আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ফ্রেড্‌রিখ্‌ এঙ্গেল্‌স ও আধুনিক বিজ্ঞান

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়


(১)

আগামী ২৮ নভেম্বর ২০২০, ফ্রেড্‌রিখ্‌ এঙ্গেল্‌সের জন্মের ২০০ বছর পূর্ণ হবে। ঠিক দু’বছর আগে আমরা কার্ল মার্ক্‌সের দ্বিতীয় জন্ম-শতাব্দী গভীর উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করেছি। কোভিড-১৯ মহামারী-বিদ্ধস্ত ২০২০ সালে, এঙ্গেল্‌সের বেলায় তেমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু তাঁর জন্মের দ্বিশতাব্দী পালনের প্রস্তুতি পর্বেও তেমন উদ্দীপনা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এটা ঠিক, মার্ক্সবাদের মূল আবিষ্কর্তা হলেন কার্ল মার্কস্‌ ও সেই জন্যই তাঁকে গত সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ মনীষী বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু, এই মতবাদকে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিশ্ছিদ্র (self consistent and complete) রূপ দিতে এঙ্গেল্‌স্‌ও যে এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেন, সে কথা কেউ অস্বীকার করবে না। তাঁর নিজের অবদানের কথা বিচার করতে গিয়ে এঙ্গেল্‌স্‌ লেখেন যে ওই মতবাদ আবিষ্কারের বেলায়, তাঁরও কিছু কৃতিত্ব আছে, কিন্তু ‘‘আমার যেটুকু স্বকীয় অবদান আছে, সেটুকু মার্কস্‌ নিজেই করে যেতে পারতেন, কিন্তু মার্কস্‌ যা করে গিয়েছেন, তা আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না”।

১৮২০ সালের ২৮ নভেম্বর তারিখে ফ্রেড্‌রিখ্‌ এঙ্গেল্‌স্ রাইনলান্ড অঞ্চলের (বর্তমান জর্মনি, ১৮২২ সালে এই অঞ্চল প্রুশিয়া রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়) বারমেন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময় জর্মনি ছিল শিল্পে অনুন্নত। কিছুটা আধুনিক শিল্প এই রাইনল্যান্ডেই, রাইন নদীর পূর্বতটে স্থাপিত হয়েছিল। এঙ্গেল্‌সের পরিবার ছিল এক বস্ত্র শিল্পোদ্যোগের অংশীদার-পুজিঁপতি। এই শহর রাইন নদীর পূর্বতটে, আর উলটোদিকে পশ্চিমতীর হল ফ্রান্সে। উল্লেখনীয়, কার্ল মার্কস্-এরও এই রাইনল্যান্ডেই ট্রিয়ের শহরে ৫ মে ১৮১৮ তারিখে জন্ম হয়, অর্থাৎ এঙ্গেল্‌সের জন্মের আড়াই বছর আগে।

এঙ্গেল্‌সের পরিবার শুধু ধনীই ছিল, তাই নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকেও ছিল গোঁড়া, রক্ষণশীল। কিন্তু এই রাইনল্যান্ডেই শিল্প স্থাপনের দরুন একদিকে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে লাগল, তেমনি সন্নিকটস্থ ফ্রান্স থেকে গণতান্ত্রিক চিন্তারও প্রবেশ ঘটল। এই চিন্তাধারা যুবা সম্প্রদায়কে খুবই প্রভাবিত করে। ফ্রেড্‌রিখ্‌ এঙ্গেলেস্‌ও এই চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন ও আলোচনা সভায় যোগ দিতে থাকেন। এঙ্গেল্‌সের রাজভক্ত পরিবার এটাকে ভাল নজরে দেখল না। উঠতি বয়সী ছেলেকে এই অবাঞ্ছিত রাজতন্ত্র বিরোধী, গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দূরে রাখতে তাঁরা ফ্রেড্‌রিখ্‌কে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে, পারিবারিক কোম্পানি ‘‘এরমেন ও এঙ্গেল্‌স’’-এর আপিসে পাঠিয়ে দিলেন, ব্যাবসার কাজ শিখতে।

ফ্রেড্‌রিখ্‌ এঙ্গেল্‌স্ ইংল্যান্ডে এলেন ১৮৪২ সালে, ২২ বছর বয়সে। সারাদিন আপিসে বসে, ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজ অনেক অধ্যবসায়ের সঙ্গে খুঁটিয়ে তিনি শিখে ফেললেন। শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর কখনই কোনো গাফিলতি ছিল না, এক্ষেত্রেও কোনো ফাঁক ছিল না। এইভাবেই তিনি শিখে ফেললেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও তার উৎপাদন এবং ব্যাবসা পদ্ধতির গোড়ার কথা, যা পরে মার্ক্‌সের গবেষণায় সহায়ক হয়, যা পরে মার্কস্‌ নানাভাবে সমৃদ্ধ করে নতুন জ্ঞানের দ্বার খুলে দেন, ও সেই জ্ঞান মানবসমাজকে নতুন আলোর সন্ধান দেয়।

এ ছাড়া এঙ্গেল্‌স্‌ ছিলেন বহু ভাষা জ্ঞানসম্পন্ন। ইউরোপ ও এশিয়ার ১৮টি ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন, শেখেন একের পর এক। তাঁর অতিথিদের সঙ্গে তিনি ওই অতিথির মাতৃভাষাতেই কথা বলতেন। একবার মার্কস্‌কে লেখা চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন যে তিনি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরবী ও ফার্সি ভাষায় নিজেকে রপ্ত করে নেবেন। তার বহু বছর পর, পারস্য থেকে এক অতিথি এলেন, এঙ্গেল্‌সের সঙ্গে দেখা করতে। সবাই ভাবছেন, দেখি এঙ্গেল্‌স্‌ এবার কী ভাষায় কথা বলেন। সবাইকে এমনকি নবাগত ওই ফার্সি ভাষী অতিথিকেও বিস্মিত করে এঙ্গেল্‌স্‌ তাঁর সঙ্গে পরিষ্কার ফার্সি ভাষাতেই আলোচনা করলেন, যে ভাষায় এঙ্গেল্‌স্‌কে কথা বলতে, আগে কেউই শোনেনি।

