আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

‘...একা হতেছি আলাদা?’

রত্না রায়


'নিজেকে মার্কসবাদী বলে গর্বিত প্রচার করি... অথচ সেইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার অভিভূত গরিমাবোধ' - এই উক্তির আলোয় পড়ে নিতে হবে অশোক মিত্রের গোটা জীবনকে। সার্তের অস্তিত্ববাদের সাম্যবাদে নিবৃত্তি ঘটান যায় কিনা, সাংগঠনিক আদর্শ বনাম ব্যক্তিআবেগের দ্বন্দ্ব থামানো যেত যদি... সারাটা জীবন এভাবেই মেলাতে চেয়েছেন লেখক,দার্শনিক,কাব্য ও সঙ্গীতপ্রেমী, অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী,কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেষ্টা শ্রী অশোক মিত্র। সদা অনুসন্ধিৎসু একটি বহতা নদীর মতো প্রায় অসম্ভব গতি ও চলনে আমদের রুদ্ধবাক করে রাখেন যিনি।

প্রণব বিশ্বাসের সম্পাদনায়, অনুষ্টুপ প্রকাশনী থেকে আগস্ট ২০১৯ সালে প্রকাশিত 'অশোক মিত্র - স্মৃতি ও কথা' গ্রন্থটি এই দুঃসময়ে একটি আলোকবর্তিকার কাজ করবে। এই অসামান্য ব্যক্তিত্বকে তাঁর মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ডের আলোচনা সহ উন্মোচিত করে দেখিয়েছেন সম্পাদক অত্যন্ত যত্নশীলতার সঙ্গে।

গ্রন্থটিতে ব্যাক্তিগত স্মৃতিচারণ ১৩টি; মার্কসবাদী ও অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্রকে খুলেখাবলে দেখা 'আমার বিচার তুমি কর' শীর্ষক আলোচনা - ১০টি; তাঁর সঙ্গীতমনস্কতা, সম্পাদনা নিয়ে আলোচনা 'জীবন ভরি মাধুরী' - ৩টি; 'অনুষ্টুপ ও অশোক মিত্র' শিরোনামে অশোক মিত্রের ৭টি লেখা; 'অশোক মিত্রের কয়েকটি লেখা' অভিধায় ৩টি বাংলা লেখা ও ৪টি ইংরাজী লেখা এবং সবশেষে তাঁর জীবন ও গ্রন্থপঞ্জী - এই হলো ৪৩৯ পাতা গ্রন্থের সারাৎসার।

গ্রন্থের শুরুতে 'নিবেদন' অংশে সম্পাদক প্রণব বিশ্বাস বলেন 'অবিচল' বিশেষণে অশোক মিত্রকে যেমন মানায় তেমন বোধ হয় আর কাউকেই নয়।' ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের সিংহভাগ ভেঙে, কিছু বন্ধু স্বজনের সহায়তা নিয়ে রাজনীতি-সমাজ-সাহিত্য-দর্শন সচেতন অন্যরকমের কাগজ 'আরেক রকম' পত্রিকা প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন এই ৮৫ বছরের চিরযুবা। সম্পাদক মহাশয় আমাদের জানান অশোক মিত্রের প্রয়াণের বৎসরাধিক কাল পরে বহু বাধা বিঘ্নের অবসানে এই গ্রন্থটি তাঁরা প্রকাশ করতে পারলেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে মূল গ্রন্থে ঢোকা যাক।

'নিমেষ গণন হয় কি মোর সারা' এই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ পর্বে অমিয় দেব ১ মে ২০১৮ অশোক মিত্রের জীবনের শেষদিনটিকে স্মরণ করে শুরু করেন তাঁর লেখা। শুনিয়েছেন যুবক অশোক মিত্রের বুদ্ধদেব বসুতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকার কাহিনি, পরবর্তীতে আসে কবিতা থেকে মিছিলে উত্তরণ বা অবতরণের ঘটনা। সরকারি উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর একটিও প্রস্তাব গৃহীত হয়নি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায়। নিজের দলেও কোনো উত্তরণের সংকেত খুঁজে পাননি।কিন্তু কবিতা ও রবীন্দ্রগান আজীবন তাঁর জন্য কোল পেতে দিয়েছিল।

সুপ্রিয়া রায়চৌধুরী, অরুন্ধতী দত্ত ও যশোধরা রায়চৌধুরী প্রত্যেকেই তাঁদের পারিবারিক সম্পর্কের গ্রন্থি উন্মোচন করে দেখিয়েছেন স্নেহপ্রবণ একটি মানুষকে যিনি ছোটদের দিয়েছেন সমবয়সীর মর্যাদা ও সন্তানসুলভ আদরযত্ন। আতিথ্যে তিনি ও তাঁর স্ত্রী গৌরী মিত্র ছিলেন সমান মনোযোগী ও আন্তরিক। যতদিন চলনক্ষম ছিলেন, বিভিন্ন রেস্তঁরায় ভাগ্নে ভাগ্নীদের খাইয়েছেন। কবিতা লেখায় উৎসাহ দিয়েছেন যশোধারা দেবীকে। কীভাবে তাঁদের সঙ্কটকালে অভিভাবকের মতো পাশে থেকেছেন স্মরণ করেছেন সুপ্রিয়া দেবী।

