আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন

শৌভিক চক্রবর্তী


সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হল। অনেক পণ্ডিতের মতেই এই নির্বাচন আমাদের সময়কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এর প্রধান কারণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প একজন স্বৈরাচারী, এবং তাঁর এই সরকারের প্রধান পদাধিকারী থাকার দরুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোই বিপর্যয়ের সম্মুখে। এর সঙ্গে প্রচুর ক্ষতি এবং মূল্য সাধারণ মানুষদেরকেও বহন করতে হচ্ছে। তার প্রধান উদাহরণ হল যে এখন অবধি মার্কিন দেশে ২৪০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে করোনার জন্য যা এক কথায় বলতে গেলে অভাবনীয়। তাই, বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীরা এই নির্বাচনকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে ঘোষণা করেছিলন, এবং ট্রাম্প সরকারের পরাজয়ের আবেদন জানিয়েছিলেন। মার্কিন দেশের নির্বাচন শেষ হল এই নভেম্বর মাসের তিন তারিখ, এবং এখন অবধি বাইডেনকেই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংবাদমাধ্যম ঘোষণা করেছেন। এই নির্বাচনের কী তাৎপর্য এবং এর ফলাফল কেন এরকম হলো তা আমরা এখানে আলোচনা করব। কিন্তু, সেই আলোচনায় যাবার আগে পাঠকদের সুবিদার্থে মার্কিন নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি কী পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন, তা এখানে বলে রাখা ভালো।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি একটু জটিল। আমেরিকাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হয় ইলেক্টোরাল কলেজের ভিত্তিতে। কোন রাজ্য কটি ইলেক্টোরাল কলেজের অধিকারী হবে, তা নির্ধারিত হয় সেই রাজ্যের জনসংখ্যার নিরিখে। আমেরিকাতে মোট ৫৩৮-টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে। এই সংখ্যাটি এই ভাবে নির্ধারণ করা হয় - ৪৩৫-টি হলো কংগ্রেসের আসন, ১০০-টি সেনেটের আসন, এবং ৩-টি আসন ১৯৬১ সালে ২৩-তম সংশোধনের দ্বারা ওয়াশিংটন ডিসির জন্য বরাদ্দ করা হয়। অর্থাৎ, নির্বাচনে জিত নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থীকে অন্তত ২৭০-টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে জয়ী হতে হবে। এই ধরনের একটি ব্যবস্থা শুধুমাত্র যে জটিলই তা নয়, এই ব্যবস্থার মধ্যে কিছু বড় ত্রুটিও আছে।

প্রথমত, ধরা যাক, একজন প্রার্থী সারা দেশজুড়ে সবচেয়ে বেশি ভোট পেল, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি ইলেক্টোরাল কলেজেও ২৭০-টির বেশি আসন পাবেন। হতেই পারে গোটা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও, রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী যেই সব রাজ্যে ইলেক্টোরাল কলেজে বেশি আসন আছে, সেই সমস্ত রাজ্যে জয়লাভ করতে পারেননি। এবং, তাঁর ফলে উনি নির্বাচনে পরাজিত। এর উদাহরণ আমরা ২০১৬ সালেই দেখতে পাই। ডেমোক্র্যটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টন পপুলার ভোট অর্থাৎ জনপ্রিয় ভোটের দিক থেকে ২৮.৭ লক্ষ বেশি ভোট পেলেও, উনি ইলেক্টোরাল কলেজে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে কম আসন পান। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩০৬-টি ইলেক্টোরাল কলেজের আসনে জয়লাভ করেন, এবং হিলারি ক্লিন্টন মাত্র ২৩২-টি আসনে জয়লাভ করেন। অর্থাৎ, পপুলার ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও, হিলারি ক্লিন্টন পরাজিত হন, এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

দ্বিতীয়ত, ইলেক্টোরাল কলেজে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদেরও নিজেদের ভোট পরিবর্তন করার অধিকার আছে। কিন্তু এই ঘটনা খুবই দুর্লভ, এবং সচরাচর এর কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না। অবশ্য, সম্প্রতি ২০১৬-তে এর একটা ব্যতিক্রম হয়েছিল। ইলেক্টোরাল কলেজের অন্তত ছয় জন প্রতিনিধি তাঁদের ঐতিহ্য ভেঙে, তাঁদের রাজ্যের নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট দেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। ঐতিহাসিকভাবে, এরকম ঘটনা খুবই দুর্লভ এবং এর প্রভাবে ফলাফল উলটে গেছে এরকম কোনো নিদর্শনও নেই। কিন্তু, যেই ভাবেই দেখা যাক, এই পদ্ধতিটা খুবই জটিল। এবং, সম্প্রতিককালে এই পদ্ধতির প্রচুর সমালোচনা এবং বিরোধিতাও হচ্ছে। প্রধানত, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন জন-আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে এর প্রচুর সমালোচনা শোনা যায়। তাঁদের দাবি এই ইলেক্টোরাল কলেজের বদলে পপুলার ভোটের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়া উচিৎ। সে যাই হোক, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলও ইলেক্টোরাল কলেজের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতে চলেছে।

