আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ট্রাম্পের পরাজয় অথবা বিশ্বরাজনীতির প্রিজনার্স ডিলেমা

স্বপন ভট্টাচার্য


আমেরিকার সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের পরে এ লেখা লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে বোকা বনে যাবো না তো? নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে লোকে ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম মন্তব্য করে থাকে এই ভরসায় যে পদ্ধতিটা যখন গণতান্ত্রিক তখন ভোটের আগে যতই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়ে থাকুক না কেন এবং মসনদে বিজয়ীর অধিকার চার বছরের জন্য পাকা করার জন্যই যখন ভোট, তখন ক্ষমতার হস্তান্তর রীতিমাফিক ও কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখেই হবে। ভাষ্যকারের দ্বিধাগ্রস্ততা এই যে, সঞ্জয়ের মত যা চোখে দেখা যাচ্ছে সে তার একখানা ধারাবর্ণনা করতে চাইছে বটে তবে কুরুক্ষেত্রে কৌরবপক্ষই পরাজিত হল কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দেখছি ট্রাম্পের চলে যাওয়া আর জো বাইডেনের হোয়াইট হাউসে আসা - এই দুটো ঘটনাকে একেবারে একটা আর একটার প্রতিপূরক মনে করা যাবে না। এ পুরো কালো আর ও পুরো সাদা, এভাবে রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা কাজ করলে তো কথাই ছিল না, কিন্তু তা হয় না বলেই আমাদের যা আছে তার মধ্যেই বেছে নেবার কাজটা করতে হয়। যারা বলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আমাদের এত মাথা ঘামানোর কী আছে, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় বিশ্ববীক্ষার অভাব থাকলে মানুষ ঘরেরও নয়, বাহিরেরও নয়। যে কালে আমাদের ঘরে ঘরে টেলিভিশন তো কোন ছাড়, রেডিও ছিল হাতে গোণা, শহরের এক প্রান্তের খবর ছেপে অন্য প্রান্তের মানুষের কাছে পৌঁছাতে সপ্তাহখানেক লেগে যাওয়াও বিচিত্র ছিল না কিন্তু সেই কালে চিন, ভিয়েতনাম, কিউবা, বলিভিয়া, চিলে, প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান আমাদের প্রতিবেশী ছিল। আজ ঘরের মধ্যে পৃথিবী কিন্তু সেই পৃথিবীতে, দুঃখের কথা, আমাদের বড় ঘরখানা খাটো খাটো দেখাচ্ছে।

যাই হোক, বাকি বিশ্বের সঙ্গে ট্রাম্পের আমেরিকা যে নীতি নিয়ে চলেছে, দুটো কথায় তার সারসংক্ষেপ করে দেওয়া যায়। কথাদুটি হল ইউনিল্যাটারালিজম এবং কনফ্রন্টেশনালিজম - একবগ্গা গোঁয়ার্তুমি এবং দ্বান্দ্বিকতা। ২০১৬’তে তার নির্বাচনী প্রচারেই ট্রাম্প বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল সে কী করতে চলেছে। তার শ্লোগান ছিল ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ যার নির্গলিতার্থ তখনই সে পরিষ্কার করে দিয়েছিল - ট্রাম্পের আমেরিকা কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের নিঃশর্ত বন্ধু হবে না। তার একবারে নিকটতম প্রতিবেশী দুটি দেশ - কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে বহুদিন ধরে চলে আসা বাণিজ্যচুক্তি Nafta সে নির্বাচিত হয়েই বাতিল ঘোষণা করেছিল। এদের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে সে রাজি নয়। ফলে Nafta’র জায়গা নিয়েছে ২০২০’র জুলাইতে হওয়া ত্রিদেশীয় বাণিজ্যচুক্তি US-Mexico-Canada Agreement (USMCA)। মেক্সিকোর সঙ্গে ৭২২ মাইল সীমান্তের পুরোটাই সে পাঁচিল তুলে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল এবং ৪৪৫ মাইলের জন্য অর্থও অনুমোদন করিয়ে নিতে পেরেছিল সে এই চার বছরে। নীতিতে পরিবর্তন এনে চেইন মাইগ্রেশন অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি থেকে অভিবাসন বন্ধ করে দিল সে। তার ভিসা নীতিও হয়ে উঠল মেধাভিত্তিক। এর ফলে অগণিত শিশু তাদের পরিবার, বাপ, মা বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘেটোর মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ল মেক্সিকো-হন্ডুরাস সীমান্তে। হোয়াইট হাউসে আসার তিন দিনের মধ্যেই সে বাতিল করেছিল Trans Pacific Partnership (TPP) যা হল বারোটা দেশ ও আমেরিকার মধ্যে একটা সহযোগিতার চুক্তি। আমেরিকা ব্যতীত দেশগুলি ছিল জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বাহারিন, ব্রুনেই, পেরু, চিলে এবং ভিয়েতনাম। ২০১৫ সালে গৃহীত এই সিদ্ধান্ত চুক্তি হিসাবে কার্যকর হয়েছিল বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন। বলাই বাহুল্য, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এসেই পত্রপাঠ এটিকে বাতিল করে।

