আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

সমসাময়িক

সংক্রমণের সালতামামি


নাইন নাইন সিক্স। মানে, ৯৯৬। সংক্রমণ সিক্ত সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। নব বাস্তব বা নিউ নর্মাল সমাজে শ্রমদিবস হয়ে যাচ্ছে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা এবং সপ্তাহে ৬ দিন। সংক্ষেপে ৯৯৬।

সামাজিক দূরত্ব বিধি এতদিনে রপ্ত হয়ে গেছে। আপাত দৃষ্টিতে সম্মিলিত প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে গেছে। কাজেই এই বিধি প্রতিহত করার নাকি সুযোগ নেই। প্রতিরোধ প্রশ্নাতীত।

বহু ঘাম রক্ত প্রাণ ঝরিয়ে জয় করা অধিকার, ৮ ঘন্টা কাজের দিন এখন ইতিহাস। সংক্রমণের প্রকোপে সভ্যতাকে অবরুদ্ধ করে শতাধিক বছরের পুরনো সামাজিক চুক্তি অর্থাৎ ৮ ঘন্টার শ্রমদিবস নীরবে বাতিল হয়ে গেল। মে দিবসের কাহিনি ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। কোথাও কোথাও অবিশ্যি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস সরাসরি পাঠ্য পুস্তক থেকে বাতিলই করে দেওয়া হয়েছে। সেইসব জায়গার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ৮ ঘন্টার কাজের অধিকার বা মে দিবস হয়ে যাবে কল্পলোকের গল্প।

পরীক্ষাটা আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরিষেবার সঙ্গে যুক্তদের জন্য হুকুম জারি হল বাড়িতে বসে ইন্টারনেট মারফত অনলাইনে কাজ করতে হবে। বাড়িতে কম্পিউটার না থাকলে অথবা কম্পিউটার-দক্ষ না হলে কাজের অযোগ্য বলে ঘোষণা করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন এলাকায় বসবাস করলে বা ইন্টারনেট শ্লথগতিতে কাজ করলে কী করতে হবে তার কোনো নিদান দেওয়া হয়নি। ফলাফল - 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' বলে দিনে বারো তো বহুদূর ষোলো/আঠারো ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পছন্দ না হলে - বস্তা নাও, রাস্তা দেখো। অর্থাৎ ঘুরিয়ে ঘাড় ধাক্কা। কাজের বাজারে লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ একজন বাতিল হলে কাল আরেকজনকে কম মজুরিতে কাজে লাগিয়ে দেওয়া যাবে। না, বেতন নয়; এখন যতটুকু শ্রমের প্রয়োজন তা তো ঠিকাচুক্তির মাধ্যমেই ভাড়া করা হচ্ছে; কাজেই মজুরি বলাই সঙ্গত। আর পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক কর্মচারী দিয়ে প্রত্যক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখার পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েই প্রয়োগ করা হচ্ছে ৯৯৬ শ্রম ব্যবস্থা। এর নাম নব বাস্তব। নেহাত মুখ ঢেকেছে মাস্ক। অন্যথায় এমন হুকুমনামা জারির পর মুখ লুকিয়ে কাজ করতে যেতে হত। অথবা শুরু হতে পারত প্রতিবাদ মুখর আন্দোলন।

সংক্রমণের দাপটে স্কুল কলেজের দরজায় অনেককাল আগেই তালা পড়েছে। যেখানে সুযোগ সুবিধা রয়েছে এবং শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা কম্পিউটার-দক্ষ সেখানে চলছে অনলাইন ক্লাস। অন্যথায় ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত টিউশন ফি কীভাবে আদায় হবে! ছাত্রছাত্রীরা এর ফলে কেমন শিক্ষিত হচ্ছে তার মূল্যায়ন পরে করা যাবে।

সংক্রমণের সুবাদে অবিশ্যি নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র ছোটো মাঝারি শিল্প যা সংক্ষেপে এমএসএমই নামে পরিচিত সেই ক্ষেত্রে কম পুঁজি বিনিয়োগ করে অনেকেই কাজ শুরু করেছেন। মাস্ক, গ্লাভস্, স্যানিটাইজার, ফেস্ শিল্ড, পিপিই ইত্যাদি তো সংক্রমণ সময়েরই উদ্ভাবন। আত্মনির্ভর দেশ গড়ার লক্ষ্যে এ এক অবশ্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ভোকাল ফর লোকাল প্রকল্পের মধ্যেও এই নতুন শিল্পদ্যোগীরা নিশ্চয়ই অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।