ম্যাঞ্চেস্টারে, দুই বছর শিক্ষানবিশির সময় আপিসে বসে এঙ্গেল্‌স্‌ অনেক পরিশ্রম করতেন বটে, তবে ছুটির পর যুবক এঙ্গেল্‌সের জীবন ছিল অন্য রকম। তাঁর পরিচয় হয় মেরি ব্রাউন নামে আইরিশ এক যুবতীর সঙ্গে যিনি হয়ে ওঠেন এঙ্গেল্‌সের জীবন সঙ্গীনী।এই মেরি ব্রাউন ছিলেন শ্রমিক পরিবারের মেয়ে ও তিনিই এঙ্গেল্‌স্‌কে নিয়ে যান শ্রমিক বস্তিতে, যা এঙ্গেল্‌সের চোখ খুলে দেয়। এঙ্গেল্‌স্‌ নিজেই লিখেছেন,‘‘আমি মধ্যবিত্তদের পোর্ট-ওয়াইন ও শ্যাম্পেন-যোগে সান্ধ্য পার্টি পরিহার করে চলতাম; আমার অবসর সময়ের পুরোটাই আমি শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে মেলামেশা করে কাটাতাম।’’

১৮৪৪ সালের আগস্ট মাসে দেশে ফেরার পথে, প্যারিসে কার্ল মার্কসের সঙ্গে যখন এঙ্গেল্‌সের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটল, এঙ্গেল্‌স্‌ তাঁকে ইংল্যান্ড সম্পর্কে বিশ্লেষণ পড়ে শোনালেন। মার্কস্‌, শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, বললেন - এই লেখা শীঘ্রই ছাপাতে হবে। বারমেনে ফিরে এই খসড়াকে এঙ্গেল্‌স্‌ আরও সমৃদ্ধ করেন। মার্কস্‌কে তিনি এক চিঠিতে লেখেন ‘‘আমি পর্বত-প্রমাণ বই পুঁথি ও ইংল্যান্ডের খবরের কাগজ নিয়ে লিখতে বসেছি।’’ এই লেখাই পুস্তকাকারে ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত হল, শিরোনাম- ‘‘ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা,’’ শ্রেণি শব্দটি প্রণিধানযোগ্য। এই বইতে, ইংল্যান্ডে তিনি যা দেখেছেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এঙ্গেল্‌স্‌ দিয়েছেনঃ কারখানার অবস্থা, যন্ত্রের ব্যবহার, শ্রমিকের দারিদ্র, তাঁদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যাপারে পুঁজিপতিদের চরম অবহেলা, টাইফাস মহামারীর প্রকোপে মৃত্যু, নারী ও শিশুর জীবন ও দুর্দশা, আইন-শৃঙ্খলার অরাজক পরিস্থিতি - খুন, চুরি-ডাকাতি, বদমায়েশি, মাতলামি-মদ্যাসক্তি, পতিতাবৃত্তি সহ নানান অপরাধের আখড়া ছিল এই শ্রমিক বস্তি-অঞ্চল। এ সবের বর্ণনা চার্ল্স ডিকেন্সের লেখায় পাবেন, আর পাবেন রবীন্দ্রনাথের ‘‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’’ পড়লে। এই ভাবেই বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নের প্রক্রিয়া এঙ্গেল্‌সের শুরু হয় এবং তাকে তিনি আয়ত্ত করেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে। এই বই জুড়ে আছে, ফিল্ড ওয়ার্কের সঙ্গে পরিসংখ্যানের ব্যবহার, যার প্রশংসা মার্কস্‌ করে গেছেন। এই বইতে আরো একটি জিনিস পাবেন, তা হল এঙ্গেল্‌সের নিজের হাতে আঁকা কিছু ছবি।

লেনিনের মতে, ইংল্যান্ডে আসার আগে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এঙ্গঁল্‌সের আগ্রহ ছিল অস্পষ্ট, তারপরই তিনি ধাপে ধাপে এগোতে থাকেন। পুলিশ ও গুপ্তচরদের এড়িয়ে তিনি প্রুশিয়ার নানান জায়গায় বক্তৃতা দেন। ১৮৪৫ সালে ব্রুসেল্‌সে তাঁর সঙ্গে মার্ক্‌সের আবার যখন দেখা হল, এঙ্গেল্‌স বলেন যে ততদিনে মার্ক্‌স বস্তুবাদের ভিত্তিতে মানব ইতিহাস ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ভিত্তি প্রায় তৈরি করে ফেলেছেন। এরপর কয়েক বছর মার্ক্‌স ও এঙ্গেল্‌স্‌ নানান তাত্ত্বিক বিতর্কে অংশ নেন, সাংগঠনিক বিষয়ে নেতৃত্ব দেন। এই সবই করতে হয় গোপনে, সরকারের চোখ এড়িয়ে। কিন্তু এত সতর্কতা সত্ত্বেও নানান সরকারের কাছে তাঁরা নির্যাতিত হয়ে চললেন বারবার। পুলিশি তল্লাসি চালিয়ে তাঁদের সম্পাদিত কাগজ বাজেয়াপ্ত হতে লাগল।

অবশেষে ১৮৪৮ সালে ইউরোপের নানান অংশে শ্রমিক বিদ্রোহ ফেটে উঠল। এই সময়েই মার্ক্‌স্‌ ও এঙ্গেল্‌স্‌ লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত ‘‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’’ (ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮)। এই অভ্যুত্থান নানান জায়গায় সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ নেয়; বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধক্ষেত্রের নেতৃত্ব দেন এঙ্গেল্‌স্‌ নিজে।