TPP’র খোলসটা বাণিজ্যের হলেও এটা ছিল আসলে একটা ভূ-রাজনৈতিক চুক্তি যা মূখ্যত চিনের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশগুলোকে আমেরিকামুখী করে তোলা। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে যেটা হল তা হচ্ছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এগারো দেশের Comprehensive and Progressive Agreement for Trans Pacific Partnership (CPTPP) যেখানে আমেরিকার যোগদানের দরজা তারা খুলে রেখেছে। এর বিপরীতে চিনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership) নামের একটা মুক্ত বাণিজ্য সম্ভাবনা যেটা এই কুড়ি কুড়ির পনেরই নভেম্বরেই সই হয়েছে। RCEP হল পনেরটি এশিয়া –প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের মধ্যে একটা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি যার অংশীদার একই সঙ্গে চিন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। পৃথিবীর ত্রিশ শতাংশ মানুষ বাস করে এই দেশগুলিতে এবং তাদের মিলিত বাণিজ্যের পরিমাণ এই দু’হাজার কুড়িতে ২৬.২ ট্রিলিয়ন ডলার যা আবার সারা পৃথিবীর ত্রিশ শতাংশ বাণিজ্যের সমপরিমাণ। পৃথিবীর বাণিজ্যের অভিকেন্দ্র এই এশিয়ার দিকে সরে আসা, এ’ও কিন্তু ট্রাম্পের সময়েই বেশ একটা পাকাপোক্ত রূপ পাচ্ছিল। দুনিয়ার বাণিজ্যে আমেরিকার মুষ্টি ক্রমশ আলগা হয়ে আসার অবশ্যম্ভাবী ফল হল চিনের উত্থান এবং ট্রাম্পের একলা চল রে নীতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল সেটা।

এই যে ট্রাম্পের যাওয়া আর বাইডেনের আসার মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়ার সমস্যাটাকে প্রিজনারস ডিলেমা বলতে ইচ্ছে করছে তার কারণ হল এই যে জোটে যুক্তরাষ্ট্রের না থাকাটা এই দেশগুলোর সবার কাছে কাম্য তো নয়ই, বরং তারা হয়তো পুনরায় নেতৃত্বের ব্যাটন আমেরিকার হাতেই দেখতে চায় কিন্তু তা ঠিক কতটা খবরদারির বিনিময়ে তা অনিশ্চিত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) দেশগুলির সঙ্গে তার সম্পর্কের দিন দিন অবনতি হয়েছে। ন্যাটোতে আমেরিকার ভূমিকা বরাবরই বিগ ব্রাদারের। EU ভুক্ত দেশগুলোও এ কারণে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধে পেয়ে আসছিল। ট্রাম্পের আমলে আর্জেন্টিনার অ্যালুমিনিয়ামের জন্য বা ব্রাজিল কলম্বিয়ার কফির জন্য নতুন শুল্কহার চালু হল তেমনই হল ফরাসী ওয়াইনের জন্য বা বেলজিয়ামের চকলেটের জন্য। ন্যাটোভুক্ত বলে তাদের আলাদা রেয়াৎ তো করেই নি বরং ন্যাটো সদস্যদের খরচ বাড়াতে বলে নিজের খরচ কমিয়ে আনতে চেয়েছে সে। জার্মানি থেকে সেনা সরিয়ে এনে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্মুক্ত করে দিতে চেয়েছে এবং এই কারণে এঞ্জেলা মার্কেলের সঙ্গে তার সমীকরণে যে শীতলতা দেখা দিয়েছে তা স্মরণকালের আমেরিকা-জার্মানির মধ্যে ছিল না।