স্বাস্থ্য পরিষেবা শিল্পও পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন পাঁচতারা হাসপাতাল চিকিৎসাধীন মানুষের কাছ থেকে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে অর্থ আদায় করে চলেছে। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হাসপাতালে থাকাকালীন মৃত্যু হলে মৃতের পরিবার পরিজনের হাতে মৃতদেহ তুলে দিতে যথেষ্ট সময় নেওয়া হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে মৃতদেহের রক্ষণাবেক্ষণ করার খরচ হাসপাতাল কেন বহন করবে। সবমিলিয়ে পাঁচতারা হাসপাতালের পক্ষে এ বড়ো সুখের সময়।

নভেম্বর ১৭, ২০১৯। অজানা অণুজীবের খবর প্রথম প্রচারিত হল। পরের এক বছরে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়সীমায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ। এখনও পর্যন্ত সোয়া ৬ কোটির মতো মানুষ আক্রান্ত। মারা গেছেন সাড়ে ১৪ লক্ষের বেশি মানুষ। ভারতে প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়ার পর ২৭১ দিনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কোটি ছুঁতে চলেছে। ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ২০০ জন প্রয়াত। পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা পৌনে পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। আট হাজারের বেশি মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে। এসবই অবিশ্যি সরকারি তথ্য। এর বাইরেও কতজন আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন তার খবর কী করে পাওয়া যাবে?

সংক্রমণের মূল কারণ যে অণুজীব তার জন্মরহস্য এখনও অজ্ঞাত। স্বভাবতই তার স্বভাব চরিত্র অজানা। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে দিনরাত এক করে গবেষকরা এই বিষয়ে কাজ করে চলেছেন। কোনো গবেষণাই এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। বিভিন্ন গবেষণাপত্র বলছে যে গত এক বছরের মধ্যে এই ভয়াবহ অণুজীবের চরিত্রে অন্তত তিরিশবার পরিবর্তন বা মিউটেশন হয়েছে। গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিতর্ক চলছে। অথচ প্রতিষেধক উদ্ভাবনের কাজ নাকি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে অণুজীবের কোন সংস্করণের প্রতিরোধ করার জন্য এই টিকা উপযোগী। উত্তরে সকলেই থাকে মৌন।

সংক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিষেধক বাজারে আনার জন্য বিশ্বের বড়ো বড়ো ওষুধ নির্মাতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে অলিখিত প্রতিযোগিতা। এবং বিভিন্ন মাধ্যমে অনবরত প্রচারিত হচ্ছে প্রতিযোগিতার ধারাবিবরণী। টিকা কবে বাজারে আসতে পারে, তার দাম কত হবে ইত্যাদি নিয়ে কত না আলোচনা!

সংক্রমণের বর্ষপূর্তির প্রাক্ মুহূর্তে হঠাৎ করে বিশ্বের সেরা ওষুধ নির্মাতারা দাবি জানাতে শুরু করেছে তাদের টিকার সাফল্যের মাত্রা। কারো দাবি নব্বই শতাংশ। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা দাবি বিরানব্বই শতাংশ। অন্যজন আরও এক শতাংশ বাড়িয়ে পরের দিন সোচ্চার হলেন। কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে না এই শতাংশটা কিসের মাত্রা নির্ধারণ করছে। প্রথম সম্ভাবনা - একশো জনকে টিকা দিলে পাঁচ জনের জন্য এই টিকা কার্যকর হবে না। বিকল্প সম্ভাবনা - সকলেরই নব্বই বা বিরানব্বই শতাংশ সংক্রমণ প্রতিহত হবে। কাজেই টিকা নেওয়ার পরেও কারো সংক্রমণ হলে ধরে নিতে হবে যে অপ্রতিরোধ্য আট বা দশ শতাংশই সংক্রমণের জন্য দায়ী। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোনো শব্দ কিন্তু উচ্চারণ করা হয়নি। এইসব রহস্যাবৃত প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব না দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে কোটি কোটি টিকা। এবং শুরু হয়েছে বাজার দখলের লড়াই।

