আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

কৃষি আইনের হেরাফেরিঃ কৃষি বিপণনের রাজনীতি

সুখবিলাস বর্মা


এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। লাদাখ-গালওয়ান সীমান্তে চীন আমাদের কত জমি দখল করে বসে আছে তা নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য দেশবাসীর কাছে নেই; দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আজ কোন জায়গায় কেউ তা জানে না; এসব বিষয়ে ভারত সরকারের প্রধান মন্ত্রী-বিদেশ মন্ত্রী-প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কথায় কোনো মিল নেই। চীনের রাজনৈতিক আক্রমণের সাথে সাথে কোভিড-১৯ আক্রমণে সারা দেশ বিপর্যস্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ট্রাম্প তোষণ, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা দখলের ছক ইত্যাদির জন্য লক-ডাউন ঘোষণায় অহেতুক বিলম্ব এবং বিলম্বের কারণে যে সময় পাওয়া গেল তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে পরিযায়ী শ্রমিকদেরকে উদ্দিষ্ট রাজ্যগুলিতে পাঠানোর ব্যবস্থা না করে কোনো রাজ্যের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই আচমকা লকডাউন ঘোষণা দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে করোনা সংক্রমণ দেশকে এপিডেমিক থেকে প্যানডেমিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অয্যোধ্যায় মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের জনসমাগম সংক্রমণকে আরও ব্যাপকতর করার পথে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছে। করোনা সংক্রমণ ভারতবর্ষ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় সব রাজ্যেই অব্যবস্থা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে। প্রাক-করোনা অর্থনৈতিক অবনমন আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করে দেশের সাধারণ-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সকলকেই বিপর্যস্ত করেছে; দেশের যুবক যুবতিদের জন্য প্রতিশ্রুতিমত কাজের সংস্থান, নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি তো দুরের কথা, কত মানুষের কাজ খোওয়া গেছে, কত শত মানুষ বেকার হয়েছে তার হিসাব কেন্দ্রীয় সরকার ও সব রাজ্য সরকার দিতে পারছে না। কিন্তু মোদীজি বলছেন-সব ঠিক হ্যায়। অবশ্য এই অবস্থার মধ্যেও আম্বানি-আদানি দের সম্পত্তির পরিমাণ নাকি অনেক বেড়েছে। আম্বানি এখন বিশ্বের প্রথম ১০ ধনাঢ্যের একজন। তাই হয়ত-সব ঠিক হ্যায়। স্বভাবতই পাহারাদার চৌকিদারের কথা মনে পড়ছে। চোর চুরি করে ফাঁক করে দিলেও চৌকিদারের হাঁক-সব ঠিক হ্যায়। দেশের এই কঠিন অবস্থার মধ্যেই নরেন্দ্র মোদীজি তাঁর নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। বরং বলা যেতে পারে, কোভিড-১৯ জনিত প্যানডেমিক-এর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য সামাজিক দুরত্বের সুযোগ নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে দেশে যেমন ইচ্ছা আইন পাশ করিয়ে নিচ্ছেন।

লকডাউন-এর বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন চালাতে গিয়ে মোদীজির দল সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলেছেন। গত ২০শে সেপ্টেম্বর এই রকমই ন্যক্কারজনক ঘটনা পরিদৃষ্ট হল দেশের সংসদ কক্ষে। দেশের এমনতর সংকটজনক অবস্থায় মোদীজি মুখে কৃষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলছেন, কিন্তু কাজে অকৃষক বড় ব্যবসায়ীদেরকে সুবিধা দেওয়ার জন্য কৃষক স্বার্থ বিরোধী আইন পাশে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এইজন্যই কৃষকের স্বার্থ বিরোধী তিনটি বিল পাশ হল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে -
1) THE FARMERS' PRODUCE TRADE AND COMMERCE (PROMOTION AND FACILITATION) BILL, 2020 2) THE FARMERS' (EMPOWERMENT AND PROTECTION) AGREEMENT ON PRICE ASSURANCE AND FARM SERVICES BILL, 2020 and 3) THE ESSENTIAL COMMODITIES (AMENDMENT) ORDINANCE, 2020. লক্ষ্যণীয় যে The Ordinance was promulgated by the President on 5th June, 2020 that is, in the midst of the pandemic.