এই অভ্যুত্থান পরাজিত হল। কার্ল মার্কস্‌কে বেলজিয়াম সরকার নির্বাসিত করল, ফ্রান্সও তাঁকে বসবাসের অনুমতি দিল না। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কা হল এই, তাঁর নিজের দেশ প্রুশিয়া মার্ক্‌সের নাগরিকত্ব বাজেয়াপ্ত করে নিল। অবশেষে নাগরিকত্বহীন, কপর্দকহীন, দারিদ্রক্লিষ্ট কার্ল্‌ মার্কস্‌ ১৮৪৯ সালে ইংল্যান্ডে বসবাসের অনুমতি পেলেন। এঙ্গেল্‌স্‌ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে দর কষাকষি করে ওই ‘‘এরমেন ও এঙ্গেল্‌স্’’ কোম্পানির ম্যাঞ্চেস্টার আপিসে জুনিয়র কেরানি হিসাবে যোগ দিলেন। এই কোম্পানিতে ১৮৫১ থেকে ১৮৬৯ অবধি কাজ করার পর, এঙ্গেল্‌স্‌ স্বেচ্ছা অবসর নেন। সারা জীবন তাঁর আয়ের ও পেন্‌সনের টাকা তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর নিজের পরিবার অর্থাৎ মেরি ব্রাউনেরও, মার্ক্‌সের পরিবার ও অন্যান্য অনেক বিপ্লবীদের ভরণ-পোষণের কল্পে।

আবার ফেরা যাক সেই গোড়ায়। ইংল্যান্ডে তাঁর প্রথম প্রবাসকালে (১৮৪২-৪৪) এঙ্গেল্‌স কী দেখেছিলেন? শ্রমিক জীবনের দুর্দশার পাশাপাশি তিনি দেখলেন কীভাবে পুঁজিপতির মুনাফা বৃদ্ধি হয়। এই পরিস্থিতির উৎপত্তি কীভাবে হল, সেটা বুঝতে এঙ্গেল্‌স্‌ শিল্প- বিপ্লবের পূর্বেকার ইতিহাস অধ্যয়ন করে বলেন, ‘‘সেই সময়কার উদ্দমহীন জীবন মানবজীবনের উপযুক্ত ছিল না, চিন্তার জগৎ ছিল মৃত। আজ থেকে ৬০ বা ৮০ বছর আগে ইংল্যান্ডের জীবনে কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না। ছিল, অন্যান্য দেশেরই মত, ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র-কারিগরি সম্পন্ন ছোট শহর, এছাড়া সবাই কৃষিজীবী। কিন্তু আজ কোনো দেশই ইংল্যান্ডের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তার রাজধানীর জনসংখ্যা হল ২৫ লক্ষ। এই শিল্পোদ্দ্যোগের বিকাশে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়টি হল, শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব।’’


(২)

যেটা এঙ্গেল্‌সের নজর এড়ায় নি, সেটা হল এই যে এই আমূল পরিবর্তনের পিছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রথমে, সুতো কাটার বেলায় চরকার সঙ্গে, ১৭৬৪-৬৫ সালে যুক্ত হল ‘‘জেনি’’ যন্ত্র, যার দ্বারা ১৬ থেকে ১৮টি ববিন (bobbin, লাটাই) ও তকলিকে (spindle) একই সঙ্গে চালিয়ে সুতো কাটা সম্ভব হয়ে উঠল। চরকায়, একটা হাতে চাকা ঘোরাতে হয় আর অন্য হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে টেনে, তুলোর গোলা থেকে সুতোকে বার করতে হয় ও ক্রমে সেই সুতো ববিনে গুটিয়ে যাবে। কিন্তু এবার যখন ‘‘জেনির’’ সাহায্যে ১৬ থেকে ১৮ টি তুলোর গোলা থেকে (আমাদের তো আর রাবণের মত কুড়িটা বা দুর্গার মত দশটা হাত নেই) সুতো টেনে বার করা সম্ভব হয়ে উঠল, তখন একটা হাত চরকার চাকা চালাতে ব্যবহার করা হল, আর অন্য হাতটা খালিই রইল। সেই হাতটি পেল বিশ্রাম। পরে এই হাতটি দিয়ে চরকা চালান হল, অন্যটিকে দেওয়া হল বিশ্রাম। অতএব সর্বক্ষণই চাকা চলল দ্রুত বেগে। এঙ্গেল্‌স্‌ দেখলেন যে এইভাবে জেনির সঙ্গে মোকাবিলায় ছোট তাঁতি-জোলা সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আগে এই জোলারাই কিছু সময়, অর্থাৎ পার্ট টাইম চাষ-বাষও করতেন। কিন্তু এই নতুন মেশিনের আক্রমণে তাঁরা হেরে গিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়লেন। লেবার-টাইম বাঁচিয়ে তৈরি, এই সস্তা কাপড় একদিন বাংলায় পৌঁছল, তারপর বাংলার অদৃষ্টে যা ঘটল, তার আলোচনাও অনেকেই করেছেন।

যন্ত্রের এই ‘‘আক্রমণ’’ এরপর বহুগুন শক্তি নিয়ে এসে এই হস্ত-চালিত ‘‘জেনি’’ কেও ধ্বংস করল। এবার আর হাতে চালান যন্ত্র নয়, এল জেম্‌স্‌ ওয়াট্‌ নির্মিত বাষ্পচালিত স্টিম ইঞ্জিন (steam engine)। বস্ত্রশিল্পে এই ইঞ্জিনই ঘোরাতে লাগল অসংখ্য তকলি। মানুষের শ্রম হয়ে গেল বহুলাংশে অপাংক্তেয়। তার ফল কি যে হল, সেটা এঙ্গেল্‌স্‌ উদ্ধৃত ইংরাজি কবিতার লাইন থেকেই বোঝা যায়।

The Steam King

‘‘There is a King, and a ruthless King,
Not a King of poet’s dream.
But a tyrant fell, white slaves know so well,
And that ruthless King is steam.’’


এতদিন ইংল্যান্ডের মানুষ কৃষাঙ্গদেরই ক্রীতদাস বলে জানত, কিন্তু আজ কিনা শ্বেতাঙ্গরাও এই অত্যাচারী স্টিম-কিং-এর শাসনে ক্রীতদাসত্ব করছে, আর ওই অত্যাচারী tyrant, বার বার পিস্টন (piston) ফেলে তাদের বাড়ি মারছে!

