আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

অনন্তের স্তনবৃন্তে অলোকরঞ্জন

পল্লববরন পাল


অনন্তের স্তনবৃন্তে শরণার্থী এক শিশু ঘুমিয়ে রয়েছে,
ভূমধ্যসাগরে ওরা দুইজন একই নৌকায়
ভেসে আছে, ইটালির দিকে ওই মগ্নতরী দোলে;
শিশুটির মা নেই, অনন্ত তাকে দুধ দেবে বলে
এক অপ্সরীর কাছে একটি স্তনযুগ ভিক্ষা চায়।


সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার একচ্ছত্র ও উজ্জ্বলতম আন্তর্জাতিক মুখ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত - রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিদের মধ্যে কবিতানির্মাণ থেকে শব্দসংস্থিতির ব্যঞ্জনায় নিপাট নির্জন ব্যতিক্রম হিসেবে সিদ্ধ ও সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত। তাঁর সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে কাটাছেঁড়া আমার অসাধ্য, সে সব বাংলা বা বিশ্বসাহিত্যের মগ্ন গবেষকদের লোভচকচকে বিষয়। আমার সামান্য যেটুকু লেখাপড়া স্থাপত্যবিজ্ঞান বা নির্মাণ প্রযুক্তি বিষয়ে। সাহিত্য বা বিশেষ করে বাংলা কবিতার সঙ্গে, সত্যি বলছি, আমার নিষিদ্ধ গোপন ইন্টুবিন্টু - এর বেশি কিছু না। সেই প্রেমোৎসারিত স্পর্ধা - শব্দের এই নিরঙ্কুশ নির্মাণপ্রকৌশলের ব্যতিক্রমী অনন্য আলোকরঞ্জনরশ্মিতেই সদ্যবিগত এই কিংবদন্তী কবিকে নিয়ে আমার সীমিত ও ইচ্ছিত নিবিড় শ্রদ্ধাসংস্মৃতি পেশ করি।

অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি অলোকরঞ্জন একদম স্বরচিত রেওয়াজী স্বরে অনর্গল কথা বলেছেন কবিতায় আপাদমস্তক বিচিত্র এক অত্যাধুনিক শাস্ত্রীয় কাব্যভাষায় - যে ভাষা গভীর অনুশীলিত উপলব্ধির সহজ শরীরী অনুবাদ। অলোকরঞ্জিত ভাষা বিশ্লেষণে প্রথম নজর পড়ে নির্মিত শব্দের চমকের ওপর। শব্দের এই বিদগ্ধ আয়োজন সম্পর্কে স্বকলমে অলোকরঞ্জন বলেন -
“সমার্থক শব্দ বলে কিছু নেই, আছে বোধিদ্রুমে বরদ শব্দকল্প। অথবা এক-একটি শব্দ, আজকের সময়ের বিশিষ্ট মানুষের মতো, এক-একটি ব্যঞ্জনাসঙ্কুল দ্বীপ। অর্থাৎ একটি কবিতা একটি দ্বীপপুঞ্জ যেখানে এক-একটি শব্দের অনাশ্রয়িতা শেষ অবধি মুছে গিয়ে পরম আশ্রয়ের মতো হয়ে ওঠে’।”

কবির এই অভিনিবিষ্ট অনুভূতি কবিতাপাঠককে শীলিত শিষ্টতায় অবিশ্রাম বিদ্বান করে তোলে। এক অনন্ত অভিসার-শিক্ষাভ্রমণে মেতে ওঠে পাঠক।

