আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

সমসাময়িক

লাভ জিহাদ


‘বিবাহ’ শব্দের অর্থ কী? দুটি মত। এক, বিশেষভাবে বহন কর। দুই, বলপুর্বক আনয়ন করা। ভারতে আর্যরা এসেছিল নারীবিহীনভাবে। এদেশের নারীদের বলপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতো। অনেকে তো মনে করেন, রাতের বেলায় বিয়ের একটি কারণ এটি। লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া। এই সেদিন-ও বিহারে রীতি ছিল প্রথম রাত নববধূকে ভূস্বামী বা সবর্ণের মানুষের ঘরে কাটাতে হবে। নীরদ সি চৌধুরীর লেখায় আছে, বিয়ের পর প্রথম রাতে কুলগুরুর দীক্ষা দেওয়ার নামে লালসা চরিতার্থ করার হাত থেকে নববধূকে রক্ষা করেন খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে।

ইহুদি ধর্মে অ-ইহুদিকে বিয়ে করা নিষেধ। ইহুদি ধর্ম-সংস্কৃতি গ্রন্থ 'তামলুদে' এ-বিষয়ে পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা আছে। ইজরায়েলে যে-কারণে অন্য ধর্মে বিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তু ভারতে তা নেই। ছিল না।

ভারতে নয় রকম বিবাহ পদ্ধতি 'মনুস্মৃতি' অনুযায়ী চালু। ১. অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহ, ২. ব্রহ্ম বিবাহ, ৩. দৈব বিবাহ, ৪. আর্ষ বিবাহ, ৫. প্রজাপত্য বিবাহ, ৬. গান্ধর্ব বিবাহ, ৭. অসুর বিবাহ, ৮. রাক্ষস বিবাহ, ৯. পিশাচ বিবাহ।

১. অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহঃ যাকে আজকের চলতি ভাষায় ‘ইন্টার কাস্ট ম্যারেজ’ বলে, সেই ব্যাপারটাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ঋষিরা। উচ্চবর্ণের পুরুষ তথাকথিত নিম্নবর্ণের নারীর পাণিগ্রহণ করলে তাকে ‘অনুলোম’ বিবাহ বলা হতো। আর পাত্র যদি নিম্নবর্ণ থেকে আগত হন এবং পাত্রী হন উচ্চবর্ণজাতা, তাহলে সেই বিবাহকে ‘প্রতিলোম’ বলা হতো।
২. ব্রহ্ম বিবাহঃ এই বিবাহে পাত্রের পিতা কন্যার পরিবারে উপস্থিত হয়ে তার পিতার অনুমতি প্রাথর্না করেন। এই বিবাহকেই সর্বোৎকৃষ্ট বিবাহ বলে মনে করতেন আর্য ঋষিরা।
৩. দৈব বিবাহঃ এমন বিবাহে কন্যার পিতা দীর্ঘ সন্ধানের পরে কোনও সঠিক ঋত্বিকের হাতে কন্যাকে সম্প্রদান করেন। ঋত্বিকও যথাবিহিত যজ্ঞের দ্বারা কন্যার পাণিগ্রহণ করেন।
৪. আর্ষ বিবাহঃ এমন বিবাহে বরপণ দেওয়া হয়। সে-যুগে বরপণ হিসেবে সাধারণত গরু বা সোনা দান করা হত।
৫. প্রজাপত্য বিবাহঃ যে বিবাহে কন্যার পিতা আশীর্বাদপূর্বক কন্যাকে পাত্রস্থ করেন, তা-ই প্রজাপাত্য। ব্রহ্ম বিবাহে যেমন পাত্রসন্ধান সেভাবে হয় না, এখানে সেটা জরুরি।
৬. গান্ধর্ব বিবাহঃ প্রেমজ বিবাহ। পাত্র ও পাত্রীর সম্মতিই যথেষ্ট। পিতা-মাতার সম্মতিও এমন বিবাহে নিষ্প্রয়োজন। তবে তা থাকলে ক্ষতি নেই।
৭. অসুর বিবাহঃ যে বিবাহে কন্যাপণ নেওয়া হয়, তাকেই অসুর বিবাহ বলে।
৮. রাক্ষস বিবাহঃ কন্যার আত্মীয়দের হত্যা বা জখম করে কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিবাহ। এমন বিবাহ অনেক সময়ে যুদ্ধেও গড়াত।
৯. পিশাচ বিবাহঃ ঘুমন্ত, নেশাগ্রস্ত, অথবা উন্মাদদশাগ্রস্ত কন্যাকে বলপূর্বক বিবাহের নাম পিশাচ বিবাহ। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