অতএব বহু মানুষের চোখে যন্ত্রই হয়ে দাঁড়াল যক্ষপুরীর রাজা। কিন্তু সেটাই কি পূর্ণ চিত্র? ওই বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি একটি অন্য ব্যাখ্যাও দিল, ‘‘একদিকে মেশিনকে আমরা পূঁজিপতিদের এই ক্রূর অত্যাচারের অতি শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে দেখতে পাই; কিন্তু অন্যদিকে যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ দ্বারাই স্বতন্ত্র বাস্তব পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারব, যার দ্বারা আমরা শ্রমিক সমাজকে এই বেতন-উৎপাদন (wages-production system) শৃঙ্খলের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হব।’’

অতএব, যন্ত্র-বিনাশও নয় বা ‘‘নমো যন্ত্র’’ বলে তার স্তুতিও নয়। এই শিল্পায়ন প্রক্রিয়া এঙ্গেল্‌স খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত ‘‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’’ যা মার্ক্‌স ও এঙ্গেল্‌সের যুগ্ম প্রয়াসে রচিত হয়েছিল, তার একটি পরিচ্ছেদে দেখতে পাইঃ ‘‘বুর্জোয়া এই এক শতাব্দীরও কম শাসনকালে এমন এক উৎপাদন ক্ষমতার স্থাপনা করেছে, যা বহু শতাব্দী জুড়েও সম্ভব হয় নি। প্রকৃতিকে সে বশে এনেছে, যন্ত্রের উদ্ভব ঘটিয়েছে, কারিগরী শিল্পোদ্দ্যোগে ও কৃষি ক্ষেত্রে রসায়ন বিজ্ঞানের প্রয়োগ সাধন করেছে; করেছে নদীতে, পুরো জনসমাজকে যেন মন্ত্রবলে মাটি ভেদ করে বার করে এনেছে-যেখানে কিনা পূর্বতন শতাব্দীতে এই বিপুল উৎপাদন শক্তি (productive forces) সামাজিক শ্রমের (social labour) কোলে সুখ নিদ্রায় ঘুমিয়ে কাটাচ্ছিল?’’ পড়ে দেখুন, এই বিশ্লেষণ এঙ্গেল্‌সের ওই উপরোক্ত, ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে পাবেন।

পরবর্তীকালে এঙ্গেল্‌স্‌ এই স্টিম ইঞ্জিনের উদ্ভাবনের ইতিহাস খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি বলেন যে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। প্রথম উদ্ভাবন হল ফ্রান্সে, পরে সেই জ্ঞান পৌঁছল জর্মনিতে ও তারপর ইংল্যান্ডে সে পূর্ণতা পেল। এঙ্গেল্‌স্‌ দেখলেন যে এই উদ্ভাবন ছিল সম্পূর্ণভাবে কারিগরি উদ্ভাবনার দ্বারা তাড়িত ও তারই প্রয়োজনে বলবিদ্যা (mechanics) ও তাপবিদ্যার (heat and thermodynamics) মধ্যে এক বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক স্থাপিত করে। এই কাজ সম্পন্ন করতে এঙ্গেল্‌স্‌কে জোসেফ ফ্যুরিয়র (Joseph Fourier) সাদি কারনো (Sadi Carnot), রুডল্‌ফ্‌ ক্লাউসিয়স (Rudolf Claussius), হেরমান হেলম্‌হোল্‌ট্‌স্‌ (Hermann Helmholtz), জেমস্‌ ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল্‌ (James Clerk Maxwell) - আদির বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গবেষণাও অধ্যয়ন করতে হয় ও তাঁদের উদ্ধৃতিও তিনি দেন।

পূঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়া ও তার সমালোচনা (critique) উপস্থাপনা করতে মার্ক্‌স্‌ ও এঙ্গেল্‌স্‌ নানা বিষয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা করেন ও নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেন। এঙ্গেল্‌স্‌ নিলেন প্রকৃতি বিজ্ঞান (natural science) মার্ক্‌স্‌ নেন গণিতের ভার। ১৮৬০ ও ১৮৬৩ তে লেখা দুটি চিঠিতে তাঁর প্রিয় ‘‘জেনারেল’’ কে সম্বোধন করে মার্ক্‌স্‌ মোটামুটি ভাবে বলেন,‘‘আপনি আর্টিকেল চেয়েছেন। সেটা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি Differential ও Integral calculus শিখতে ব্যস্ত ও ওই বিষয়ে পড়ার ও শেখার প্রচুর জিনিস জমে উঠেছে। আমার পরামর্শ, আপনিও এই বিষয়গুলি আয়ত্ত্ব করুন। মিলিটারি বিষয়ে, আপনার অধ্যয়নে এই বিষয় দুটি অপরিহার্য। এই ‘‘জেনারেল’’ কে? সেই খটকা হয়ত লেগেছে। তাঁর কমরেডরা এঙ্গেল্‌স্‌কে ‘‘জেনারেল’’ বলেই ডাকতেন। আগেই বলেছি, ১৮৪৮-৪৯ এ নানান অভ্যুত্থানে তিনি শ্রমিক দলগুলিকে মিলিটারি নেতৃত্ব দেন। তিনি নিজেও ছিলেন এক সুদক্ষ গানার (gunner) ও কমান্ডার। প্রুশিয়ার বাডেনের মিলিটারি সংঘর্ষে, অন্য সকলকে স্থানান্তরিত করার পর, তবেই এঙ্গেল্‌স্‌ নিজে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়েন। এই লড়াইেয়ে পরাজয় হল ঠিকই তবে এঙ্গেল্‌সের সঠিক স্ট্রাটেজির জন্য অনেকের প্রাণ রক্ষা পায় ও আহতদের বাঁচান সম্ভব হয়।