দময়ন্তী বসু সিং কবিতাভবনের সাথে অশোক মিত্রের অম্লমধুর সম্পর্কের একটি মনোগ্রাহী ছবি এঁকেছেন। শ্রী মিত্রের প্রথম যৌবনের তীর্থভূমি কবিতাভবনের সঙ্গে ধীরে ধীরে তাঁর বন্ধন শিথিল হয়ে যায়, অথচ অন্তরে থাকে এক দুর্মর আকর্ষণ! মার্কসবাদে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। দময়ন্তী দেবী জানান বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'অনুদ্ধারণীয়' গল্পটি লিখেছিলেন এক তরুণ বিপ্লবীকে নিয়ে, যার বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেন প্রবীণ লেখক।

প্রভাতকুমার দাসও কবিতাভবন ও অশোক মিত্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে আলোকপাত করেছেন। কবি হিসেবে কবিতাভবন তাঁকে তুলে ধরতে চায়নি, কিন্তু কবিতা পত্রিকার আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সমর্পিত সৈনিক।

স্বপন সোম অশোক মিত্রের গভীর সংগীতানুরাগের কথা শুনিয়েছেন আমাদের। তিন ও চার দশকের বাংলা আধুনিক গান, গণনাট্য সংঘের গান, শচীন দেববর্মণ ও হিমাংশু দত্তের গানের বিশেষ ভক্ত ছিলেন শ্রী মিত্র। 'আমার মৃত্যুর পর' নামক নিবন্ধের উল্লেখ করেছেন শ্রী সোম, যেখানে অশোক মিত্র তাঁর স্মরণসভায় যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হয় বলে আবেদন জানান। গানগুলিও তিনি উল্লেখ করে দেন - তিনটি ধাপে মোট ষাটটি গান। এ তথ্য আমাদের জানান শ্রী সোম।

প্রদীপ ঘোষ অশোক মিত্রের শেষ দিনগুলির বেদনাঘন চিত্র চোখের সামনে তুলে ধরেন। একটি মধুর দাম্পত্য তাঁকে শতেক ঝড়ঝাপটাতেও আগলে রেখেছিল। স্ত্রীবিয়োগের পর শরীর মন, রাজনৈতিক অবনমন সবকিছু মানুষটিকে কোনঠাসা করে দিয়েছিল।

অমিতাভ রায় বিবৃত করেছেন 'আরেক রকম' পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখার জন্য শ্রী মিত্রের করুণ আকুতির কথা। অসাধারণ ইংরাজি লিখতেন অশোক মিত্র। প্রশংসা করলে উত্তর দেন - মাতৃভাষা ভাল করে শিখলে অন্য ভাষা সহজেই আয়ত্ত করা যায়। 'তাল বেতাল' গ্রন্থের জন্য শ্রী মিত্রের সাহিত্য একাদেমি পুরষ্কার প্রাপ্তির কথাও জানিয়েছেন শ্রী রায়।

ভাস্কর দাশগুপ্ত তাঁর লেখায় অকপটে স্বীকার করেছেন বামপন্থার অভিজ্ঞান চিনে নিতে অশোক মিত্রের লেখাগুলি তাঁকে কতটা সাহায্য করেছে। 'রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করবার সহায়ক শক্তি তো অবশ্যই অশোক মিত্রের রচনাসম্ভার।' শ্রী মিত্রের বেশ কিছু দরকারি লেখার একটি তালিকাও আমরা পাই ভাস্করবাবুর 'জনৈকের স্মৃতি কন্ডূয়ন' শীর্ষক স্মৃতিচারণে।

সাংবাদিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য ভাষায় জানান ১৯৮৪ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের সঙ্গে মহাকরণে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা। রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে পাওনা টাকার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু দিল্লি থেকে পাওয়া গেছে 'গভীর নৈঃশব্দ্য'। দু'খানা হাত পিছমোড়া করে বেঁধে কেন্দ্র বলছে 'বেণী বাঁধো তো মা জননী' - এই শব্দবন্ধ বা চিত্রকল্প কোনো মন্ত্রীর মুখে কখনো শোনেননি শ্রী চট্টোপাধ্যায়। অনির্বাণ বাবু মনে করিয়ে দেন যে বামপন্থী নেতাকর্মীদের কাছে শ্রী মিত্রের একটাই দাবি ছিল - শিক্ষিত হওয়ার দাবি, নান্দনিক বিবেক ও বোধশক্তি গড়ে তোলার দাবি। অনির্বাণ আরো মনে করেন, রোম্যান্টিকতা শ্রী মিত্রের কাছে দুর্বলের আলস্য নয়, বেটোফেনের প্রত্যয়ী স্বপ্ন!

রুশতী সেন তাঁর স্মৃতিচারণে অতি শৈশবে অশোক মিত্রের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারের একটি মধুর ছবি উপহার দিয়েছেন। বাল্যকাল থেকে প্রৌঢ়ত্ব অবধি শ্রী মিত্রের স্নেহলাভে ধন্য তিনি। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যেরাও ব্যতিক্রম নন। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি মাইলফলক।কিন্তু বিভূতিভূষণের অপু যেভাবে শ্রী মিত্রের মনকে অধিকার করে আছে, সত্যজিৎ রায়ের অপুকে তা জায়গা ছাড়তে নারাজ - এই নাছোড় আবেগের কথাও জানিয়েছেন শ্রীমতী সেন। অশোক মিত্রের কাছে ভোট বড় বালাই ছিল না। সঞ্চয়িতা চিট ফান্ড কান্ডে মানুষের ভুল ব্যাখ্যাকে ভুল ই বলেছেন শ্রী মিত্র এবং ভোটযুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিলেন। এ তথ্যও আমরা রুশতী দেবীর কাছে পাই। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে শ্রী মিত্রের নীরবতা তাঁর মনোভাবকেই ব্যক্ত করে বলেও তিনি মনে করেন। তবে নন্দীগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও হালফিলে বুদ্ধিজীবীদের কোনো প্রশ্ন বা উত্তর কিছুই শোনা যায় না।