এখন এই গান্ধর্ব বিবাহে যতো আপত্তি। আপত্তি তথাকথিত উচ্চবর্ণ/ সবর্ণ ও অ-সবর্ণ বিবাহে। এবং এ-সব ক্ষেত্রে বহু খুন জখমের কবর মেলে। বাড়ির মেয়ে তথাকথিত নিম্নবর্ণকে বিয়ে করলে নাকি সম্মানহানি ঘটে। প্রচার মাধ্যম এই নারকীয় ঘটনার নামকরণ করেছে 'অনার কিলিং'। ভাবা যায়। পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি অনার কিলিং ঘটে। ভারত-ও কম যায় মা। ২০১৯ এ শুধু জানুয়ারি থেকে জুনে ৫৮ জনকে অনার কিলিং বা হেট ক্রাইমের শিকার হতে হয়েছে।

এখন একটা কথা খুব ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে - লাভ জিহাদ। মানে কী? হিন্দু সম্প্রদায়ে জন্মানো মেয়ে মুসলিম ধর্মে জাত ব্যক্তিকে বিয়ে করতে বা প্রেম করতে পারবে না। এটা লাভ জিহাদের অঙ্গ। কিন্তু মুসলিম মেয়ে হিন্দু ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করলে তা 'ঘর য়াপসি'। উত্তরপ্রদেশে একটা অধ্যাদেশ আনা হয়েছে। ২৮ নভেম্বর তড়িঘড়ি সই-ও করে দিয়েছেন গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল। আইনটির নাম 'প্রহিবিশন অফ আনলফুল কনভারসান অফ রিলিজিয়ন অর্ডিন্যান্স ২০২০'। এবং এই আইনে ২৯ নভেম্বর ২০২০ তারিখেই বেরিলি জেলায় মামলা রুজু হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের সহ-মুখ্যসচিব ও বেরিলি জেলার পুলিশ সুপার। হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক - এই আইন আনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এটা ভারতে প্রচলিত স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪-র পরিপন্থী। সেখানে দু ধর্মের মানুষ বিয়ে করতে পারেন। ৯ অক্টোবর ১৯৫৪ এই আইন পাস হয়। ১ জানুয়ারি ১৯৫৫ থেকে তা কার্যকর হয়। এই আইন থেকে বাঁচতে বলা হচ্ছে, জোর করে ধর্মান্তর রোখা। কোনটা জোর করে আর কোনটা স্বেচ্ছায় সেটা কে বলবেন? সেই ব্যক্তি। কিন্তু তা নয়, বাবা বা মা বলছেন। বেরিলিতেও তাই ঘটেছে। অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে প্রেম বা বিয়ে করলেই ধর্ম পাল্টাতে হয় না। ইতিহাসে এ-রকম নজির ভুরিভুরি। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের ইহুদি স্ত্রী রায়হানা তাঁর ধর্ম পরিত্যাগ করেননি। ভারতে মুসলিমদের বিকাশের মূলে আছে বাণিজ্য ও বিবাহ। কেরালার রাজা চেরামন পেরুমল নিজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের প্রথম মসজিদ কেরালায় ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে। কেরলেই আরব বণিকরা কেরলিয়ন মেয়েদের বিয়ে করে বসবাস করা শুরু করেন। এদের বলা হতো মোপলা বা জামাই। এই মোপলারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্তত ১০ হাজার জন প্রাণ দেন। যা মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