ইউরোপে এই অভ্যুত্থানের প্রায় দশ বছর পর, ১৮৫৭ তে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের (ইংরেজরা বলে ‘‘সিপাহী বিদ্রোহ’’) রণাঙ্গণের বিশ্লেষণ এঙ্গেল্‌স্‌ করে গেছেন। বিশেষ করে লখ্‌নৌর রণক্ষেত্রের আলোচনা পড়ে দেখুন, মনে হবে যেন প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট, নাকি সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টি! সামরিক বিষয়ে calculus-এর ব্যবহার প্রথম হয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যা আজ Lanchester Differential Model নামে খ্যাত ও এরপর বহু মডেল তৈরী হয়েছে যাদের বলা হয়, Differential Combat Models। এই সবই হয় মার্ক্‌স্‌ ও এঙ্গেল্‌সের মৃত্যুর কয়েক দশক পরে। উপরে, মার্ক্‌সের চিঠি দেখে বোঝা যায় যে বিজ্ঞানের নানান শাখার তাৎপর্য তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন ও পথ-নির্ঘন্টের আভাসও কিছুটা পেয়েছিলেন।


(৩)

বেশ কয়েক বছর ছেদ পড়ার পর এঙ্গেল্‌স্‌ একক ভাবে আবার লিখতে থাকেন মোটামুটিভাবে ১৮৭৬ সাল থেকে। এর মাঝে তিনি মার্ক্‌স্‌কে নানান তাত্ত্বিক কাজে সহায়তা করেছেন; ক্যাপিটালের প্রথম খন্ড সম্পাদনা করে প্রকাশ করতেও সাহায্য করেন। ১৮৭৬ সাল থেকে ১৮৭৮ অবধি লেখা প্রবন্ধগুলি, ‘‘ড্যুহরিং-এর মতবাদের বিরোধে’’ (Anti-Dühring)। বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে গভীর আলোচনা এই বইতে পাওয়া যাবে। এই বইটির বিষয়ে লেনিন বলেন যে এটি হল বিপ্লববাদ ও সমাজতন্ত্র শিক্ষা বিষয়ে এক অত্যুত্তম পাঠ্য পুস্তক।

সেই সময় অয়গেন ড্যুহরিং (Eugen Dühring) নামে এক জর্মন বুদ্ধিজীবী প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। আপাতদৃষ্টিতে তিনি বস্তুবাদী হলেও Eugen Dühring-এর মতবাদ ছিল অ-ঐতিহাসিক (ahistoric) ও বিল্পব বিরোধী। ক্ষুরধার বিশ্লেষণের দ্বারা, এঙ্গেল্‌স্‌ ড্যুহরিংবাদকে ব্যবচ্ছেদ করে তার অসারতা প্রমাণ করেন। এই বইয়ের সারমর্ম এক সংক্ষিপ্ত নির্যাস আকারে পাওয়া যাবে এঙ্গেল্‌সের পরবর্ত্তী এক গ্রন্থে, যার নাম ‘‘সমাজবাদ - কল্পিত ও বৈজ্ঞানিক’’ (Socialism - Utopian and Scientific) যার প্রকাশকাল ১৮৮০ সাল। এই বইতে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব, ইতিহাসের পরকাষ্ঠায় বিচার করা হয়। বড় কথা, এখানেই দেখান হল যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি হল মূলত সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। মানুষের চিন্তার জগৎ-ও সমাজে তার বাস্তব অবস্থা ও অবস্থানের দ্বারা নির্ণীত হয়। এবং, এইসবই হল সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস দ্বারা প্রভাবিত। সেই কারণেই দাস-ব্যবস্থা আধারিত প্রাচীন গ্রীক সমাজে কোনো বাস্তব পরীক্ষা উদ্ভূত বিজ্ঞান (empirical science) ছিল না। কায়িক শ্রম যেখানে সহজলভ্য (ক্রীতদাসের শ্রম) ও অবহেলিত, সেখানে শ্রম-বিমুখ দাস-প্রভুরা বিলাসিতায় জীবন কাটাতেন। বিজ্ঞান তাই মনগড়া কল্প-চিন্তাতেই থেমে গেল।

অবশ্য, তাঁদের হাতে এই অবসর থাকার ফলে অন্যদের empirical science কে তাঁরা যুক্তিগতভাবে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন। এই অবদান কিন্তু অতি মূল্যবান। কিন্তু তার বেশি ওই বিজ্ঞান আর অগ্রসর হতে পারল না। সেই ক্ষমতা তার ছিল না ও অর্জনও করতে পারেনি, ওই শ্রমবিমুখতার দরুন।

এরপরই মানব ইতিহাসে ঘনিয়ে এল এক গতিহীনতা, যাকে বলি অন্ধকার যুগ। তার অবসান ঘটল প্রায় দেড় হাজার বছর পর কোপার্নিকান বিপ্লবে (Copernican Revolution)। এই সম্পর্কে এঙ্গেল্‌স্‌ বলেন, ‘‘ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রকৃত প্রাকৃতিক-বিজ্ঞানের জন্ম হল ও তারপর থেকে তার গতি হয়ে উঠল ক্রম-বর্ধমান।’’ শুধু যে প্রকৃতি-বিজ্ঞান জন্মলাভ করল তাই নয়, দর্শনের আঙ্গিনায় সুনিশ্চিত, যুক্তিগত ও বাস্তবে পরীক্ষিত বস্তুবাদ এগিয়ে চলল। এই বস্তুবাদী দর্শনের সূচনা করেন, আধুনিক যুগে ফ্রান্সিস্‌ বেকন, জন লোক্‌, টমাস হব্‌স্‌, ক্রিশ্চিয়ান ভোলফ্‌। প্রাচীন গ্রীক বা ভারতীয় বস্তুবাদী দার্শনিকদের হাতে পরীক্ষিত প্রমাণ ছিল না, তাই তাঁদের মতবাদ বেশীদূর অগ্রসর হতে পারে নি। কোপার্নিকান বিপ্লব সেই রাস্তা খুলে দিল। এল নিউটন প্রবর্তিত, বিজ্ঞানে সর্বসিদ্ধতার (universality) সূচনা, অর্থাৎ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার নিয়ম, অবলোকনকারী (observer) নির্বিশেষে এক ও অভিন্ন - সেটা আমার বেলায়, আপনার বেলায় বা বিরিঞ্চি বাবা ও বাবা রামদেবের বেলায় একই। সেই কারণেই, নিউটনের বলবিদ্যার ও মাধ্যাকর্ষণের সূত্র ধরে, গ্রহ সমূহের কক্ষপথের ব্যাখ্যা যেমন পাই (এগুলি হল কেপলারের সূত্র) তেমনই চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের দরুন সমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটার সঠিক ব্যাখ্যাও পাই, যা উপস্থাপনা করেন, পিয়্যের-সিঁম-লাপ্লাস (Piere-Simon Laplace)।

এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। উইলিয়াম হেরশেল (William Herschel) ও তাঁর বোন ক্যারলিন (Caroline Herschel) ১৭৭০-র পর প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবৎ ছোটবড় নানান সাইজের দূরবীন তৈরি করে, আকাশ-জরিপের কাজ (sky survey) চালালেন। তাঁরা আবিষ্কার করলেন নানান ধূমকেতু (comet) জোড়া-নক্ষত্র (binary stars or double stars) ও ইউরেনাস গ্রহ। দেখা গেল যে এই জোড়া নক্ষত্রও একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে, সেই কেপলারের সূত্র অনুসরণ করেই।

পরে অবশ্য দেখা গেল যে ইউরেনাসের কক্ষপথের রেখা কেপলারের সূত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। ফাঁক থাকছে সামান্য, কিন্তু সেটাই বা কেন? ১৮৪০-এর দশকে লে ভেরিয়ার (Urbain Le Verrier) প্রমুখ বিজ্ঞানীরা বললেন, হয়তো বা অদৃশ্য কোনো এক গ্রহের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবেই এমনটি ঘটছে। সেই অনুসারে চলল, অনেক সূক্ষ্ণ হিসাব (calculation)। অবশেষে, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬, বার্লিন মানমন্দির (observatory) দেখতে পেল নেপচুনকে, প্রায় ওই লেভেরিয়ার নির্দেশিত অবস্থানেই।

আবার হেরশেলই ছাপালেন বহু নক্ষত্রপুঞ্জর (star clusters) ও নেবুলা (nebula বা ধুমপুঞ্জ)-র ক্যাটালগ। আমাদের ছায়াপথ নীহারিকা (Milky Way Galaxy) যে অসংখ্য তারা দিয়ে গঠিত (আমরা জানি, আমাদের এই ছায়াপথে রয়েছে ১০১০-১০১১ নক্ষত্র) তার চাক্ষুষ প্রমাণ গালিলিও দূরবীন ব্যবহার করে ১৬০৯ সালে দেন। এইবার, উনবিংশ শতাব্দীতে ইম্মানুয়েল কান্ট্ (Immanuel Kant) প্রশ্ন তুললেন, ‘‘আমরা ছাড়াও অন্য গ্যালাক্সিও তো থাকতে পারে। থাকতে পারে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড-দ্বীপ সমূহ।’’

এই সব বিষয়েই এঙ্গেল্‌স্‌ গভীরভাবে অবগত ছিলেন। তিনি বললেন যে এরই দ্বারা বস্তুবাদের (materialism) পক্ষে অসংখ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগৃহীত হয়ে চলেছে। এইভাবেই, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের নিয়ে চলেছে ব্রহ্মাণ্ডের নানান কোণায় ও বিশ্বরূপ দেখিয়ে চলেছে, কানায় কানায় ভরে।


(৪)

উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের শিল্প-বিপ্লব বিজ্ঞানকে বিভিন্ন পথে চালিত করে চলে ও সেই সঙ্গে মার্ক্‌স্‌-এঙ্গেল্‌সের কৌতূহলী অনুসন্ধিৎসাও চলল নানান পথে, বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের খোঁজে। নিউটনের সূত্র তো বলবিদ্যার (mechanics) পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেঃ দেখিয়ে গেছে ভর (mass), ভরবেগ (momentum) ও শক্তির (energy), নিত্যতা (constancy, বা তাদের conservation)। তাহলে, কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই চলমান শক্তি (kinetic energy) গতিহীন বাষ্পের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে থাকে? - কারণ আমরা তো দেখি যে কোনো বাষ্প ছিদ্র-পথ দিয়ে নির্গমনের সময় গতি (motion) লাভ করে। উত্তরটা অনেক অনুসন্ধানের পর জানা গেল, এই চলমান শক্তি বস্তুর অভ্যন্তরেই বাঁধা পড়ে আছে।

ব্যাপারটা হল এই রকমঃ উদাহরণ বশত, যে কোনো ইন্ধনের উদাহরণ দেখা যাক। এই ইন্ধনের রাসায়নিক গঠনের মধ্যেই আছে শক্তি তার রাসায়নিক শক্তির আকারে বাঁধা পড়ে আছে। জ্বালন (ignition) ও দহন (combustion)-এর ফলে এই শক্তি মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সে তখন অন্য আকার (form) নেয়, বেরিয়ে আসে তাপ শক্তির আকারে। এই তাপশক্তিই (heat energy) বরফ কে গলিয়ে করে তরল জল আবার তরল জলকেও বাষ্পে পরিণত করতে পারে। এই বাষ্প- তার অণু (molecule), পরমাণু (atom) - পায় তাদের চলমান শক্তি। পিস্টনের (piston) সঙ্গে অণু পরমাণুর এই ক্রমাগত ধাক্কার (collision) ফলেই তারা ভারি পিস্টন্‌কেও ঠেলতে সক্ষম হয় - এই কাজই করে চলে। এ ভাবেই ইঞ্জিন চলে। এরপর কয়েক ধাপ এগিয়ে দেখা গেল যে শক্তি বিভিন্ন আকারে বিরাজ করতে পারেঃ মেক্যানিকাল (mechanical), তাপ (heat), রাসায়নিক (chemical), আলোক (light), বৈদ্যুতিক (electric), চৌম্বকীয় (magnetic) ইত্যাদি। অপরদিকে, শক্তির আকারও এক থেকে অন্যে পরিবর্তন হতে পারে। একে বলে, interconvertibility of energy।