অলোকরঞ্জনের কাব্যভাষাকে বিশিষ্ট স্বতন্ত্রতা দেয় তার বাক্য ও চিত্র নির্মাণ। উপরের কবিতায় এক অপ্সরীর কাছে শিশুকে দুধ খাওয়াবে বলে অনন্তের ‘স্তনযুগ’ ভিক্ষে চাওয়া - এই নতুন শব্দনির্মাণে নতুনতর চিত্রকল্প বাংলা কেন বিশ্বসাহিত্যে কেউ এর আগে আঁকবার হিম্মত দেখিয়েছেন কখনও? শব্দবিন্যাসে অলোকরঞ্জনের এই অগাধ একনায়কতন্ত্র শুধু তাঁর কবিতায় নয়, যাপন-অভ্যাসেও সাবলিল ছিল। কুর্নিশ করে কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষ বলছেন - “জার্মানি থেকে টেলিফোনে একটি মেয়ের প্রসঙ্গে বলল - দজ্জালিকা। কাউকে লাই দিতে নেই, এ তো আমরা হামেশাই বলে থাকি। বলে অলোকও। কিন্তু সে বলে - চৌ-এন লাই দিতে নেই। মেয়ের দিকে অতিশয় নজর দিতে দিতে ভারাক্রান্ত বাবা অলোকের কাছে ‘কন্যাকুব্জ’।... চিঠি না পেলে সেটা হয় ‘অপত্রক’ দশা আর নয়তো ‘শব্দ সাড়া নেই’।” শব্দের বিচিত্র বুনন তাঁর নেশা। নমুনা কবিতার ছত্রে ছত্রে - আত্মপ্রকাশ থেকেই স্বকীয় আলোকে রঞ্জিত - প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবন বাউল’ খোলা যাক -
● কান্নাকীর্তনীয়া জলজ্যান্ত লোক
● এক যন্ত্রণার ইমনকল্যাণ
● তারই সঙ্গে ছিল কিছু তরঙ্গদ্রাঘিমা
● গভীর দুঃখে অদ্রিপাষাণ
● ঘৃণায় হবে সে আগুনঝুরি
● কাঁথা-স্টিচ মেঘে মেঘে
● জল্লাদের খর্গ হয়ে মৃত্যুমিথুনমশাল ঝল্‌মলালো
● অমিত অ্যালকোহলিকতা বুঝি ভালো?...

এইরকম বিচিত্র শব্দমিশেল পাঠকের মনোযোগকে রঙিন নেশাতুর করে তোলে। আরো ঘনিষ্ঠ হয় অলোকরঞ্জিত কবিতা। অসংখ্য বিদেশী শব্দদেরও ধুতিপাঞ্জাবিশাড়িব্লাউজে বাঙালি করে তুলেছেন অলোকরঞ্জন। যেমন - অ্যালিকোলাহল, অ্যাবস্যাডত্ব, নিসর্গনার্শারি, থিয়োরিবিদ্ধ, রবীন্দ্রএলিট, গ্লোবপল্লি ... ছবি ও সহি দেখিয়া লইবেন - আমাদের কোনো শাখা নাই - একদম নিজস্ব স্বতন্ত্র ব্র্যান্ডিং।

অলোকরঞ্জনের আত্মপক্ষ সমর্থন -
“ভাষা এবং শব্দ এক নয়। ভাষার মধ্যে ধ্বনি আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। তা নাহলে অর্থহীন বৈদিক স্তোভধ্বনি ঐ মর্যাদা পেত না, ব্রজবুলির মতো আবেগনিয়ন্ত্রিত, ব্যাকরণবিস্মৃত ভাষা পেতাম না আমরা। আধুনিক কবিতার শব্দই সমগ্র ভাষাকে কোণার্ক কিন্নরীর চিবুকে ক্ষোদিত করে তুলে ধরেছে। অনন্ত শূন্যের দিকে মালার্মে সাদা কাগজ মেলে রেখেছিলেন, ভাষার ভাষা পরম শব্দকে অভ্যর্থনা করে নেবেন বলে। বাংলা কবিতায় এই মুহূর্তের শব্দৈষণা বিশ্লেষণ করলে দেখবো মালার্মের নিরঞ্জন সেই শব্দসন্ধানে এসে মিলেছে জীবনানন্দের শব্দব্যক্তিত্ব।”

আর অলোকরঞ্জিত বাংলা অভিধানে শাঁখ বাজাতে বাজাতে মৎস্যবীজের মতো অসংখ্য নতুন শব্দ এমন অনায়াস-অভ্যাসে বেমালুম ঢুকে পড়লো, যেন বেদযুগ থেকে তৎসাময়িক বংশপরম্পরার প্রযত্নে এ অভিধানবাস - কুহেলিঘনিম, জীবনানীচ্ছায়ে, দিগন্তদীর্ঘল, অপেক্ষাঘনিমচক্ষু, স্বনিকেত, অপটুয়া, ভরসাভ, আড়ভাবুক...

