আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

নয়া শ্রম আইনঃ মালিকের পৌষমাস-শ্রমিকের সর্বনাশ

অর্জুন রায়


সদ্য সমাপ্ত সংসদের অধিবেশনে পর পর দুদিনে পাশ হয়ে গেল তিনটে শ্রম আইন সংক্রান্ত কোড। প্রথমে ২২ সেপ্টেম্বর লোকসভায় আর তার পরের দিন ২৩ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে নেওয়া হল Industrial Relations Code Bill 2020, Code on Social Security Bill 2020 এবং Occupational Safety, Health and Working Conditions Code Bill 2020। এর আগে ২০১৯ সালে The Wage Code Bill 2019 সংসদে পাশ করানো হয়েছে। সদ্য পাশ হওয়া তিনটি কোড এবং ওয়েজ কোড-এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমানে প্রচলিত ২৯টি শ্রম আইনকে বেঁধে দিল। শ্রম সংক্রান্ত বিষয়টি সংবিধানে যুগ্ম তালিকাভুক্ত অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার উভয়েই এই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে যদিও সাংবিধানিক বাধ্যতা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে রাজ্যস্তরের আইনের বিরোধ বাঁধলে কেন্দ্রীয় আইনকেই মান্যতা দিতে হবে। রাজ্যসরকারগুলি কেন্দ্রীয় শ্রম আইনের কিছু ধারা সংযোজন/সংশোধন করতেই পারে কিন্তু তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার/রাষ্ট্রপতির সম্মতি আদায় করতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বোক্ত চারটি কোড-এর মাধ্যমে যে আইনগুলিকে বদলে দিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করতে চলেছে সেগুলি সবই কেন্দ্রীয় আইন। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রায় ৪০টি আইন এবং বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় ১০০টি শ্রম সংক্রান্ত আইন আছে তবে নতুন চারটে কোড-এর মাধ্যমে দেশের শ্রম আইনের যে খোলনলচে বদলে দেওয়া হল সেকথা বলাই বাহুল্য। এককথায় বলা যায় যে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়কাল থেকে চলে আসা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী যে সমস্ত আইনি সুযোগ সুবিধা প্রচলিত শ্রম আইনগুলিতে ছিল তার প্রায় সমস্তটাই নয়া শ্রম আইনের মাধ্যমে হরণ করে পুরো আইনি ব্যবস্থাটাকেই মালিকপক্ষের অনুকুলে পরিণত করার কাজ সম্পন্ন করে দেওয়া হল।

প্রশ্ন এটাই যে কেন রাতারাতি সমস্ত শ্রম আইনকে পরিবর্তন করে দেওয়া হল? কেনই বা সংসদের উভয়কক্ষে যখন বিরোধী দলের সাংসদরা অনুপস্থিত (কৃষি বিল নিয়ে তখন বিরোধীরা সংসদ বয়কট করেছিল) তখন কোনোরকম আলোচনা ব্যতিরেকে নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই তিনটে শ্রম কোড পাশ করিয়ে নেওয়া হল? কী এমন বাধ্যবাধকতা ছিল যার জন্য এই অতিমারির সময়ে স্বল্পমেয়াদী সংসদের অধিবেশনেই এই আইনগুলোকে পাশ করাতে হল? কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার বলেছেন ১ এপ্রিল ২০২১ থেকেই চারটে শ্রম কোড চালু করে দেবে এবং শ্রম ক্ষেত্রের সংস্কার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার কাজটা একসঙ্গে এই চারটে শ্রম কোড প্রয়োগ করার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন করা হবে। গত বছর পাশ হওয়া ওয়েজ কোড এবং এবারের তিনটে কোড-এর বিধি বা রুল্‌স একসঙ্গে চালু করার সমস্ত উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকে যে নেওয়া হচ্ছে সেকথাও কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন (দি ইকনমিক টাইমস, ২৭.০৯.২০)। অর্থাৎ সরকার শ্রম সংস্কার করতে মরীয়া এবং সেই কাজটা তারা খুব দ্রুততার সঙ্গে করতে বদ্ধপরিকর। একবার বিধি বা রুলস চূড়ান্ত হয়ে গেলে এই চারটে কোড-ই আইনে পরিণত হবে যা কিনা CIA (Consortium of Indian Association)-এর আহ্বায়ক রঘুনাথান-এর মতে, “এই নয়া শ্রম কোডগুলি নতুন উদ্যোগ (শিল্প) সমূহকে লগ্নিকারী বান্ধব করতে বাধ্য, ব্যাবসা সহজতর করতে সাহায্য করবে (ease of doing business), যে সব বিদেশী সংস্থা চীন দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তাদেরকে আহ্বান করতে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে“ এবং কারোর মতে একবার আইনে পরিণত হয়ে গেলে সেটা দেশের শ্রম-সংস্কারের ক্ষেত্রে “খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার (game changer) কাজ করবে"। মোদ্দা কথা হল এটাই যে এই শ্রম আইন সংস্কার দেশের শ্রম-সংক্রান্ত এতদিনের পরিচিত ব্যবস্থাপনাকেই সম্পূর্ণরূপে বদলে দিতে চলেছে যা কিনা দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিল্পমহল, পুঁজিপতিরা এবং দেশের শাসকশ্রেণি চাইছিল। এবং এটা করা হচ্ছে দেশের শ্রমিকশ্রেণি তথা শ্রমজীবি মানুষের দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলন-আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকার, আইনি রক্ষাকবচ এবং দর কষাকষি করার ন্যূনতম ক্ষমতা - সবকিছুকে ধ্বংস করে।