মুঘল আমলে মুঘল সম্রাটরা বহু রাজপুত বিবাহ করেন। আকবরের স্ত্রী অম্বরের রাজা ভীরমলের কন্যা হারকা ছিলেন পরবর্তী মুগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের মা। জাহাঙ্গিরের প্রথম স্ত্রী মানবাই ছিলেন খসরুর মা। সম্রাট শাজাহানের মায়ের নাম যোধাবাই।

কবি কাজি নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলা সেনগুপ্ত ধর্ম পরিবর্তন করেননি। এ-যুগে উত্তরপ্রদেশে জন্মালে নজরুলের যে কী হতো!

উত্তরপ্রদেশে এই অধ্যাদেশ যখন আনা হচ্ছে, তখন উত্তরপ্রদেশের আইন শৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক অবস্তা শোচনীয়। ২৯ নভেম্বর দি টেলিগ্রাফ প্রথম পাতায় লিখছে, প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর কেন্দ্র বারাণসীতে এলেই সুজাবাদে বস্তি উচ্ছেদ হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এসেছিলেন ২০০ মানুষ উচ্ছেদ হয়েছিলেন। সমাজকর্মীদের চেষ্টায় সেপ্টেম্বরে আবার কোনোমতে বাস শুরু করলেই ২৮ ফেব্রুয়ারি ৭০ পরিবার উচ্ছেদ। বাসিন্দারা মুসলিম নন দলিত। ট্রাম্প এলে গুজরাটে বস্তি আড়াল করতে দেওয়াল দিতে হয়, বারাণসীতে মোদী এলে উচ্ছেদ। বস্তির বাসিন্দাদের পক্ষে জিরা দেবী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কবে কবে বারাণসী আসবেন জানিয়ে ক্যালেন্ডার করে দিলে সুবিধা হয়, তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের উচ্ছেদের সময় এসেছে। হেলিপ্যাডের ১৫০ মিটার দূরে এই বস্তি। প্রবল শীতে ঘর ছাড়া। কেন না প্রধানমন্ত্রী কার্তিক পূর্ণিমায় আলোয় সাজানো শহর দেখবেন।

মোদী যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন 'লাভ জিহাদ' শব্দের জন্ম দেওয়া হয় গুজরাটে। এরপর কেরালা ও কর্ণাটকে এররসার। ২০০৯-এ। কর্ণাটকে প্রমোদ মুথালিক নামে সঙ্ঘ পরিবারের এক সদস্য জন্ম দেন শ্রীরাম সেনা নামে এক সংগঠনের। বক্তব্য, আইসক্রিম পার্লার, স্কুল, কলেজ, নাটক, চলচ্চিত্রের হল পাহারা দেওয়া যাতে হিন্দু মেয়েরা মুসলিমদের দ্বারা প্রলুব্ধ না হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। ২০১৪ তে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সরাসরি আসরে নামে আরএসএস তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাশালী পরিবার সঙ্ঘ পরিবার। তাঁদের মুখপত্র 'অর্গানাইজার' এবং 'পাঞ্চজন্যে' ২০১৪ এর সেপ্টেম্বরে লেখা ছাপা হয় - প্যার অন্ধা ইয়া ধান্দা। গড়ে তোলা হল - হিন্দু বহেন বেটি বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি। এরা নিয়োগ করতে লাগলো খোচর বা টিকটিকি আদালতে, থানায় - যাঁরা মামলা মোকদ্দমা করতে সাহায্য করবে। বাবা-মাকে জানাবে। বাবা-মায়ের আপত্তি না থাকলেও এরাই দায়িত্ব নেবে সিধে করার। ২০১৫তে কেরলে অবস্থা দাঁড়াল সাঙ্ঘাতিক। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ক্রিস্ত্রোফে জেফ্রল্ট ২৬ নভেম্বর লিখছেন, আদিয়া নামে এক তরুণীর বাবা-মা কেরল হাইকোর্টে জোর করে ধর্মান্তরের অভিযোগ আনে। হাদিয়া নিজে অন্য কথা বললেও কেরল হাইকোর্ট ২০১৭তে বাবা-মায়ের পক্ষে রায় দিয়ে বলে, বিয়ে অবৈধ। হাদিয়াকে বাবা-মায়ের জিম্মায় তুলে দেয়, কারণ হাদিয়া নাকি ইসলামী গোঁড়াদের হাতে পড়েছে। হাদিয়ার স্বামী সুপ্রিম কোর্টে গেলেন। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টা খতিয়ে দেখতে এনআইএ-কে তদন্ত ভার দিল। এবং হাদিয়ার অসম্মতি সত্ত্বেও এই এনআইএ-র রায়ের অপেক্ষা না করে তাঁকে বাবা মায়ের হাতে তুলে দেয়। ২০১৮র মার্চে এনআইএ তদন্ত করে জানাল, এটা প্রেমের ঘটনা, এতে জঙ্গি হাত নেই। সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে স্বীকার করল, বিয়ে বৈধ।