এরপরেই চলে আসি এই গ্রন্থের বিতর্কিত অধ্যায়ে - 'আমার বিচার তুমি করো'। এই পর্বে অভিরূপ সরকার 'অশোক মিত্রের অর্থনীতি' প্রবন্ধে স্বীকার করেছেন, অর্থনীতির যে তাত্ত্বিক কাঠামো অধুনা সর্বজনস্বীকৃত, অশোক মিত্র বহু আগেই জ্যান টিনবার্গেনের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ 'Terms of trade and class relations' এ তার কাঠামো ফেঁদে রেখেছেন। সারস্বত সমাজের দীনতা এতখানি যে এই অবদান তাঁরা মনে রাখতে চাননি।

শুভনীল চৌধুরী 'অর্থনীতির ভিন্ন পাঠ' শীর্ষক লেখায় বলেছেন উপরোক্ত গবেষণাপত্রের ২০০৫ সালের সংস্করণে অশোক মিত্র দেখিয়েছেন উদারীকরণ কিভাবে বড়ো চাষীদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে; ফলতঃ প্রান্তিক চাষী খেতমজুরদের সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী আর্থিক সংস্কারের ফলে লাভবান হচ্ছে,কিন্তু শ্রমিক কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে তাদের কোনো গরজ নেই। শ্রী চৌধুরী অশোক মিত্রকে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য উৎসর্গীকৃত বিরল বুদ্ধিজীবী বলে উল্লেখ করেছেন।

অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠভাবে মিত্র কমিশনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি জরুরি কাজ করেছেন কুমার রাণা। সকল শিশুকে স্কুলের আওতাভুক্ত করা, প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করা, স্কুলে রান্নাকরা খাবার পরিবেশন করা, প্রত্যেক স্কুলে ছাত্রদের জন্য রান্না করা খাবার যোগান দেওয়া, গ্রামে পাঠাগার স্থাপন - মিত্র কমিশনের সুপারিশগুলি আজও কি কার্যকর করা হয়েছে সঠিকভাবে ; প্রশ্ন রেখেছেন লেখক। নিজের দলের কাছেই বা কতটা গ্রাহ্য হয়েছে শ্রী মিত্রের এই প্রস্তাবগুলি? কিন্তু সমাজ গড়ার কাজে মিত্র কমিশনের রিপোর্টকে ঐতিহাসিক বলে দাবি করেছেন শ্রী রাণা।

পক্ষান্তরে বিশ্বজিৎ রায় প্রশ্ন তুলেছেন অশোক মিত্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। তাঁকে মাটির সঙ্গে যোগ না থাকা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে মনে করেন শ্রী রায়। জনসংযোগের কাজেও তিনি ব্যর্থ। যদিও শ্রী মিত্রের 'কমরেড বাচ্চা মুনশীর ভূগোলের বই' নিবন্ধটি প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ রায় বলেন 'এমন মায়া-মমতাময় লেখা কমই পড়েছি তাঁর'। কিন্তু প্রাথমিকে ইংরাজি তুলে দেওয়ার চরম বিরোধী শ্রী রায়। অশোক মিত্র অবশ্য মনে করেন তাঁর স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে সরকারের প্রয়োগজনিত দুর্বলতায়। প্রাথমিকে ইংরাজি না পড়া একটি প্রজন্মকে পিছিয়ে দিয়েছে একথা যদি সত্য হয়; এটাও প্রমাণিত যে বর্তমানে ঘরে ঘরে মাতৃভাষাবিমুখ তথ্যজ্ঞানী একটি প্রজন্ম ক্রমশ বেড়ে উঠছে। প্রবীণ শিক্ষকদের কাছে জানা যায় প্রাথমিকে ইংরাজি চালু হওয়ার দেড় দশক পরেও পঞ্চম শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীরা ইংরাজিতে নিজের নাম, বাবামায়ের নামও সঠিক ভাবে লিখতে পারছে না। নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের স্কুলেই এই সমস্যা প্রকট। এর সমাধান কোথায়? মাতৃভাষার প্রসার ও গরীবগুর্বোদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শ্রী মিত্র। কিন্তু চাষাভূষোরা কি আদৌ তাঁর লেখা পড়বে - প্রশ্ন করেছেন শ্রী রায়। তবে এ প্রশ্ন তো সকল বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য! বরং অশোক মিত্র দীর্ঘদিন বাংলা দৈনিক পত্রিকায় লিখে গেছেন...।

