আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলন

প্রস্কণ্ব সিংহরায়


কয়েকদিন আগে, সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীনে গঠিত হল দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি। সরকারী প্রজ্ঞাপণে জানানো হয়েছে নতুন এই অ্যাকাডেমির উদ্দেশ্য - ‘দলিত সাহিত্যধারার চর্চা ও বিকাশ, দলিত জীবন বিষয়ে গবেষণা, দলিত সাহিত্যের গ্রন্থাগার গঠন, দলিত মনীষীদের রচনাবলী প্রকাশ ইত্যাদি’। প্রায় তিন দশক ধরে সাংগঠনিকরূপে চলমান বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলন এই প্রথম একটি সরকারী স্বীকৃতি পেল। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের দলিত রাজনীতিতে এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কিন্তু দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর পরেই সমাজমাধ্যমে ধরা পড়ল উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকশ্রেণির এই বিষয়ে অস্বস্তি। প্রশ্ন উঠল - সাহিত্যের আবার দলিত-অদলিত ভেদাভেদ হয় নাকি?

হাস্যকর হলেও, এ ধরনের প্রশ্ন নতুন নয়। আগেও ঠিক একই রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলন। আসলে এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে উচ্চবর্ণ ভদ্রলোক বাঙালির বর্ণগত বৈষম্যের উদাহরণ। সে কথায় আসব। তার আগে ভারতবর্ষে দলিত আন্দোলন ও তাতে দলিত সাহিত্যের অপরিহার্য ভূমিকা বিষয়ে দু-চার কথা আলোচনা করা প্রয়োজন।

এ দেশে নিম্নবর্ণের মানুষের জীবনের অবস্থা বোঝানোর প্রেক্ষাপটে ‘দলিত’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন বাবাসাহেব আম্বেদকার তার পাক্ষিক পত্রিকা বহিষ্কৃত ভারত-এ। আম্বেদকারের মতে, ‘‘Dalithood is a kind of life condition which characterizes the exploitation, suppression and marginalization of dalits by the social, economic, cultural and political domination of the upper caste brahminical order।’’ মহাত্মা গান্ধী নিম্নবর্ণের মানুষকে ‘হরিজন’ নাম দিয়েছিলেন। হরিজন, অর্থাৎ, ঈশ্বরের সন্তান। আম্বেদকার গান্ধীর এই নামকরণের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের মানুষকে scheduled castes অথবা depressed classes হিসেবে সম্বোধন করতে পছন্দ করতেন। ‘দলিত’ শব্দটি নিম্নবর্ণের মানুষের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচিতি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে আম্বেদকারের মৃত্যুর পর। এর পিছনে দলিত সাহিত্য আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য।

দলিত সাহিত্য বিষয়টি জনসম্মুখে আসে ১৯৫৮ সালে। মুম্বই-এ সে বছর এক দলিত সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। দলিত সাহিত্যের আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখান থেকেই শুরু। এই সম্মেলনে ঠিক হয় যে মারাঠি ভাষায় দলিত মানুষের লেখা সাহিত্য বা দলিত মানুষ সম্পর্কে লেখা সাহিত্য যেন এক পৃথক পরিচিতি লাভ করে যার নাম দলিত সাহিত্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও সাহিত্য সংগঠনগুলি যেন দলিত সাহিত্যের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে এর প্রাপ্য মর্যাদা দেয়। পরবর্তীকালে দলিত সাহিত্যের এই সংজ্ঞা বদলায়। দলিত সাহিত্যিক শরণ কুমার লিমবালের মতে দলিত মানুষের দলিত চেতনা থেকে লেখা সাহিত্যই হল দলিত সাহিত্য।