কারিগরি শিল্পের প্রয়োজনে ইন্ধনের দহন নিয়ে অনেক গবেষণা চলল। দেখা গেল যে জ্বালন ও দহনের জন্য অক্সিজেন অতি প্রয়োজনীয়; এছাড়া ইন্ধনের আণবিক (molecular) গঠনে হাইড্রোজেন ও কার্বনের অস্তিত্বের দরুনই, অক্সিজেনের সংস্পর্শে তারা জ্বলতে পারে, যার জন্য আজকাল আমরা তাদের বলি হাইড্রোকার্বন। অতএব, কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ আণবিক গঠনের দ্বারাই তার প্রকৃতি (properties) নির্ধারিত হয়, ওই গঠনের মধ্যেই তার শক্তির উৎস লুকিয়ে আছে। এইভাবেই, আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের জন্ম হল।

তারপর রসায়ন বিজ্ঞানে এল নানান যুগান্তকারী আবিষ্কার। হেনরি ক্যভেনডিশ্‌ (Henry Cavendish), জোসেফ প্রিস্টলি (Joseph Priestly), কার্ল শীলে (Carl Wilhem Scheele) জন ডাল্টন (John Dalton) প্রমুখ বিজ্ঞানীদের প্রয়াসে রসায়ন বিজ্ঞান নানান দিকে ডালপালা মেলে চলল। কিন্তু তাকে মৌলিক সূত্রে বেঁধে দিলেন ফরাসী বিজ্ঞানী আঁতোয়াঁ লাভয়সিয়র (Antoine Lavoisier): যেমনটি পদার্থের বলবিদ্যার বেলায় করেছিলেন নিউটন। এরপর, জন ডাল্টন একে আরও একধাপ এগিয়ে দিলেন; আনলেন আধুনিক অণুশাস্ত্র ও তার পক্ষে নানান পরীক্ষাগত প্রমাণও জড়ো হতে লাগল। অবশেষে, ১৮৬৯ সালে, নানান মৌলিক পদার্থের পরমাণুদের (atoms of element) চরিত্র (properties) ও পারমাণবিক ভর (atomic mass)-এর মধ্যে এক অজানা যোগসূত্র আবিষ্কার করে, তাদের এক অভিনব পর্যায়ক্রমিক ছকে (periodic table) বিন্যাস করে সাজিয়ে দিয়ে গেলেন রুশ বিজ্ঞানী ডিমিট্রি মেন্ডেলিয়েভ (Dimitry Mendeleev)। এই শেষোক্ত আবিষ্কারকে অভিনন্দন জানিয়ে এঙ্গেল্‌স্‌ লিখলেন, ‘‘নিজের অজান্তে, হেগেলের সূত্র-অর্থাৎ পরিমাণ (quantity) ও চরিত্রের (properties) সম্বন্ধ - প্রয়োগ করে মেন্ডেলিয়েভ এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যার তুলনা করতে পারি, লেভেরিয়ারের নেপচুন আবিষ্কারের সঙ্গে।’’

এঙ্গেল্‌স্‌ কেনই বা এই কথা বললেন? তার কারণ এই। সেই যুগে বস্তুবাদী বিজ্ঞান তখনও ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। উপরের বিবরণ থেকেই বোঝা যায় যে কীভাবে দেখা গেল যে, তাপবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্র সংক্রান্ত অণু-পরমাণুর সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান একই সূত্রে বাঁধা। একদিকে সে ব্যাখ্যা করল, গ্যাসিয় (gaseous) পদার্থের চাপ (pressure), তাপমাত্রা (temperature) ও ঘনত্বের (density) সূত্র, যাকে বলে gas laws, আবার অন্যদিকে বুঝিয়ে দিল বর্ণালী-বীক্ষণ (spectroscopy)-এর গোড়ার কথা। সবচেয়ে মৌলিক সিদ্ধান্ত যেটা এল, সেটা এই যে, কোনো বস্তু আপাতদৃষ্টিতে চলনহীন (static) হলেও তার অভ্যন্তরে অণু-পরমাণু সততই গতিময়। অবশেষে, বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানে ঘটল বিপ্লব, এবং সেখান থেকেই অণু-পরমাণুর অভ্যন্তরের গতিবিদ্যা এক নতুন মাত্রা পেল।

এই বিংশ শতাব্দীর বিপ্লব-ই আমাদের বুঝিয়ে দিল যে, কোনো বস্তুর রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয় চরিত্র বুঝতে হলে তার আণবিক ও পারমাণবিক গতিবিদ্যা কোয়ান্টমবাদ দিয়ে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে হবে। এই সব অবশ্য ঘটল বিংশ শতাব্দীতে, এঙ্গেল্‌সের মৃত্যুর বহু পরে। কিন্তু আবিষ্কারের ধারা যে নানান পথে প্রবাহিত হচ্ছে, সেটা তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন। তাই নানান সময়ই, নব আবিষ্কৃত তথ্য ও গাণিতিক ফর্মুলা ব্যবহার করে এঙ্গেল্‌স্‌ নিজেই তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের ফলাফল যাচাই করেছেন।

এঙ্গেল্‌সের জীবদ্দশায় বিজ্ঞান নানান দিকে প্রবাহিত হয়েছিল, যেমন ওই সময়েই বিদ্যুৎ চৌম্বকত্ব (electromagnetism) তার সম্পূর্ণতা লাভ করে। বিবিধের মাঝে মহান-মিলনের খোঁজে নানান দিকে নজর রেখেও, এঙ্গেল্‌সের দৃষ্টি ঘুরি মরুপথে পথ হারায়নি। তাঁর মৃত্যুর (৫ই আগস্ট, ১৮৯৫) বহু বছর পরে, তাঁরই নোটবই থেকে সংগ্রহ করা নানা প্রশ্ন ও খসড়া-প্রবন্ধ সংগ্রহ করে প্রকাশিত হয় এক অসামান্য গ্রন্থ, ‘‘প্রকৃতির দ্বন্দ্ববাদ’’ (Dialectics of Nature)। এঙ্গেল্‌স্‌ এখানে নানান প্রশ্ন করেছেন, যার গভীরতা অসামান্য ও কোনো কোনো ব্যাপারে তিনি উত্তরের নির্দেশও দিয়ে গেছেন। যেমন, ‘‘জৈবিক প্রক্রিয়া পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে চলতে বাধ্য, তাহলে জড় রসায়ন থেকে জীবের উৎপত্তি হয় কীভাবে?’’ তবে এই সব বুঝতে তিনি লুদভিগ ফয়েরবাখের (Ludwig Feuerbach) উদ্ধৃতি টেনে সতর্কও করে দেন,‘‘জীবন শুধুমাত্র রসায়ন বিজ্ঞানে সীমিত করলে চলবে না, এর পরিধি প্রকৃতি জুড়ে বিস্তৃত।’’


(৫)

জীববিদ্যায় যে আবিষ্কারটি মার্ক্‌স ও এঙ্গেল্‌স্‌কে বিশেষভাবে প্রেরণা জোগায়, তা হল চার্লস্‌ ডারউইনের আবিষ্কৃত, ‘‘প্রজাতির বিবর্তন তত্ত্ব’’ (Evolution of Species), এমন কি, মার্ক্‌স্‌ এক সময় ঠিক করেছিলেন যে ক্যাপিটালের প্রথম খন্ড ডারউইনকে উৎসর্গ করবেন। ডারউইনের তত্ত্ব প্রকাশের পরই উচ্ছসিত হয়ে, মার্ক্‌স্‌ ও এঙ্গেল্‌স্‌ একে অপরকে লিখলেনঃ ‘‘ঈশ্বর-কৃত-সৃষ্টি’’ এই মতবাদের মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। ডারউইনের তত্ত্ব ‘‘অস্তিত্বের সংগ্রাম’’ (Struggle for Existence) থিওরির আধারে গঠিত, যা অবশেষে নানান প্রজাতিকে ‘‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’’ (Natural Selection) আবর্তে ঠেলে দেয়। এরই ফলে কোনো প্রজাতি লুপ্ত হয় আবার কোনো প্রজাতি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে বেঁচে থাকে।

এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডারউইন শরীর-অভ্যন্তরের প্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করেন নি। তাঁর সব দৃষ্টিই ছিল শরীরের বাইরে যেমন, খাদ্য-সংগ্রহ, খাদ্য-সংগ্রহের তাড়নায় আন্তঃপ্রজাতি সংঘর্ষ, পারষ্পরিক বিনাশ ইত্যাদি। এঙ্গেল্‌স্‌ কিন্তু যে সব প্রশ্ন রাখলেন, তার মূল বিষয় হল শরীরের আভ্যন্তরিক বিষয়। এই গ্রন্থ অনেককে প্রেরণা জোগায়, আবার অনেকে কঠোর সমালোচনাও করেন এই বলে যে এই বইএ মূল কোন আবিষ্কারের উল্লেখ নেই। এঙ্গেল্‌সের সেই রকম কোনো লক্ষ্যই ছিল না, বা তিনি তেমন কোনো দাবিও করেন নি। তাঁর মূল প্রশ্ন ছিলঃ মৃত্যু যদি জীবের শরীরের জড় রসায়নগুলি মাত্র ফেলে রেখে যায়, তাহলে জীবনের প্রক্রিয়ার সূচনা হয় কীভাবে? জীবকোষের (cell) গঠন ও বিন্যাসই বা কী ভূমিকা পালন করে? বা, কীভাবে জীবন এগিয়ে চলে ও একদিন মৃত্যুর দরজায় এসে পৌঁছয়? এই জীবন রক্ষায় প্রোটিনের (protein) কী ভূমিকা ও শরীরে তার উৎপাদন হয় কীভাবে? পদার্থ ও রসায়নবিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব থেকে আমরা শরীরের মধ্যে শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতার বিষয় বুঝব কীভাবে?

এই সব মৌলিক প্রশ্ন থেকেই আসে আবিষ্কার। এই সব প্রশ্ন বিংশ শতাব্দীতে জীব বিজ্ঞানে মূল ধারার সৃষ্টি করে, যদিও উনবিংশ শতাব্দীতে তারা প্রাধান্য পায় নি বা তৎকালীন বিজ্ঞানে এর প্রস্তুতি-ও ছিল না। এই সকল প্রশ্নকে বিজ্ঞানের কেন্দ্রে যাঁরা নিয়ে আসেন, তাঁরা হলেন, জন ডেসমন্ড বারনাল (John Desmond Bernal), জন বুরডন স্যান্ডারসন হলডেন (John Bourdon Sanderson Haldane) ও আলেকজান্ডার ওপারিন (Alexander Oparin)-এর নেতৃত্বে মার্ক্‌স্‌বাদী বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল, ‘‘বস্তুর গঠন বস্তুর চরিত্রকে কীভাবে নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করে, ও তার বিবর্তনের গতিপথই বা কী?’’ জীবের উদ্ভবে ও জীবনের সমাপ্তি এই দুই বিষয়ই এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত।

এঙ্গেল্‌সের একটি প্রবন্ধ ‘‘বানর হতে মানুষের বিবর্তনে, শ্রমের ভূমিকা’’ কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। অনেকেই বলেন যে এই বিশ্লেষণ লামার্কিয়ন (Lamarckian-এর প্রবক্তা Jean Bapatiste de Lamarck-এর নামে) তত্ত্বের উপর আধারিত, যা কিনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অনেকের মত, ডারউইন নিজেও লামার্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সেই প্রভাব এঙ্গেল্‌সেও আছে। লামার্ক মনে করতেন যে প্রজাতির বিবর্তন তার পার