আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

অযোধ্যায় মন্দির-মসজিদ বিতর্কঃ যে ইতিহাসগুলি গুরুত্বপূর্ণ

আকাশ ভট্টাচার্য


আধুনিকযুগের অযোধ্যা-কাণ্ড

মন্দির ওয়াহি বনেগা। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের পর এক বছর কেটে গিয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ই আগস্ট ২০২০ ভূমি পূজন হয়েছে অযোধ্যায়। মন্দির তৈরির কাজ জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে। অন্যদিকে দাবি উঠেছে যে রামজন্মভূমির পর কৃষ্ণজন্মভূমিতেও তৈরি করতে হবে হিন্দু মন্দির। এই ধর্মস্থান পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ঠিক কতদূর গড়াবে, আর কত রক্ত ঝরাবে, তা ভবিষ্যৎ-ই জানে। তবে ইতিহাসবিদ হিসেবে গত এক বছরে আমার চোখ বারবার চলে গিয়েছে পিছনের দিকে। কীভাবে আমরা পৌঁছলাম ধর্মীয় মেরুকরণের এরকম এক ভয়াবহ মুহূর্তে?

রাম জন্মভূমি বা কৃষ্ণ জন্মভূমির দাবি ইতিহাসভিত্তিক। কিন্তু এটা শুধুমাত্র তথ্যের ঠিক/ভুলের ব্যাপার নয়। সেই ১৯৮০-র রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সময় থেকেই সংঘ পরিবারের "নরমপন্থীরা" দাবি করে এসেছে যে বাবরি মসজিদের ঠিক তলায় প্রাচীন রাম মন্দিরের ভগ্নাবশেষ থাকা বা না থাকাটা বড় কথা নয় - আসল কথা হলো বিশ্বাস। "হিন্দুরা" মনে করে যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল ঠিক সেখানেই শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম। এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করা হয়েছে কিছু ভিত্তিহীন ঐতিহাসিক কাহিনির মাধ্যমে। যেমন ভারতবর্ষে আসলে হিন্দুদের বাসস্থান, মুসলমান রাজারা হিন্দুদের হাজার হাজার বছর ধরে দমন করে চলে এবং তারা ব্রিটিশদের মতোই ঔপনিবেশিক শক্তি। গবেষণায় এ কথা প্রমাণিত যে আর্যরা আসে মধ্যে এশিয়া থেকে, ভারতবর্ষে দিল্লি সালতানাত স্থাপন হওয়ার বহু আগে থেকে মুসলমানরা এ দেশে বসবাস করেছে, মুসলমান রাজারা আদৌ হিন্দু ধর্মকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেনি, এবং মুসলমান রাজারা ভারতবর্ষকে নিজেদের দেশ বলেই মনে করতো যা ব্রিটিশরা কখনো করেনি। ভ্রান্ত কাহিনি ও বিকৃত তথ্যের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়েছে এক কৃত্রিম অনুভূতির, যা বহু হিন্দুকে ভাবতে শিখিয়েছে যে তারা নিজেদের দেশে পর হয়ে আছে।

তবে অযোধ্যার বুকে হিন্দুত্ববাদী রাম মন্দিরের গঠনকে বুঝতে হলে আমাদের তথ্যের যথার্থতা এবং হিন্দুত্ববাদ-উৎপাদিত ভ্রান্ত কাহিনির প্রশ্ন থেকে কিছুটা সরে যেতে হবে। আরো গভীরে নিয়ে যেতে হবে ইতিহাসচেতনাকে। বুঝতে হবে কেন এবং কীভাবে রাম জন্মভূমি সংক্রান্ত একটি সামান্য স্থানীয় বিশ্বাস, ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির প্রচার করা কিছু ভিত্তিহীন ঐতিহাসিক দাবি, মসজিদ ধ্বংসের মত জঘন্য কাজকে সম্ভবপর করে তুললো। রামায়ণজুগে রাম মন্দিরের ইতিহাস এবং মধ্যযুগে বাবরি মসজিদ গঠনের ইতিহাস থেকে সাময়িকভাবে সরে এসে আধুনিক যুগের গণতন্ত্র, আইন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আনাচে কানাচে চলতে থাকা ধর্মের খেলাকে অনুধাবন করতে হবে। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে আটকানোর ব্যাপারে উদারবাদী গণতন্ত্র ও আইনের সাফল্য ও ব্যর্থতার সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। বাবরি মসজিদ পুনর্গঠন হোক বা না হোক, কৃষ্ণ জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে নতুন উত্তেজনা তৈরি হোক বা না হোক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জোয়ার আটকাতে হলে অযোধ্যা-কাণ্ডের এই আধুনিক ইতিহাসটি জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