টিকা তৈরির জন্য যারা অর্থ বিনিয়োগ করেছে সেইসব বড় বড় ওষুধ নির্মাতাদের মূল উদ্দেশ্য তাদের লগ্নি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসুক। বাণিজ্যের দুনিয়ায় সেটাই প্রচলিত রীতি। ফলে শেয়ার বাজারে ফাটকা শুরু হয়ে গেছে। সম্ভাব্য টিকা নির্মাতাদের শেয়ারের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কোনো এক পদস্থ আধিকারিক প্রচারের এই দাপুটে বাজারে নিজের অধিকাংশ শেয়ার বিক্রি করে প্রায় ছাপ্পান্ন লক্ষ মার্কিন ডলার উপার্জন করেছেন। এই একটি দৃষ্টান্ত চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে গবেষণার সাফল্যর থেকেও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ।

হঠাৎ করে এত বড়ো একটা বাজারের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় তার দখলদারিত্ব নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রনায়করা স্বাভাবিকভাবেই উজ্জীবিত। প্রতিষেধকের কার্যকারিতা প্রমাণিত হওয়ার আগেই তার বন্টন-বিতরণ প্রক্রিয়ার নীলনকশা প্রণয়ন করা শুরু হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে টিকার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। সংক্রমণ কিন্তু কমেনি। উন্নত হয়নি স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো।

সংক্রমণের আবহে আর একটি দ্বন্দ্ব মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। জীবন না জীবিকা, কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার এই নিয়ে নিরন্তর আলোচনা বিতর্ক পর্যালোচনা চলছে। তথ্য-যুক্তি পেশ করে বিশেষজ্ঞরা বলার চেষ্টা করছেন কোনোটাকেই অবহেলা করা চলবে না। কিন্তু শুনছে কে? মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব বাতিল করে ঋণের আয়োজন করা হচ্ছে। ফলাফল দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। সরকারি নথিও স্বীকার করে নিয়েছে যে দেশ মন্দার কবলে নিমজ্জিত।

পর পর দুটি ত্রৈমাসিকে জিডিপি বা দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের সঙ্কোচন হলে তাকে অর্থনীতির পরিভাষায় ‘টেকনিক্যাল রিসেশন' বা আপাত মন্দা বলা হয়। ১৯৯৬-এর পর এই প্রথম ভারতের অর্থনীতিকে এমন আর্থিক সঙ্কোচনের মুখে পড়তে হল। এপ্রিল থেকে জুন ত্রৈমাসিকে জিডিপির সঙ্কোচন হয়েছিল প্রায় চব্বিশ শতাংশ। অনেকদিন পর দোকান-বাজার খোলায় এবং উৎসবের মরসুমের জন্য বিক্রিবাট্টা কিছুটা হলেও বেড়েছিল। ফলে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে সঙ্কোচন কমে দাঁড়াল সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থনীতির অবনমন কিন্তু অবরোধ করা গেল না। সবমিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা এখন সরকারিভাবে স্বীকৃত সত্য।

একই সঙ্গে সংক্রমণের আবহে একের পর এক এমন সব নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে যা কোনোমতেই দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কৃষি আইন বদলিয়ে সমস্ত কৃষি উৎপাদন ব্যাবস্থাকে গুটিকয়েক শিল্পপতির হাতের মুঠোয় তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর সবকিছুরই মালিক এখন সেই হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পপতি। দেশের অরণ্য সম্পদ আজ আইন মেনেই ধ্বংসের মুখোমুখি।