সুমন ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে অশোক মিত্রের লেখালেখি থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে এনে দেখিয়েছেন কীভাবে বর্তমান যুগের ভোটের রাজনীতি, মধ্যবিত্ত মননের অবক্ষয়,অর্থনীতির বেসামাল অবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করেছেন - 'এত বেশী টাকা চিনতে শেখানো হচ্ছে... যাদের টাকা নেই তাদের কথা কবে থেকে যেন আমরা ভুলে যেতে শুরু করবো।' (শ্যামসুদ্দিন স্যার - নগেনবাবুরাঃ প্রবন্ধ সংগ্রহ, ১৯৯২); এ কথা আজ ঘোর বাস্তব। অশোক মিত্র কী করতে পারেন নি, তা গলা উঁচিয়ে বলি আমরা, কিন্তু তিনি কী বলেছেন বা করেছেন তা ভাবতেও চাইনা - শ্রী ভট্টাচার্যের অভিমত।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য তাঁর 'পিতৃদ্রোহের অসম্পূর্ণ প্রকল্প' নামক প্রবন্ধে বলেছেন আধুনিক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর 'ঘরেও নহে পারেও নহে' অবস্থান বিষয়ে অশোক মিত্র ভালোরকম অবগত ছিলেন। ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ভাবাদর্শকে বর্জন করতে হলে ফিরতে হবে সমর সেন,সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপলব্ধির উৎসে। মার্কসবাদী প্রজ্ঞার সাহায্যে বুদ্ধদেব বসু,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যসুষমার সংকট থেকে নিজেকে মুক্ত করেন তিনি। শ্রী ভট্টাচার্য খুব চমৎকারভাবে বলেছেন - অশোক মিত্রের দ্বন্দ্ব ছিল ধ্রুপদী পিছুটান আর ঐতিহাসিক সমাজবাস্তবতাকে ঘিরে।

শুভময় মন্ডলের 'রণসাবুদ' লেখাটিতে তীব্র ভাষায় লেখক বলেছেন অশোক মিত্রের গদ্য যেন রাগে মুখ দিয়ে ফেনা তুলছে, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঘাতককে টেনে ছিঁড়ে বের করে আনতে চাইছেন তিনি। শ্রী মন্ডল পিকাসোর আঁকা 'গের্নিকা', সমর সেনের কবিতা, মৃণাল সেনের 'কলকাতা '৭১...' সবকিছুর সাথে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন এক নিঃসঙ্গ আত্মার সংগ্রামকে।

মধুসূদন দত্ত স্মরণ করিয়ে দেন সত্তর দশকের গোড়ায় বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক আই এস রায় অশোক মিত্রকে পরামর্শ দেন তাঁর আচরণে 'juvenile frivolity'র বদলে 'elderly sobriety' আনতে, নাহলে রেটিনা বিশ্লিষ্ট হওয়ার ভয় আছে। কিন্তু তাঁর ভিতরের কিশোরকেকে দমিয়ে রাখবে!

কালীকৃষ্ণ গুহ অশোক মিত্রকে পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল বলে উল্লেখ করেছেন, যিনি একই সঙ্গে আবেগপ্রবণ ও আদর্শবোধে কঠোর। 'অচেনাকে চিনে চিনে' গ্রন্থে শ্রী মিত্র জীবনানন্দকে চিনে নেওয়ার অধিকারবোধ ও তজ্জনিত গর্বের কধা বলেছেন। অশোক মিত্রের অনুরোধে 'আরেক রকম' পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীতে যুক্ত হন লেখক। কিন্তু দুবছর বাদে সেখান থেকে অব্যাহতি চান লেখক কারণ মূলতঃ মার্কসবাদে অনীহা এবং কমিউনিস্ট দেশগুলির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। অশোক মিত্র তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং ক্ষীণদৃষ্টিতে, কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষরে তাঁকে পত্র লেখেন - 'মার্কস স্বয়ং স্বৈরাচারী অত্যাচারের চরম শত্রু ছিলেন - যে মহাপুরুষ এমন সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমি তাঁর অনুষঙ্গী মার্কসবাদী গর্ব নিয়েই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই।' শ্রী গুহ এই অনবদ্য পত্রটি প্রকাশ করে ঋণী করেছেন পাঠকদের।

'স্থূলে ভুল নেই' প্রিয় কবি সমর সেনকে নিয়ে অশোক মিত্রের একটি প্রবন্ধের নামে তাঁর লেখার নামকরণ করেন অনিল আচার্য। এই নিবন্ধে শ্রী আচার্য পরিষ্কারভাবে জানান সমসাময়িক কবিদের নিয়ে অশোক মিত্রের অসন্তোষের কথা। ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থাকার ফলে অনেকের বিরাগভাজন হন, বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় থাকার দরুণ নকশালদের সুনজরে ছিলেন না। মতবিরোধের ফলে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর জোরের জায়গাটি ছিল তাঁর লেখা। ইংরাজি Now ও Frontier পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও অনুষ্টুপ ও এক্ষণ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন। মার্কসবাদ নিয়ে যে কোন শৌখিন চিন্তাভাবনাকে ঘৃণা করতেন। সকলের জন্য বাঁচাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। অনিলবাবু মনে করেন শ্রী মিত্রের স্থূলে কোনো ভুল ছিল না।

