আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

নায়কের সন্ধানে

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়


সচেতনভাবেই তিনি আত্মজীবনী লিখতে আগ্রহী ছিলেন না। অভিনেতা-কবি-সম্পাদক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সারাজীবন অন্তর্গত তাড়নায় হোক বা অনুরোধ-উপরোধে, যে-বিপুল সংখ্যক গদ্য রচনা করেছেন তা অবশ্য চালচিত্রের মতো নির্মাণ করেছে তাঁর জীবন। নির্মাণ, কেননা তা জানিয়ে দেয় কীভাবে গড়ে উঠেছেন সৌমিত্র। এই গড়ে ওঠাটাই উত্তরপ্রজন্মের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সাংস্কৃতিক অনুসন্ধান। সংস্কৃতি শব্দটার মধ্যে যে একটা ‘ইনক্লুসিভনেস’ আছে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালী সংস্কৃতির রূপ বইতে সংস্কৃতির স্বরূপ আলোচনা করতে গিয়ে গোপাল হালদার যেমন বলেছিলেন, সংস্কৃতি হল সামগ্রিকভাবে জ্ঞানবিজ্ঞান ও সৃষ্টিসম্পদ, অর্থাৎ যা আমরা জেনেছি এবং যা আমরা করেছি। ‘আর্ট বা শিল্প এই সংস্কৃতিরই একটি এলেকা (য.); আর শিল্প বলতে বোঝায় বাস্তব সৃষ্টি আর মানস-সৃষ্টি দুইই, কারণ দুইই সৃষ্টি; কারুকলা (crafts) ও চারুকলা (arts)’, উভয়েই সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। বাঙালির ক্ষেত্রে ১৯৪৭-কে যদি একটা বিভাজিকা মেনে নেওয়া যায় তবে স্বাধীনতা ও বিভাজনের যুগপৎ স্বাদে হাজির হওয়া পঞ্চাশের দশক নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এবং কলকাতার ছাত্রদের কাছে সেই দশক আরও নানান অভিঘাত সত্ত্বেও চিন্তাজগতে রীতিমতো আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার দশক। ২০১৫-র ২৫ মে এরিক হবসবম স্মারক বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন পঞ্চাশের দশকে তাঁদের ছাত্রাবস্থায় কলকাতার ছাত্রমানসের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন এইভাবেঃ
“তখন আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ. পড়ছি। কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোলেই কফি হাউস। রাস্তা মানে কলেজ স্ট্রিট, যার দু’পাশে তখন (এবং এখনও) দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বইপাড়া। শুধু বইয়ের দোকান নয়, অজস্র বইয়ের স্টল সেখানে। কফি হাউসটি আগে চালাত কফি বোর্ড, পরে তার দায়িত্ব নেয় কর্মীদের সমবায় সংগঠন। সেটি নিছক কফি বা অন্যান্য খাবারদাবার খাওয়ার জায়গা হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষার অঙ্গন, সেখানে আড্ডা, আলোচনা, যুক্তি প্রতিযুক্তির মধ্য দিয়ে অনেকে অনেক কিছু জানার, শেখার সুযোগ পেতেন। সেখানে খুব তর্কবিতর্ক হত - দীর্ঘ এবং সহিষ্ণু বিতর্ক; এগুলো প্রধানত রাজনীতি বিষয়ে, কিন্তু অন্য নানা বিষয়ও বাদ থাকত না। সেই সময়, এবং বস্তুত তার পরবর্তী অনেক দিন ধরেই, কলকাতার - কিছুটা নাক-উঁচু - তরুণ বিদ্বৎসমাজের চিন্তাধারাটা প্রধানত মার্ক্সবাদের খাতেই বইত। সেই মার্ক্সবাদ ছিল একটা বেশ আত্মসচেতন পণ্ডিতির রসে জারিত। এই মহলটির হাবভাব এমন ছিল, চিন্তাভাবনার দুনিয়ায় তারা যেন একেবারে চূড়ায় বসে আছে, তাদের ধারেপাশে কেউ নেই। সেই ধারণাটায় একটু বাড়াবাড়ি ছিল ঠিকই। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ওই পরিবেশে তরুণ ছাত্রছাত্রীরা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্কীর্ণ ঘেরাটোপে আটকে না থেকে বৃহত্তর চিন্তাবিশ্বের শরিক হওয়ার যে সুযোগ পেত, সেটা তাদের মনকে টগবগে করে তুলত”। (দেশ, ২ নভেম্বর ২০২০। অনুবাদঃ অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও কুমার রাণা)