২০২০ মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল

নভেম্বর মাসের ৩ তারিখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যে ভোটদান শেষ হয়। সাধারণত, নির্বাচন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এই বছর তার ব্যতিক্রম ঘটে। কোভিড মহামারীর জন্য এক বড় সংখ্যার মানুষ ডাকের সাহায্যে নিজেদের ভোট দেন (মেল-ইন ব্যালট বা ভারতের পরিভাষায় পোস্টাল ব্যালট)। প্রচুর মানুষের এই ভোট ডাক কর্মীদের সাহায্যে নির্বাচনী গণনাকেন্দ্রে জমা হয়, এবং এর দরুন এই সকল ভোটকে নিয়মানুসারে ক্রসচেক করা হয়। এই জন্য, সমস্ত রাজ্যের নির্বাচনী আধিকারিকরাই আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলন যে এবার ভোটের ফলাফল প্রকাশ হতে অনেক বেশি সময় লাগতে পারে। ভোট কেন্দ্রে যেই ভোটদান হয় সেইটার ফল তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যায়, কিন্তু মেল-ইন ভোটের গণনা হতে অনেকটাই সময় লাগতে পারে। এবং, বাস্তবে তা ঘটেও।

এরই সুযোগ নিয়ে, ভোটগণনা চলাকালীনই এখনকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধি, ডোনাল্ড ট্রাম্প, সেইদিন রাতেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেন। যদিও, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ডেমোক্র্যটিক পার্টির এই বারের প্রতিনিধি, জো বাইডেন, রীতিমত তখনও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে কিছু রাজ্যে এগিয়ে। এর দ্বারা, প্রচুর বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

ভোট গণনা, এই প্রবন্ধ লেখার সময় (অর্থাৎ ১৩/১১/২০২০) কিছু রাজ্যে এখনো চলছে। ফলপ্রকাশও অনেক রাজ্যে চূড়ান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু, ফল চূড়ান্ত হওয়ার আগেই, রাষ্ট্রপতি কে নির্বাচিত হবে তা নির্ধারিত হয়ে যায়। এর কারণ হল চূড়ান্ত ফলপ্রকাশ হওয়ার আগেই, এই দেশের মিডিয়া সংস্থাগুলো ঘোষণা করে দিতে পারে যে কোন প্রার্থী কোন রাজ্যে জিততে চলেছেন। এবং, ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যা অতিক্রম করা মাত্রই তাঁরা পরবর্তী রাষ্ট্রপতির নাম সমগ্র দেশবাসীর কাছে জানিয়ে দেন। মার্কিন নির্বাচনের এই হল পরম্পরা। এ বছরও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৭ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর সংবাদমাধ্যমগুলো জো বাইডেন-কে অ্যামেরিকার ৪৬-তম রাষ্ট্রপতি এবং কমলা হ্যারিসকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে। যখন এই ঘোষণা করা হয়, তখন কিছু সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী বাইডেন ২৭৯-টি ইলেক্টোরাল কলেজে জয়লাভ করতে চলেছেন এবং অন্যদের মতে উনি ২৯০-টি ইলেক্টোরাল কলেজে জয়লাভ করতে চলেছেন। পপুলার ভোটেও বাইডেন ট্রাম্পের থেকে তখন ৫০ লক্ষ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। অর্থাৎ, ইলেক্টোরাল কলেজ এবং পপুলার ভোট দুটোর মাধ্যমেই জো বাইডেন জয়ী হয়েছেন।