এর পরের পর্ব 'জীবন ভরি মাধুরী' অশোক মিত্রের সংগীতভাবনা, সম্পাদনা ও তাঁর একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে সাজানো এই পর্ব। 'বিতর্কিকা' পত্রিকার পক্ষ থেকে অশোক মিত্রের সংগীতভাবনা নিয়ে যে দীর্ঘ আলাপচারিতা চলে প্রণব বিশ্বাসের সঙ্গে তারই অনুলেখন 'আমার যে গান'। শ্রী মিত্রের গীতমঞ্জুষার বিশাল পরিধি আমাদের চমৎকৃত করে। মায়ের কণ্ঠে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গান, লোকগীতি, স্বদেশী গান শুনে বড়ো হয়েছেন শ্রী মিত্র। গান চারিয়ে গেছে তাঁর শিরা উপশিরায়। একটু বড়ো হয়ে শচীন দেববর্মণের গানের অসম্ভব ভক্ত হয়ে পড়েন, কথা অজয় ভট্টাচার্য, সুর হিমাংশু দত্ত। সুরকার হিমাংশু দত্তের প্রতিটি গানই যেন তাঁর মর্মস্থ। আর দুই প্রিয় গায়ক ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে ও দিলীপ কুমার রায়। মনে করতেন বাঙালির চরম দুর্ভাগ্য যে নজরুলের মতো সৃষ্টিশীল মানুষ অকালে নীরব হয়ে গেলেন। ডঃ অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর নজরুল গীতি সেভাবে বিকশিত হতেও পারলো না। সুচিত্রা মিত্রের উদাত্ত কণ্ঠ ও জর্জ বিশ্বাসের স্বর্গীয় স্টাইলের উচ্চ প্রশংসা করেছেন শ্রী মিত্র। 'কলকাতার গাইয়েরা ঠোঁট দিয়ে গেয়ে থাকেন, জর্জ, সুচিত্রা এঁরা গলা দিয়ে গাইতেন।' রবীন্দ্রনাথের গানকে এঁরা দুজনে গণসংগীতে রূপান্তরিত করেন - এই মত পোষণ করেন তিনি। পঞ্চাশ দশকের পরবর্তীতে বাংলা আধুনিক গান তাঁর মন জয় করতে পারেনি। এক অনবদ্য শৈলীতে গানের অশোক মিত্রকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন প্রণব বিশ্বাস।

১৯৯৩ সালে '১৪০০ সাল' পত্রিকার তরফ থেকে অশোক মিত্রের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন সৌরীন ভট্টাচার্য, তাঁকে সহায়তা করেন দীপংকর সিংহ, তীর্থংকর চট্টোপাধ্যায় এবং কিশোর সেনগুপ্ত। সৌরীনবাবুর প্রথম প্রশ্ন ছিল তাঁর শিক্ষাজীবন নিয়ে। ৬৫ বছর বয়সে পৌঁছেও শ্রী মিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাঘা বাঘা শিক্ষকদের প্রগাঢ় পাঠদান ও ছোট ছোট বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। বহু কৃতী মানুষদের কথা জানতে পারি এই স্মৃতিচারণের মাধ্যমে। দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স, লক্ষ্ণৌ ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন অধ্যাপক ও ছাত্রবন্ধুদের নানান কান্ডকারখানার কথা শুনিয়েছেন। লক্ষ্ণৌতে থাকাকালীন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে আলাপচারিতার স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে - 'He was a stylist... ওনার থেকে বড় কথুনি আর পাইনি।'’ হল্যান্ডে গিয়ে জ্যান টিনবার্গেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণার কাজ করেন। সোস্যাল ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাসী টিনবার্গেন ছিলেন ছাত্রদরদী সাদাসিধে মানুষ। হল্যান্ডে শ্রমিকদের উপার্জন না কমিয়ে কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় সেই ব্যাপারে তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন। অশোক মিত্র সখেদে মন্তব্য করেন আমাদের দেশে এই মডেল কার্যকরী করা সম্ভব নয়। রাজনীতি নিয়ে প্রশ্নগুলি করেন মূলতঃ তীর্থংকরবাবু। শ্রী মিত্র জানান ৭৭/৭৮ সালে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বামপন্থী দলের যে আন্দোলন দেখেন, এখন তা লুপ্তপ্রায়। এখনকার জমায়েত অনেক নির্লিপ্ত, আত্মসন্তুষ্টির ভাব আছে তাতে। ১৯৯৩ সালে বালক ব্রহ্মচারীর মৃতদেহ নিয়ে যে প্রহসন হয় কুড়ি বছর আগে হলে তা হতো না বলে আক্ষেপ করেছেন। বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে সৌরীনবাবুর প্রশ্নের জবাবে বলেন - তাঁর ভক্ত হওয়ার সুবাদে তিনি একজন বৌদ্ধ, কিন্তু মার্কিনি কৃষ্টির প্রতি বুদ্ধদেব বসুর অনুরাগ তাঁকে ক্রমশ কবিতাভবন থেকে দূরে ঠেলে দেয়। হালফিলের সাহিত্য নিয়েও খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না। কবিদের একজনকে আর একজনের থেকে আলাদা করে চেনা যায়না - এই অভিমত তিনি পোষণ করেন।

অশোক মিত্রের জীবনের শেষ সন্ধ্যায়, ৩০শে এপ্রিল ২০১৮ পার্ক ক্লিনিকে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি সখেদে বলেন - যে অশোক মিত্র সব সময়ই বলতেন, 'কেন আবার কষ্ট করে এলেন', সেই লোক সেদিন চোখ খুলে তাকাতেও পারেননি। 'সম্পাদনার দপ্তরঃ অশোক মিত্র' লেখাটি এই হৃদয়দ্রাবী ছবি এঁকেই শুরু করেন শ্রী ঘোষ। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে যখন গুরুদেবের আঁকা ছবি প্রদর্শনের আয়োজন করেন শঙ্খবাবু, তখন তাঁকে পত্র লিখে অভিনন্দন জানান শ্রী মিত্র। এই পত্রটি প্রকাশ করেছেন শ্রী ঘোষ। 'আরেক রকম' পত্রিকার সম্পাদনার অনুরোধ নিয়ে শঙ্খবাবুর তিনতলার ফ্ল্যাটে হেঁটে উঠে যান ৮৫ বছরের মানুষটি। কেমন লেখা চান পত্রিকায় প্রশ্ন করলে শ্রী মিত্র উত্তরে বলেন, 'উজ্জ্বল আর উদ্ধত '। তখন শ্রী ঘোষ বলেন 'তাহলে সব লেখা তো আপনাকেই লিখতে হয়'। পত্রিকার খুঁটিনাটি বিষয়ে সর্বদা মনোযোগী ছিলেন, কিন্তু ভঙ্গীটা এমন যেন কিছুই করছেন না বলে মন্তব্য করেন শঙ্খবাবু। পত্রিকার ব্যাপারে তাঁকে লেখা নটি চিঠি প্রকাশ করেছেন শ্রী ঘোষ। একজন আদ্যন্ত কবিতাপ্রেমিক মানুষ বলে শ্রী মিত্রকে অভিহিত করেছেন শঙ্খ ঘোষ এবং উল্লেখ করেছেন অশোক মিত্রের এই কবিতাপ্রাণতাই তাঁর সমাজবোধ ও জীবনযাপনের ভিত।

