন করে এক রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী সমাজ নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।


টীকাঃ ১। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p.2, para.2.
২। ঐ
৩। Kumkum Roy, ‘Examining the Draft National Education Policy, 2019’, Economic and Political Weekly, Vol 54, Issue No. 25, 22 June, 2019.
৪। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p.6. Vision.
৫। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p. 16.
৬। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p.6.
৭। ঐ
৮। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p.14, para, 4.16.
৯। ঐ
১০। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p. 14, para.4.17.
১১। ঐ
১২। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, pp. 14-15, para.4.18.
১৩। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p.17, para.4.27.
১৪। ঐ
১৫। National Education Policy 2020, Ministry of Human Resource Development, Government of India, p.37.
১৬। ‘Formed 16-member committee to study ancient Indian culture: Union Minister Prahlad Patel’, The Hindu, 14 September 2020.
১৭। Suddhabrata Sengupta, ‘Rajasaurus narmadensis and Other Mementoes of Ancient Indian Culture’, The Wire, 25 September 2020.
১৮। ‘32 MPs Ask President to Disband Committee on India’s Cultural History as Its ‘Not Pluralistic’, The Wire, 24 September 2020.
১৯। Kumkum Roy, ‘Examining the Draft National Education Policy, 2019’, Economic and Political Weekly, Vol 54, Issu No. 25, 22 June, 2019.