অমর্ত্য সেন পঞ্চাশের দশকের সূচনায় কফি হাউস-কেন্দ্রিক বাঙালির মুক্তবুদ্ধির চর্চার যে কথা বলেছেন, তাঁর থেকে বয়সে দু-বছরের ছোটো সৌমিত্র অতিক্রান্ত কৈশোর ও সদ্য যৌবনের দিনগুলিও প্রায় একইরকমভাবে দেখেছেন। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস তাঁর কাছে সেসময় শুধু আড্ডাখানা ছিল না, ছিল ‘জীবনের মধ্যে একেবারে গ্যাঁট হয়ে ঢুকে পড়া’র জায়গা। তাঁর তদানীন্তন বাসস্থান থেকে ‘পায়ে হাঁটার দূরত্ব একটা লম্বা সিগারেট’। ষাট দশক পর্যন্ত সেই যাওয়া আসা নিয়মিত চলেছে। তাঁদের আড্ডার মধ্যমণি তখন ছিলেন গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়। সে-কফি হাউস বাংলার সমাজ-রাজনীতির আঁচ থেকে দূরে থাকত না। সাহিত্যের মধ্যে খুঁজে নিত বাঁচার রসদ। তর্কবিতর্কে খোঁজা চলত নতুন রাস্তা। তাঁদের পাশের টেবিলেই বসতেন শক্তি সুনীল তারাপদ প্রমুখের কৃত্তিবাসী দল। আর এ টেবিল ও টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ মেধারা। আলাদা টেবিল ছিল নিজেদের বন্ধুদের সঙ্গে বসার জন্য, কিন্তু টেবিলে টেবিলে ছিল না জল-অচল ভেদ। যেন সমবায়ের আত্মানুসন্ধান চলছে সর্বত্র। সৌমিত্রের জীবনের অন্তত দুটো ঘটনার সঙ্গে কফি হাউসের যোগ অসামান্য। একদিন কফি হাউস যাওয়ার পথেই সত্যজিতের ছবিতে অভিনয়ের প্রাথমিক যোগাযোগটুকু হয়, আর একদিন ফেরার পথে বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের প্রস্তাবে 'এক্ষণ' পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনায় রাজি হয়ে যাওয়া। যে-সৌমিত্রকে আমরা জানি তাঁর জীবনের সবথেকে বড়ো দুটি অংশ তো এ রাস্তাতেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

সৌমিত্রের হয়ে ওঠার পিছনে যে দু-জন মানুষকে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় তার একজন শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অন্যজন সত্যজিৎ রায়। ইঙ্গমার বার্গম্যানের ছবিতে লিভ উলম্যান কিংবা আকিরা কুরোশাওয়ার ছবিতে তোশিরো মিফুনের মতো সত্যজিতের চোদ্দোটি ছবিতে সৌমিত্র। কিন্তু সত্যজিতের ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও শিশিরকুমার তাঁর চিরকালীন প্রেরণা। কবিতার প্রতি অনুরাগের জন্যই শুধু নয়, সার্বিক জীবনদর্শনে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন সৌমিত্রের জীবনদেবতা। রবীন্দ্রনাথের জীবন, নানা জাগতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া, তাঁর শক্তি, তাঁর দুর্বলতা, দুঃখ-সুখ - সবটা মিলিয়ে যে মানুষ-রবীন্দ্রনাথ, তিনিই আরাধ্য ছিলেন সৌমিত্রের। পরিণত বয়সে এক সাক্ষাৎকারে একটি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘ভেতর থেকে কেবলই মনে হয়, আমি আমার ভিতরে দেখেছি যে আমার মন যখন একটা প্রচণ্ড সংকটের মধ্যে গিয়ে পড়েছে, তখন হঠাৎ আমি ফিরে তাকিয়ে ভেবেছি যে, আচ্ছা, এরকম সময়ে রবীন্দ্রনাথ কী করতেন, কী করে এটা জয় করেছিলেন, কী করে এটা মিটিগেট করেছিলেন, কী করে তাঁর সাহিত্যের মধ্যে, তাঁর কাজের মধ্যে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ শৈশব-কৈশোরের মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠে কলেজে পড়ার সময়েই তিনি অভ্রান্ত বুঝে নিয়েছিলেন বহু মানুষের মতো তাঁরও যাপনের অনেকখানি জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিদিন তব গাথা আলেখ্যে সৌমিত্রের অমল স্বীকারোক্তিঃ
“আমার নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে কিন্তু গড়ে নিয়েছি আমি। সেখানে তিনি আমার অনাত্মীয় অপরিচিত কেউ নন। তিনি একজন ব্যক্তি এবং জীবন্ত, জীবিত। তাঁকে শুধু আমি গড়িইনি, তাঁকে আমি বাঙ্ময় করেছি। তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলি, তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, তিরস্কার করেন - এমনকী দু-এক সময় প্রশ্রয়ও দেন। শতসূর্যের থেকে ভাস্বর তাঁর সৃজনক্ষমতার মধ্যে সব সময় আমি তাঁকে খুঁজি না - তাঁকে আমি কখনো বা মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত শোকের মুখে তাঁকে চিনতে চাই”।

তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথকে জীবনের রাস্তায় পাওয়া মানে আরও বেশি করে জীবনকে মহার্ঘ জ্ঞান করা। রবীন্দ্রনাথের আগ্নেয় প্রতিভায় চোখ ঝলসে যাওয়া নয়, বরং তাঁকে আত্মস্থ করে মঙ্গলবোধে জারিত হওয়া।

সৌমিত্র বড়ো হচ্ছিলেন পঞ্চাশের দশকের বাংলায়। তাঁর ‘গ্রন্থি’ শিরোনামাঙ্কিত গদ্যটিতে অমর্ত্য সেন কথিত ‘বিদ্বৎসমাজের’ বইপত্রের প্রতি অনুরাগের একটা চমৎকার ছবি ফুটে ওঠে। কলেজজীবনে প্রবেশের পর তাঁর পাঠ্যাভ্যাসের সামান্য যে নমুনা সৌমিত্র দিয়েছেন তা সত্যিই আলাদা করে উল্লেখ করার দাবি রাখে। জর্জ টমসনের ইস্কাইলাস অ্যান্ড আথেন্স, ই. কে. চেম্বার্সের মিডিয়েভাল স্টেজ, বের্টোল্ট ব্রেখটের দ্য এক্সসেপশন অ্যান্ড দ্য রুল, ক্রিস্টিফার মারলো, মলিয়ের, সেক্সপিয়র, বেন জনসন, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, তুর্গেনেভ, চেকভ, গোগোল, ইউজিন ওনিল, আর্থার মিলার, টেনেসি উইলিয়ামস, মেটারলিঙ্ক, হাউপ্টম্যান, মাইকেল, দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ - সে এক বিস্তৃত গ্রন্থভুবন। তিনি আলাদা করে উল্লেখ করেছেন অ্যারিস্টটল, অ্যালারডাইস নিকল, এ. সি. ব্র্যাডলি, স্তানিস্লাভস্কি, গোর্কি, জুলিয়াস ফুচিক, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের নাম। চিন্তায় একটা বামমার্গী ঝোঁক ছিল বলাইবাহুল্য। আর কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের অনুসিদ্ধান্তগুলি বা দার্শনিক প্রতিপাদ্যগুলি সম্পর্কেও তখনই আগ্রহ জন্মায় তাঁর। 'ম্যানিফেস্টো অফ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি' তাঁর বাস্তব ও ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর প্রভাব ফেলে গিয়েছিল। বস্তুত সৌমিত্রের, ‘অনুরাগের বাসন্তী বেলায় বই ছিল রসবৈচিত্র্যদায়িনী প্রিয় সখীর ভূমিকা নিয়ে। দুঃসহ শোকের দুঃসময়ে, নিজস্ব দুঃখের নিদারুণ একাকিত্বে বই এসেছে সান্ত্বনা হয়ে। নিঃসঙ্গতার অসহ প্রহর বন্ধুর সাহচর্য দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে বই। আবার সংগ্রামের হাতিয়ার, কাজের যন্ত্র হয়ে বিশ্বস্ত রয়ে গেছে বই। মানুষের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে গ্রন্থই বেঁধেছে এক অচ্ছেদ্য গ্রন্থিতে।’