সংসদের দুই কক্ষেই বিরোধীরা এবং সংসদের বাইরে বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক সংগঠনগুলি তীব্র বিরোধীতা করেছে। লোকসভায় বিলগুলি তড়িঘড়ি পাশ করানো হয়েছে সংখ্যার জোরে কিন্তু রাজ্যসভায় সংখ্যার জোর না থাকাতে এবং বিল-এ কৃষক স্বার্থ বিরোধী বহু ধারা থাকার ফলে মোদীর দল ঝুঁকি নিতে চায়নি। বিল-এর ধারাগুলি ভালোভাবে বিস্তৃত আলোচনা করার সুযোগ দিলে মোদীর নিজের দল এবং সহযোগী দল থেকে প্রতিবাদের সম্ভাবনা ছিল, যেমন শিরোমণি অকালি দলের মন্ত্রী বিলের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তাই রাজ্যসভায় সংসদীয় নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে পেশি বলে ধ্বনিভোটে বিল পাশ করানো হল ২০শে সেপ্টেম্বর রবিবারে বিশেষ অধিবেশনে। বিলগুলির উপর বিশদ আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর বিরোধীদের দাবি মানা হল না; বিরোধীদের ডিভিসন-এর দাবি অগ্রাহ্য করে বেনজির পদ্ধতিতে ধ্বনিভোটে পাশ ঘোষণা করলেন মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান মহোদয়। বিরোধীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়লে ৮ সাংসদকে বরখাস্ত করা হল। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সংসদকেও স্বৈরাচারের শেষ সীমায় পৌঁছে দিলেন আমাদের মহান প্রধানমন্ত্রী।

কেন এমনটা করা হল? কিসের এত গোপনীয়তা, কিসের এত তাড়া? বিরোধী দলগুলিই বা এত সোচ্চার কেন? কি আছে বিলগুলিতে?

এবারে তাই বিলগুলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যেতে চাই। তবে তার আগে দেশের কৃষি নিয়ে একটু আলোচনা অযৌক্তিক বা অবান্তর হবে না। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই কৃষি প্রধান দেশটির কৃষির অবস্থান কোথায় ছিল? জনসংখ্যার ৮০% এর বেশি কৃষির উপর নির্ভরশীল দেশে কী ছিল কৃষির অবস্থান? এবং তারপর ধীরে ধীরে কোথায় পৌঁছেছে? একটু তথ্যতালাশ করা যাক। এই ব্যাপারে প্রাথমিক বিবেচনায় আসে যে প্রধান চারটি তথ্য যার নিরিখে বিচার করা সম্ভব্ কোথায় কী হালে ছিলাম ও আছি আমরা, সেগুলি হল-প্রধান প্রধান শস্যের আওতায় মোট জমির পরিমাণ, মোট উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা এবং সেচ-সেবিত এলাকা।

দ্রষ্টব্যঃ জমির পরিমাণ - মিলিয়ন হেক্টর
উৎপাদন - মিলিয়ন টন
উৎপাদিকা - কেজি/প্রতি হেক্টর

বলা নিষ্প্রয়োজন যে ১৯৫০ সালে দেশে কৃষির যে অবস্থা ছিল তাই নিয়ে কংগ্রেসকে এগিয়ে চলতে হয়েছে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নীতি গ্রহণ করে প্রথম পাঁচ বছরে কৃষির উপর জোর দেওয়া হয়েছিল যাতে খাদ্যশস্যের যোগানের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের কাঁচামালের যোগানের দিকটাও দেখা সম্ভব হয়। শুধু ধান গম ভুট্টা ডালশস্য তৈলবীজই নয়, উদ্যানজাত শস্য অর্থাৎ শাক সবজি আলু পেঁয়াজ লঙ্কার উৎপাদনেও বিপ্লব ঘটেছে।

কৃষির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলি অর্থাৎ মৎস্য, মাংস, ডিম, দুধ প্রভৃতি প্রাণীজাত খাদ্যের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। তাইতো আমরা গর্ব করি সবুজ বিপ্লব, শুভ্র বিপ্লব নিয়ে। দেশের কৃষকরা পরিশ্রম করেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত Indian Council of Agricultural Research (ICAR)-কে কৃষি গবেষণার জন্য একটি শক্তিশালী সংস্থায় পরিণত করে কৃষি প্রযুক্তির যথাযথ উন্নতি সাধন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেক গবেষণা কেন্দ্র।উন্নত হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি; আজ ট্রাক্টর, পাওয়ারটিলার, হারভেস্টার ইত্যাদি ছাড়া কথা নেই। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সব কিছুর জন্য প্রয়োজন হয়েছে অর্থের। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মাধ্যমে সেই প্রয়োজন বহুল পরিমাণে মেটানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাবারড (NABARD)। কৃষির উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয়েছে অসংখ্য প্রোগ্রাম, প্রজেক্ট। প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নদী প্রকল্প, গভীর নলকূপ, ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটিয়ে কৃষির জন্য সস্তায়, কোনো কোনো রাজ্যে মাশুল ছাড়াই বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। KCC, Crop Insurance, Soil Testing, Soil Health, Seed Testing, Fertiliser, Pesticides, Vermicuture, Post Harvest Management, ATMA for Training-extension ইত্যাদি সংক্রান্ত কত প্রোগ্রাম। আর এই সব কিছুর নীট ফল হল কৃষি বিপ্লব। এই সব কিছুর জন্য বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনশীলতা কোথায় পৌঁছেছে তার একটু ছোট্ট নমুনা দেখা যাক। ২০১৭-১৮ সালে খাদ্যশস্যের (Foodgrains)-এর হেক্টর প্রতি উৎপাদন (কেজি) পাঞ্জাব-৪৭০৯, হরিয়ানা-৩৬৩২, তামিলনাড়ু-৩০২৮, অন্ধ্রপ্রদেশ-২৯৩৪, তেলেঙ্গানা-২৯০৩। আলু ও পাট উৎপাদনে বাংলা এবং বাদাম উৎপাদনে গুজরাট বিপ্লব এনেছে।

উৎপাদনে এই বিপ্লব ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের বাজারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে যাতে কৃষকেরা ন্যায্য মূল্যে তাঁদের পণ্য বিক্রয় করতে পারেন। পুরনো হাট বাজারের মাধ্যমে এই কাজ সম্ভব ছিল না। তাই কৃষি বিপ্লবের রাজ্যগুলিতে শুধু নয়, সর্বত্র মাণ্ডি, কৃষক বাজার ইত্যাদি পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে। কৃষকরা মাণ্ডি বা কৃষক বাজারে কম বেশী সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (MSP) উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে দিন গুজরান করছেন-বহু কৃষক স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন রাজ্যে তাদের পুরনো নিজস্ব আই্নে চলা কৃষক বাজারের সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার ২০০৩ সালে The-State Agricultural Produce Marketing (Development and Regulation) Act, 2003 নামে একটি Model Act সব রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়ে সংস্কার সাধনে উদ্যোগী হতে বলেন। অধিকাংশ রাজ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে যান। বিশেষত ভারতের শস্য ভাণ্ডার বলে পরিচি্ত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে বহু APMC Market (মাণ্ডি, কৃষক বাজার) কৃষি পণ্যের বিপণনে অভূতপূর্ব কাজ করেছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার মাণ্ডিগুলি এতই বিখ্যাত যে রাজ্য ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উত্তরপ্রদেশ রাজস্থান থেকে ট্রাক বা ট্রাক্টর ভর্তি গম, ধান সবজি নিয়ে দলে দলে কৃষকের এই দুই রাজ্যে কৃষি বাজারে আসা মরশুমের মনোরম দৃশ্য। দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন ও বিপণনে মহারাষ্ট্রের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সেই রাজ্যে ৩০৭টি APMC Market কাজ করছে। লসলগাঁও-এর পেঁয়াজ বাজারের ভূমিকা কে না জানে? তামিলনাড়ু-তে এধরনের বাজারের সংখ্যা ২৭৭। অর্থাৎ প্রায় সব রাজ্যেই চলছে এই বাজার। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭০-এর দশকের Regulated Market আইন অনুযায়ী কৃষি বাজারগুলি চলছিল। ২০১৪ সালের ৮ই ডিসেম্বর বর্তমান সরকার ২০০৩-এর মডেল আইন অনুসরণ করে West Bengal Agricultural Produce Marketing (Regulation) (Amendment) Bill, 2014 পাশ করে প্রতি ব্লকে কৃষক বাজার নির্মাণের প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ১৮৬টি বাজার তৈরি করেছে যদিও সবগুলিতে কেনাবেচার কাজ শুরু হয়নি।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব জানেন এবং তিনি একথাও জানেন যে এই প্যানডেমিক অবস্থার মধ্যেও কৃষকরাই দেশে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন, সমগ্র দেশের মানুষের খাবার সরবরাহে ঘাটতি রাখেননি। তাইতো তিনি গর্বভরে ঘোষণা করছেন - দেশের ভিত কৃষকরাই, এই কঠিন সময়েও দেশবাসীকে পথ দেখিয়েছে কৃষিক্ষেত্র, দেশের কৃষি ব্যবস্থা মজবুত ও স্থিতিশীল রয়েছে। এখানেই আমার একটি ছোট্ট নিবেদন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে - এমনতর মজবুত কৃষি ব্যবস্থায় আপনি কেন বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করছেন? কার স্বার্থে? আপনি যদি জেনে থাকেন যে সব জায়গায় এই বাজারগুলি ঠিক মত চলছে না, তবে আরও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। রাজ্যগুলির সাহায্যে এগিয়ে আসুন, যেমনটি করেছিল ইউপিএ সরকার ২০০৩ সালে।

