আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

প্রসঙ্গঃ ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও সমাধান

প্রণব সেন


আরেক রকমঃ ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ২০২০) ভারতের অর্থব্যবস্থা ২৩.৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০) ক্ষেত্রে অর্থব্যবস্থা গতি পাওয়ার প্রাথমিক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। লকডাউনের পরে ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন বিষয় আপনার অভিমত কী? দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেই কি আর্থিক বৃদ্ধির হার আগের জায়গায় ফিরে যাবে? না কি ভারতের মন্দাবস্থা আরো দীর্ঘকাল বজায় থাকবে?

প্রণব সেনঃ এই বিষয় কোনো সন্দেহ নেই যে ২০২০-২১ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ফিরবে, যদিও তা প্রাক-কোভিড অবস্থায় নাও ফিরতে পারে, কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছবে। এই সময় ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার (-)৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল এই পুনরুজ্জীবন বজায় থাকবে কি না। এই মুহূর্তে যেই আর্থিক বৃদ্ধি আমরা দেখছি তা দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার ফলঃ

(ক) অর্থব্যবস্থার যে-সমস্ত ক্ষেত্র আয় সংকোচনের সম্মুখীন হয়নি, সেই ক্ষেত্রগুলি বর্তমানে পণ্য কিনছে, যা তারা লকডাউনের সময় কিনতে পারেনি। একে আমরা লকডাউনের সময় রুদ্ধ চাহিদার (pent-up demand) বহিঃপ্রকাশ বলতে পারি। কিন্তু এই চাহিদা দ্রুত (৩-৪ মাসের মধ্যে) বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

(খ) যে ক্ষেত্রগুলিতে আয় কমেছে তারা সঞ্চয়িত পুঁজি খরচ করে বেঁচে থেকেছে। এই প্রক্রিয়াও ক্ষণস্থায়ী কারণ অধিকাংশ গৃহস্থর পর্যাপ্ত সঞ্চয় নেই যার মাধ্যমে তারা দীর্ঘমেয়াদে তাদের ভোগ্যপণ্য ব্যয়কে এক জায়গায় ধরে রাখতে পারে।

গত বছরের তুলনায় ইতিমধ্যেই আমরা প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা হারিয়েছি, যার মধ্যে ৮ লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কর সংগ্রহ বাবদ আদায় করতে পারেনি। বাকি ১২ লক্ষ কোটি টাকা কোম্পানি এবং শ্রমিকদের আয় হ্রাস পাওয়ার দরুণ আমরা হারিয়েছি। সরকার সবসময় তার নিজের ঘাটতি মেটানোর জন্য ধার করতে পারে (যদিও সরকার মোট ৭ লক্ষ কোটি টাকা ধার করবে বলে এখনও অবধি জানিয়েছে)। কিন্তু গৃহস্থ পরিবার এবং কোম্পানিগুলি কী করবে? যেখানে ভবিষ্যৎ এখনও খুব অনিশ্চিত, সেখানে গৃহস্থ পরিবার এবং কোম্পানি আরও ঋণ নিতে চাইবে না। বিশেষ করে যখন ইতিমধ্যেই যে ঋণ তারা নিয়ে ফেলেছে তা ফেরত দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, সেখানে নতুন ঋণ নেওয়ার বিষয় তারা উৎসাহ দেখাবে না। এর ফলে যেটা হবে, তা হল, একদিকে গৃহস্থ পরিবারগুলি তাদের খরচ কমাবে, অন্যদিকে কোম্পানিগুলি তাদের বিনিয়োগ বাবদ খরচ আপাতত করবে না। এর ফল হিসেবে আর্থিক বৃদ্ধির যে উন্নতি হচ্ছিল তা কমে যাবে, এবং বৃদ্ধির হার আবার ঋণাত্বক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরেক রকমঃ লকডাউনের ফলে অর্থব্যবস্থার কোন ক্ষেত্রগুলি সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কি লকডাউনের অভিঘাত ভিন্ন হয়েছে?

প্রণব সেনঃ লকডাউনের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নির্মাণ শিল্প, তারপরে উৎপাদন শিল্প বা ম্যানুফাকচারিং এবং কিছু পরিষেবা ব্যবস্থা। বিশেষ করে ভ্রমণ সংক্রান্ত পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি, যেমন হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, এবং বেশ কিছু ব্যক্তি পরিষেবা যেমন শিক্ষা, বিউটি পার্লার, সিনেমা, থিয়েটার, ইত্যাদি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লকডাউনের অভিঘাত ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে অনেক বেশি হয়েছে কর্পোরেট ক্ষেত্রের তুলনায়। অসংগঠিত শিল্পের সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে।

আরেক রকমঃ কোভিড জনিত লকডাউন ভারতের আর্থিক বৈষম্য ও দারিদ্রের উপর কী প্রভাব ফেলেছে?

প্রণব সেনঃ কর্পোরেট ভারত, অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে এই বিষয় কোনো সন্দেহ নেই যে ভারতের আর্থিক বৈষম্য আগের তুলনায় বাড়বে। দারিদ্রের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এই কথা বলা যায় যে শহরে দারিদ্রের প্রকোপ বাড়বে। গ্রামীণ দারিদ্রের বিষয়টি জটিল। রবি ফসল এবার খুব ভালো হওয়ায় এবং শস্যের সরকারি সংগ্রহও বেশ ভালো হয়েছে বলে কৃষি ক্ষেত্র জাতীয় স্তরেই ভালো জায়গায় রয়েছে। কিন্তু এই কথা মনে রাখা দরকার যে রবি শস্যের অধিকাংশই গম যার সরকারি সংগ্রহ মাত্র ৭টি রাজ্য থেকে হয়ে থাকে। এই রাজ্যগুলি তাই অর্থনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যদিকে, আরো ৭টি রাজ্য রয়েছে, যেখানকার গ্রামীণ অর্থব্যবস্থা পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠানো টাকার উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। যে বিপুল সংখ্যায় এই পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে এসেছেন, পরিযায়ী শ্রমিক নির্ভর আয়ের উৎস আর নেই বললেই চলে। এই রাজ্যগুলিতে নিশ্চিতভাবে গ্রামীণ দারিদ্র বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। খরিফ ফসল কেমন হয় এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের আবার শহরে কাজে ফেরার হার এবং তাদের পাঠানো অর্থের যোগানের কী অবস্থা দাঁড়ায় তার উপর এই রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। দেশে কোভিডের সংক্রমণ যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে এই প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হবে বলেই মনে হয়।

আরেক রকমঃ Centre for Monitoring the Indian Economy (CMIE)-র সমীক্ষা দ্বারা উপলব্ধ বেকারত্বের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে বেকারত্বের হার হ্রাস পেলেও একই সময় শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণের হার (জনসংখ্যার অনুপাতে যত মানুষ কাজ করছেন এবং কাজ খুঁজছেন) বিগত কিছু মাসে কমেছে। বর্তমান অর্থব্যবস্থার সংকটের প্রেক্ষিতে ভারতের বেকারত্বের সমস্যার বিষয় আপনি যদি কিছু আলোকপাত করেন।

প্রণব সেনঃ এই তথ্যটি শুধুমাত্র একটি সংখ্যা। একটি উদাহরণের মাধ্যমে সমস্যাটি বুঝতে সুবিধা হবে। ধরা যাক ১০০ জন কর্মক্ষম বয়সের মানুষের মধ্যে ৯০ জন কর্মরত এবং ১০ জন কাজ খুঁজছেন, তাহলে বেকারত্বের হার হবে ১০ শতাংশ এবং শ্রম বাজারে অংশগ্রহণের হার হবে ১০০ শতাংশ। এবারে ধরুন যে ১০ জন বেকার অবস্থায় চাকরি খুঁজছিলেন, তাঁরা হতোদ্যম হয়ে কাজ না খুঁজে বাড়িতে বসে থাকবেন বলে স্থির করলেন। তাহলে বেকারত্বের হার কমে হবে শূন্য শতাংশ এবং শ্রম বাজারে অংশগ্রহণের হার হবে ৯০ শতাংশ। সংক্ষেপে, লকডাউনের ফলে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা আর নতুন কোনো চাকরি খুঁজছেন না, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে চাকরির সুযোগ আর নেই।

আরেক রকমঃ এখন অবধি সরকারর তরফে যে সমস্ত নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তার অধিকাংশই সস্তায় ঋণ দেওয়া এবং অর্থব্যবস্থায় টাকার যোগান বাড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সরকারি খরচ বা ‘ফিস্‌কাল স্টিমিউলাস’-এর কথা সরকার খুব বেশি ভাবছে না। এই নীতিসমূহ কি কাজ করছে?

প্রণব সেনঃ যখন লকডাউন চলছিল বা লকডাউন প্রত্যাহার করার শুরুতে এই নীতিসমূহগুলি যথার্থ ছিল। লকডাউনের সময় যেহেতু কোনো উৎপাদন সম্ভব ছিল না, ‘ফিসকাল স্টিমিউলাস’-এর কোনো প্রভাব পড়ত না। সেই সময় নির্দিষ্টভাবে যাতে কোম্পানিগুলি দেউলিয়া না হয়ে যায় তার দিকে নজর রাখা দরকার ছিল। ঋণ শোধের উপরে ‘মোরাটোরিয়ম’ দেওয়া বা লকডাউন প্রত্যাহারের শুরুতে সস্তায় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে এই লক্ষ্যপূরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু জুন মাসের শেষার্ধ থেকে ‘ফিস্‌কাল স্টিমিউলাস’ দেওয়ার মতন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই মুহূর্তে রুদ্ধ চাহিদার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বলে আমরা এই স্টিমিউলাসের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে ভাবতে পারি। কিন্তু এই প্রক্রিয়া অর্থব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র ক্ষেত্রেই ঘটছে, যা আসলে দেশের সংগঠিত ক্ষেত্র। কিন্তু অর্থব্যবস্থার বাকি ক্ষেত্রে চাহিদার সমস্যা রয়েছে, যা একমাত্র ‘ফিস্‌কাল স্টিমিউলাস’-এর মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব।

আরেক রকমঃ ভারতের অর্থব্যবস্থা যাতে দ্রুততার সঙ্গে প্রাক-কোভিড অবস্থায় ফিরে আসতে পারে তারে জন্য কী করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?

প্রণব সেনঃ লকডাউন প্রায় সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের পরে অর্থব্যবস্থার প্রাক-কোভিড স্থিতিতে ফিরে যাওয়া প্রধানত নির্ভর করবে চাহিদার অবস্থার উপর। যেহেতু অর্থব্যবস্থার প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে, চাহিদা আবার গত বছরের মানে সরকারি নীতির সাহায্য ছাড়া ফিরে যাবে বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। স্টিমিউলাসকে বজায় রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা এককালীন বড়ো একটি ‘ফিস্‌কাল স্টিমিউলাস’-এর মাধ্যমে বাড়ানো গেলেও, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এই ‘স্টিমিউলাস’ বজায় রাখতে হবে অন্তত তিন বছর। এর কারণ হল এই যে, যতক্ষণ না বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিন্ত হচ্ছেন যে তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বাজারে থাকবে, ততক্ষণ অবধি তারা নতুন বিনিয়োগ করবে না। বলা যেতে পারে যে অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন যতক্ষণ না উ‍ৎপাদন ক্ষমতার (capacity utilisation) ৮৫ শতাংশে পৌঁছচ্ছে (বর্তমানে যার মান হল ৬০ শতাংশ), ততক্ষণ বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করবে না। তাই সরকারের উচিত একটি বড় ‘ফিস্‌কাল স্টিমিউলাস’ প্যাকেজের ঘোষণা করা, যার মধ্য দিয়ে ২০১৯-২০ সালের তুলনায় বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আগামী তিন বছর অনেকটাই বাড়িয়ে রাখতে হবে। এই নীতি অবিলম্বে বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন, নয় তো, আমাদের উৎপাদন ক্ষমতার ক্ষতি হয়ে যাবে, যা এই নীতির মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব।

আরেক রকমঃ ‘সামাজিক দূরত্ব’-এর সমাজের উপর কী প্রভাব ফেলেছে বলে আপনি মনে করেন।

প্রণব সেনঃ ভারতের শহরে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যে খুব ভালো ছিল এমন কথা বলা যায় না। শহর থেকে গ্রামের উদ্দেশ্যে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাঁচার তাগিদে রওনা দিয়েছিলেন, তার থেকেই এই কথা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। আমাদের দেশের গ্রামে বরং মানুষের প্রতি মানুষের সামাজিক সহানুভূতি অনেক বেশি। সামাজিক দূরত্বের নীতি এই বৈশিষ্টগুলিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। সন্দেহ ও সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়ার প্রবণতা অতীতে কখনওই এত ব্যাপক ছিল না। আমরা আমাদের প্রতিবেশী, এমনকি বন্ধুদেরও আমাদের ভালো থাকার অন্তরায় হিসেবে দেখছি, তাদের অবস্থা কেমন তার তোয়াক্কা করছি না। যেমনভাবে আগে কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে ব্যবহার করা হত, এখন তেমনি আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করছি। আসল প্রশ্ন হল, এই প্রবণতা আর কতদিন চলবে? কোভিড-এর সর্বজনীন প্রতিষেধক দেওয়া হয়ে গেলে কি এই প্রবণতা বিদায় নেবে? নাকি শহরের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে থাকবে এই সন্দেহের প্রবণতা? আমরা জানি না।


______________________________

বিশিষ্ট পরিকল্পনা বিশারদ প্রণব সেন ‘আরেক রকম’ পত্রিকার জন্য এই লিখিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি মূল ইংরেজি থেকে অনুদিত।