কেন এটা করা এত জরুরি হয়ে পড়ল সেই আলোচনায় ঢোকার আগে নয়া শ্রম কোডে কোন কোন বিষয়গুলো নিয়ে আসা হয়েছে এবং কীভাবে নয়া আইনের মাধ্যমে শ্রমজীবী জনতার অধিকার ধ্বংস করা হয়েছে সেগুলো একঝলকে দেখে নেওয়া যাক। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে নতুন চারটে শ্রম কোডে যে সমস্ত আইনকে একত্রিত করে চারটে আলাদা আলাদা কোড বা আইন করা হচ্ছে তার মধ্যে অনেক আইন আছে যেগুলো স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশে প্রচলিত ছিল, বেশ কিছু আইন আছে যেগুলো দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরবর্তী সময়ে চালু হয়েছে এবং বিস্তারিত আলোচনায় না ঢুকেও একথা বলা যায় যে প্রতিটি আইন তৈরি বা চালু হওয়ার পিছনেই সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত এবং শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। যেমন দেশের প্রথম শ্রম সংক্রান্ত আইন Workmen’s Compensation Act, 1923 চালু হওয়ার নেপথ্যে যে কারণ ছিল সেটা আইনের মুখবন্ধেই উল্লেখিত ছিল, “The growing complexity of industry in this country, with the increasing use of machinery and consequent danger to workmen, along with the comparative poverty of the workmen themselves renders it advisable that they should be protected as far as possible, from hardship arising from accidents. A legislation of this kind helps to reduce the number of accidents …thereby making industry more attractive to labour and increasing its efficiency…” অর্থাৎ শ্রমজীবি মানুষদের শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা, তাদের সুরক্ষার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া এইসব আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হত এমনকি স্বাধীনতার পূর্বেকার আইনগুলির ক্ষেত্রেও।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী তিনটে আইন যথা Trade Unions Act, 1926, Industral Employment (Standing Orders) Act, 1946 এবং Industrial Disputes Act, 1947 (01.04.1947 থেকে প্রবর্তিত) যাদের একত্রিত করে নয়া Industrial Relations Code 2020 করা হয়েছে কিম্বা স্বাধীনতার ঠিক পরবতী সময়ে The Factories Act 1948, The Mines Act 1952, The Plantation Labour Act 1951, The E.S.I. Act 1948, The Employees Provident Funds & Miscellaneous Provisions Act 1952 ইত্যাদি আইনকে একত্রিত করে যে পৃথক দুটি কোড The Occupational Safety, Health and Working Conditions Code 2020 এবং Code on Social Security 2020 করা হয়েছে সেই সমস্ত আইনেই শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়গুলি উল্লেখিত ছিল। এককথায় বলতে গেলে রাষ্ট্রের যে কল্যাণকামী ভূমিকা, তার একধরনের প্রতিফলন ছিল উপরে উল্লেখিত আইনসমূহে। কিন্তু গত বছরে পাশ হওয়া The Code on Wages 2019 এবং সদ্য পাশ হওয়া তিনটে কোড-এ রাষ্ট্রের সেই কল্যাণকামী ভূমিকাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকের স্বার্থ, তাদের চাকুরীর নিরাপত্তা, চাকুরীর স্থায়িত্ব, সংগঠিত হওয়ার, ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের আইনি অধিকার সমস্ত কিছুতেই বিধিনিষেধ আরোপ করে, খর্ব করে পুঁজিপতি তথা মালিকশ্রেণির হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। এতদিনকার প্রচলিত আইন বদলে যে নয়া আইন চালু হতে যাচ্ছে তাতে দেশের শিল্প-সম্পর্কের আমূল বদল ঘটে যাবে, শ্রমজীবি জনতার জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণভাবে মালিকশ্রেণি এবং দেশের সরকারের খেয়ালখুশির উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