এর পরের পর্বটি অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত অশোক মিত্রের ৭টি লেখা নিয়ে গ্রথিত। প্রথম লেখা 'যুদ্ধ, বিশ্বায়ন এবং বিকল্প বাম বৈদেশিক নীতি' আসলে ২০০৩ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাৎকার। বিশ্বজিৎ রায় ও ইমানুল হক এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন। প্রথম প্রশ্ন - বিশ্বায়নবিরোধী মানুষই কি আসলে যুদ্ধবিরোধী? - বিশ্বায়নের ফলে সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলির ক্ষয় হচ্ছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি জাঁকিয়ে বসছে। এখনও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মূল শক্তিটি কিন্তু বিশ্বায়নবিরোধী। দ্বিতীয় প্রশ্ন - সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপস্থিতি কি মার্কিন আগ্রাসনকে বাড়তে দিয়েছে? স্ট্যালিনীয় চিন্তার প্রসার ঘটলে হয়তো রাশিয়ার এই পরিণতি ঘটতো না। - এখানে অশোক মিত্র অবশ্য খুবই রক্ষণশীল কমিউনিস্টদের মতো কথা বললেন; যাই হোক, এর পরের প্রশ্ন - বিশ্বায়নের পটভূমিকায় বামপন্থীদের কী করণীয়? বিকল্প বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে কি কোন রকম ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন? - দেশের দুই বড়ো রাজনৈতিক শক্তি বিজেপি ও কংগ্রেস উভয় দলই বিশ্বায়নকে স্বাগত জানাচ্ছে। এই দুটি দলই দেশের থেকেও বিদেশী প্রভুদের কথা বেশী ভাবছে। যে দুটি বামপন্থী সরকার টিকে আছে তাদের কোণঠাসা অবস্থা। আমেরিকায় যুদ্ধ ঘোষণার আগে সেনেটের সমর্থন প্রয়োজন। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় যে কোনো বৈদেশিক চুক্তির জন্য প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই অস্বীকার করছে। হায় ! তবু তো অশোক মিত্র সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীরের ইউনিয়ন টেরিটরির অন্তর্ভুক্তিকরণ দেখে যাননি!

পরের লেখা 'আদর্শের বিকল্প নেই' ১৯৮৯ সালে 'চীনের ছাত্র আন্দোলন' শীর্ষক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত। যদিও অশোক মিত্র মনে করতেন তিয়েনানমেন স্কোয়ারের হত্যালীলাকে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলি কিছুটা অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছে, তিনি স্বীকার করেন এই ছাত্রবিস্ফোরণের জন্য দায়ী নেতৃত্বের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব,সাধারণের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ,সম্পন্ন চাষীদের বাড়তি উৎপাদনের সুযোগ, ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, আমেরিকা ও জাপানের সাথে প্রায় পাঁচহাজার চুক্তি সম্পাদন প্রভৃতি জ্বলন্ত সমস্যা। আদর্শ মুলতুবি রেখে,স্রেফ আর্থিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে একটি গোঁজামিলের সমাজতন্ত্র চালু করা হয়েছিল। ধনতান্ত্রিক দেশ থেকে মূলধন তথা প্রযুক্তি ঢালাও ভাবে আমদানি করব অথচ ধরে নেব সমাজতন্ত্র অক্ষয় থাকবে - এ তো সোনার পাথরবাটি।

এর পরের প্রবন্ধ 'জীবনানন্দ প্রসঙ্গ'। এখানে শ্রী মিত্র প্রথমেই স্বীকার করেন বুদ্ধদেব বসুর তীক্ষ্ণ বিচারক্ষমতা এবং 'কবিতা' পত্রিকা না থাকলে জীবনানন্দ বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা হয়তো আরো দেরী করে পাঠকের সামনে আসতো। জীবনানন্দের কবিতাকে 'কুহকিনী' আখ্যা দিয়েছেন লেখক,যা কাছে গেলে মৃত্যুর মতো,নিবিড়তম প্রেমের মতো আলিঙ্গন করে। কিন্তু বর্তমানে জীবনানন্দীয় ঘোর বাংলা কবিতাকে একজায়গায় আটকে রেখেছে। জীবনানন্দের কবিতায় যে শুদ্ধ প্রেম, জ্ঞান, সর্বোপরি সামাজিক পটভূমি আছে তা প্রায় সকলেরই অনায়ত্ত। অথচ তাঁকে, তাঁর ভাষাকে লুণ্ঠন করে, কথা সাজিয়ে বাংলা কবিতাকে আবিল করে তোলেন একদল কবি। ফলত, হারিয়ে যায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ প্রমুখ কবিদের কণ্ঠস্বর।