গোড়ার দিকে দলিত সাহিত্য আন্দোলন মারাঠি ভাষাতেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকে। ১৯৬০-এর দশকে বাবুরাও বাগুল, আন্নাভাও সাথে ও অন্যান্য মারাঠি দলিত লেখকদের কলমে একের পর এক উঠে আসে দলিত জীবনের নানা উপাখ্যান। ভারতীয় সাহিত্যে জন্ম নেয় এক নতুন চিন্তাধারা, সাহসী ভাষার ব্যবহার, ভিন্ন রাজনীতি এবং পাঠকের সামনে এসে পড়ে নিম্নবর্ণের মানুষের না বলা অনেক অভিজ্ঞতার কথা। বাবুরাও বাগুলের মতে ভারতের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য হল হিন্দু সাহিত্য। সেখানে নিম্নবর্ণের মানুষের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান নেই। উচ্চবর্ণের সাহিত্যের বিষয়, চিন্তা-ভাবনা বা গল্পের নায়ক দলিত সমাজের মানুষ কখনই হয়ে উঠতে পারেনি, পারবেও না। দলিত সমাজের মানুষকে যদি নিজের গল্প বলতে হয়, তাহলে তা তাদের নিজেদেরই লিখতে হবে। সঠিক স্বীকৃতি ও প্রতিনিধিত্বের কারণেই দলিত সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব।

এরপর ১৯৭২ সালে মুম্বই-এ দলিত প্যান্থারস নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়। এই সংগঠনের অধিকাংশ কর্মীই ছিলেন দলিত সাহিত্যিক। যেমন নামদেও ধাসাল, অর্জুন দাংলে, জে. ভি. পাওয়ার প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে দলিত সাহিত্য আন্দোলন নতুন উদ্যমে বেড়ে ওঠে। এরা গান্ধীবাদী জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং আম্বেদকারের চিন্তাধারা ও আদর্শকে ভারতের রাজনীতির মঞ্চে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০-এর দশকে দলিত প্যান্থারস-এর হাত ধরেই দলিত শব্দটি সমাজের নিপীড়িত, নিম্নবর্ণের মানুষের স্বঘোষিত, রাজনৈতিক পরিচিতি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দলিত হয়ে ওঠে মুক্তি ও মর্যাদার পরিচিতি। ‘হরিজন’-এর মত ‘দলিত’ শব্দটি উচ্চবর্ণের মানুষের নিম্নবর্ণের উপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো নাম নয়। বরং সমাজে মর্যাদার সাথে নিজেদের কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে নিতে এই স্বাধীন গণতান্ত্রিক পরিচিতিকে আলিঙ্গন করেছে এ দেশের কোটি কোটি নিম্নবর্ণের মানুষ।

মহারাষ্ট্রের থেকে দলিত সাহিত্য আন্দোলন ছড়িয়ে পরে অন্যান্য রাজ্যেও। দলিত প্যান্থারস-এর পাশাপাশি ১৯৭০-এর দশকে কর্ণাটক এ তৈরি হয় দলিত সংঘর্ষ সমিতি। তারপর ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে দালিত সাহিত্য আন্দোলনের ধারা প্রচলিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে। দিল্লিতে দলিত লেখক সঙ্ঘ গঠিত হয়। দলিত সমাজের বিভিন্ন দিক - দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা, সামাজিক বৈষম্য, উচ্চবর্ণের অত্যাচার এবং নিজেদের অধিকারের লড়াই ও সংগ্রামের কাহিনি স্পষ্ট ফুটে ওঠে দলিত সাহিত্যের গল্প, কবিতা, গান, নাটক ও আত্মকথার মাধ্যমে। পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক দলিত সাহিত্য ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাতে অনুবাদ করাও শুরু হয়। ফলতঃ ১৯৯০-এর দশকে দলিত সাহিত্য এ দেশে এক পৃথক স্বতন্ত্র সাহিত্য আন্দোলনের পরিচিতি লাভ করে। ঠিক এই সময় দেশের বাকি রাজ্যের দলিত সাহিত্যের প্রসারণের সাথে তাল মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়।

১৬-ই অগাস্ট, ১৯৯২ পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে একটি কালো দিবস। এই দিন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী চুনি কোটাল আত্মহত্যায় মারা যান। বহুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণগত বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই ছাত্রী। তার অপরাধ ছিল সে আদিবাসী, একজন লোধা সম্প্রদায়ের মেয়ে। চুনি কোটালের মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের দলিত সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নাড়িয়ে তোলে এবং তারা একটি সংগঠন তৈরি করার তাগিদ অনুভব করেন। এদের অনেকেই অবশ্য এযাবৎ নিজ নিজ উৎসাহে বাকি দেশের দলিত সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে দলিত প্যান্থারসের ২৩-তম প্রতিষ্ঠাদিবস উদযাপন অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ্য করে শুরু হয় বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা। প্রথম বছর বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা দুটি উদ্যোগ নেয়ঃ এক, চুনি কোটালের নামে একটি বার্ষিক স্মারক বক্তৃতা চালু হয়, এবং দুই, চতুর্থ দুনিয়া নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু হয়। গত তিন দশক ধরে বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে দলিত ও আদিবাসী সমাজের বহু সাহিত্যিকের লেখা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। চতুর্থ দুনিয়া পত্রিকা ছাড়াও, এই সংগঠনের পক্ষ্য থেকে দলিত কণ্ঠ, নীড়, ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও অনেক গল্প, প্রবন্ধ ও আত্মকথন রয়েছে বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার প্রকাশনার তালিকায়। দলিত সাহিত্য চর্চা ও প্রকাশনা ছাড়াও, বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার সংবিধানে সংগঠনের অন্যান্য কর্মসূচী লিপিবদ্ধ আছে। যেমন, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক সামাজিক বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই, দলিত মহাপুরুষদের নামে পুরস্কার স্থাপনা, তথ্য সংগ্রহশালা ও পাঠাগার নির্মাণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ইত্যাদি।

বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার পরিসরের বাইরেও অনেক মানুষ বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। কেউ কেউ নিজস্ব তাগিদে, বাকিরা বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে। ধরা যাক সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর কথা। কখনও স্কুলে যাননি, নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শিখেছেন, কোনো সংগঠনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, রিক্সাচালক থেকে রাঁধুনি বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, অথচ সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় আজ বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলনের একজন প্রধান সৈনিক তিনি। তার আত্মজীবনী ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ (২০১২) ও অন্যান্য রচনা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সদ্য গঠিত দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

এই রাজ্যের দলিত সাহিত্য আন্দোলনে অন্যান্য সংগঠনের ভুমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তার একটি উদাহরণ হল ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তৈরি ঐকতান গবেষণা সংসদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৮ সালে নিতিশ বিশ্বাস সম্পাদিত দলিত সাহিত্য শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশ করে ঐকতান। এরকম আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিত সাহিত্য সংকলনের কথা এখানে বলা দরকার। এক, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘দলিতের আখ্যানবৃত্ত’ (২০০৫) ও দুই, মনোহরমৌলি বিশ্বাস ও শ্যামল কুমার প্রামানিক সম্পাদিত ‘শতবর্ষে বাংলা দলিত সাহিত্য’ (২০১১)। এই দুটি সংকলনেই নমঃশূদ্র, রাজবংশী, পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়, বাগদি, বাউরি, হাড়ি, ডোম, কৈবর্ত এবং বাংলার অন্যান্য দলিতজনের সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় সংকলনের নামটি - ‘শতবর্ষে বাংলা দলিত সাহিত্য’ - কিন্তু মনে অন্য কৌতূহল জাগায়। বাংলার দলিত সাহিত্যের বয়স কি তাহলে একশ বছরের বেশি? প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চয়ই না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাহিত্যকে দলিত সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন অনেকেই। মহাত্মা জোতিবা ফুলে বা আয়োথি থাস বা আয়ানকালির রচনা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। একইরকম ভাবে বাংলার দলিত সাহিত্যিক মহলেও মতুয়া সাহিত্য কে বাংলার প্রথম দলিত সাহিত্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। বলা হয় যে দুটি গ্রন্থ - তারকচন্দ্র সরকার রচিত শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত (১৯১৬) এবং মহানন্দ হালদার রচিত শ্রীশ্রীগুরুচাঁদচরিত (১৯৪৩) - বাংলার দলিত সাহিত্যের ঐতিহাসিক দলিল। মতুয়া ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মতুয়া সাহিত্য। মতুয়া মহাসঙ্ঘ ও শাখা সংগঠনের উৎসাহে মতুয়াদের নানা পত্রপত্রিকা এ রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ফলে বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলনের এক বিশেষ অধ্যায় হল মতুয়া সাহিত্য।

এ পর্যন্ত আমরা দেখলাম দলিত সাহিত্য কেন ও কীভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে নিপীড়িত মানুষের এক পৃথক স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা হিসেবে গড়ে উঠেছে। এবারে ফিরে আসা যাক শুরুর আলোচনায় - সাহিত্যের আবার দলিত-অদলিত ভেদাভেদ হয় নাকি? এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। তবুও প্রশ্নটি শুনে দুটি কথা মাথায় ঘুরছে। প্রথমত, উচ্চবর্ণ বাঙালি কি এ দেশের দলিত রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ? তা যদি হয়, তাহলে তথাকথিত প্রগতিশীল বাংলার পরিস্থিতি নিতান্তই হতাশাজনক। দ্বিতীয়ত, একই সাথে মনে হল যে এ প্রশ্ন তো আর নতুন না। ১৯৯৪ সালে বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার উদ্যোগে যখন চতুর্থ দুনিয়ার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় তখন আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় একই প্রশ্ন উঠেছিল - ‘‘কবিতা বা সাহিত্যের পরিচয় কি ‘দলিত’ হতে পারে!’’ প্রায় তিরিশ বছর পরে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি গঠনের সময়েও প্রশ্নের চরিত্র বদলায়নি। তার কারণ এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শহুরে উচ্চবর্ণ ভদ্রলোক শ্রেণির প্রাতিষ্ঠানিক দখলের বাইরের কোনো উদ্যোগকে স্বীকৃতি না দেওয়ার রাজনীতি। বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জনজীবনে উচ্চবর্ণের মানুষের অসামান্য আধিপত্য। এই আধিপত্য এতটাই জোরাল যে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অনেকেই বিশ্বাস করে যে এ রাজ্যে বর্ণগত বৈষম্য এবং জাতপাতের রাজনীতি নেই। এই ধারণা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। তার একটি কারণ অবশ্যই বাংলার দলিত সাহিত্য আন্দোলন যার ফলে দলিত সমাজের নানা অভিজ্ঞতা্র গল্প আজ আমাদের সামনে বর্তমান। বাংলা দলিত সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদও হচ্ছে। মনোরঞ্জন ব্যাপারী, মনোহরমৌলি বিশ্বাস এবং যতিন বালার আত্মজীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে গত কয়েক বছরে। ফলে এ রাজ্যের বাইরেও পাঠকরা আজ বাংলা দলিত সাহিত্যের সাথে পরিচিত। এই মুহূর্তে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। আশাকরি আগামীদিনে অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে বাংলা দলিত সাহিত্য আন্দোলনের স্বতন্ত্র ধারা অব্যাহত থাকবে।


______________________________

References:
● গোপাল গুরু, ২০১৮, দ্য পলিটিক্স অফ নেমিং, সেমিনার, ৭১০ (Link: http://www.india-seminar.com/2018/710/710_gopal_guru.htm, accessed on 12.10.2020)
● কে. সত্যনারায়ান ও সুজি থারু, ২০১৩, দলিত রাইটিংঃ অ্যান ইন্ট্রোডাকশন, দ্য এক্সারসাইজ অফ ফ্রিডমঃ অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দলিত রাইটিং, পৃ. ১২।
● Ibid.
● Ibid, পৃ. ৭।
● Ibid, পৃ. ১৭।
● মনোহরমৌলি বিশ্বাস ও শ্যামল কুমার প্রামানিক, ২০১১, ভূমিকা, শতবর্ষে বাংলা দলিত সাহিত্য, পৃ. ১৫-১৯।