সুলভ এবং জনকল্যাণমূলক যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় রেল দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছে। অবরোধের আড়ালে সেই সুস্থির ব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার এটাই নাকি আদর্শ সময়। লাভজনক এবং যাত্রীদের বেশি পছন্দের ট্রেনগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব চলে গেছে বেসরকারি সংস্থাদের কাছে। অলাভজনক ট্রেন যেগুলিতে যাত্রী সংখ্যা কম সেগুলি বাতিল। বন্ধ করে দেওয়া হবে বহু রেল স্টেশন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতের বহু ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে। কু ঝিক ঝিক রেলের গাড়ি এখন আর দূর গাঁয়ের কোনো ইস্টিশনে থামবে না। পুরোনো আমলের চলচ্চিত্রে অথবা প্রবীণদের স্মৃতিতে থেকে যাবে সেই মন্থর রেলগাড়ি। নব বাস্তব সমাজে যাত্রীদের সুবিধার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় রেল থেকে অর্থ উপার্জন।

সংক্রমণের দাপটে অর্থনৈতিক মন্দার আবহে বাজারে ক্রেতার বড়োই অভাব। কিন্তু আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে অবিচল থেকে এখন ক্রেতার শর্তে জাতীয় বিমান পরিবহন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি, টেলিফোন কোম্পানি এককথায় যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের মানুষের মুখে মাস্ক আঁটা আছে বলে তাদের পক্ষে মুখর হওয়া সম্ভব নয় ধরে নিয়ে নির্বিকার ভাবে দেশের সমস্ত উৎপাদন ও পরিষেবা ব্যবস্থা কতিপয় বিনিয়োগকারীদের হাতে সঁপে দেওয়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়!

সংক্রমণ-সন্ত্রস্ত সমাজে প্রচলিত সামাজিক ধ্যানধারণা বিধ্বস্ত। 'মানুষ মানুষের জন্য' এখন যেন শুধুমাত্র জনপ্রিয় গানের কলি। নব বাস্তব জীবনে সামাজিক সহমর্মিতা সহযোগিতার মানসিকতা উধাও। সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শারীরিক বা পারস্পরিক দূরত্ব রক্ষা করা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু শুরুর দিন থেকে চব্বিশ ঘন্টা ধরে দিনের পর দিন বলে যাওয়া হয়েছে সামাজিক দূরত্ব অত্যন্ত জরুরি। মাস তিনেক আগে হঠাৎ করে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার। ততদিনে সংক্রমণজনিত ভয়-সন্দেহ, আতঙ্ক-উদ্বেগ সমাজের মধ্যে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে মানবমনের সমস্ত সুকুমার প্রবৃত্তি বিলুপ্ত করে দিয়েছে। মাস্ক পরিহিত নব বাস্তব হয়তো খুলে দিয়েছে এতদিন ধরে বহু যত্নে লালিত সামাজিক শিষ্টাচার, সামাজিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি।

দৈনন্দিন কথোপকথনে অনেকখানি জায়গা দখল করেছে মাস্ক, গ্লাভস্, স্যানিটাইজার, ফেস্ শিল্ড, পিপিই, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ, সিম্পটোম্যাটিক, অ্যাসিম্পটোম্যাটিক জাতীয় পরিভাষার শব্দ। বহুদিন ধরে প্রচলিত বলে 'লক আপ' শব্দবন্ধ এখন পৃথিবীর সব ভাষার নিজস্ব শব্দ। কলকারখানায় যাঁরা কাজ করেন তাঁদের কাছে 'লক আউট' অচেনা শব্দবন্ধ নয়। সংক্রমণ সমাজসভ্যতাকে সার্বিকভাবে শিখিয়ে দিল 'লক ডাউন' কারে কয়!

নব বাস্তব জীবনে সবকিছুই কিন্তু নতুন নয়। অবরোধের দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে দেশে মানুষের প্রবল আলোড়নের ফলে পর্যুদস্ত হয়ে চলেছে রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা। দেশের মধ্যেও কৃষকদের সম্মিলিত ক্ষোভ এখন রাজধানীর দরজায় আছড়ে পড়েছে। সীমান্তের যুদ্ধ নয়, দেশের অন্নদাতাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে রাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করেছে। নব বাস্তব সমাজসভ্যতার অনেক বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে তা সমাজের অন্য অংশের জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে। হয়তো এইভাবেই নব বাস্তব দুনিয়ায় শুরু হয়ে গেল নতুন ধারার জন আলোড়ন।