প্রথম পদক্ষেপ

অযোধ্যাকাণ্ডের শুরুয়াত আজ থেকে দেড়শো বছর আগে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখনো আওয়াধে ওয়াজিদ আলী শাহ-র রাজত্ব। দেশে ইংরেজদের প্রবেশ ও খ্রীষ্টান পাদ্রীদের কার্যকলাপ বৃদ্ধির ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজের নেতৃবৃন্দ ক্রমে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এই তথাকথিত ধর্মসঙ্কটের জন্য সেই সময়কার ধর্মসংস্কারকরা হিন্দু ধর্মের দুটি বৈশিষ্টকে দায়ি করে বসলেন। হিন্দুদের খ্রীষ্টানদের মতো সুসংগঠিত গীর্জা নেই, এবং কোনো একটি বিশেষ ঈশ্বর বা কোনো একটি বিশেষ ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস নেই। সংস্কারকরা প্রশ্ন তুললেনঃ এগুলি ছাড়া কি সংগঠিত হওয়া সম্ভব? আর সংগঠিত না হলে ধর্মসঙ্কটের বিরুদ্ধে মোকাবিলা কীভাবে হবে? এই ধরনের কথাবার্তা শুরু হলো বাংলায়, মহারাষ্ট্রে ও উত্তর ভারতে।

ধর্ম সংস্কারের এই ধারণাটি কিন্তু একটু অদ্ভুত। যাদের আমরা আজ হিন্দু বলে জানি, তারা তো নানা মতে ও নানা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এক বিশেষ ঈশ্বর বা বিশেষ গ্রন্থের মাধ্যমে কি এক ধর্মকে অন্য ধর্মের রূপ দেওয়া যায়, নাকি দেওয়া উচিৎ? সব থেকে বড়ো কথা, সে সময়ে কি এই ধরনের পরিবর্তন সত্যিই প্রয়োজনীয় ছিল? পাদ্রীরা কিছু জায়গায় ধর্মপ্রচারে সক্ষম হলেও, তাদের সাফল্যের হার খুব বেশি ছিল না। কিছু হিন্দু উচ্চবর্ণের সংস্কারক, প্রধানত ভয়ে ও স্বার্থরক্ষার দায়ে, নিজেদের হাতে তুলে নিলেন বিশেষ গ্রন্থ এবং বিশেষ ঈশ্বর কেন্দ্রিক হিন্দু ধৰ্ম গড়ে তোলার দায়িত্ত্ব। ভারতজুড়ে যখন এই রকম আবহ তৈরি হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে অযোধ্যাতে কিছু ঘটনা ঘটে। প্রায় হঠাৎ করেই স্থানীয় মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মায় যে যেই জায়গায় অবস্থিত বাবরি মসজিদ, যা কিনা সম্রাট বাবর ১৬শ' শতাব্দীতে তৈরি করেছিলেন, তার ঠিক উলটোদিকের জায়গাটিই নাকি শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান।