সৌমিত্রের কাছে অভিনয়ের প্রথম আদর্শ শিশিরকুমার। ছাত্রাবস্থায় তার সঙ্গে কাটিয়েছেন অনেক বিকেল-সন্ধে, সে-ঘনিষ্ঠতা নেহাত নাবালকের সঙ্গে বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রায় অবসরপ্রাপ্ত নায়কের কালযাপন নয়। একসঙ্গে একবার অভিনয়ও করেছেন। সৌমিত্র সমৃদ্ধ হয়েছেন অভিনয় প্রসঙ্গে শিশিরকুমারের অজস্র সংবেদী পর্যবেক্ষণে। কলকাতায় প্রথম থিয়েটার দেখতে এসেই শিশিরকুমারকে দেখা তাঁর, অন্য থিয়েটারও দেখছেন, গ্রুপ থিয়েটার দেখছেন, কিন্তু কোথাও তাঁর মনে হচ্ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ীর থিয়েটারটাই উৎকৃষ্ট। সেই ধারাকেই তিনি অনুসরণ করতে চান। বেশি মানুষের কাছে নিজের প্রগতিশীল বক্তব্যটা পৌঁছে দিতে তাই পেশাদার রঙ্গমঞ্চের প্রতি সৌমিত্রের স্পষ্ট পক্ষপাত। শিশিরকুমার তাঁর কাছে ছিলেন অভিনয়শিক্ষার চলমান বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর বৈদগ্ধ্য, উইট, ‘মননদীপ্ত সরসতা এবং আপন অনন্য ব্যক্তিত্বের’ প্রকাশ দেখে সৌমিত্রের মনে পড়ে যেত জর্জ বার্নার্ড শয়ের কথা। আসলে সৌমিত্র নিজের স্নায়ুতে অনুভব করেছিলেন শিশিরকুমারের হৃদ্‌স্পন্দন। অধ্যাপকের নিরুপদ্রব জীবন ছেড়ে দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে শিশিরকুমারের পেশাদার রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ে আসাটা প্রকৃতপক্ষে বৈপ্লবিকই ছিল।

সৌমিত্রের জীবনের প্রথম বড়ো বদলটা এসেছিল ১৯৫৯-এর মে দিবসে মুক্তি পাওয়া অপুর সংসার-এর পর। সত্যজিৎ রায় ১৯৩১-এ প্রকাশিত 'অপরাজিত' উপন্যাসের এই অংশটিকে আশ্চর্য দক্ষতায় প্রায় সৌমিত্রের প্রথম যৌবনের সমসাময়িক করে ফেলেছেন। পাঠক কল্পনা করুন, বন্ধুর সঙ্গে 'সধবার একাদশী' নাটক দেখে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে রাতে টালাপার্কের আস্তানায় ফেরার সময় সৌমিত্রের মুখ দিয়ে সেসময়ের মানসিক অবস্থা স্পষ্ট করতে তাকে দিয়ে যে বলানো হলঃ ‘...বুদ্ধি দিয়ে ছাড়া সে কোনো কিছু মানতে চাইছে না, কিন্তু তার কল্পনা শক্তি আছে, তার অনুভূতি আছে, ছোটোখাটো জিনিস তাকে মুভ করছে, তাকে আনন্দ দিচ্ছে... সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না, সে পালাচ্ছে না, এসকেপ করছে না, সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, তার মধ্যেই আনন্দ, হি ওয়ান্টস টু লিভ’ - এ তো পঞ্চাশের বাঙালি যুবকের রোজনামচা প্রায় বলা যায়।

জীবনকে দেখার এবং বিশ্লেষণের যে-প্রশিক্ষণ সৌমিত্র পেয়েছিলেন তাতে তাঁর পক্ষে অবলীলায় বলা সম্ভব হয়েছিল, আমি ‘নায়ক চরিত্রের চরিত্রাভিনেতা হতে চাই’। চলমান চিত্রমালার নাক্ষত্রিক ঔজ্জ্বল্যের উলটো দিকের অন্ধকারেও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। তাই জীবনকে চেয়েছেন শিল্পে অনুবাদ করে নিতে। চরিত্রাভিনেতারা হয়ে উঠেছেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। চার্লস চ্যাপলিনের মতো ‘আহত প্রেমিক’ হয়েছেন তাঁর আরাধ্য। ভারতের চলচ্চিত্রে দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, উত্তমকুমারদের শ্রদ্ধার আসনে রেখেও তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, রবি ঘোষেরা তাঁর কাছে অত্যন্ত জরুরি মানুষ। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস কিংবা সম্পর্কে তাঁর ছোটোমাসি সুচিত্রা মিত্রের গানে নিমগ্ন মানুষটি আবার তাঁর দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বলে মনে করতেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। বাণিজ্যিক ও সমান্তরাল ধারার ছবিতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভের পরও তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন বলরাজ সাহনি ‘আমার আইডল’। বলরাজের নিজেকে ডিগ্ল্যামারাইজ করার অসামান্য দক্ষতার ভক্ত ছিলেন তিনি। শ্রমজীবী কোনো রিকশাওয়ালা, কাবুলিওয়ালা বা হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের 'অনুরাধা' ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় কিংবা এম এস সথ্যুর 'গরম হাওয়া'-য় জুতো ব্যবসায়ীর ভূমিকায় তাঁর ভূমিকা সৌমিত্রের চেতনায় গভীর ছাপ রেখে গেছে। অভিনয়ের ইতিহাসে তুলসী চক্রবর্তীর অনন্যতা নিয়ে লিখতে বসে সৌমিত্র অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির কথা উদ্ধৃত করে দেখাতে চেয়েছিলেন অভিনেতা কেমন সমাজ থেকেই শেখেন, সমাজ থেকেই জানেন এবং সমাজের সামনেই হাজির করেন নিজের সময়কে। অর্ধেন্দুশেখর বলেছিলেনঃ
আমি দেখি, তোমরা দেখিতে জানো না। তাই তোমাদের শিখিতে এত কষ্ট হয়। অভিনয় শিক্ষা কোনো ব্যক্তিবিশেষের নিকট হয় না - প্রকৃত অভিনয় সমাজের কাছে শিখিতে হয়। দেখিতে শিখিতে হয় - দেখিয়া বিচার করিতে হয়।… এবং উপযুক্ত অবসরে তা আরোপ করিতে চেষ্টা করিতে হয়।