মূল যেসব সর্বনাশ ঘটানো হয়েছে নয়া শ্রম কোড-এ সেগুলি একঝলকে দেখে নেওয়া যাক।

১) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ - (ক) নয়া আইনে সংসদ বা রাজ্যের আইনসভাকে এড়িয়ে সরকারের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে শ্রম আইনের বিভিন্ন বিষয়। যেমন ২০১৯ সালে যে বিল পেশ করা হয়েছিল তাতে কেন্দ্রীয় অধিগৃহীত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারকে উপযুক্ত সরকার (appropriate government) হিসেবে বলা হয়েছিল যা এতদিনের প্রচলিত আইনে ছিল কিন্তু ২০২০ সালের সংশোধিত আইনে বলা হল যে এমনকি যেসব সংস্থায় কেন্দ্রের অংশীদারি ৫০ শতাংশেরও কম সেখানেও কেন্দ্রীয় সরকারই উপযুক্ত সরকার হিসেবে বিবেচিত হবে অর্থাৎ নয়া আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করা হল। (খ) কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার চাইলেই যেকোনো নতুন শিল্প সংস্থা বা একগুচ্ছ শিল্প সংস্থাকে নতুন শ্রম সংক্রান্ত কোড-এর আওতার বাইরে রাখতে পারে অর্থাৎ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের মর্জি অনুযায়ী নতুন একাধিক শিল্প সংস্থা শ্রম আইন না মেনে তাদের খেয়ালখুশি মত চলতে পারবে।

২) ক্লোজার - লে অফ - ছাঁটাই - মালিকের হাতে অবাধ ক্ষমতা - ২০১৯ সালে সংসদে পেশ করা কোড-এ পুরনো আইন অনুযায়ী কমপক্ষে ১০০ শ্রমিক শিল্পে থাকলে উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে সরকারের (শ্রম দপ্তরের) অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামুলক ছিল, কিন্তু ২০২০তে পেশ করা কোড-এ সংখ্যাটা বাড়িয়ে ৩০০ করে দেওয়া হল। অর্থাৎ ৩০০-র নিচে শ্রমিক নিযুক্ত যেকোনো শিল্পে কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করতে বা কারখানা সাময়িক বন্ধ করতে কিম্বা চিরতরে বন্ধ করে দিতে আর কোনোরকম নিয়ননীতির তোয়াক্কা বা অনুমতির অপেক্ষা করতে হবে না মালিকদের। মোদ্দা কথা এটাই যে আনুমানিক ৭৪ শতাংশের উপর শ্রমজীবি মানুষ এবং প্রায় ৭০ শতাংশ শিল্প সংস্থা কোনোরকম আইনি সুরক্ষাকবচ-এর বাইরে চলে গেল নয়া শ্রম আইনে। ৩০০ পর্যন্ত কাজ করে এমন শিল্প সংস্থায় যখন খুশি কাজ থেকে ছাঁটাই করা, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া সবটাই মালিকদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দেওয়া হল।