অলোকরঞ্জনের বিষয়ানুযায়ী উপলব্ধ শব্দেরা পোষা আদুরে বেড়ালের মতো তাঁর কাব্যভাষার অপরিহার্য অঙ্গ - এমন শব্দ যা অপ্রত্যাশিত অথচ সহজেই বিশ্লেষণযোগ্য, বোধগম্য অথচ ব্যাখ্যাতীত, নিকট স্বজন অথচ অস্পষ্ট অচেনা। জীবন ও কবিতা উভয়ের প্রতি অম্লান বিশ্বাস ও মগ্ন আহ্লাদ কবি অলোকরঞ্জনকে সময়ের সমান্তরালে কাব্যভাষার প্রত্যাশিত পরিবর্তনে সামিল করেছে বরাবর। প্রথম থেকেই অলোকরঞ্জন সমাজমনস্ক। কিন্তু বাংলা থেকে উড়ে যখন ইউরোপে পৌঁছলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা ও বোধ ইউরোপাত্মক বিস্তৃতি লাভ করলো - এবং কবির ভাষাগত ব্যক্তিগত ভেতো আবেগ বদলে গেলো তীব্র অন্তর্জাগতিক শাণিত বাস্তবতায় - কিন্তু তাঁর নিজস্ব স্টাইলেই।

“কাব্যজিজ্ঞাসার একটি বড়ো ঝোঁক নিঃসন্দেহে কবিস্বভাবের রূপান্তর। কবি, জায়মান কবিতার চাহিদায়, নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলবেন, এবং নিজের মানসিকতাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকবেন যতক্ষণ না ঐ আত্মা-অতিক্রান্তি সাধিত হয়।”

“বহুদিন নিরাসক্তির পরে আমি
নীড়-আসক্ত হয়ে
ছুটে গেছি যেই কবিবন্ধুর কাছে
সে বলে আমায় - ‘অনুপ্রাসের মোহে
তোর এই নষ্টামি।’
তারপরে গেছি ওয়ালটেয়ারে ছুটে
অনুমোদনের আগে,
জল বলে ওঠে পৈশাচী উল্লাসে
শাখাপত্তনম তোর ইতিহাসে নেই,
তোমার নিয়তি বিশাখাপত্তনেই।

[শ্লেষে, আশ্লেষে - প্রণিত অগ্নি কাকে বলে তুমি জানো?]

অলোকরঞ্জনের শব্দ ও চিত্রনির্মিত এই কাব্যভাষার আঙ্গিক বা প্রকরণ ভাবনা ভীড়ের মধ্যেও নিজের মুখে ফোকাস-আলো ঠিক ধরে রাখে। শব্দের মতোই তাঁর বাক্য নির্মাণও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌন্দর্যে ভাস্বর। ছন্দের স্ফূর্তি ও মিলের পারিপাট্যে তাঁর কাব্যভাষাকে অনন্য উদ্ভাস সম্মান দেয়। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘যৌবন বাউল’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতায় তিনি লিখছেন -
গঙ্গাজলে উঠুক পাপ    সূর্য হোক অপ্রতাপ
  সকালে, আমি কিরণ বিকাবো না।
ভগবানের গুপ্তচর    মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর
  ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়বো না।


অজস্র ছাত্র-ছাত্রী এবং মুগ্ধ পাঠকের মধ্যে দাঁড়িয়েও বরাবর নিজেকে অপূর্ণ মনে করেছেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বরাবরই মনে করেছেন, যা কিছু তিনি পেয়েছেন তা অনেক; বরং কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া হল না তাঁর। অন্যত্র তিনি অন্যরকম ছন্দ ও মিলে অন্যরকম নির্মাণ করছেন -
গেল আমার ছবি-আঁকার সাজসরঞ্জাম
কোথায় পটভূমি কোথায় পড়ে রইল তুলি,
তুমি আঁকলে ছবি আবার তুমি আঁকলে নাম,
ফকিরি সাজ নেওয়ার ছলে ভরে নিলাম ঝুলি,
শুধু নিলাম সব মাধুরী, দিতে পারলাম না।

আকাশ আমার ক্ষমা, আমার অসীম নীহারিকা;
প্রিয়া, আমার ক্ষমা, আমার নিরালা অঙ্গনা;
মাগো, আমার ক্ষমা, আমার প্রদীপ অনিমিখা;
মর্ত্যভূমি ভরা আমার আনন্দবেদনা;
নিয়ে গেলাম সব মাধুরী, দিতে পারলাম না।