সমাজের কাছে শেখা এবং সমাজকে খানিকটা বাসযোগ্য করে নেওয়ার জন্য লড়াইতেও তাই তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিধাহীন। একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষে যখন বাংলার রাজনীতি দাঁড়িয়েছিল একটা বদলের মুখে, তখনও স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানিয়েছিলেন, ‘দক্ষিণপন্থী মঞ্চে দাঁড়াইনি, দাঁড়াবো না’। শোনা যায় সক্রিয় সংসদীয় রাজনীতিতে আসার প্রস্তাবও ফিরিয়েছেন বিভিন্ন সময়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যখন শিল্পায়নের মডেল নিয়ে তর্ক চলছে তখনও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন শিল্পের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে। আবার নন্দীগ্রামে মানুষের মৃত্যুর বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু বলেছেন - ‘আমি এমন কোনো প্রতিবাদী মঞ্চের শরিক হতে পারি না, যে মঞ্চ আমার জীবনের ৬০ বছর ধরে চেনাজানা দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা অধিকৃত’। রোহিত ভেমুলা, কানহাইয়া কুমার কিংবা বিনায়ক সেনের প্রসঙ্গেও মতামত জানিয়েছেন। প্রতিবাদী হলেই তাকে 'দেশদ্রোহী' বলে দাগিয়ে দেওয়ার যে বিভাজনমূলক রাজনীতি আমাদের দেশে ইদানীং বেশ সুলভ তারও বিরোধিতা করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অটুট আস্থায় স্মরণ করেছেন মহাত্মা গান্ধি-মৌলানা আজাদ-দেশবন্ধু-সীমান্ত গান্ধি-সুভাষচন্দ্রের নাম, শ্রীচৈতন্য-রামকৃষ্ণদেবের উদার ধর্মচিন্তার কথা। সমকালের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, ’এতকাল পরে ভারতবর্ষের শুভবুদ্ধি, সংস্কৃতি-সচেতন মানুষকে নিশ্চয়ই বিজেপির নেতাদের কাছে ধর্মশিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন নেই, যে ধর্মের শিক্ষা এত মৃত্যু উপহার দেয়, তা আর যাই হোক, মনুষ্যত্বের ধর্ম নয়’।

আত্মজীবনী লেখা নিয়ে তাঁর যে-ধারণার কথা বলে এই নিবন্ধ শুরু হয়েছিল, সেই সূচনাবিন্দুতে ফিরে গিয়ে এটুকু বলে রাখা যাক, কুরোশাওয়ার 'সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি' তাঁকে যথেষ্টই ভাবিয়েছিল। রশোমন-এর এপারে, যেদিকে আলোকিত জীবন, সে-জীবন নিয়ে কুরোশাওয়া শব্দ খরচ করেননি। সৌমিত্রেরও ধারণা ছিল তিনি ‘বায়োগ্রাফিক্যালি’ বিশেষ ‘ইন্টারেস্টিং’ না হলেও টুকরো টুকরো যেসব গদ্য রচনা করে গেছেন তা কার্যত তাঁর মেজাজ ও মনোবীজকেই ধারণ করে। একজন অসামান্য অভিনেতা যিনি কায়মনোবাক্যে নায়কের চরিত্রাভিনেতাই হতে চেয়েছেন, সামাজিক সংকটে পালন করতে চাননি নাক্ষত্রিক দূরত্ব, তাঁর গদ্যরচনাগুলি উত্তরপ্রজন্মের কাছে সেই মানুষটিকেই রক্তমাংসে হাজির করে।