সমগ্র দেশজুড়ে প্রধানত বড় শহরাঞ্চলে শুরু হয়ে যায় আনন্দোৎসব। বাইডেন সমর্থকরা এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কর্মীরা তাঁদের প্রিয় নেতার জয়লাভে চতুর্দিকে আনন্দ ও খুশির উৎসবে মেতে ওঠেন। যদিও, পরম্পরা অনুযায়ী পরাজিত প্রার্থী তাঁর বিজয়ী প্রতিনিধিকে ফোন করে হার মেনে নেন ও শুভেচ্ছা বার্তা জানান, এ বছর কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটে। ট্রাম্প এখনও অবধি তাঁর পরাজয় স্বীকার করেননি এবং এই নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই উনি মিথ্যা দোষারোপ করতে থাকেন যে এই নির্বাচনে ওনাকে প্রতারণা করে হারানো হয়েছে। প্রচুর রাজ্যে উনি আইনের সাহায্যে গণনা বন্ধ করার চেষ্টা করে চলেছেন এবং অনেক রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রকাশিত ফল মেনে নিতেও অস্বীকার করছেন। তাই, সেই অর্থে এই বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সত্যি বিরল। কিন্তু ট্রাম্পের এই ব্যবহার হয়ত তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারের তুলনায় ব্যতিক্রমী নয়; এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে উনি ২০২৪ সালেও আবার পদপ্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করছেন।

ফলাফলের বিশ্লেষণ

এখনই এই বছরের ফলাফলের পূর্ণ বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর নয়। এর প্রধান কারণ যা আগেও বলেছি যে গণনা এখনও চলছে। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারা খুবই কঠিন। এই বছর এরকম ফলাফল হওয়ার পেছনে কারণ কী তা কিছু এক্সিট পোলের তথ্যানুযায়ী এবং রাজনৈতিক আপাতদৃষ্টিতে যা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে, তাই তুলে ধরছি পাঠকদের জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই ফলাফলের সঠিক বিশ্লেষণ রাজনৈতিক কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এই সরকার কী নীতি গ্রহণ করবে তা অনেকটাই নির্ভরশীল এই সমস্ত তথ্য ও বিশ্লেষণের ওপর।

প্রথমত, এই ফলাফল থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকদের মধ্যে এবং আমেরিকান স্বতন্ত্র সাধারণ ভোটদাতাদের মধ্যেও। এটা স্পষ্ট কারণ আগের বারের ২০১৬ সালের তুলনায়, সংখ্যার হিসেবে ট্রাম্পের ভোট বেড়েছে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ভোট পেয়েছিলেন ৬.২ কোটি, এবং এখন অবধি ২০২০ সালে ট্রাম্প ভোটে পেয়েছেন ৭.২ কোটি। অর্থাৎ, এই ৪ বছরে ট্রাম্পের ভোটের সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ১ কোটি। আগের বার ট্রাম্প নির্বাচন জেতার পর অনেক পণ্ডিতই এই মতামত পোষণ করেছিলেন যে এই জয় একটি দুর্ঘটনা মাত্র। মানুষ ট্রাম্পের কথায় ভুল বুঝে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং, কিছু প্রগতিশীল সাংবাদিক এটাও বলেছিলেন যে ট্রাম্পের জয় সম্ভবপর হয়েছিল বিদেশী শক্তির সাহায্যে - প্রধানত তাঁরা রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। আশা করা যায় এই নির্বাচনের ফলাফলের পর তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন যে ট্রাম্পের মতন স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক নেতারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে, এবং তা একেবারেই আকস্মিক নয়। এর কারণ বুঝতে গেলে অনেক কথা বলা প্রয়োজন, যা এই একটি প্রবন্ধে হয়তো সম্ভবপর নয়। এইটুকু অবশ্য বোঝা যাচ্ছে যে এরপর হয়তো কেউ ট্রাম্পের জয়কে দুর্ঘটনা বা বৈদেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেবেন না।

দ্বিতীয়, ট্রাম্পের সমর্থক প্রধানত দেখা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরেই। বড় শহর এবং আশেপাশের শহরতলিতে এখনও ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তাই বেশি। এর একটা প্রধান কারণ হলো যে শহরাঞ্চলের মানুষেরা সাধারণত মিশ্র বাতাবরণে থাকেন যেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের মানুষ একই অঞ্চলে বসবাস করেন। এর ফলে, তাঁদের ওপর ট্রাম্পের জাতিবৈশিষ্ট্যবাদী বক্তব্যের প্রভাব কিছুটা হলেও কম। পার্শ্ববর্তী শহরাঞ্চলেও এই একই ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৮ সালে কংগ্রেসের ভোটের সময়ও দেখা যায় যে শহরতলিতে ডেমোক্র্যাটদের প্রভাব অনেকটাই বেশি। ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেন তাঁর প্রভাব আরও বাড়িয়ে ফেলেন, এবং ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিন্টনের তুলনায় ৪.৬ শতাংশ ভোট বেশি পান।

তৃতীয়ত, এখানে বলে রাখা ভালো যে শহরাঞ্চল এবং তাঁর আশেপাশের শহরতলিতে আফ্রিকান-আমেরিকান-দের সংখ্যা বেশি, এবং তাঁরা ট্রাম্পের রাজনীতির খুব একটা সমর্থক নয়। যদিও, এবার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে, অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা বাইডেনকেই তাঁদের সমর্থন জানান। তথ্য থেকে এও জানা যাচ্ছে যে শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের মধ্যে ২০২০ সালে ট্রাম্পের সমর্থন কিছুটা বাড়লেও, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে ট্রাম্পের ভোটের হার ৫ শতাংশ কমে গেছে। আমার ধারণা এর একটা প্রধান কারণ হল যে আগের বারে ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটদের একজন মহিলা প্রার্থী ছিলেন, এবং এই বছর একজন পুরুষ। অনুমান করা যেতেই পারে যে ২০১৬ সালে শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না। এই বছর অবশ্য তাঁদের ওই দ্বিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। এখনও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও খুব ভালো ভাবেই উপস্থিত। বাকি বর্ণের মানুষদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বাইডেন তাঁর সমর্থন অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন, বিশেষত হিস্পানিক এবং লাতিনো ভোটারদের মধ্যে। এর ফলে উনি ফ্লোরিডা রাজ্যে পরাজিত হন। না হলে, বাইডেনের জয় আরও অনেক বৃহত্তর হত।

চতুর্থ, শ্রেণির দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাইডেনের ভোট নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে ২০১৬ সালের থেকেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্সিট পোলের মতে বাইডেন তার ভোটের হার অনেকটাই বাড়িয়েছেন যাঁদের পারিবারিক বাৎসরিক আয় ১০০,০০০ ডলারের কম। অ্যামেরিকাতে ২০১৯ সালে, বাৎসরিক পারিবারিক মধ্যমা আয় হলো ৬৮,৭০৩ ডলার। বাইডেনের ভোটের হার ১১.০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১৬ সালের তুলনায় যাঁদের বছরে পারিবারিক রোজগার ৫০,০০০ থেকে ৯৯,৯৯৯ ডলারের মধ্যে, এবং ৩.৩ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন যাঁদের বছরে পারিবারিক রোজগার ৫০,০০০ ডলারের নিচে। অর্থাৎ, এই ধারণার কোনো তথ্যগত ভিত্তি নেই যে ট্রাম্পের জন্য গরীব মানুষ ভোট করেন। বরং ঠিক উলটোটারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তথ্য থেকে। ট্রাম্পের ভোটের সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় ৭.০ শতাংশ বেড়ে গেছে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ধনী শ্রেণির মানুষদের মধ্যে যাঁদের বছরে পারিবারিক আয় ১০০,০০০ ডলারের বেশি। এর দ্বারা একটা কথা স্পষ্টই বোঝা যায় যে রাজনৈতিকভাবে এই উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের এক বড় অংশের কাছে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন এবং ধনই প্রাধান্য পায়। এই চার বছরে, তাঁদের যে আর্থিক লাভ হয়েছে, সেই লাভকেই তাঁরা বাকি সমস্ত কিছুর ওপর বিবেচনা করে ট্রাম্পকেই তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন। অর্থাৎ, গরীব মানুষের আসল শ্রেণিশত্রু-কে তা এই নির্বাচন থেকে অনেকটাই স্পষ্ট এবং বিভ্রান্তির খুব একটা জায়গা নেই। ভবিষ্যতে বাম ও প্রগতিশীল রাজনীতির পথ নির্ধারণ করতে আশাকরি এই তথ্য সাহায্য করবে।

মার্কিন দেশে প্রগতিশীল রাজনীতি এবং তাঁর ভবিষ্যৎ

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সঙ্গে বহু রাজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট এবং কংগ্রেসের জন্যও ভোট হয়। প্রগতিশীল বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির নীতির জন্য যেই সব প্রার্থীরা লড়াই করেছিলেন তাঁরা বেশিরভাগই জয়লাভ করেছেন। এনাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো নিউ ইয়র্কের আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ, মিশিগানের রাশিদা তালিব, মিনেসোটার ইলহান ওমর, এবং ম্যাসাচুসেটস-এর আয়না সোয়িনী প্রেসলি।

ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে ওয়াশিংটনের প্রমিলা জয়পাল এবং ক্যালিফোর্নিয়ার রো খান্নাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রগতিশীল বিষয়সূচি নিয়ে প্রচার করে নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য। এনারা সকলেই মেডিকেয়ার-ফর-অল এবং ব্ল্যাক-লাইভস-ম্যটার এর সমর্থক। এই দুটো স্লোগানই এখন আমেরিকাতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিকভাবে - প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা এই দুই স্লোগানের পূর্ণ সমর্থন করছেন দেশজুড়ে। এই রাজনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আরও অনেক প্রগতিশীল প্রতিনিধিরা এই ভোটে জয়লাভ করেছেন - কোরি বুশ, জামাল বোমান, বনি কোলম্যান, পিটার দেফাযিও, মার্ক পোকান, এবং আরও অনেকে। এনারা সকলেই বার্ণি স্যাণ্ডার্সের নেতৃত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীল নীতি ব্যালটে ছিল যা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। ২২.০ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে ফ্লোরিডা রাজ্যে জয়লাভ করেছে প্রতি ঘণ্টায় ১৫ ডলার ন্যূনতম বেতনের দাবি। অ্যারিজোনা রাজ্যের ধনীদের ওপর সেই রাজ্যের মানুষ ৩.৫ শতাংশ কর বসানোর পক্ষে রায় দিয়েছেন, এবং এই অতিরিক্ত কর শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ করা হবে। কলোরাডো রাজ্যে একটি নীতি ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে যা শ্রমিকদের ১২ সপ্তাহের পূর্ণ বেতনের সাথে মেডিকাল এবং পরিবারের প্রয়োজনে ছুটির মঞ্জুর করেছে। এই সমস্তই ব্যলটে ছিল, এবং মানুষ এদের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন। এরকম আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া গেছে এই বছরের নির্বাচনে। এই ফলাফলগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর দ্বারা প্রমাণিত যে সঠিক নীতি নিয়ে মানুষের কাছে প্রচার করা গেলে, আমেরিকার মতন পুঁজিবাদী দেশেও প্রগতিশীল রাজনীতির ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।

বর্তমান পরিস্থিতি

আগেও বলেছি, এবং শেষেও মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি তাঁর হার মানতে অস্বীকার করছেন। এটি খুবই দুঃখজনক, যদিও আশ্চর্যজনক নয়। উনি প্রত্যেকদিন তাঁর পক্ষাবলম্বীদের এই মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন যে উনিই এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এর দ্বারা দুটি কঠিন সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক, পরবর্তী বাইডেন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা যা তথ্য এবং সাহায্য প্রয়োজনীয়, তার কোনো কিছুই তাঁরা পাচ্ছেন না। এখানে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে রাখা যে আমেরিকাতে এখন কোভিড একটা মহামারীর আকার নিয়েছে। প্রত্যেকদিন, ১৫০,০০০-এর বেশি রুগী কোভিড পজিটিভ ধরা পড়ছে। দ্বিতীয় কারণটিও একইমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের এই ভোটের ফলাফল না মানা এবং সারাক্ষণ কোনো প্রমাণ ছাড়া এই ভিত্তিহীন অভিযোগ করা যে এই নির্বাচনে জোচ্চুরি করে তাঁকে হারানো হয়েছে, এর ফলে মানুষ নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরেই আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। এই ভুল বার্তায় বিশ্বাস করে এক বড় সংখ্যার মানুষই গণতন্ত্র এবং ভোট ব্যবস্থার ওপর ক্রমশ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। এটা খুবই বিপজ্জনক দিকে এগিয়ে চলেছে। এর একটা ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে যে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপরেই মানুষ সম্পূর্ণরূপে আস্থা হারিয়ে ফেললো। এবং, এই আশঙ্কা পুরোপুরি ভিত্তিহীন নয়। একটা নিরীক্ষার তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্রের প্রতি অসন্তুষ্টি বেড়েই চলেছে। এবং, ট্রাম্পের এই বার্তা খুবই বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে দিতে পারে মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর।

অবশ্য, শেষে এও বলে রাখা ভালো যে এখনও আশার আলো আছে। কারণ, এই মহামারীর মধ্যেও ১৬.১ কোটি মানুষ এই বছর ভোট দিয়েছেন - ঐতিহাসিক ভাবে এখন অবধি সবচেয়ে বেশি। তাই, এখনও প্রগতিশীল এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।