২০১৭তে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের অন্যতম প্রচার ছিল - লাভ জেহাদ। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই অজয়কুমার বিস্ট ওরফে আদিত্যনাথ যোগী অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড গঠন করলেন। যাঁদের লক্ষ্য প্রেম আটকানো, মানে মুসলিম ছেলে ও হিন্দু মেয়ের প্রেম আটকানো। সাভারকর বলেছিলেন, ভারতীয় আদর্শ মেনে নিলেই সে ভারতীয়। নব্য সঙ্ঘীরা আরেকটি কাঠি বাড়া। তাঁদের কাছে, অন্য ধর্মের মানেই বিদেশি।

প্রেম করার স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তাতে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বাবা-মাও নন। অথচ একটা রাজ‍্য সরকার সংবিধান বিরোধী আইন আনছে, অর্ণব গোস্বামী মামলায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বাণী ছড়ানো সুপ্রিম কোর্ট চুপ। চুপ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই। সবাই সহি হিন্দু হতে ব্যস্ত।

ভারতে আন্তঃজাতি বিবাহ হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর আন্তঃধর্মীয় বিবাহ হচ্ছে ২.৩ শতাংশ। খ্রিস্টানদের মধ্যে এটা ৩.৫%,শিখদের মধ্যে ৩.২%, হিন্দুদের মধ্যে ১.৫% আর মুসলমানদের মধ্যে ০.৬%। এটা লিখেছে ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস। রাজ্যওয়ারি হিসেবে ঝাড়খণ্ডে ৫.৭%, অন্ধ্রে ৪.৭%, ছত্তিশগড়ে ০.৬% হিসেব দেখলে সবচেয়ে এগিয়ে পাঞ্জাব ৭.৮%। আর সবচেয়ে কম পশ্চিমবঙ্গে ০.৩%। এ হিসেব ২০১৩-র। ২০১৯ এর হিসেব মিলেছে দিল্লির। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট নিবন্ধীকৃত বিবাহ ১৯২৫০। তার মধ্যে আন্তঃজাতি বিবাহ ৫৮৯।

সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন, আন্তঃধর্মীয়, আন্তঃজাতি বিবাহ যত বাড়বে সমাজপ্রগতিও তত বাড়বে, হবে সাংস্কৃতিক সামাজিক উন্নয়ন। কিন্তু সেদিকে তো নয়া ভারত নির্মাতাদের খেয়াল নেই। তাঁরা পিছনে হাঁটতে ব্যস্ত।