হঠাৎ কেন ছড়িয়ে পড়লো এমন ধারণা? হিন্দু ধর্মের যেমন নানা মত, তেমন রামায়ণেরও কিন্তু নানা সংস্করণ রয়েছে। সংস্করণ অনুযায়ী ঘটনাক্রম পাল্টে যায়, যার বর্ণনা আমরা পাই পাউলা রিচম্যান-এর বই "অনেক রামায়ণ"-এ। রিচম্যান গভীর গবেষণার ভিত্তিতে লিখেছেন যে কিছু সংস্করণে বলা আছে রামের সাথে যুক্ত অযোধ্যা ইহলোকের কোনো জায়গা নয়। অযোধ্যা স্বর্গলোকের এক মায়ানগরী। আবার অন্যান্য সংস্করণ ইহলোকেই অযোধ্যার সঠিক স্থান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে। এগুলির মধ্যে তুলসীদাসের রামায়ণ, যা লেখা হয় ১৬শ' শতাব্দীতে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তুলসীদাসের রামায়ণ আধুনিকযুগের রামভক্তির ভিত্তিপ্রস্তর, এবং এতে লেখা আছে উত্তর ভারতের অযোধ্যাতেই শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম। এখানে বলে রাখা দরকার রাম জন্মস্থান সংক্রান্ত এই ধারণাগুলি কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক নয়। এগুলি হলো বিশ্বাস। তুলসীদাসও বিশ্বাসের ভিত্তিতেই আওয়াধের অযোধ্যাকে রামের অযোধ্যা ঘোষণা করেন। আঠারোশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্রমে উত্তর ভারতে তুলসীদাসী রামায়ণ জনপ্রিয় হয় ও তার হাত ধরেই অযোধ্যায় ছড়িয়ে পড়ে রাম জন্মভূমি সংক্রান্ত এই বিশেষ ধারণা। উল্লেখযোগ্য, বাবরি মসজিদ নির্মাণের কয়েক দশকের মধ্যে লেখা হয়ে থাকলেও, এই পুঁথিতে কিন্তু কোনো প্রাচীন রাম মন্দির ধ্বংসের কথা বলা নেই। মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ গড়া হয়েছিল, এই বক্তব্য চাড়া দিয়ে ওঠে অনেক পরে হিন্দুত্ববাদীদের উসকানিতে।

অযোধ্যায় এই বিশ্বাস জনপ্রিয় হওয়ার পর নির্মোহী আখড়া নামক ওখানকার এক সম্প্রদায় তথাকথিত রাম জন্মস্থানকে কেন্দ্র করে ছোটোখাটো এক স্থানীয় আন্দোলন গড়ে তোলে। এর পিছনে স্থানীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে খানিক ঝুট ঝামেলা পাকানোর তাগিদ ছিল বলেই মনে হয়। আর ছিল হিন্দুদের সংগঠিত করার মনোবৃত্তি। ঐ সময়ে হিন্দু সংগঠকদের কিছু অংশ তুলসীদাসের রামকেই হিন্দু ধর্মের জনক হিসেবে গ্রহণ করার কথা ভাবছিলেন। এহেন পরিস্থিতে বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির তৈরির দাবি নিয়ে ১৮৮৫ সালে নির্মোহী আখড়ার এক সাধু, মহন্ত রঘুবর দাস, ফায়জাবাদ জেলা আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। উনি দাবি করেন শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থলে হিন্দুদের প্রার্থনা করতে দিতে হবে। আদালত দাবি মানেনি। উলটে প্রশ্ন তোলে, হঠাৎ রামের জন্মস্থান মসজিদের ভেতরে চলে এলো কী করে? কারণ তার আগে পর্যন্ত বেশিরভাগ স্থানীয় মানুষ মনে করতেন জন্মস্থানটি মসজিদের বৃহত্তর পরিসরের মধ্যে হলেও ঠিক প্রার্থনাস্থলে নয়, তার উল্টোদিকের একটি জায়গায়। আদালত মনে করে যে রঘুবর দাসের দাবি মানলে শহরে দাঙ্গা সুনিশ্চিৎ। নির্মোহী আখড়া সাময়িকভাবে মন্দির নির্মাণে বিফল হলেও এর পরের দশকগুলিতে অযোধ্যায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ক্রমে বাড়তে থাকে। ক্রমবর্ধমান এই মন্দির মসজিদ বিতর্ক ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি নির্ণায়ক মোড় নেয়।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মের রাজনীতি

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে স্বাধীনতার মুহূর্ত; এই সময়টাকে বলা যেতে পারে আধুনিক যুগের অযোধ্যাকাণ্ডের প্রথম পর্ব। ব্রিটিশ আমলের মধ্যভাগ থেকে এক নব্য হিন্দু ধৰ্ম গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে তথাকথিত রাম জন্মভূমিতে প্রার্থনার দাবি তোলে নির্মোহী আখড়া। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে ধর্মসংস্কারের ঐ ধারা হিন্দু মহাসভার মাধ্যমে এক রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ১৯২৫ সালে গঠন হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আর. এস. এস.), যা হিন্দু সংগঠন আন্দোলনকে এক রাজনীতি ঘেঁষা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার রূপ দেয়। হিন্দু মহাসভা ও সংঘ তাদের নিজস্বতা বজায় রেখেও শীঘ্রই একে ওপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। দুইয়ে মিলে জন্ম দেয় আধুনিক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির। ব্রাহ্মণ্যবাদী রক্ষণশীলতা এবং মুসলমানবিরোধী জাতীয়তাবাদ হয়ে দাঁড়ায় এই রাজনীতির প্রধান উপজীব্য।

উল্লেখযোগ্য, আধুনিক রাজনৈতিক পরিকাঠামোর প্রতি কিন্তু এদের কোনো বিরূপ মনোভাব দেখা যায়নি। বরং উদারবাদী রাষ্ট্রের পারিকাঠামোকে ব্যবহার করে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে সমঝোতা করে, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রক্ষণশীলতা প্রচার করাই ছিল এদের প্রধান উদ্দেশ্য। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত এরা পুঁজিবাদের প্রতীকী বিরোধিতা করত বটে, কিন্তু তা কোনোদিনই কোন পরিপূর্ণ কার্যক্রমের রূপ নেয়নি। আবার ১৯৯১-এর পর আরএসএস- এর মূলস্রোত নব্য উদারবাদের জোরদার সমর্থক হয়ে ওঠে। সে যাই হোক, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে হিন্দু মহাসভা কংগ্রেসি গণ-আন্দোলন ও উদারবাদী নির্বাচনী ধারার মধ্যে কাজ করে রাজনীতির মূলস্রোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। এবং নানা কৌশল অবলম্বনে এরা মুসলমানদের এক বড় অংশকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। দেশভাগের রাজনীতিতে এদের গোপন ভূমিকার প্রমাণ মেলে মার্কিনি-পাকিস্তানি ইতিহাসবিদ আয়েশা জালালের বইগুলিতে।

দেশভাগ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষ (ও পাকিস্তান) দুই দেশেই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি উর্বর জমি খুঁজে পায়। ভারতবর্ষে এই রাজনীতিকে শক্ত করার প্রচেষ্টায় কাজে লেগে যায় সেই বাবরি মসজিদ। প্রথমে হিন্দু মহাসভা ও পরে আরএসএস দুই দফায় বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের মনে হিন্দুত্ব নামক এক কৃত্রিম অনুভূতির জন্ম দিতে সক্ষম হয়। এই হলো অযোধ্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় পর্ব। এর প্রথম দফার সূচনা হয় ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর। ১৯৩৪ সালে রাম জন্মস্থানের দাবিকে কেন্দ্র করে অযোধ্যাতে ছোটোখাটো দাঙ্গা হয়েছিল। এর পর ঐ বিতর্কিত স্থানে জনা ২০ পুলিশ মোতায়েন করে স্থানীয় আদালত। পুলিশ পাহারা সত্ত্বেও ২২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে হিন্দু মহাসভার কিছু কর্মী মসজিদে ঢুকে প্রার্থনাস্থলে রামের মূর্তি স্থাপন করে। আদালতের আদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সামলাতে ঐ পরিসরে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় ও নামাজ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ আদালত বা প্রশাসন কেউই কিন্তু মূর্তি সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। হিন্দু মহাসভার প্রচার করা রামলাল্লার নিজগৃহে প্রত্যাবর্তনের কাহিনি কিছুদিন পর আদালত পর্যন্ত মেনে নেয়। ভবিষ্যতে ঝামেলা বাড়তে পারে এমন অনুমান করে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড চায় ঐ জমি হিন্দুদের হাতে তুলে দিতে। কেউ তখন তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি।

অযোধ্যাকান্ডের দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দফার ক্রিয়াকাণ্ড ঘটে ৭০-এর দশকে। ততদিনে হিন্দু হাসভার অবসান ঘটেছে এবং ভারতীয় জন সংঘের হাত ধরে আরএসএস লোকসভায় প্রবেশ করেছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সুবিধাবাদী জোট-রাজনীতির মাধ্যমে মূলস্রোতে প্রবেশ করতে তারা প্রবলভাবে সচেষ্ট। জয়প্রকাশ নারায়ণের নবনির্মাণ আন্দোলন এদের উপহার দেয় সেই সুযোগ। জননেতা জে.পি. ভাবেন আন্দোলনে সামিল করে এদের ভাবধারা পালটাবেন; হিন্দুত্বর ভ্রান্তি তুলে ধরবেন এদের সামনে। ফল হয় ঠিক উলটো। ৭০-এর আন্দোলনের জোয়ার স্তিমিত হওয়ার সাথে সাথে জয়প্রকাশ নারায়ণকে দেওয়া শান্তির আশ্বাসন ভুলে আরএসএস কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করতে নামে। সম্বল সেই বাবরি মসজিদ। ততদিনে তৈরি হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি; অটল বিহারি বাজপেয়ী, লাল কৃষ্ণ আডবাণী, গোবিন্দাচার্য, মুরলি মনোহর যোশী প্রমুখ তার হোতা। এই পার্টি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দুইয়ে মিলে গড়ে তোলে রাম জন্মভূমি আন্দোলন, যা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে সমাজে ধর্মীয় মেরুকরণকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।

অযোধ্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় পর্বের কথা শেষ করার আগে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই একটি বিশেষ ব্যাপারে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের ক্ষেত্রে অ-হিন্দুত্ববাদী ধারা ও দলগুলির কিন্তু কিছুটা অবদান থেকেছে। কখনো বা ভ্রান্ত কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে আবার কখনো বা সুবিধাবাদী মনোভাবের ফলে বারে বারে এরা হিন্দুত্ববাদীদের কাজকে সহজ করে দিয়েছে। জে.পি.-র বিতর্কিত কৌশলের কথা আগেই বলা হয়েছে। ৮০-র দশকে আমরা দেখতে পাই কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্ববাদী মনোভাব। রাম জন্মভূমি আন্দোলন দাবি জানিয়েছিলঃ ঠিক যেখানে মসজিদের প্রার্থনাগৃহ, ঠিক সেখানেই শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম, অর্থাৎ ঠিক ঐখানেই মন্দির তৈরি হওয়া চাই, যা মসজিদ ধ্বংস না করে কোনোদিনই সম্ভব ছিল না। এ কথা জানা সত্ত্বেও যখন মসজিদের পরিসরে শীলাপূজনের দাবি উঠলো, তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকার সোৎসাহে রাজি হলো।

১৯৪৯ সালের পর আবার খোলা হলো সেই বিতর্কিত স্থলের তালা। খালিস্তান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিখদের সমর্থন কমে গেছিলো কংগ্রেসের প্রতি। শাহ বানো কাণ্ডের ফলে মুসলমানদের সমর্থন কমার ভয় ছিল। কাজেই হিন্দু ভোট ধরে রাখা জরুরি হয়ে উঠেছিল কংগ্রেসের কাছে। ভালো উপায় বের করলেন রাজীব গান্ধী, ভাবলেন খানিক তোষণ করা যাক হিন্দুত্ববাদী অনুভূতিকে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২, যেদিন মসজিদ ভাঙা হলো, তখনো কংগ্রেস ক্ষমতায়। প্রাধানমন্ত্রী নারসিংহ রাও। স্থানীয় কিছু পুলিশ পরে বলেন যে দিল্লি থেকে একবার অর্ডার এলেই মন্দির ওয়াহি বানায়েঙ্গে দলকে সামলে ফেলা যেত। এমন কোনো অর্ডার কিন্তু সেদিন দিল্লি থেকে আসেনি।

আদালত, রাজনীতি, ইতিহাস

প্রথিতযশা আইনজীবী, সাংবিধান-পণ্ডিত, ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার আব্দুল গফুর নূরানি বহুবার দুঃখের সাথে বলেছেন যে অযোধ্যাকাণ্ডে কেবল রাজনীতির খেলাতেই নয়, আইনের আদালতেও মুসলমানেরা ঠকেছে। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদের উত্থানের ক্ষেত্রে কেবল উদারবাদী গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যর্থতা নয়, আইনের ব্যর্থতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ৮০-র দশক থেকে এখন পর্যন্ত, অর্থাৎ গত বছরে আসা সর্বোচ্চ আদালতের রায় পর্যন্ত, একের পর এক বিচার কিন্তু ওই বিতর্কিত জায়গায় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের কেসকে দুর্বল করেছে। এই ধরুন ১৯৮৬-র রায়, যার ভিত্তিতে মসজিদের তালা খুলে দেওয়া হলো। ঐখানে নামাজ পড়তে দেওয়ার দাবি নিয়ে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ১৯৬১ সালে মামলা করে, অর্থাৎ ১৯৮৬-র রায় বেরোনোর সময় এরা কিন্তু এই কেস-এর সাথে জড়িত। তা সত্ত্বেও গেট খোলার শুনানিতে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে ডাকা হয়নি। এমনকি তাদের শুনানির খবর পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

এরপর ১৯৮৯ সালে দেবকী নন্দন অগ্গরওয়াল নাম এক ব্যক্তি রামজন্মস্থানের দাবি সমেত আরেকটি মামলা দায়ের করে। এই মামলায় তিনি নিজের পরিচয়ে দায়ের করেননি। করেন রাম লালা অর্থাৎ শিশু রাম, যার মূর্তি ওই ১৯৪৯-এর মধ্যরাত্রে হাঙ্গামার ফলে বিরাজমান, তার বন্ধু হিসেবে। এবং আদালত মামলা স্বীকার করে কারণ দেব-দেবীর হয়ে কোনো জীবন্ত ব্যক্তির মামলা লড়ার অধিকার আমাদের আইনে আছে। এইভাবেই সেই রামলাল্লা, যিনি ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদে উদয় হন, তিনি আদালতে প্রবেশ করেন। এখানে বলা দরকার যে রামলাল্লার নামে মামলা স্বীকার করে আদালত বেআইনি বা অসাংবিধানিক কিছু না করে থাকলেও, এটি স্বীকার করার অর্থ হলো রামলাল্লার উপস্থিতির পিছনে জবরদস্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করা অথবা উপেক্ষা করা। মসজিদে রাম লালার প্রবেশের পিছনে যে একটা ঘোলাটে ব্যাপার ছিল, সেটা আদালত চাইলেই তুলে আনতে পারতো কিন্তু তা করেনি। এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী।

মসজিদ ধংস হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার জমিটি অধিগ্রহণ করে এই বলে যে শান্তির চিহ্ন হিসেবে ওখানে ইস্কুল, হাসপাতাল, পুস্তকালয় ইত্যাদি তৈরি হবে। মসজিদ পুনর্নির্মাণের কথা সরকার বলে না। জমি অধিগ্রহণের পর সর্বভারতীয় মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পরিষদ (All India Muslim Personal Law Board)-এর সদস্য ইসমাইল ফারুকী আদালতে এই অধিগ্রহণকে চ্যালেঞ্জ করেন এই বলে যে সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় প্রার্থনাস্থলকে সরকার এইভাবে অধিগ্রহণ করতে পারে না। ১৯৯৪ সালে সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয় জমি অধিগ্রহণ অসাংবিধানিক নয়। এই রায়তে এমন কিছু কথা বলা হয় যা সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের দাবিকে রীতিমতো দুর্বল করে তোলে। আদালত দাবি করে যে জমি অধিগ্রহণ বেআইনি হতো যদি ঐ প্রার্থনাস্থল ইসলাম ধর্মের অন্তরঙ্গ অংশ হতো। আদালত বলে যে নামাজ তো যে কোনো জায়গায় পড়া যায়, অর্থাৎ ঐ মসজিদের গুরত্ত্ব সেরকম নয়। হিন্দু ধর্মের সাথে তুলনা টেনে বলা হয় যে ঐ জন্মস্থান যেহেতু হিন্দু ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান হিসেবে গণ্য, জায়গাটি ইসলামের থেকে হিন্দু ধর্মের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বলাই বাহুল্য বক্তব্য হিসেবে এটি বিতর্কিত। প্রথমত মসজিদ ইসলাম ধর্মের অন্তরঙ্গ অংশই বটে। বরং বলা যেতে পারে সব হিন্দুর কাছে রাম কিংবা অযোধ্যা ততটা গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়। আগেই বলে হয়েছে রাম অর্থাৎ অযোধ্যা অথবা রাম ও অযোধ্যাই হিন্দু ধর্মের সারমর্ম, এরকম ধারণা কিন্তু আদৌ প্রাচীনকাল থেকে চলে আসেনি। এই ধারণা তৈরি হয়, বরং বলা উচিত তৈরি করা হয়, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে তথাকথিত রাম জন্মস্থান সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীদের তৈরি করা ধারণা আইনি স্বীকৃতি পেলো এবং যে হিংসার মধ্যে দিয়ে এই ধারণা তৈরি করা হয়, তার কথা আইনের খাতা থেকে মুছে যেতে লাগলো।

এরপর চলে আসব ২০০৩-এ। ততদিনে কিছুটা রাম মন্দির সংক্রান্ত আবেগের সুবাদে আবার কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। এলাহাবাদ হাই কোর্টের তরফ থেকে ২০০৩ এ সরকারি প্রত্নতাত্বিক সংস্থাকে (Archaeological Survey of India) বলা হলো ওই বিতর্কিত স্থলটিকে খুঁড়ে দেখতে, এবং ঐখানে রাম মন্দির ছিল কি ছিল না সে বিষয়ে নির্ণায়ক কিছু বক্তব্য রাখতে। এই প্রক্রিয়া ছিল নেহাত অপ্রয়োজনীয়। ইতিমধ্যে সুরাজ ভান, আর এস শর্মা, আথার আলীর মতো ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্বিদরা পরিষ্কার প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীর কিছু গঠন ছাড়া ওর নিচে কিছুই ছিল না। অথচ সরকার মনোনীত কমিটি ২০০৩ এ রিপোর্ট লিখে দিলো যে ওর নিচে হিন্দু মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে এবং ২০১০-এর বিচারে এলাহাবাদ হাই কোর্ট তা মেনে নিলো।

বিতর্কমূলক রায়, অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ

এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায় ছিল বিচিত্র। এই রায় অনুযায়ী ওই বিতর্কিত স্থলটিকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। এক তৃতীয়াংশ পায় নির্মোহী আখড়া, এক তৃতীয়াংশ রামলাল্লা বিরাজমান আর এক তৃতীয়াংশ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। ভেতরের অংশ, যেখানে জোর করে রামের মূর্তি বসানো হয়, দেওয়া হয় রামলালাকে, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে নয়। পুরো জমিটা কেন দেওয়া হলো না সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ পুনর্গঠনের জন্য? বলা হলো যে এ জমির অধিকার দাবি করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ তাদের নেই। বাবরি মসজিদ ৪০০ বছর পুরানো হতে পারে, কিন্তু ওখানে যে টানা নামাজ পড়া হত তার প্রমাণ কী? আর অন্যদিকে মসজিদের ভেতরের দিকে যে রাম লালার মূর্তি আছে সেটাই প্রমাণ যে ঐ জায়গাটায় হিন্দুদের দাবি বেশি। রামলাল্লার দাবিটিই বা মানা হলো কোন ভিত্তিতে ? Law of limitation অনুযায়ী, কোনো সম্পত্তিজনিত বিতর্কে, বিতর্ক শুরু হওয়ার ১২ বছরের মধ্যে মামলা দায়ের না করলে সেই দাবি ন্যায্যতার স্বীকৃতি পায় না। আদালত ১৯৪৯কে এই বিতর্কের গোড়ার তারিখ বলে মানে। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে রামলাল্লা বিরাজমান মামলা করেছে ৪০ বছর পর। এখানে আবার অন্য গল্প। আদালত দাবি করে যে শিশুদের ক্ষেত্রে এই Limitation এর নিয়ম কার্যকরী হয় না। আর রাম লাল্লা হলেন চিরশিশু!

এই এতো কাণ্ডের পর আসে গত বছরের রায়। ২০১০-এর রায়কে সর্বোচ্চ আদালত এই বলে খারিজ করে যে ঐ জমিকে এভাবে ভাগ করার নিবেদন ঐ ৩ দলের কেউই করেনি। গত বছরের দেওয়া রায় পুরো জায়গাটিকে একটি ইউনিট বলে ধরে। অর্থাৎ পুরো জায়গাটা হয় এর নয় ওর। সর্বোচ্চ আদালত বলে যে নির্মোহী আখড়ার দাবিটি ন্যায্য নয়। তাহলে বাকি থাকলো সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ও রামলাল্লা বিরাজমান। এদের মধ্যে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড শুধুই ভেতরের অংশ অর্থাৎ আসল মসজিদটা দাবি করেছিল। আর রামলাল্লা বিরাজমান ভেতরের অংশ ও বাইরের অংশ দুই-ই দাবি করেছিল। এবং ২০০৩-এর রায় অনুযায়ী এই দুই দাবির মধ্যে রামলাল্লা বিরাজমানের দাবির জোর বেশি। কাজেই ফলাফলঃ বিতর্কিত স্থলের পুরোটাই চলে গেলো রামলালা বিরাজমানের কাছে। ২০০৩-এর রায়কে খারিজ করলেও সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু রায়ের ভিত্তিগুলিকে খারিজ করেনি, এটি লক্ষণীয়। আরও অনেক কথাই আছে গত বছরের রায়তে যেগুলি রীতিমতো বিতর্কিত। যেমন সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে সমানে মুসলিম পার্টি বলা হয়েছে আর রামলাল্লা বিরাজমানকে হিন্দু পার্টি। এর অর্থ কী? হিন্দু ও মুসলামন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই অনেকে থাকতে পারে যারা এই দুই পার্টির দাবির সাথে একমত নয়। আদালত বলেছে যে জটিল ঐতিহাসিক তত্ত্ব তাদের আওতার বাইরে। এবং ইতিহাসের ভিত্তিতে রায় দেওয়া সম্ভব নয়। তার অর্থ এই হয়ে দাঁড়ালো যে কিছু ভ্রান্ত ঐতিহাসিক দাবিকে জনগণের বিশ্বাস বলে চালিয়ে মসজিদকে মন্দিরে পরিণত করার প্রচেষ্টা আইনি মান্যতা পেলো। সর্বোচ্চ আদালত এও বলেছে যে এই ঝামেলা ঠিক ১০০ বছরের নয়। যবে থেকে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায় ভারতে আছে, তবে থেকেই এই দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ দ্বন্দ্ব উৎপাদনের যে ভয়ানক প্রক্রিয়া, তাকে মুছে দিলো আদালত।

কিছুদিন আগে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ঘোষণা করেন যে রাম মন্দির নির্মাণের সাথে সাথে অযোধ্যাকাণ্ডের সমাপ্তি। এই মন্দির যেন হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। সেরকম হলে তো খুবই ভালো হয়। তবে কৃষ্ণজন্মভূমি নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে রাজনীতি করতে নেমেছে তাতে মনে হচ্ছে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মনোবাঞ্ছা পূরণ নাও হতে পারে। অর্থাৎ রামজন্মভূমি আন্দোলনের রক্তরঞ্জিত ঘটনাক্রম হয়তো এখনো ইতিহাস নয়। যদি অযোধ্যাকণ্ডের পর মথুরাকাণ্ড বা কাশীকাণ্ড উপস্থিত হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে সেই মুহূর্তগুলিতে যেগুলি অন্যরকমভাবে ঘটলে বাবরি মসজিদের ভয়ঙ্কর পরিণতি আটকানো যেত। শিক্ষা নিতে হবে মুছে যাওয়া ঘটনাগুলি থেকে। শুধরে নিতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ দল ও নেতাদের করে যাওয়া ভুল। প্রখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড থম্পসনের কথায় ইতিহাস একটি সাংস্কৃতিক কাঠামো যার মধ্যে ভালোমন্দের লড়াই চলতে থাকে। ভালোমন্দের এই লড়াইতে দিক নির্দেশনের জন্য আধুনিকযুগের অযোধ্যাকাণ্ডের কাহিনিকে জীবিত রাখা এখনকার ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসকারদের একটি জরুরি কাজ।


পুস্তক বিবরণীঃ
১। আয়েশা জালাল, একক মুখপাত্রঃ জিন্নাহ, মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের দাবি, লাহোরঃ সঙ্গ-এ-মীল, ২০১০।
২। এ জি নূরানী, বাবরি মাসজিদ প্রশ্নঃ ১৫২৮-২০০৩, নয়া দিল্লীঃ তুলিকা, ২০০৪।
৩। ক্রিস্টোফ জাফরেলো, হিন্দু জাতীয়তাবাদ আন্দোলন ও ভারতীয় রাজনীতিঃ ১৯২৫-১৯৯০, নয়া দিল্লীঃ পেঙ্গুইন, ১৯৯৯।
৪। চেতন ভট্ট, হিন্দু জাতীয়তাবাদঃ সূত্রপাত, মতবাদ ও আধুনিক অতিকথা, লন্ডনঃ রুটলেজ, ২০২০।
৫। পাউলা রিচম্যান, অনেক রামায়ণ, ক্যালিফর্নিয়া, ১৯৯১।