৩) শ্রমজীবি জনতার ধর্মঘটের অধিকার হরণ - নয়া শ্রম কোড-এ যা বলা হয়েছে তাতে শ্রমিকদের ধর্মঘট যা তাদের অর্জিত অধিকার রক্ষার এবং ন্যায্য দাবি আদায়ের ও লড়াই-আন্দোলনের শেষ এবং অন্যতম অস্ত্র তাকে বাস্তবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শিল্প সংস্থার কোনো শ্রমিক ৬০ দিনের আগাম নোটিশ না দিয়ে ধর্মঘটে যেতে পারবে না, নোটিশ দেওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে ধর্মঘট করা যাবে না, ধর্মঘটের নোটিশ পাওয়ার পর যদি শ্রম দপ্তরের আধিকারিক (conciliation officer) আলোচনার জন্য মিটিং ডাকে তাহলে সেই আলোচনা শেষ হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে (আলোচনায় সমাধানসূত্র না পাওয়া গেলে) ধর্মঘট করা যাবে না, যদি অমিমাংসীত বিষয় লেবার কোর্ট/লেবার ট্রাইব্যুনাল-এ পাঠানো হয় তাহলে সেখানে কেস চলাকালীন সময়ে এবং কেস শেষ হওয়ার ৬০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট করা যাবে না (Chapter viii, Section 62)। সব মিলিয়ে যেটা দাঁড়াল সেটা হল এই যে ধর্মঘটের নোটিশ দেওয়া এবং আইনি প্রক্রিয়া চলার পর্যায়কে দীর্ঘায়ত করে প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকদের আইনসঙ্গত ধর্মঘট করা প্রায় অসম্ভব করে দেওয়া হল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে একমাত্র জরুরী পরিষেবার ক্ষেত্রগুলো বাদ দিলে (পরিবহণ, ব্যাংক, সিমেন্ট, কয়লা, লোহা ও ইস্পাত শিল্প ইত্যাদি) আর কোথাও শ্রমিকদের ধর্মঘট করার জন্য ১৪ দিনের নোটিশ দেওয়ার প্রয়োজন হত না এবং আইনি প্রক্রিয়া প্রলম্বিত করে বস্তুত ধর্মঘট করার অধিকার হরণের কোনো সংস্থানই ছিল না পূর্বের Industrial Disputes Act, 1947-এ।

৪) শ্রমিকদের মর্যাদার সঙ্গে কাজ করার ও কাজের ন্যূনতম নিশ্চয়তা হরণ - নয়া Industrial Relations Code 2020-তে যেকোনোরকম শিল্প সংস্থায় স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকার জন্য শ্রমিক সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। এই স্ট্যান্ডিং অর্ডার হল কোনো শিল্প সংস্থায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজের সময়, ছুটির দিন, মাস মাইনের দিন, মজুরি/বেতন, শিফট ডিউটি, কোনো শ্রমিক-কে কাজ থেকে বরখাস্ত বা সাময়িকভাবে বসিয়ে দিলে (সাস্পেনশন) নোটিশ দেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় উল্লেখ করার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাপনা। এতদিন ধরে ন্যূনতম ১০০ শ্রমিক থাকলেই এই স্ট্যান্ডিং অর্ডার-এর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নয়া শ্রম কোডে (Industrial Relations Code) সংখ্যাটা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। এর ফলে দেশের অধিকাংশ শিল্প সংস্থার শ্রমিক কর্মচারীরাই তাদের কাজের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে মালিকের তৈরি করা শর্তাবলী মেনে কাজ করতে বাধ্য থাকবে, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজের নিশ্চয়তা বলে কিছুই থাকবে না, কাজের সময়, কাজের শর্তাবলী, শো-কজ, সাস্পেনশন ছাড়াই কোনো কারণ না দেখিয়েই যেকোনো সময় শ্রমিকদের কাজ থেকে বরখাস্ত করার বেলাগাম ক্ষমতা মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হল। এই নয়া আইনের মাধ্যমে ৩০০ পর্যন্ত যে-কোনো শিল্পক্ষেত্রে মালিকদের ইচ্ছেখুশি মত যেকোনো শর্তে শ্রমিক নিয়োগ এবং ছাঁটাই করার (Hiring and Firing) একচেটিয়া ক্ষমতা তুলে দিয়ে শ্রমজীবি মানুষকে কাজের জায়গায় চরম নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হল এবং তাদের উপযুক্ত, শোভন (Decent) কাজের পরিবেশ-এর নিশ্চয়তা সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়ার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করা হল।