আবার এটাও বলা দরকার, চিনের সঙ্গে নতুন শুল্কচুক্তি করার ফলে ৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি সীমান্ত কর আদায় করেছে আমেরিকা এবং এই প্রথমবার তাদের বাণিজ্যে আমদানি ও রপ্তানিশুল্কের মধ্যে ঘাটতি কমে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। এখানে আবার সেই প্রিজনারস ডিলেমার কথাই ঘুরে ফিরে বলতে হয়। গোটা ইউরোপ প্রায় তাদের উৎপাদনের সিংহভাগ চিনে চালান করে বসে আছে। ট্রাম্পের তা পছন্দ নয় এবং সে মালের শুল্ক চড়া। রাশিয়া থেকে তেল আসবে সরাসরি ইউরোপে আর তার জন্য কয়েকটা দেশের মাটির তলায় পাতা হবে তেলের পাইপলাইন। ট্রাম্প বলল, সে সব দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আনতে হবে। জো বাইডেন এলে আমেরিকার চিন পলিসি বা ইয়োরোপ পলিসির রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে যাবে তা মনে হয় না। সেদিন বিবিসি-তে এক রাশিয়ান প্রতিবেদক বললেন ট্রাম্প ছিল অতিমাত্রায় প্রেডিক্টেবল - অনুমানযোগ্য। সে কী করবে তার হদিশ পেতে কোনো ধাঁধাঁ ভাঙতে হয় না। বাইডেনকে দু বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখে তেমন মনে হয় নি তাদের। রাশিয়া যে তেল রপ্তানির জন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্য দিয়ে পাইপলাইন পাততে চাইলে ট্রাম্প বাধা দেবে বা নিষেধাজ্ঞা আনতে চাইবে সেটা জানা কথাই, কিন্তু জো বাইডেন তা বিনা বাধায় হতে দেবে তেমনও কী অনুমান করা যায়? যায় না, কেন না জো বাইডেন এক দশক পুরনো আমেরিকার মূল্যবোধের শরিক, এবং সে কারণেই আনপ্রেডিক্টেবল।

তার রাজত্বকালে ট্রাম্প আর কোন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা সঙ্ঘ থেকে বেরিয়ে এসেছে তা দেখে নেওয়া যেতে পারে।

UNESCO: ২০১৮ তে সে বেরিয়ে এল UNESCO থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রধানত আমেরিকার উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘের এই সংস্কৃতি ও সৌধরক্ষা সংক্রান্ত কমিটি। এটুকু বললে অবশ্য UNESCO সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। আমরা জানি বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিজড়িত স্থান ও নিদর্শনগুলো বাঁচাতে UNESCO কি ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। ২০১১তে রাষ্ট্রসংঘ প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেবার পর এবং ইস্রায়েল একতরফাভাবে পূর্ব জেরুজালেমকে তার রাজধানী ঘোষণা করার পর রাষ্ট্রসংঘে তা নিন্দিত হবার পর, আমেরিকা ও ইস্রায়েল তাতে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সেটা ওবামার সময়। ট্রাম্প আসার পর ২০১৭ সালেই নোটিস দেয় রাষ্ট্রসংঘকে যে তারা বেরিয়ে যাবে এবং ২০১৮ এর প্রথম দিন থেকেই তারা আর ইউনেস্কোতে নেই, নেই ইস্রায়েলও। তার কালে প্যালেস্টাইন উত্তরোত্তর বিপন্ন হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও ইস্রায়েলকে সে একসঙ্গে বসিয়ে শান্তিচুক্তি সই করাতে পেরেছে বটে তবে তাতে প্যালেস্টাইন বিপন্নতর হয়েছে। বিতর্কিত জেরুজালেমে নিজেদের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাম্পের আমেরিকা বাকি বিশ্ব তথা রাষ্ট্রসংঘকে যে বার্তা দিতে চেয়েছে বাইডেনের আমেরিকা তার চাইতে অন্যতর কিছু হবে এমনটা অনুমান করার কোনো ভিত্তি নেই। তবুও ট্রাম্প গেলে প্যালেস্টাইনের মানুষের মধ্যে যে একই সঙ্গে প্রত্যাশা ও সংশয় তৈরি হয়েছে তাকে প্রিজনার্স ডিলেমা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?