কিন্তু স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী সেপথে না গিয়ে পেশির জোরে সংখ্যার জোরে বাঁকা পথে নতুন আইন পাশ করলেন - ভুলে গেলেন যে সংবিধানে কৃষি এবং বিপণন দুটোই রয়েছে রাজ্যের এক্তিয়ারে। The Farmers' Produce Trade and Commerce (Promotion And Facilitation) Act, 2020 পাশ হল যে আইনকে Retrospective Effect দেওয়া হল ৫ই জুন, ২০২০ থেকে। বড় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে তৈরি এই আইনে কৃষিপণ্য বিপণনে রাজ্য সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এই আইন অনুসারে যে কোনো কৃষক, ব্যবসায়ী বা Electronic Trading and Transaction Platform কোনো ব্যবসার জায়গায় (Trade Area) খাদ্যশস্য, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত দ্রব্য, সরষের খইল সহ পশুখাদ্য, কাঁচা কার্পাস, কাঁচা পাট ইত্যাদির অবাধ বেচাকেনা করতে পারবেন। এই আইনটির সবচেয়ে মারাত্মক ও আপত্তিকর বিষয় হল 'ব্যবসার জায়গা'র সংজ্ঞা। 'ব্যাবসার জায়গা' বলতে উৎপাদন স্থান, সংগ্রহ, জমা বা মজুত করার স্থান ইত্যাদি বোঝায়, কিন্তু এপিএমসি বাজার, বাজারের ইয়ার্ড, সাব-ইয়ার্ড ইত্যাদি 'ব্যাবসার জায়গা' বলে পরিগণিত হবে না। এ যেন রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের শত্রুতা। রাজ্যের অধিকারের প্রশ্ন ছাড়াও সরকার কর্তৃক তৈরি পরিকাঠামোর সদ্ব্যবহারের প্রশ্ন থেকেই যায়। হাজার হাজার টাকা খরচ করে যে বাজারগুলি তৈরি হয়েছে এবং যার অধিকাংশই হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায়, সেগুলি আর বৈধ বাজার থাকবে না? গত পাঁচ ছয় বছরে RKVY প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি বিপণন ব্যবস্থা মজবুত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে ১০০০ কোটি টাকার বেশী দিয়েছে। সে কি সৃষ্ট সমস্ত পরিকাঠামো ফেলে রেখে নষ্ট করার জন্য? এ তো নীতির প্রশ্নও বটে।

দ্বিতীয় আইনটি হল প্রথমটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উৎপন্ন ফসলের দাম, উৎপাদনের কাজে প্রয়োজনীয় মালপত্রের যোগান ইত্যাদি সম্পর্কিত চুক্তি বিষয়ে। লিখিত চুক্তিতে ফসলের দামের সঙ্গে গুনমান ইত্যাদি উল্লিখিত থাকবে। এই দাম কি হবে সেটা অবশ্যই নির্ভর করছে কৃষকের দর কষাকষির ক্ষমতার উপর। ভারতের অধিকাংশ কৃষকের এই ক্ষমতা কতটুকু? ২০১৫-১৬ সালে ৬৮% কৃষক প্রান্তিক চাষি যাদের জমির পরিমাণ গড়ে ০.৩৮ হেক্টর এবং ১৮% ক্ষুদ্র চাষি যাদের জমির পরিমাণ গড়ে ১.৪০ হেক্টর। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময়ে এরা কি বড় ছোটো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠবে, বিশেষ করে যেখানে এমএসপি অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের বিষয়টি তুলে দেওয়া হচ্ছে, কেননা কোনো আইনেই এর উল্লেখমাত্র নেই।

তৃতীয় আইনে ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের আওতা থেকে খাদ্যশস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে মোদীজির ব্যবসায়ি বন্ধুরা মনের সুখে মজুতদারি চালিয়ে যাবেন। কেননা উদ্যানজাত দ্রব্যের অর্থাৎ আলু, পেঁয়াজ, শাক-সবজি, ফলমূলের ক্ষেত্রে মুল্যস্তর ১০০% বৃদ্ধি না পেলে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এর চেয়ে ভাল সুযোগ ব্যবসায়ীরা কোথায় পাবেন? পচনশীল দ্রব্যের ক্ষেত্রে এই ঊর্ধ্বসীমা ৫০%।

কৃষক-স্বার্থ বিরোধী এই ধরণের নির্মম আইনের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক কারণেই বিরোধী দলগুলি এবং কৃষক সংগঠনগুলি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টে কেস ফাইল করা হয়েছে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় যায়।