৫) Factory আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রমিকের মৌলিক অধিকার হরণ-- পূর্বতন ফ্যাক্টরি আইন অনুযায়ী ( Factories Act, 1948 ) শক্তি ( পাওয়ার ) চালিত কোনো উৎপাদন শিল্পে ১০ জন কাজ করলে এবং শক্তি ছাড়া কোনো শিল্পে ২০ জন কাজ করলেই তাদের ফ্যাক্টরি বা কারখানা হিসেবে গন্য করা হত এবং এই আইন স্বাধীনতার ১ বছরের মধ্যেই চালু করা হয় এবং এতদিন ধরে এভাবেই চলছিল। কিন্তু The Occupational Safety, Health and Working Conditions Code 2020 হিসেবে যে নয়া কোড পাশ করানো হল যার মধ্যে পূর্বতন ফ্যাক্টরিজ আইন-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতে ফ্যাক্টরি বা কারখানার সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হল এবং বলা হল যে যেখানে শক্তি চালিত উৎপাদন হয় সেখানে ২০ জন বা তার বেশি এবং শক্তি ছাড়া যেখানে উৎপাদন হয় সেখানে ৪০ জন বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করলে তবেই তাদের কারখানা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হবে। ১৯৪৮ সালের আইনের মুখবন্ধেই বলা ছিল, “The Factories Act, 1948 provides for the health, safety welfare and other aspects of workers in factories” যা থেকে এই আইনের মুখ্য উদ্দ্যেশ্য স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং কল্যাণ সহ দৈনিক কাজের সময়/ঘণ্টা, অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য অতিরিক্ত মজুরি, সাপ্তাহিক কাজের সর্বাধিক সময়/ঘণ্টা, সাপ্তাহিক ছুটি, বার্ষিক ছুটি, দৈনিক কাজের মধ্যে বিশ্রামের নির্দিষ্ট সময় সহ নানা ধরনের বিধি ব্যবস্থার সংস্থান এই আইনে করা আছে। কিন্তু নয়া শ্রম কোডে কারা কারখানা হিসেবে গন্য হবে তার শ্রমিক সংখ্যা যখনি ২০ ও ৪০ করে দেওয়া হল (যথাক্রমে শক্তি সহ ও শক্তি ছাড়া) তখনি এক বিশাল সংখ্যক কারখানা (বিশেষত ছোট ও ক্ষুদ্র - মাঝারি) এবং তাদের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবি মানুষ আইনি রক্ষাকবচের বাইরে চলে গেল, বলা ভাল নয়া আইনের মাধ্যমে সরকার তাদের সেই রক্ষাকবচ কেড়ে নিল। ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গেছে দেশের শ্রমজীবি জনতার ৯০.৭৪ শতাংশ মোট ৬৭.০৯ শতাংশ কারখানায় কর্মরত (যেখানে ১০ বা তার অধিক সংখ্যক শ্রমিক আছে) [Statistics of Factories 2013, Ministry of Labour and Employment, Govt. of India, published on 26.10.2016]। যদিও এই রিপোর্টে অনেক রাজ্যের তথ্য নেই তবু এর থেকে ধারণা করা যায় যে আসলে নয়া শ্রম আইনের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ শ্রমজীবি মানুষকেই সমস্ত ধরনের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এক দানবীয় ব্যবস্থা কায়েম করার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।