'সেই সব শেয়ালেরা' প্রবন্ধটি ১৯৮৮ সালে লেখা হয়, পুনর্মুদ্রিত হয় ১৯৯৮ সালে 'জীবনানন্দ বিশেষ সংখ্যা'য়। অশোক মিত্র কবিতা পাঠে কতটা মনোযোগী ছিলেন তা এই প্রবন্ধে উদ্ঘাটিত। আট পঙক্তির এই কবিতাটি প্রায়ই আবৃত্তি করতেন তিনি। কবিতাটি তাঁকে সম্মোহিত করে রাখতো। বরফের ওপরে শিকারোন্মুখ শেয়ালেরাও যেন বিস্ময়ে হতগতি হয়ে পড়ে। তাদের হৃদয়ের এই বিপন্ন বিস্ময় যদি মানুষের আত্মায় প্রবেশ করানো যেত? - যেখানে 'নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে'। শ্রী মিত্র ভেবেছিলেন জীবনানন্দকে একদিন এই কবিতার রহস্য নিয়ে কথা বলাবেন। কিন্তু তিনি জানতেন, স্বভাবনীরব কবি তাতে নীরবতর হয়ে যেতেন।

'পূর্বাশার কথা' প্রবন্ধটি ১৯৯৮ সালের শারদীয়া সংখ্যায় 'পূর্বাশা ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য' শীর্ষক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত। সঞ্জয় বাবু ও তাঁর বন্ধু সত্যপ্রসন্ন দত্ত দুজনে মিলে পূর্বাশা পত্রিকার দেখভাল করতেন। পাশের ফ্ল্যাটে চতুরঙ্গ পত্রিকার অফিস। অশোক মিয্র স্মৃতিচারণ করেছেন - প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজারঞ্জন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সকলে মিলে আলোচনা করছেন অস্তিত্ববাদ নিয়ে - কি চমৎকার সাহিত্যিক পরিমণ্ডল, যা আজ স্বপ্ন বলে মনে হয়! সঞ্জয় ভট্টাচার্য অশোক মিত্রের কাছে বাংলা কবিতা নিয়ে একটি লেখা চেয়েছিলেন। তবে সেই লেখা তিনি ফেরত দেন কারণ শ্রী মিত্রের বামপন্থী মনোভাবে তাঁর ছুৎমার্গ। কিন্তু এই গোঁড়ামিকে সম্মান জানিয়েছেন লেখক, কারণ তিনি নিজেই কখনো নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননা।

'রক্তের দাগ ঢাকবে আর্তনাদে' - ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ। মহাশ্বেতা দেবীর 'হাজার চুরাশির মা' তাঁর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন তিনি। হাজার হাজার যুবক যুবতীর লড়াই ও আত্মত্যাগের এই আখ্যানকে প্রণাম জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু নামভূমিকায় যে অভিনেত্রীকে দেখা যায় বাস্তবে অত্যাচারী শাসকদের সাথে তাঁর গভীর সখ্য শ্রী মিত্রকে পীড়িত করে। তিনি অভিনেত্রীর নামোল্লেখ করেননি, তাই আমিও করছি না। এই লেখাটির ছলে বোধকরি অশোক মিত্র মহাশ্বেতা দেবীর কাছে তাঁর অভিযোগ পেশ করেন।

'আধুনিক বাংলা কবিতা' - ২০০০ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধ বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'আধুনিক বাংলা কবিতা' নামক কবিতা সংকলন নিয়ে। এই বইটি আমরা হাতে পেয়েছি। কিন্তু ১৯৪০ সালে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও আবু সঈদ আয়ুব এর যুগ্ম সম্পাদনায় এই গ্রন্থের প্রথম প্রকাশ ঘটে তা অশোক মিত্রের কাছেই জানতে পারলাম। সম্পাদকদ্বয় উঁচুমানের দুটি মুখবন্ধও রচনা করেন। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে বুদ্ধদেব বসু তাঁদের নামোল্লেখও করেন নি। সমাজচেতনাশীল কিছু কবিদেরও ছাঁটাই করা হয়। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া কোল্ড ওয়ারের ছায়াই কি তবে ঘনীভূত হয়েছে কবিতা সংকলনেও! বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও প্রথম সংষ্করণের ভূমিকাদুটিকে মহার্ঘ বলে উল্লেখ করেছেন শ্রী মিত্র। এই প্রবন্ধের শেষ পঙক্তিতে শ্রী মিত্র বলেছেন, 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা নয়, বিসংবাদ জাগাতে ভালবাসে?'

এবার আমরা চলে আসব গ্রন্থের একেবারে শেষ অধ্যায়ে - 'অশোক মিত্রের কয়েকটি লেখা'। প্রথম নিবন্ধ 'আমার মৃত্যুর পর'। তাঁর স্মৃতিকথা 'আপিলা চাপিলা'র শেষ বাক্য এই নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন -‘এই অকিঞ্চৎকর জীবনে দুটি আলাদা চরিতার্থবোধঃ এক রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমার জন্ম; দুই আমার চেতনা জুড়ে মার্কসীয় প্রজ্ঞার প্লাবিত বিভাস’। এই নিয়ে তাঁর মনে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের স্থান নেই। মার্কস তাঁকে সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে দীক্ষা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের চূড়াবিন্দুতে। তাঁর মৃত্যুর পর যদি কোনো স্মরণসভা হয় তাহলে সেখানে যেন রবীন্দ্রগানই গাওয়া হয়। মোট ষাটটি গানের তালিকা তিনি পেশ করেন ধাপে ধাপে। জগৎসভায় এই তাঁর শেষ চাওয়া!

২০০২ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে লেখা অশোক মিত্রের প্রবন্ধ 'জনশূন্যতার কানে রুদ্ধকণ্ঠে'। এই - ব্যতিক্রমী কবির জীবনের অজ্ঞাত দিক তুলে ধরেছেন শ্রী মিত্র। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দ্বিতীয়া স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীতের কিংবদন্তী গায়িকা, কিন্তু বাড়ীতে তিনি ইংরাজীতেই কথা বলতেন। ফলতঃ কবি হয়তো তাঁকে নিজের কবিতা পড়ে শোনাতেই পারতেন না। নাস্তিকের নিঃসঙ্গতা বড়ো কঠিন বিষয়। বাংলাভাষার এতবড়ো কবির দিনযাপনে মাতৃভাষার ব্যবহার প্রায় ছিলই না।অশোক মিত্র সখেদে লেখেন - সমর সেন তাঁর পুঞ্জিত অবিশ্বাস সত্ত্বেও ক্বচিৎ মুহূর্তে ভাবতে বাধ্য হন 'একদিন মাটির পৃথিবীতে আকাশগঙ্গা বইবে', বিষ্ণু দে - উদাত্ত নির্দ্বিধায় বলেন 'জল দাও আমার শিকড়ে'। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথের কোনো প্রস্থানভূমি নেই, 'তিনি তাঁর নেতিতে নির্বাসিত'।

'আমাদের সম্বল আমাদের অহংকার' প্রবন্ধে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসংগীতের একটি মরমী আলোচনা করেছেন শ্রী মিত্র। নানা জটিলতা, নানা সমস্যার মাঝেও বাংলা সাহিত্য,নাটক, চলচ্চিত্র বাঙালি সমাজকে এগিয়ে দিয়েছে। আর সেই তরঙ্গের শীর্ষে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান। জর্জ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রগান আমাদের পাওয়া না পাওয়ার সকল বন্ধনকে ঘুচিয়ে দিয়েছে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কণ্ঠের রূপমাধুরী দিয়ে বাঙালি জীবনে একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন। শিল্পীর মৃত্যুর পর অশোক মিত্রের এই প্রবন্ধ দেশ পত্রিকায় ১৫ই এপ্রিল ২০০০সালে প্রকাশিত হয়।

চরণ গুপ্ত ছদ্মনামে Frontier পত্রিকায় ১৯৬৯ সালে শ্রী মিত্রের Calcutta Diary লেখাটি প্রকাশ পায়। অনবদ্য ইংরাজীতে ভিয়েতনামের জয়গান করেছেন লেখক, যে ভিয়েতনাম আজও মাথা উঁচু করে আছে কমিউনিজমের কড়াকড়ি থেকে উদার অগ্রসারমানতায়। The Telegraph পত্রিকায় ২০০৫ সালে A different ballgame নামক নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ইংরাজী ভাষাশৈলীর চরম অভিব্যক্তি ঘটেছে এই ছোট্ট লেখায়। 'তুমি আর নেই সে তুমি' শচীন দেববর্মণের এই গানটির অনুষঙ্গে লেখেন - 'Those annals are as dead as a dodo though'; পরম ভালবাসায় ক্রিকেট নিয়ে লেখেন 'batting, bowling, fielding each has undergone a metamorphosis.' শেষে লেখেন 'cricket is no longer the cricket as it once was'.

'The Telegraph' পত্রিকায় ১৯৮২ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ 'A little unknown barely recognised aunt'। কণক বিশ্বাসের জোয়ারি করা কণ্ঠের গান কজন মনে রেখেছে? দায়ী করেছেন সত্যজিৎ রায়ের জনপ্রিয়তাকে, কারণ কণক বিশ্বাস তাঁর মাসি! শ্রী মিত্রের এই এক কৌতুকাবহ একদেশদর্শিতা!

অবশেষে রয়েছে শ্রী দীপক নায়ার কৃত অশোক মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী - 'Ashok Mitra: A biographical sketch'। শ্রী মিত্রের জীবদ্দশায় এটি রচিত, এবং অর্থনীতিবিদ হিসেবে তাঁকে নিয়ে রচিত একটি প্রবন্ধসংকলন থেকে এটি গৃহীত। এরপর আসে ইংরাজীভাষায় রচিত তাঁর গ্রন্থের একটি তালিকা। এবং সবশেষে শ্রী মিত্র রচিত বাংলা বইয়ের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দিয়ে গ্রন্থের অবসান।

বৃষ্টিপাত নিয়ে খনার বচন আছে 'দূর সভা নিকট জল/নিকট সভা দূর জল'। দূরবর্তী শাসকের কুশাসন নিয়ে আমরা প্রচণ্ড সরব হলেও নিকটবর্তী অপশাসককে মৃদু ঠোনা মেরে ছেড়ে দিই। শ্রী মিত্র এইধাতুতে গড়া মানুষই ছিলেন না। তাই কোনো জামাতেই তাঁকে আঁটে না। নিজের অর্থে বিদেশ যাবেন বলে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। আবার ফিরে এসে মন্ত্রীত্বে শপথ গ্রহণ করেন। নিজের দলে তাঁর কদর ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবেও মন‌ মত কাজ করতে পারেননি। কিন্তু সারা জীবন ভালো কিছু করার দুর্মর জেদ তাঁকে পেড়ে ফেলতে পারেনি। 'প্রশ্ন ও সম্ভাব্য উত্তরাবলির অন্বেষণ ও বিশ্লেষণের অন্য নামই তো আন্দোলন, আন্দোলন ছাড়া তো বিকাশের পথ নেই।' (প্রশ্ন উত্তর উত্তরহীনতা)। আশ্চর্যের কথা আ