ইরান নিউক্লিয়ার ডিলঃ এই চুক্তি, Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) যার ভালো নাম, সেটি আসলে আমেরিকা ইরান ছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে একটা সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এটাও স্বাক্ষরিত হয়েছিল ওবামার কালে ২০১৫’তে এবং এর মর্মার্থ ছিল ইরানকে কেবল অসামরিক কাজে পারমানবিক শক্তি ব্যবহার করতে দেওয়া। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই ছিল এখান থেকে বেরিয়ে আসা কারণ এর ফলে নাকি আমেরিকার নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। ২০১৮’তে নিরাপত্তা পরিষদে যখন ইরানের নিজস্ব সামরিকবাহিনীর জন্য অ-নিউক্লীয়ার অস্ত্র কেনার সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব ১১-২ ভোটে গৃহীত হয়, তখনই ট্রাম্প এই চুক্তির অংশীদারিত্ব অস্বীকার করে বেরিয়ে যায়। বাইডেন কি করবে? মনে রাখতে হবে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ের চুক্তি এটা। ট্রাম্প সেটা বাতিল করে এবং তার নেভি সীল বাহিনী ড্রোন আক্রমণে ইরানের ভিতরে ঢুকে সেখানকার দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব সুলেমেনিকে হত্যা করে আসে। এর পর যে উত্তেজনা এই দু দেশের সম্পর্কে তৈরি হয়েছে তা বাইডেন এলে রাতারাতি মিটে যাবে এ আশা করা যায় না, কিন্তু ভারত বা তার মত যেসব দেশ ইরানের তেলের উপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল তাদের ভিতরে ইরান থেকে বাড়তি তেল আমদানি করার অনুমতি পাবে এবার - এমন একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। প্রিজনার্স ডিলেমা হল তা হলেও হতে পারে কিন্তু ঠিক কিসের বিনিময়ে? হেজবোল্লাহ, হামাস বা প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ আমেরিকায় নিষিদ্ধ এবং ইস্রায়েল আমেরিকা সমীকরণে যেমন বাইডেন এলেও পরিবর্তন হবে না তেমনই ইরানের উপর যে প্রায় সর্বগ্রাসী নিষেধাজ্ঞা জারি আছে তা সহজে উঠে যাবে বলে মনে হয় না।

UNRWA (U N Relief and Works agency for Palestine Refugees in Near EasT): এটি রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা দ্বারা ১৯৪৯ সালে অনুমোদীত একটি উদ্যোগ যা ইস্রায়েল রাষ্ট্র গঠিত হবার পরে প্যালেস্টাইনের বাস্তুহারা মানুষদের ত্রাণ, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে আজকেও গাজা ভূখন্ডে, ওয়েস্ট ব্যাংকে এবং লেবানন সিরিয়া জর্ডনের মত কয়েকটি রাষ্ট্রে। আমেরিকা ছিল এই খাতে সর্বোচ্চ দাতা। অসম দানের ভার নিতে রাজি নয় বলে ট্রাম্প যেমন UDAid (প্যালেস্টাইন শরনার্থীদের জন্য দান) –এ টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল, তেমনই এখান থেকেও। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জার্মানি এই খাতে বাড়তি টাকা ঢেলেছে, কিন্তু আমেরিকা ফেরে নি। টাকাটাই সব হলে কথা ছিল না, ট্রাম্পের প্রশাসন এর ফলে ফিলিস্তিনি বাস্তুহারাদের স্বভূমিতে ফেরার অধিকারকেই দলে পিষে দিল বলে মনে করা যায়। এই ২০১৮ সালেই ট্রাম্প রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তার যুক্তি ছিল মানবাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রসংঘের অবস্থান ইস্রায়েলের স্বার্থের পরিপন্থী। জো বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এসব জায়গায় ফেরবার কথা বলেছেন বটে তবে সাহায্য পূর্বতন অবস্থাতেই ফিরবে তা মনে হয় না, কেন না ট্রাম্প যে হাওয়া তুলে দিয়েছে - আমেরিকার ঘাড়ে অন্যায্য বাড়তি খরচের দায় - তা রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাট নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানের মনের কথা। বাইডেন ফিরলেও খরচের মূল বোঝাটা তার পক্ষে এখন বহনের প্রতিশ্রুতি দেওয়াই কঠিন।

INF (Intermediate Range Nuclear Forces Treaty): এটা হল রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ১৯৮৮ সালে সই হওয়া একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। রোনাল্ড রিগ্যান ও মিখাইল গোর্বাচভ-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মূল কথা হল ভূমি থেকে ভুমিতে বা আকাশে ছোঁড়ার মত স্বল্প ও মধ্য-দূর পাল্লার পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালাস্টিক বা ক্রুইজ মিসাইল তারা নিজেরাই ধংস করে ফেলবে এবং ধংসের পরেও দশ বছর ধরে একে অন্যের অন-সাইট নিরীক্ষণের সুযোগ রেখে দেবে। ১৯৯১ এর মে মাসে মধ্যেই উভয় দেশ মিলে ২৬৯২ টি এমন ক্ষেপণাস্ত্র সত্যিই ধংস করে। এই নিষেধাজ্ঞা সমুদ্রে স্থিত ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য প্রযুক্ত ছিল না। ২০১৮ তে ট্রাম্প যুক্তি দিল চিনের ক্ষেপণাস্ত্র সংখায় ও পাল্লা দুইই বাড়ছে, সাউথ চায়না সী’তে চিনের প্রাধান্য মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে ফলে নিজেদের নিরাপত্তার কারণেই এই চুক্তি থেকে আমেরিকার বেরিয়ে আসা দরকার। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে এই বিচ্ছেদ সম্পন্ন হবার কথা। জো বাইডেনের পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতি এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান তার উপ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অবস্থায় আদপেই স্পষ্ট ছিল না। বোধ হয় এ কারণেই ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে পাওয়া রাশিয়ার পক্ষে অনেক বেশি সুবিধাজনক ছিল।

প্যারিস পরিবেশ চুক্তিঃ ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে দুটো সিদ্ধান্ত আলাদাভাবে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিন্দিত হয়েছে তার প্রথমটি হল প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা আর দ্বিতীয়টি হু থেকে বেরিয়ে যাওয়া। প্যারিস চুক্তি হল বিশ্বের তাপমান নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৯৫ টি দেশের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি যার মূল নীতি হল কার্বন জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে শিল্প-বিপ্লবের পূর্ববর্তী বিশ্বের তাপমাত্রার থেকে বড়জোর ২ ডিগ্রি বৃদ্ধির সীমায় বেঁধে রাখা। চুক্তি রূপ নেয় ২০১৬-এর ৪ নভেম্বর। কথা ছিল চার বছর সময়সীমার আগে কেউ বেরিয়ে যেতে পারবে না। ট্রাম্প তার ২০১৬-এর নির্বাচনী প্রচারেই বলেছিল কার্বন জ্বালানি ব্যবহারে বাড়তি সুবিধে পাচ্ছে চিন বা ভারতের মত দেশগুলো। চুক্তি নতুন করলে ভালো, নয়ত তারা এটা মানবে না। আমেরিকার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একদিন পরেই, অর্থাৎ এই কুড়ি কুড়ি নভেম্বরের চার তারিখে আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারিস পরিবেশ-চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। জো বাইডেনের অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে অবশ্য অবস্থান খুব স্পষ্ট, তিনি গ্রীন এনার্জির কথা বলে প্রচুর সমর্থন পেয়েছেন সন্দেহ নেই। বাইডেন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার পরে সম্ভবত প্রথম কাজ তার হবে প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসা।

খোলা আকাশ (Open skies) চুক্তিঃ ৩৫ দেশের মধ্যে বিশ্বাসের বাতাবরণ বজায় রাখার জন্য এই চুক্তিতে সামিল আমেরিকা রাশিয়া ছাড়াও ন্যাটো ও ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলো। চুক্তির মর্মার্থ হল, যে কোনো দেশ অন্য দেশের সামরিক ঘাঁটির উপরে অস্ত্রবিহীন নজরদার বিমান চালিয়ে পরখ করতে পারবে কেউ কোনো অন্যায় বা অযাচিত সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা? এই লেখা যখন লিখছি, ২২ নভেম্বর, আজকেই মধ্যরাত্রি থেকে আমেরিকার এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথা। ট্রাম্প যুক্তি দিল জর্জিয়া, ইউক্রেনে রাশিয়ার আচরণ নিন্দাযোগ্য এবং তাদের সঙ্গে যে শান্তির বাতাবরণে জর্জ ডব্লিউ বুশ এই চুক্তি করেছিলেন আজ সেই বাতাবরণ নেই বরং সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। ফলে আমেরিকা এখান থেকে বেরিয়ে আসছে। আগেই বলেছি, ট্রাম্পকে নিয়ে রাশিয়ার সমস্যা কম, কেন না সে যে এটা করবে তা অনুমান করা কঠিন ছিল না। জো বাইডেনের রাশিয়া সম্পর্কে অবস্থান যে আমূল বদলে যাবে তা মনে হয় না, আর বাইডেন যা করতে চাইবেন সেটাই পারবেন কিনা তা তো নির্ভর করছে সেনেটের অংকের উপর। সে কথায় পরে আসছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাঃ এই করোনা অতিমারির কালের সবচেয়ে বড় কমিক রিলিফের নাম সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম দিকে যখন চিনে, দক্ষিণ কোরিয়াতে এবং তার পরপরই ইরানে ও ইয়োরোপে করোনার থাবা চেপে বসছে তখন সে মানতেই চায় নি এটাকে প্যান্ডেমিক আখ্যা দেবার কোন যুক্তি সত্যিই থাকতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জার থেকে বড় কিছু নয় করোনাভাইরাস, সুতরাং তার জন্য লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, ব্যবসা বন্ধ এমন কি মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকেও সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। তার সাদা রিপাবলিকান সমর্থকদল যত হেলাফেলা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতাগুলো অমান্য করে গেছে তত কোভিড আমেরিকায় জাঁকিয়ে বসেছে। রোগের এপিসেন্টার যখন চিন থেকে ইউরোপ হয়ে আমেরিকায় সরে এল, তখন সে কী না করেছে - ব্লিচিং পাউডার খেতে বলেছে মানুষকে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মহৌষধিপ্রমাণ গুণ ব্যাখ্যা করেছে, স্টেডিয়ামে লোক ডেকে জনসভা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত করোনাকে চিনা ভাইরাস বলে অভিহিত করে হু’কে দায়ী করেছে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির এজেন্ট হয়ে কাজ করার অভিযোগে। আমেরিকা ছিল হু’তে সবথেকে বড় অনুদান দেওয়া দেশ। তারা সেই অনুদান বন্ধ করার কথা ঘোষণা করে জানালো সমভাবাপন্ন দেশগুলোকে নিয়ে বরং একটা বিকল্প প্রকল্পের কথা ভাববে, কিন্তু হু’তে তারা আর থাকবে না। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হল বিশ্বব্যাপী এবং তার দেশেও যে প্রতিক্রিয়া কম হয় নি এই কুড়ি কুড়ি ভোটের ফলাফল তা দেখিয়ে দিচ্ছে। ওয়াশিংটনস্থিত সারা বিশ্বে মান্য একটি সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির গবেষণা সংস্থা PEW Research সেপ্টেম্বরেই জানিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে আর কখনও সারা পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গিতে আমেরিকার অবস্থান এত নীচে নামে নি। এই বিচ্ছেদের নোটিশ হয়েছে গত জুলাইতে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি আমেরিকার পাকাপাকিভাবে হু থেকে বেরিয়ে আসা সম্পন্ন হবার কথা। বাইডেন এই সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে ফিরিয়ে নেবেন। বাইডেনের ভোটে জেতাই হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে। অতিমারিকালে মানুষদের বাড়ি থেকে মেইলে বা ৩রা নভেম্বর ভোটের দিনের আগে অন্য দিনগুলোয় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ফাঁকায় ফাঁকায় বুথে এসে (ওদেশে এমন নিয়ম আছে) ভোট দেবার ডাক দিয়ে বাজিমাৎ করেছেন বাইডেন। গণনায় দেখা গেল ভোটের দিনের ভোটে ট্রাম্প পঞ্চাশটার মধ্যে উনপঞ্চাশটা স্টেটেই জিতে ছিল কিন্তু পোস্টাল ব্যালটে বাইডেনের জয় ঠিক তত সংখ্যক স্টেটেই এবং সেটাই নির্ণায়ক পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