৬) ঠিকা ও পরিযায়ী শ্রমিকদের আইনে পরিবর্তন - ঠিকা শ্রমিক আইন ও পরিযায়ী শ্রমিকদের আইনেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কোনো ঠিকাদার মারফৎ ২০ বা তার বেশি শ্রমিক শিল্প সংস্থায় নিযুক্ত হলে সেখানে ঠিকা শ্রমিক আইন [Contract Labour (Regulation and Abolition) Act, 1970 প্রযোজ্য হত যা নয়া আইনে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছে। অর্থাৎ ঠিকা শ্রমিক আইনের সুরক্ষা পেতে গেলে এখন থেকে কমপক্ষে ৫০ জন শ্রমিক ঠিকাদার মারফৎ নিযুক্ত হতে হবে এবং কোনো শিল্প সংস্থা ঠিকাদার মারফৎ ৫০-এর কম শ্রমিক কাজে নিযুক্ত করলে সেই সংস্থার ক্ষেত্রে কোনোরকম বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা যাবে না এবং তার ঠিকাদার নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য আইনের কোনো সুরক্ষাবিধি থাকবে না। এমনিতেই আইন থাকলেও এতদিন ঠিকা শ্রমিকরা নানারকম বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতনের মুখোমুখি হত, একইরকম কাজ করে স্থায়ী শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পেত আর নতুন আইনে (The Occupational Safety, Health and Working Conditions Code 2020) শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে আইনের পরিধিকেই আরো সংকুচিত করে দেওয়া হল। নয়া আইনে যদিও বলা আছে যে মূল উৎপাদনের জায়গায় (core activities) ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না কিন্তু কোনটা core activities সেটা নির্ধারণ করবে সরকার, মানে ঠিকা শ্রমিক কোথায় নিয়োগ করা যাবে আর কোথায় করা যাবে না তার সবটাই সরকারের ইচ্ছেমত ঠিক হবে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ঠিকা শ্রমিক প্রথা বন্ধ করার যে দাবি এতদিন ট্রেড ইউনিয়ন করে এসেছে তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে বরং ঠিকা শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনাকেই আরো তীব্র করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের যে ঠিকেদার এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে নিয়ে যেত তখন সেই শ্রমিকদের নিয়োগ করার সময় তাদের মজুরির ৫০ শতাংশ displacement allowance হিসেবে দেওয়া আইনে বাধ্যতামূলক ছিল [ISMW (RE & CS) Act, 1979] কিন্তু নয়া আইনে সেই বিষয়টি পুরোপুরি বাতিল করে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হয়েছে এবং ঠিকেদারদের দায়বদ্ধতা কমিয়ে তাদের মুনাফা বৃদ্ধির পথ সুগম করে দেওয়া হয়েছে।

৭) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংকোচন - নয়া শ্রম আইনে যদিও কোনো শিল্প কারখানায় ৭ জন বা তার বেশি শ্রমিক নতুন ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি করার জন্য আবেদন করতে পারবে কিন্তু সেই ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পাবে কিনা সেটা নির্ভর করবে ওই শিল্প-কারখানায় ১০ শতাংশ বা ১০০ জন শ্রমিক (যেটা কম হবে) ওই নতুন ট্রেড ইউনিয়ন-এর সদস্য হয়েছে কিনা সেটা দেখার পরেই [Section 6(2)] যার মধ্য দিয়ে কোনো শিল্পে নতুন করে ট্রেড ইউনিয়ন করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ল। সবচেয়ে মারাত্মক যে নিয়ম নয়া আইনে রাখা হয়েছে সেটা হল যেকোনো কারখানায় একটাই ট্রেড ইউনিয়ন-কে মালিকের সঙ্গে শ্রমিকদের দাবি- দাওয়া নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া হবে sole negotiating union হিসেবে যে ইউনিয়নের সঙ্গে ৫১ শতাংশের বেশি শ্রমিকের সমর্থন থাকবে/সদস্য থাকবে এবং সেটা ওই কারখানার মালিকপক্ষই ঠিক করবে [Section 14(3)]। আর যদি কোনো একটা ইউনিয়ন সেই সদস্য সংখ্যা দেখাতে না পারে বা তাদের সেই সমর্থন না থাকে তাহলে মালিকপক্ষ একাধিক ইউনিয়ন মিলিয়ে Negotiating Council তৈরি করে দেবে এবং সেই council-এ থাকতে হলে প্রতিটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন/সদস্য সংখ্যা থাকতে হবে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে আসলে এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করা এবং মালিকের সঙ্গে দরকষাকষি করার অধিকারকেই খর্ব করে দেওয়া হচ্ছে এবং শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া নিয়ে মালিকদের সঙ্গে আলোচনার রাস্তা কার্যত দুরূহ করে দেওয়া হচ্ছে।