কবি আলোক সরকারের কাছে তাঁর বন্ধু অলোকরঞ্জন ‘শব্দের ধ্বনিরঙ্গে, চিত্রের বর্ণবিভঙ্গে প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসী’। এই আবেগমথিত চিত্রবহুল নির্মাণভাষাও সময়ের সাথে সাথে নিজস্ব মুনশিয়ানায় বদলিয়েছেন অলোকরঞ্জন। এই স্থিতিস্থাপন যে কোনো কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির মূল শর্ত।

“এখন ডিজিট্যাল হয়ে
মানুষ বেঁকে আছে, বামন এসে দ্যাখো
চকিতে চন্দ্রমা ছোঁয়।
সিতাংশুকে শেষ রাতে
বৈশ্বানরে রেখে ফিরছিলাম যেই
বামন ডিজিট্যাল হয়ে।

বলল আমাদের তোরা
মিছেই কাঁদছিস, জন্ম ঘটলেই
মৃত্যু আছে গ্রহজোড়া।...”

[ডিজিট্যাল - এখনও নামেনি বন্ধু নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি]

অলোকরঞ্জনের আত্মকথন -
“ছন্দ থাকবেই। রবার্ট ফ্রস্ট বলতেন না যে, যেমন জাল না টেনে ব্যাডমিন্টন বা টেনিস খেলা সম্ভব নয়, তেমন স্বরবৃত্ত বা তানপ্রধান বা মাত্রাবৃত্ত- তাতে সরাসরি না লিখলেও যে কবিতার মধ্যে ছন্দ নেই সেইরকম কোনও কবিতাকে আমি কিছুতেই অভিনন্দিত করতে পারব না। অরুণ মিত্রের পরে গদ্যছন্দটা অনেকটাই এসেছে। তার মাঝামাঝি, তার পাশাপাশি, তার আড়াআড়ি তাঁর কোনাকুনি যদি ছন্দ থেকে যায় তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বলে আমি মনে করি। আমি জানি অনেকেই বিশ্বাস করেন না এটা। কোন ঠাকুর? অবন ঠাকুর ছবি লেখে। এটাও তো একটা ছন্দ। এটাকে তো স্ক্যান করা যায়। যে গদ্যকে আমি স্ক্যান করতে না পারি সেই গদ্যকে কবিতার রাজকিরিট পরানোর আগে মাথা নত করে ভাবব যে তাহলে কি এতকাল আমি ভুল ভেবেছি? ... কবিতা একটা হাতের কাজ। সুভাষদা যেটা ভাবতেন। কিন্তু সেই সুভাষদার কবিতা- ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ সেখানেও কিন্তু স্বরবৃত্ত ছন্দ এসে যাচ্ছে। সুভাষদা এগুলোকেই এমনভাবে এক একটা কবিতায় ব্যবহার করছেন যে সেইগুলো মিছিলের মন্ত্র হয়ে উঠছে। সেইগুলো, আমরা যাকে মেমোরেবেল স্পিচ বলি, স্মৃতিধার্য বাগ্মিতা, তার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে উঠছে। এটাও কিন্তু এক ধরনের হাতের কাজ। উনি কবিতাগুলোকে সেইভাবে দাঁড় করিয়েছেন। অন্যদিকে দেখো, কাগজ ভাঁজ করার খেলা, অরিগ্যামি যেটাকে বলে - অনেক কবিরা সেটা খেলেন। এটা খুব স্বগত খেলা। তুমি তাকে দিঘির মধ্যে ভাসিয়ে দিতেও পারো একটা নৌকোর মতন। আবার তুমি তাকে পরমুহূর্তে ঘুড়ি করে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারো। এটাও একটা হাতের কাজ।”

অন্যত্র লিখছেন -
‘আমি ছন্দের বা রূপকল্পের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। একটি বাক্য বা একটি শব্দও যাতে অতিরিক্ত না হয় সেদিকে আমার একটা প্রলোভন। বিশেষণ জর্জরিত যেন না হই সেদিক থেকে সচেতন যেমন থাকি, তেমনি অন্যদিক থেকে কবিতার কারুকর্ম বিষয়ে ...। অর্থাৎ কবিতার যে আন্তর-রূপকল্প - প্রত্যেকটা কবিতাই আমার কাছে নতুন ফর্ম নিয়ে নতুন রূপকল্প নিয়ে আসতে চায়। আমি মেটাতে পারি কিনা আমি জানি না। আমি জায়মান, নির্মীয়মান যে নির্মিতি তাকে ধরে রাখবার চেষ্টা করি।’

অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত - তিন ছন্দরমণীর সাথেই অলোকরঞ্জনের অনায়াস হৃদয় দ্রাব্য অভিসার। তাঁর ‘যৌবন বাউল’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই মুগ্ধ উদাহরণ টানা যাক -
১) অক্ষরবৃত্ত -
   “কী মেঘ দেখালে নিজে মেঘের আড়ালে বসে
   নিজে তো দেখলে না তুমি মৃদু স্বভাবের দোষে”

[প্রবর্তক]

২) স্বরবৃত্ত -
   “কী করে যে অতটুকু ঘরের মধ্যে আছ,
   বাইরে কত সমারোহ শালতমালের, কত”

[তুলসীতলা]

৩) মাত্রাবৃত্ত -
   “তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
   সহজ হবে তুমি আমার মতো”

[একটি কথার মৃত্যুবার্ষিকীতে]

এ একেবারেই অলোকরঞ্জিত ব্র্যান্ডিং - মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের মতো, যার কোনো শাখা নাই। শব্দের সঙ্গে শব্দ বুননে ব্যঞ্জনার আচমকা মহামাত্রিক প্রসৃতি বা ভুমিকম্পন সমগ্র অলোকরঞ্জনসাহিত্য জুড়ে ‘বিরাজ সত্যসুন্দর’। এ সম্পর্কে প্রথিতযশা সমালোচক সুমিতা চক্রবর্তীর মতে - “ঈষৎ অচেনা শব্দের অভিঘাত, খুব চলতি সাম্প্রতিক শব্দের প্রয়োগ পাঠকের মনকে টেনে নিতে পারে। অলোকরঞ্জন সচেতনভাবেই কাব্যভাষায় ছন্দ ও মিলের অভিনব শ্রুতি বাজিয়ে তোলেন। বহু নতুন ধরনের শব্দ, পদবিন্যাস ও চিত্রকল্প নিয়ে আসেন তিনি।”

একটি শব্দ অকস্মাৎ একটি আস্ত কবিতার বহুমাত্রিক ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে। অলোকরঞ্জনের নির্মাণশৈলীতে এমন উদাহরণ প্রচুর। নিবন্ধের শুরুর ‘অনন্তের স্তনবৃন্তে’ কবিতায় যেমন ‘স্তনযুগ’ - একটা ভাসমান নৌকোর ছবি হঠাৎ কালোত্তীর্ণ ইতিহাস হয়ে উঠলো কবিতার অন্তিমে। তেমনি ‘শুভেন্দু শোনো’ কবিতায় -
জীবনানন্দ সভাঘরে
তোমায় ডেকেছি সমাদরে
তারপর ভিড় হতেই
দুজন বসেছি বারান্দায়
শুভেন্দু শোনো, এছাড়া আর আমাদের কোনো তীর্থ নেই।


‘তীর্থ’ শব্দে হঠাৎ যেন মাঙ্গলিক শঙ্খ বেজে উঠলো, এবং কবিতা থেকে উঠে যাওয়ার পরেও বহুক্ষণ পাঠকের অন্দরে রিনরিন প্রতিধ্বনি বাজতে থাকলো - রতিশৃঙ্গারের মতো। একটিমাত্র শব্দে মহাকাব্য নির্মাণ যে সে কবির কম্মো নয়। তার জন্য দরকার অলোকরঞ্জনরশ্মির প্রয়োগ ও নির্মাণজ্ঞান। কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আধুনিক বাংলা কাব্যইতিহাসের সম্ভবত শেষ তীর্থ, ভবিষ্যতের যৌবনবাউলেরা বিশদ পুণ্যার্জনের আশায় যেখানে ভ্রমণে দীক্ষা নেবে।

নির্মাণ তো শুধুই দেহজ উপন্যাস রচনা নয়। শুধু ইঁট সিমেন্টেই নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় না। স্থাপত্যের সবচেয়ে জরুরি ও জটিল বিজ্ঞান-অধ্যায় চরিত্র নির্মাণ। অলোকরঞ্জনের কবিতা এতোটাই বহুমাত্রিক, তার কবিতার যে কোনো নির্মাণ শৈলী নিয়ে অক্লেশে কুড়ি ফর্মা লিখে ফেলা যায়। বিশেষত টাটকা মৃত্যুর পরে তাঁর কবিতার চরিত্রের নির্মাণ প্রকৌশল নিয়ে লেখার প্রস্তুতিতে ইত্যবসরে নিশ্চয়ই বাঘা বাঘা পণ্ডিতবর্গ নিজ নিজ রাতঘুমদের সঙ্গে কুস্তি লড়ছেন। এই নিবন্ধ আমি শুধু তাঁর কবিতার চরিত্রের মূল শিরদাঁড়ার উল্লেখ করে সমাপ্তিরেখা টানবো। এবং বলা বাহুল্য, সেটাও আমার কথা নয়, শ্রী সৌমিত্র দস্তিদার লিখেছেন -
‘উৎপল দত্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এক পুরস্কার ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে দীর্ঘ কবিতা “শাহেনশা তোমার পুরস্কার তোমারই থাক”-এ একটা লাইন লিখেছিলেন ‘‘পুরনো সুভাষ মুখুজ্জে আমার হাতিয়ার।’’ তেমনি আজ সারা দুনিয়া জুড়ে মহাসংকটকালে নিঃসন্দেহে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আমাদের হাতিয়ার। প্রাচীন ক্ষয়ে যাওয়া বিবর্ণ বামপন্থার বদলে নব্য মার্কসবাদী ডিসকোর্সে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত পাঠ অবশ্য কর্তব্য। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত শুধুই আধুনিক বা আন্তর্জাতিক নন, তিনি স্বৈরতান্ত্রিক পৃথিবীতে মুক্ত বিবেক। গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর।

এই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিশ্ব নাগরিক হয়েও আদ্যন্ত বাঙালি। বাংলার। কাঁটাতারহীন অখণ্ড বাংলার। কতবার কতভাবে যে নিজেকে, নিজের বোধকে ভেঙেছেন, বদলেছেন ভাষা তা নিয়েই পাতার পর পাতা লিখে ফেলা যায়। গভীর প্রত্যয়ে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখে ফেলেন -
“যুদ্ধ এখন আর ঘোষিত হয় না। চলতেই থাকে।”

এর চেয়ে যুদ্ধবিরোধী কবিতার লাইন আমার অন্তত চট করে মনে আসছে না। ক্রমেই কালো-সাদায় ভাগ হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ছিলেন আলোর দিশারী। যুদ্ধ আর নিরন্ন মানুষের চলমান ভিড়, শরণার্থী জীবন ঘুরেফিরে এসেছে অলোকরঞ্জনের লেখায় বলায় নিবিড় দীর্ঘশ্বাসে। ভারতে, পশ্চিমবঙ্গে যখন ক্রমেই ‘অনুপ্রবেশ’ হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অস্ত্র, যখন শাসক দলের দাপুটে নেতারা ‘ঘুষপেটিয়া’ বলে একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তুলতে অতি সক্রিয় তখন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের চলে যাওয়া বড়ই কষ্টের। ব্যথার।’

তথাপি তোমায় খেলতেই হবে, দুপুরে আজ যদিও
আততায়ীদের হাতে
নিহত হয়েছে তোমার বুকের নিবিড় সতীর্থেরা
মাঠে নেমে তাই কালো ব্যাজ পরে নিয়ো।

খেলার এখন অর্থই নেই, জয় আর পরাজয়
সমদ্যোতিক হয়ে গেছে পৃথিবীতে,
দেশ আর দল একাকার হলে নরহত্যায় নামে
পেনাল্টি কিকে জিতে

এবার তুমিই টার্গেট, দেখি লোহিতসাগর ছেয়ে
তোমার রুধির বাণী,
গ্যালারিতে বসে আমরা দেখছি চলছে তোমায় ঘিরে
যমে ও মানুষে অপূর্ব টানাটানি।

[কবিতার নাম - ‘খেলতে নামলে কালো ব্যাজ পরে নিয়ো’]