ট্রাম্প নামক অসুখটির সবচাইতে বড় রোগলক্ষণ হল গণতান্ত্রিক মুল্যবোধের প্রায় অবলুপ্তি। সে ঘোষিত বর্ণবাদী। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকে সে সমাজবিরোধী আখ্যা দিতে পারে অবলীলায়। ট্রাম্পের আমেরিকান হল খোলাখুলিভাবেই সাদা বর্ণবাদী আমেরিকান যে সমানাধিকার এবং গণতান্ত্রিক নৈতিকতার ধার ধারে না। সে এই দফায় জিতলে নির্বাচিতের রাষ্ট্রপতিত্বকালের সময়সীমা দু’দফায় আট বছরে সীমাবদ্ধ রাখার যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা তাকেই সে হয়ত বদলে দেবার উদ্যোগ নিত। এর ফল হয়েছে যেটা তা হল সারা বিশ্বেই যে সমস্ত রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে একনায়কতন্ত্রী ভাবনা ছাই চাপা আগুনের মত ধিক ধিক করে জ্বলছিল তাতে বেশ হাওয়া লেগে গেছে। ব্রাজিলে জাইরে বোলসেনারো, ফিলিপিনসে রড্রিগো ডুটেরটে, হাঙ্গেরিতে ভিক্তর ওরবান, ইতালিতে মাতেও স্যালভিনি এদের সবারই ট্রাম্পের অনুপ্রেরণায় ভোট-টোট এড়িয়ে রাজত্বকাল বাড়ানোর অভিপ্রায় আছে। নরেন্দ্র মোদীর ভাবনাতেও কি রাষ্ট্রপতিপ্রধান শাসনতন্ত্রের ভাবনা নেই?

আমেরিকার মুক্তবিশ্বভাবনায় ভারতের অবস্থান মোটের উপর নরমে গরমে ভালোই ছিল। ওবামার সময়ও শুল্ক নিয়ে, মেধাসত্ত্ব নিয়ে কাশ্মীর নিয়ে কিছু ঠেলাঠেলি ছিলই কিন্তু একই সঙ্গে আমেরিকায় ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের, শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীদের সমাদরে গ্রহণ করেছে তারা যার জন্য আজ ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান জনগোষ্ঠী এত প্রভাবশালী। ট্রাম্প সহজ ভিসায় অর্গল পরিয়েছে, স্বজনের পরিচয়ে ভিসা পাওয়াও আজ সহজ নয়, ভেবে দেখলে অবাক হতে হবে হাউডি মোদী করে মোদীর লাভটা কী হয়েছে? লাভ এই যে মসৃণভাবে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে গেছে, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রনীতির অভিযোগ পকিস্তান করে বটে কিন্তু তাতে আর আমেরিকা কান দেয় না। এমন কি ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর আমেরিকার কংগ্রেসের সদস্যা প্রমীলা জয়পালের সঙ্গে দেখাই করতে চান নি যখন ভদ্রমহিলা কাশ্মীরে মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা চেয়েছিলেন। মনে হয় কি এসব ওবামার আমলে বা ট্রাম্প না হয়ে হিলারি ক্লিন্টন যদি ২০১৬ নির্বাচন জিততেন তাহলে এত সহজে হতে পারতো?

আমেরিকার যে গ্লোবাল একটা নজরদারি ছিল তা ট্রাম্প নিজের জমানায় তা শিথিল করে এনেছে। এই সব নেতাদের পক্ষে ট্রাম্পের পরাজয় যে সুখবর নয় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এখানে আবার ওই প্রিজনার্স ডিলেমা’র কথাই বলতে হয়। যখন বলছি আমেরিকার নজরদারি আগের মত থাকলে হিন্দুত্বের হয়ত এত রমরমা হত না, ৩৭০ বা কাশ্মীর ভাগ সহজে হত না, তখন আমরা কী মনে মনে আমেরিকাকে আবার ওই দাদাগিরির ভূমিকাতেই দেখতে চাইছি না? দেশের মধ্যে প্রতিবাদী আন্দোলনের দুর্বলতা ও বিশ্বের ভোঁতা হয়ে আসা সংবেদনশীলতা, যা মূলত আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়েই ছিল ট্রাম্পপূর্ব কাল অবধি- এ দু’য়ে মিলে দেশে দেশে ক্রমশ দক্ষিণ বা অতি দক্ষিণপন্থী প্রবণতা শক্তি পাচ্ছে, প্রাণ পাচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়। তবুও জো বাইডেনের জিত যদি সারা বিশ্ব জুড়ে বাড়তে থাকা দক্ষিণপন্থী প্রবণতার উত্থানকে লাগাম পরাতে পারে তবে সেটা হবে এই নির্বাচন থেকে বড় প্রাপ্তি।

নির্বাচনের ফলাফল, এখনো পর্যন্ত ঝুলে আছে বলাই সঙ্গত। তবে আশা করা যায় আমেরিকার উদারনৈতিকতার খোলস এখনো অতটা আলগা হয়ে যায় নি যে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকেই তারা প্রহসনে পরিণত হতে দেবে। তবে ডেমক্র্যাট বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেও ট্রাম্পিয়ানার যে অবসান হবে না, বরং তা যে আরো কুৎসিতভাবে সে দেশে প্রতিভাস হবে তা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়। ট্রাম্প মোট ভোটসংখ্যার নিরিখে এবং সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী ইলেক্টোরাল কলেজের সীটপ্রাপ্তির নিরিখে-দু’ভাবেই বাইডেনের থেকে নীচে শেষ করেছে বটে কিন্তু সে ভোট পেয়েছে গতবারের তুলনায় আশি লক্ষ বেশি। উপরন্তু সেনেটে রিপাবলিকানদের আধিপত্য এখনো বহাল আছে। সেখানে চারটি আসন খালি, যার দুটি আলাস্কা থেকে রিপাবলিকানদেরই পাবার কথা, বাকি দুটো জর্জিয়া থেকে - যার একটাও গেলে বাইডেন সেনেটে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। এই দুটিতে দুটি না পেলে বাইডেনকে পণবন্দির রাজ্যপাট চালাতে হবে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা ভিতর থেকেই দুর্বল হবে, বাইরে তার প্রভাব এড়ানো অসম্ভব। মোটের উপর ট্রাম্প যেটা করতে পেরেছে গত চার বছরে তা হল তাদের সমাজের ফাটলগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়া। সে ফাটল বোজাতে পারাটাই জো বাইডেনের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাকি কথা তার পরে।