৮) মজুরির সংজ্ঞা বদল - নয়া Idustrial Relations Code-এ মজুরির সংজ্ঞায় ব্যাপক বদল আনা হয়েছে। পুরনো I. D. Act, 1947-এ মজুরি বলতে বেসিক, ডিএ, ঘর ভাড়ার টাকা, জল ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ, ভ্রমণের জন্য ছাড়, চিকিৎসা জনিত খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে মজুরি হিসেব করা হত। কিন্তু বর্তমান আইনে বেসিক, ডিএ বাদ দিয়ে বাকি সব কিছুই মজুরির সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এর পরিণতিতে যেটা হবে সেটা হল এই যে শ্রমিকদের ছাঁটাই করলে প্রাপ্য ভাতা, সাসপেন্ড হলে প্রাপ্য ভাতা, বকেয়া প্রাপ্য মজুরি এবং অবসরকালীন সমস্ত প্রাপ্য টাকার অঙ্ক বিপুল ভাবে কমে যাবে, কারণ এগুলো সবটাই শ্রমিকের মজুরির উপর ভিত্তি করে হিসেব করা হয়।

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে আরো নানারকম পরিবর্তন করা হয়েছে নয়া শ্রম আইনে। সমস্ত পরিবর্তন নিয়ে স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ সীমিত। তবু আলাদা করে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। যেমন পুরনো Industrial Disputes Act 1947-এ কোনো শ্রমিকের চাকুরীর শর্ত পালটাতে হলে (মজুরি, কাজের সময় ও বিশ্রামের সময়, ছুটি এবং সবেতন ছুটি, শিফট ডিউটি-র বদল ইত্যাদি) ২১ দিনের নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল [Section 9A, Fourth Schedule]। নয়া কোড-এ এই শর্ত রেখেও একটা ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে আর সেটি হল এই যে “উপযুক্ত সরকারের আদেশ বলে এই ধারার ব্যতিক্রম করা যাবে”। অর্থাৎ সরকারের আদেশ বলে যেকোনো সময় মজুরি/মাইনে ছাঁটাই, কাজের সময় বদল বা ছুটি না দেওয়া ইত্যাদি করা যাবে ২১ দিনের নোটিশ না দিয়ে এবং শ্রম দপ্তরে আলোচনা ব্যতিরেকেই। Code on Social Security 2020 তে সব ধরনের অসংগঠিত, গিগ ওয়ার্কার (যারা নির্দিষ্ট কাজ বা পেশার সঙ্গে যুক্ত নয়), প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার (যারা কোনো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কাজ করে যেমন ওলা-উবের চালক, সুইগি - জোমাটো ডেলিভারির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারী) - এদের জন্য National Social Security Board তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যেখানে Aggregator অর্থাৎ যারা ওইধরনের শ্রমিক- কর্মচারীদের কাজে নিযুক্ত করে তাদের বার্ষিক Turn Over-এর ১-২% ওই বোর্ডের ফান্ডে টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু এর জন্য যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ফান্ড থাকবে সেখান থেকে কোনো অসংগঠিত শ্রমিককে সাহায্য পেতে হলে কিম্বা সরকারী কোনো কেরিয়ার সেন্টার থেকে কোনো সহায়তা পেতে হলে তাকে আগে নাম নথিভুক্ত করাতে হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে আধার নাম্বার যুক্ত করতে হবে যা দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী।

কেন এই পরিবর্তন?

কিসের তাগিদে রাতারাতি দেশের শ্রম আইনের মৌলিক বিষয় পালটে দিয়ে শ্রমজীবি মানুষের সমস্তরকমের আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হল? এই সর্বনাশা পরিবর্তনের পিছনের ইতিহাসটুকু জানা দরকার। আর দরকার সেই ইতিহাসের সলতে পাকানোর কাহিনি। ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস-এর নেতা রবীন্দ্র ভারমা-র নেতৃত্বে তদানীন্তন বাজপেয়ী সরকার দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন গঠন করে সংগঠিত শিল্পে শ্রম আইনের সংস্কার ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য জাতীয় স্তরে একটি আইন প্রণয়ন করবার লক্ষ্যে। ২০০২ সালে এই কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করে যেখানে চলতি শ্রম আইনগুলিকে একত্রিত করে ৫টি আইনে নিয়ে আসার কথা বলা হয় এবং কুড়ির নিচে শ্রমিক সংখ্যা আছে এমন ক্ষুদ্র সংস্থার জন্য পৃথক আইন চালু করার কথা বলা হয়। সেই সুপারিশ মেনে বর্তমান মোদী সরকার সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি আইনকে ৪টে শ্রম কোডে পরিণত করল অথচ ২০-র নিচে শ্রমিক সংখ্যার ক্ষুদ্র সংস্থার জন্য আইন প্রণয়ন তো দুরস্থান উলটে নয়া শ্রম কোডে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিকদের (৩০০ পর্যন্ত) সমস্তরকমের আইনি রক্ষাকবচ কেড়ে নেওয়া হয়েছে (আই.এল.ও-র তথ্য অনুযায়ী তাদের সদস্য দেশের মাত্র ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও ছোট সংস্থার শ্রমিকদের জন্য কোনো আইন নেই, বেশিরভাগ দেশই এই ধরনের সংস্থাকে শ্রম আইনের বাইরে রাখেনি)। আর এই কাজটা করা হয়েছে পুরোপুরি বেআইনি ভাবে এবং প্রচলিত সমস্ত রীতিনীতি ভঙ্গ করে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আই.এল.ও-র ১৪৪তম কনভেনশন (আমাদের দেশ যা অনুমোদন করেছে) অনুযায়ী আলোচনা ছাড়া শ্রম আইনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা যায় না। অথচ এই বেআইনি কাজটাই গায়ের জোরে করে ফেলা হল। আমাদের দেশে শ্রম সংক্রান্ত যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা আলোচনা করার একটি সর্বোচ্চ ফোরাম আছে যা Indian Labour Conference (ILC) নামে পরিচিত। ১৯৪২ সালে এই ILC-র প্রথম অধিবেশন হয় এবং দেশের শ্রম সংক্রান্ত যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখানে আলোচনা করা হয়। এখানে কেন্দ্র, রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি, ট্রেড ইউনিয়ন, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সকলের উপস্থিতিতে আলোচনা করে শ্রম সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে ২০১৫ সালে ৪৬তম অধিবেশনের পর আর কোনো ILC অধিবেশন হয়নি এবং এই ফোরামকে এড়িয়েই দেশের শ্রম আইনের খোলনলচে বদলে দেওয়া হল।

সলতেটা আসলে পাকছিল বিগত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে যখন এদেশে নয়া উদারনৈতিক আর্থিক সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। দেশের পুঁজিপতিরা, মালিকশ্রেণি, চাইছিল শ্রম আইন সংস্কার, যার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া যাবে, ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা খর্ব করা হবে, শ্রমিকদের আইনি রক্ষাকবচ সরিয়ে দিয়ে মালিকদের অবাধ লুঠতরাজ আর মুনাফার রাস্তা পরিষ্কার করা যাবে। নরসিংহ রাও সরকার আর্থিক সংস্কার শুরু করল, বাজপেয়ী সরকার শ্রম কমিশনের মাধ্যমে শ্রম আইন সংস্কারের কাজে হাত দিল, মাঝে মনমোহন সিংহের সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সংস্কার করলেও শ্রম আইন সংস্কার পুরোটা করে উঠতে পারেনি বামপন্থীদের চাপে। কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠ মোদী সরকারের হাত ধরে দেশের প্রায় সাত দশকের শ্রম আইনের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে শ্রম ও শিল্পক্ষেত্রের চিত্রটাই বদলে দেওয়া হল। নয়া শ্রম আইনের মধ্য দিয়ে পুঁজিপতি, মালিকশ্রেণির একচেটিয়া মুনাফার ক্ষেত্রে সমস্ত বাঁধা সরিয়ে দিয়ে, শ্রমিকদের মধ্যযুগীয় শোষণ-নিপীড়নের মুখে ঠেলে দেওয়া হল। দুঃখের বিষয় এটাই যে এই শ্রম আইন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিছক নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ আর একদিনের ধর্মঘট ডাকার মধ্যেই এখনো সীমাবদ্ধ যার মাধ্যমে সামনের সমূহ বিপদকে মোকাবিলা করা যাবে না। শিরে সর্পাঘাত হলে পায়ে বাঁধন দিলে যে কাজের কাজ কিছুই হবেনা এটা আর কবে বুঝবে এদেশের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো?